top of page

মিজান মাস্টার।

ঠাস ঠাস করে চারটা শব্দ হলো। সবাই হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে আছে মিজান মাস্টারের দিকে।


.

মিজান মাস্টার মাথা নিচু করে আছেন। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় কয়েক শতাধিক দর্শনার্থী-শিক্ষার্থী সবাই চুপ করে গেছে। একদম পিনড্রপ সাইলেন্স চারিদিকে।

.

এলাকার বেশ গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন মিজান সাহেব। একসময় শিক্ষকতা করতেন। শিক্ষকতায় উনার সুনাম পুরো এলাকাব্যাপি। 'মিজান মাস্টার' বললেই সবাই একবারে চিনে ফেলে।

.

শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন পায় ১৫ বছর হলো। বয়স প্রায় ষাট ছুই ছুই। এই বয়সেও উনি থেমে নেই। আশপাশের সব এলাকা থেকে অনেক অনেক ছেলেমেয়ে এসে প্রতিদিন ভীড় জমায় মিজান মাস্টারের টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরটাতে। সেখানে সবাইকে একদম বিনে পয়সায় শিক্ষাদান করেন মিজান মাস্টার।

.

ফ্রিতে জ্ঞান বিতরন করাটাই মিজান মাস্টারের সবচেয়ে বড় অপরাধ। ইদানিংকালে ব্যাঙ্গের ছাতার মত এখানে ওখানে গজিয়ে উঠেছে বিভিন্ন কিন্টারগার্ডেন স্কুল। তৈরী হয়েছে অনেক অনেক প্রাইভেট কলেজও।

.

মিজান মাস্টারের বাসা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দুরেই বিশাল এলাকাজুড়ে তৈরী করা হয়েছে "আহমদ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ"। সেখানে অনেক অনেক টাকা দিয়ে পড়াশোনা করে এলাকার উচ্চবিত্ত মানুষদের সন্তানেরা। সমস্যাটা এখানেই, অনেক টাকার বিনিময়ে অনেক সুযোগ সুবিধা পাওয়া স্কুল সাথে প্রতিটা বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা টিউটর রেখেও কুলিয়ে উঠতে পারছেনা সেই স্কুলের শিক্ষার্থীরা।

.

প্রতিবছর এলাকার সব সরকারি স্কুল কলেজে পড়ে এরকম একদম নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েরা পাচ্ছে গোল্ডেন প্লাস, পাচ্ছে বৃত্তি। আর তাই এই নামি স্কুলে পড়িয়েও সন্তানের ফলাফল নিয়ে অসন্তুষ্ট অভিভাবকেরা জানিয়েছেন অনেক কমপ্লেইন।

.

এতেই আতে ঘা লেগেছে "আহমদ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ" এর ধর্তাকর্তা আহমদ সাহেবের। আহমদ সাহেব বর্তমান ক্ষমতাশীন দলের এক প্রভাবশালী নেতা।

.

আহমদ সাহেব অবশ্য ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার মিজান মাস্টারের শরণাপন্ন হয়েছেন। মাস্টার সাহেবকে খুব মোটা অংকের টাকার লোভ দেখিয়েছেন যাতে করে উনি আহমদ সাহেবের নামী স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

.

কিন্তু মিজান মাস্টারের এক কথা, "অনেক তো হলো বাবা! বয়সে কুলায় না। তাই নিজের সুবিধামত কিছু বাচ্চাকে পড়াই। আমি এদের ছেড়ে দিলে এরা একেবারে ভেসে যাবে। সবখানে এখন শিক্ষা বানিজ্য। আমি ফ্রিতে পড়াই তাই এরা ভালো করে। আমি পড়ানো ছেড়ে দিলে আর কোন কৃষকের ঘরে ডাক্তার জন্মাবেনা, কোন রিক্সাওয়ালার ঘর থেকে ইঞ্জিনিয়ার আসবেনা।"

.

এতেই বেশ মনোক্ষুন্ন হয়েছিলো আহমদ সাহেবের। উনাকে সবাই প্রচন্ড ভয় করে আর এই সামান্য মাস্টারের সাহস কীভাবে হয় উনার কথা না মেনে পালটা জবাব দেওয়ার! তাও প্রথমবার হলে কথা ছিলো, বারবার বারবার করে বলার পরেও কথা অগ্রাহ্য করেছেন উনি। শাস্তি তো পেতেই হবে।

.

ফন্দি আটলেন আহমদ সাহেব। উনার নিজের মেয়েকেই পড়তে পাঠালেন মিজান মাস্টারের টিনের ছাউনি দেওয়া ক্লাসে। মিজান মাস্টার সরল মনে পড়াতে শুরু করলেন আহমদ সাহেবের মেয়েকে; অন্যান্য সব শিক্ষার্থীর সাথে, ব্যাচে ।

.

আহমদ সাহেবের মেয়ে তিশা বাবার ফন্দিমত কাজ করল। একদিন সবাইকে পড়ানো শেষ করে ছুটি দেওয়ার সময় তিশা বললো, "স্যার, আমার কিছু অংকে সমস্যা আছে। ওরা চলে গেলে আপনি একটু একা বুঝিয়ে দিবেন প্লিজ?"

.

বয়সের ভাড়ে ন্যুজ মিজান মাস্টার ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও রাজি হলেন। সবাই চলে গেলো। টিনের ছাউনি ফাকা হয়ে গেলো। এই সুযোগকেই কাজে লাগালো তিশা।

.

মুহুর্তেই নিজের জামার কাপড় ছিড়ে ফেলে চিৎকার করতে লাগলো। মিজান মাস্টার এহেন পরিস্থিতিতে কী করবেন বুঝে উঠতে না পেরে হতভম্ব হয়ে গেলেন। মুহুর্তেই আহমদ সাহেবের রেডি করে রাখা লোকগুলো পৌছে গেলো মিজান মাস্টারের ছাউনিতে।

তিশা ফোপাতে ফোপাতে বললো, "স্যার বলেছিলেন পড়া শেষ হলে অপেক্ষা করতে। আমার নাকি কিছু অংকে সমস্যা আছে, তাই স্যার বুঝিয়ে দিবেন। আমিও তাই অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সবাই চলে যাওয়ার পর হঠাত স্যার আমার সাথে..."

.

কথা শেষ না করেই হুহু করে কাঁদতে শুরু করলো তিশা।

রাতেই সালিশ বসানো হলো। প্রধান বিচারক হলেন স্বয়ং আহমদ সাহেব, তিশার বাবা।

.

এলাকার মানুষ কেউই ব্যাপারটা বিশ্বাস করলোনা, বিশ্বাস করলোনা মিজান মাস্টারের অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও। তারা সবাই জানে কে অপরাধী। কিন্তু এখানে কিছু বলতে গেলে যে কপালে শনি আছে এটাও সবাই জানে। এমনিতেই আহমদ সাহেবের অনেক ক্ষমতা, যেকোন কিছু করে ফেলতে পারেন। এই ভেবে সবাই মেরুদন্ডহীনের মত দাঁড়িয়ে মজা দেখতে লাগলেন।

.

মিজান মাস্টারকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে উঠলেন আহমদ সাহেব, "শুয়োরের বাচ্চা! এই বুইড়া বয়সে তুই এত সাহস পাস কই?" এই বলে আরো দুইটা থাপ্পড় মারলেন মিজান মাস্টারের গালে।

মিজান মাস্টার থাপ্পড় খেয়ে দিগ্বিদিক হারিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।

.

প্রায় এক সপ্তাহ হলে গেলো মিজান মাস্টার আর ঘর থেকে বাইরে যান না। লোকলজ্জায় মাথা নিচু করে সারাক্ষন ঘরেই ঢুকে থাকেন। উনার শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন আসে, ছাউনির নিচে চুপচাপ বসে থাকে, আবার চলে যায়।

একদিন হঠাত একটা খাম এলো মিজান মাস্টারের কাছে। খাম খুলে চমকে উঠলেন মিজান মাস্টার।

একটা আইনি নোটিশ এসেছে। সাত দিনের মধ্যে ভিটে ছাড়তে হবে মিজান মাস্টারকে। নোটিশে বলা হয়ে মিজান মাস্টার যেই জমির উপরে আছে তা আহমদ সাহেবের নামে উইল করা। তাই এক সপ্তাহের নোটিশ জারি করে উনাদের বের হয়ে যেতে বলা হয়েছে।

মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো মিজান মাস্টারের। কী করবে ভেবে পেলেন না মিজান মাস্টার।

.

এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা ধরে কিছু না বলে কানে লাগালেন মিজান মাস্টার। ওপাশ থেকে আহমদ সাহেবের গম্ভীর আওয়াজ ভেসে উঠলো,

.

"কিরে মাস্টারের বাচ্চা! কেমন লাগে এবার?"

.

-কেন এমন করছো তুমি আহমদ? তুমি কিন্তু আমার ছাত্র ছিলে। শিক্ষকতার এই প্রতিদান দিচ্ছো তুমি?

.

-এই চুপ! জ্ঞান দিবিনা। আমি লোক নিয়ে আইতাসি। বাসাত্তে বাইর হ এক্ষনি, নইলে একটারেও আস্ত রাখুম না।

.

মিজান মাস্টার আতংকে-লজ্জায় থরথর করে কাপতে লাগলেন। কোন কথা বলতে পারলেন না তিনি। বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধড়াস-ধড়াস করছে। হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে বসে পড়লেন তিনি।

.

প্রায় ঘন্টাখানিকের মধ্যেই দলবল নিয়ে হাজির হয়ে গেলো আহমদ।

আহমদ বাংলা ফিল্মের ভিলেইনদের মত সবার সামনে দাঁড়িয়ে আর তার পিছনে মোটা বাঁশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা। দেখে মনে হচ্ছে আহমদ সাহেবের চেয়ে তারাই বেশি রেগে আছে।

মিজান মাস্টার বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। পেছনে বের হয়ে গেলো মিজান মাস্টারের সহধর্মিনি হামিদা বেগম।

আহমদ প্রায় চিৎকার করে বললো, "মাস্টারের বাচ্চা! এখনও বের হইসনি কেন? বের হয়ে......"

.

কথা শেষ করতে পারলেন না আহমদ সাহেব। হঠাত করে ঠাস করে একটা বাশের আঘাত পড়লো তার মাথায়। মুহুর্তেই আহমদ সাহেবের ভাড়া করে আনা বাকি সদস্যরাও হুড়মুড়ি বাঁশ উচিয়ে ধিড়িম ধাড়াম শব্দে সাপ মারার মত পিটাতে থাকলো আহমদ সাহেবকে।

.

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে রইলেন মিজান মাস্টার আর তার সহধর্মিনী।

.

প্রচন্ড ক্ষমতাধর আহমদ মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লো। তার গগনবিদারী চিৎকার হারিয়ে গেলো আঘাতের ঠাস ঠাস শব্দের কাছে। একসময় আহমদ জ্ঞান হারালো, কিন্তু মাইর থামলোনা।

.

আরো কিছুক্ষন পর একজন সবাইকে চিৎকার করে থামতে বললো। সবাই মার থামালে আহমদ সাহেবের নাকের কাছে হাতের উলটো পিঠ রেখে চেক করে দেখলো আহমদ বেচে আছে কিনা।

চেক করে প্রায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো শালা খতম।

.

তারপর সবাই মিজান মাস্টার সামনে এসে দাড়ালো। বেশ স্বাস্থবান গোছের একজন আনাড়িভাবে সালাম দিয়ে বললো, "স্যার আমি ফারুকের বাপ। আমার পোলা এখন ঢাকা ইউনিভার্ছিটিতে পড়ে। সবই আপনার দয়া স্যার। আমরা থাকতে আপনার কোন ক্ষতি হইতে দিমুনা। আপনি খালি আমগো পোলাপাইনডিগোরে মানুষ কইরা দ্যান।"

.

সবাই সাথে সাথে চিৎকার করে বললো, "হ্যা হ্যা।"

.

আরেকজন লাঠি হাতে সামনে আসলো। মিজান সাহেব দেখেই চিনতে পারলেন উনাকে। "এই তুই কবির না? আমার ছাত্র ছিলি না তুই? তোর ছেলে তো এখন মেডিকেলে পড়ে, তাইনা? "

.

উনি মাথা ঝাকালেন এবং সাথে সাথেই মাথা নিচু করে ফেললেন ।

মিজান মাস্টার বললেন, "এবার এই লাশের কী হবে? পুলিশ তো আমারে বাইন্ধা নিয়ে যাবে? এইডা তোরা কী করলি?"

.

মোটা করে মানুষটা আবার বলে উঠলো, "আপনার কোন চিন্তা করতে হবেনা স্যার। এই খুন আমি করসি। আমি জেল খাটমু। খালি স্যার কথা দেন আমগো মত গরীব লোকের বাচ্চাডির হাত আপনি কোন দিন ছাইড়া দিবেন না। আমার ছুডু মাইয়াডা পইত্যেকদিন আপনার কাছে আইতো। তার খুব শখ সে ডাক্তারনি অইবো। ওরে ডাক্তারনি হইবার মত কইরা পড়াইয়েন ছ্যার। "

.

মিজান মাস্টারের চোখে পানি চলে আসলো। প্রায় কাদতে কাদতে মিজান মাস্টার বললেন, "কথা দিলাম।"

0 comments

Recent Posts

See All
Enjoy
Free
E-Books
on
Just Another Bangladeshi
By
Famous Writers, Scientists, and Philosophers 
click here.gif
click here.gif

Click Here to Get  E-Books

lgbt-bangladesh.png
bottom of page