top of page

বৈচিত্রের মধ্য ঐক্য

কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা লেখা দেখেছিলাম, লেখক সেই সংক্ষিপ্ত লেখাতে হিন্দুদের একটি বিশেষ দুর্বলতাকে ব্যঙ্গাত্মক ভাবে তুলে ধরে ছিলেন।লেখক লিখেছিলেন বেশির ভাগ হিন্দুই ব্রহ্মচর্যকে নিজের আদর্শ বলে ঘোষণা করলেও আবার রোহিঙ্গাদের সন্তান উৎপাদন দেখে ঈর্ষান্বিত হয়।



লেখাটির মধ্যে যথেষ্ট সারবস্তু রয়েছে, তবে এখানে ঈর্ষান্বিত হবার কারণ অস্তিত্ব সংকট এটাও বুঝতে হবে। এই লেখা নিয়ে আমার উদ্বেগ হয়নি, উদ্বেগ হয়েছে লেখক তার লেখাটিকে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য ব্রহ্মচর্যের উদাহরণ দেবার জন্য অকারণ আচার্য শঙ্করকে টেনে আনেন এবং শঙ্করের একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে শঙ্করকে চরম মিসোজেনিস্ট আখ্যায়িত করতে শুরু করেন এবং নিজের মন্তব্যে দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থান করবার জন্য শঙ্করকে মায়াবাদী,ছদ্মবৌদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি আখ্যায় আখ্যায়িত করতে থাকেন। আমার সঙ্গে লেখকের পরিচয় নেই তারপর ঐ লেখাতে বাইরের লোকের প্রবেশও ছিল নিষিদ্ধ এবং যারা শঙ্করকে নিয়ে উক্ত মন্তব্যের বিরোধিতা করছিল ঐ পোষ্টে তাদের সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিগত পর্যায় বিবাদও শুরু হয়ে গিয়েছিল তাই ঘটনাটি এড়িয়ে যাই, বলাবাহুল্য আমি সামান্য মানুষ আমার সবথেকে শ্রেষ্ঠতম অস্ত্রই এড়িয়ে যাওয়া, এইরকম অনেক ক্ষেত্রেই এড়িয়ে যাই, যেমন কিছুদিন আগে দেখলাম কিছু বিচিত্র বুদ্ধিসম্পন্ন নাবালক বেদমন্ত্রের বিকৃত করে ফেসবুকে প্রচার করছে বেদের মূর্তিপূজার প্রামাণ্য, সেখানেও এড়িয়ে গেলাম এই মনে করে মানুষ যত বেদের সত্য কম জানবে বেদ ততই সুরক্ষিত থাকবে।


এইবার মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক, আচার্য শঙ্কর কি বাস্তবিকই মিসোজেনিস্ট ছিলেন? প্রথমেই জানতে হবে ইংরেজি মিসোজেনিস্ট শব্দের বাংলা শব্দার্থ কি, মিসোজেনিষ্টের বাঙলা মানে হল 'নারীবিদ্বেষী'। নারী বিদ্বেষী মানে যে ব্যক্তি সমগ্র নারী সমাজের উপর বিদ্বেষ ভাব প্রকাশ করেন।কিন্তু আচার্য শঙ্কর কি সমগ্র নারী জাতির উপর বিদ্বেষাভাপন্ন ছিলেন? না, তেমন কোন বাস্তবিক প্রমাণ আমরা শঙ্করের জীবন থেকে পাইনা, তিনি ছিলেন প্রচণ্ড মাতৃভক্ত, মায়ের আদেশ নিয়েই তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করে ছিলেন এবং কথা দিয়ে ছিলেন মায়ে অন্তিমকালে তিনি অবশ্যই মায়ে সঙ্গে সাক্ষাৎ পূর্বক আশীর্বাদ গ্রহণ করবেন এবং তিনি তাঁর কথা পালনও করে ছিলেন নিষ্ঠার সঙ্গে।


দ্বিতীয় প্রমাণ, শঙ্করের সঙ্গে যখন মণ্ডন মিশ্রের তর্ক শুরু হয় তখন সেই তর্ক সভার বিচারক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন মণ্ডনের সহধর্মিণী সরস্বতীদেবী। এইক্ষেত্রে শঙ্কর যদি নারীবিদ্বেষী হতেন,তিনি অবশ্যই সরস্বতীদেবীর সভাপতিত্ব স্বীকার করতেনা, সুতরাং বলা যেতেই পারে শঙ্কর কখনওই নারী বিদ্বেষী ছিলেন না।


শঙ্কর ছিলেন কঠিন সন্ন্যাস ধর্মের পৃষ্ঠপোষক তাই তার রচিত বিভিন্ন শ্লোকে ব্রহ্মচর্য পালনরত শিষ্যদের জন্য বারংবার কামিনী ও কাম নিয়ে সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে। এটা কিন্তু নারী বিদ্বেষের মাপকাঠি নয়, এটা কাম বিদ্বেষের সাবধানবাণী।আর শঙ্কর কিন্তু এই তত্ত্বের প্রবর্তক নয়, এটি প্রাচীন ভারতের অন্যতম ধর্মদর্শন। ভারতের আর্য সংস্কৃতিতে মূলত দুই প্রকার বেদোক্ত ঈশ্বর সাধনার পথ দেখতে পাওয়া যায় ১) সর্বব্যাপক রূপে ঈশ্বর অনুভূতি ২) অন্তস্থ ঈশ্বরের উপাসনা। প্রথম দলের পৃষ্ঠপোষক ভারতীয় ঋষি সমাজ এবং দ্বিতীয় দলের পৃষ্ঠপোষক ভারতীয় মুনিরা। আর্য সমাজ ব্যবস্থা মূলত চারপ্রকার জীবন আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত, ব্রহ্মচর্য, গৃহস্থ,বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস।আর্য ঋষিরা এই চারপ্রকার জীবন আদর্শে জীবন অতিবাহিত করেন। কিন্তু একদল ঈশ্বর জিজ্ঞাসু মানুষ কেবল ব্রহ্মচর্যের অপাপবিদ্ধ পথকেই মোক্ষের একমাত্র পথ হিসাবে ঘোষণা করেন তখনই শুরু হয় সন্ন্যাস মার্গ।


প্রধানত ঋষিরা কামকে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে সৃষ্টির কাজে সংযুক্ত করে ভারতীয় সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে, কামকে সংযম দ্বারা সংসার ধর্ম পালন করতে বলে গেছেন তাঁরা। এই পদ্ধতিকে বলে মদনমোহন। কামনা দ্বারা মোহিত না হয়ে, কামনাকে মোহিত করে জীবন যাপন করা। পরবর্তী সময় বিষ্ণু হয়ে ওঠেন এইধারার প্রতীক।


অপরদিকে সংযম নয় কামনাকে সরাসরি নিধন করে, কামনা ও কামকে জীবন থেকে দূরে সড়িয়ে নিয়ে মোক্ষ পথে শুদ্ধ থাকবার পথকে বলে মদনদহন, আর এইপথে প্রতীক হলেন রুদ্র বা শিব।


প্রথম দল কর্মকাণ্ডে ও জ্ঞানের আলোকে বিশ্বাসী, দ্বিতীয় দল অন্তস্থ জ্ঞানেই মোক্ষপথ সন্ধান করে। এই দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতাও যথেষ্ট প্রাচীন, কখনও সংহিতাবাদীদের জয় হয়েছে আবার কখনও বেদান্তবাদের জয় হয়ে। মণ্ডনের সঙ্গে শঙ্করের তর্কও কিন্তু সংহিতা ও বেদান্ত দর্শনের শ্রেষ্ঠত্বের জন্যই হয়েছিল। তাই বুঝতে হবে শঙ্করের আগেও এই প্রতিযোগিতা যথেষ্ট ছিল এবং ব্রহ্মচর্যবাদের মূল পীঠস্থান ছিল এই বঙ্গ। শঙ্করের গুরুর গুরু অদ্বৈত বেদান্তের অন্যতম প্রবক্তা গৌড়পাদ ছিলেন একজন বাঙালি। বাস্তবিক ব্রহ্মচর্য কোনপ্রকার নারীবিদ্বেষ মূলক মার্গ নয়, এটি কামনা নিবৃত্ত মার্গ যা প্রাচীন ভারতের অন্যতম ধর্মচিন্তা এবং শঙ্করও নারীবিদ্বেষী নন।


এই আবার আলোচনা করবার চেষ্টা করবো শঙ্করকে মায়াবাদী ও ছদ্মবৌদ্ধ বলবার কারণ নিয়ে।


শঙ্করকে মূলত মায়াবাদী ও ছদ্মবৌদ্ধ বলে আক্রমণ করেন বৈষ্ণব আচার্যরা বিশেষত বৈষ্ণব আচার্য রামানুজ, শঙ্কর প্রচারিত অদ্বৈত বেদান্তের মতবাদ খণ্ডনের সময় অনেক স্থানে যুক্তিতর্কের পরিবর্তে শঙ্করকে মায়াবাদী ও ছদ্মবৌদ্ধ বলে আক্রমণ শুরু করেন এটা নিতান্ত সম্প্রদায়গত প্রতিহিংসা মাত্র।


বৈষ্ণবরা যতই শঙ্করের মতকে মায়াবাদ বলে আক্রমণ করুক না কেন শঙ্করের মতবাদ আসলে বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদ, বেদান্তসূত্রভাষ্যে ২/২/৯ সূত্রের ভাষ্যে শঙ্কর নিজে বলছেন- জ্ঞানশক্তির সাংখ্য অনুমান করিলে প্রতিবাদকার্য হইতে তিনি নিবৃত্ত হইলেন,আর তখন এক চেতনাই অনেকস্বরূপ জগৎ প্রপঞ্চের উপাদান হইল- এইভাবেই ব্রহ্মবাদ স্বীকার করা হইল।


শঙ্করমতে জগৎ মিথ্যা অর্থাৎ মায়া,সত্য একমাত্র ব্রহ্ম, সুতরাং মায়া মূলতত্ত্ব নয়, ব্রহ্মই মূলতত্ত্ব।এইজন্য ব্রহ্মবাদই বলা সঙ্গত।


শঙ্কর অবশ্যই ব্রহ্মচারী এবং ক্ষণজন্মা সন্ন্যাসী ছিলেন তাঁর এই সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি প্রায় ৮০টির মত সম্প্রদায়ের সঙ্গে বির্তকে বিজয়ী হয়ে আধুনিক হিন্দুধর্মের রূপরেখা টেনে গিয়েছিল যার প্রধান কথা হল বৈচিত্রের মধ্য ঐক্য।



এইবার প্রশ্ন হল আমরা কি? আমরা সমস্ত ভালোর গুণগ্রাহী মাত্র আমরা একাধারে ঋষি আদর্শে সংসার করবো,সন্ন্যাসীদের সম্মান করবো আবার রোহিঙ্গাদের অতিরিক্ত প্রজনন দেখলে উৎকন্ঠা প্রকাশ করবো।



0 comments
Enjoy
Free
E-Books
on
Just Another Bangladeshi
By
Famous Writers, Scientists, and Philosophers 
click here.gif
click here.gif

Click Here to Get  E-Books

lgbt-bangladesh.png
bottom of page