top of page

পোস্টমর্টেম


নরসিংদী সরকারী হাসপাতালের মর্গে যে লাশটি এখন পোস্টমর্টেম এর জন্য এল সেটি একটি মেয়ের লাশ। সতেরো আঠারো বছর হবে। আমারো একটি মেয়ে আছে, এবার আঠারো হবে। এই বয়সী মেয়েরা অনেক আবেগ প্রবণ হয়। আবেগের বশবর্তী হয়ে আত্মহত্যাকেও তারা সাদরে গ্রহন করে। অবশ্য এই মেয়েটি আত্মহত্যা করেনি। মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট। তার সমবয়সী একটি ছেলেও ছিল সে মোটরসাইকেলে। ছেলেটির বাবা মা ছেলের লাশ নিয়ে যাবার সময় পুলিশের কাছে বলেছে মেয়েটিকে চিনে না। ছেলেটিরও পোস্টমর্টেম হবে, নারায়নগঞ্জ হাসপাতালে। পাঁচদোনার কাছাকাছি এক্সিডেন্ট হয়েছে গত দু'দিন আগে। এই দুইদিন লাশের কোনো পরিচয় মিলেনি। আজ পুলিশের নির্দেশে লাশটির পোস্টমর্ডেমের দ্বায়িত্ব পড়েছে আমার উপর। জালাল আর আমি মিলে ফ্রিজ থেকে লাশটি বের করেছি। জালাল চলে গেছে, তার ছেলেটির সামান্য জ্বর। একা এর আগেও বহু লাশ কাটাকাটি করেছি।

আমার মেয়ে ঝুমা এবার ইন্টারে পড়ে। ছেলেকে নিয়ে কোনো চিন্তা না থাকলেও মেয়েটিকে নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় আছি। সে কলেজের এক ছেলের পাল্লায় পড়েছে। ছেলেটি ছাত্র রাজনীতি করে, নেশা করে শুনলাম। ঝুমা অবশ্য নেশা করার কথাটি স্বীকার করেনি। অনেক শাসন করেছি, কোনো লাভ হয়নি। মেয়েটা বড় বেয়াদব হয়ে গেছে। বাবা মায়ের কথা যে না শুনে সে সন্তান কখনো সুখী হয় না। ঝুমা তিনদিন আগে চোখে পানি নিয়ে বলেছিল, "আমি অভিকে নিয়ে সুখী হব। তোমরা আমাকে কষ্ট করে বড় করেছো বলে যেখানে খুশি সেখানে বিয়ে দিবা? আমার পছন্দের কোনো দাম নেই তোমাদের কাছে?" ছেলে নেশা করে, রাজনীতি করে। এই ছেলে নাকি পছন্দ আর সেই পছন্দেরও দাম দিতে হবে। আমি ঝুমার মা'কে কড়া করে বলে দিলাম, "তোমার মেয়েকে বুঝাও। যত শ্রীঘ্রই পারি তোমার মেয়ের জন্য ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দেব। ঐ অভি নাকি টভির ভূত যেন মাথা থেকে নামায়।"

লাশের মাথায় আঘাত পেয়েছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী সারা শরীরই কাটাকুটি করতে হবে। প্রয়োজনীয় সব কিছু খুলে রেখে চার ইঞ্চি সুঁই দিয়ে পেট আর মাথা সেলাই করে দিতে হবে। রাত প্রায় দেড়টা। জানালার গ্লাস দিয়ে ইমার্জেন্সি ভবনের গেইটে পাহাড়াদার মজিদ মিঞাকে দেখা যাচ্ছে। বেটা কত যে ঘুমাতে পারে। সারাদিন ঘুমিয়েও মধ্যরাতে বসে ঝিমাবে। চারিদিক খুবই নীরব। প্রথম প্রথম ভয় পেলেও এখন যত রাতই হোক, লাশ কাটতে ভয় পাই না। ভয় পাব কেন? আমারো একদিন মরতে হবে। স্বাভাবিক মৃত্যু না হলে আমার লাশকেও হয়তো কোনো ডোম কাটাকাটি করে চোখ, মগজ, কলিজা, কিডনী খুলে রেখে দিবে।

এইমাত্র মেয়েটির লাশের দিকে ভালো করে তাকালাম। কত মায়াবী চেহারা। ঠিক আমার মেয়েটার মত। ওর বাবা মা, ভাই বোনরাও হয়তো অনেক আদর করত। অথচ তারা জানেইনা তাদের মেয়েটি দু'দিন আগে মারা গেছে। অনেক খুঁজেছে নিশ্চয় তার বাবা মা। কত লক্ষ্মী মেয়ে, বোরখা পড়া ছিল। ছেলেটার সাথে কেন যে গেল মোটর সাইকেলে? ছেলেটি কী হতে পারে সম্পর্কে? প্রেমিক?

ছুড়ি হাতে আমি এগিয়ে গেলাম লাশের একদম কাছাকাছি। হঠাৎ জানালার একটি কপাট জোরে শব্দ করল। বাইরে বাতাসের ঝাপটা। ফাল্গুন মাসের বাতাসের এত তীব্র গতি হবার কথা নয়। মনে হচ্ছে কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়েছে। জানালা বন্ধ করে এলাম। সাথে সাথে রুমের বাতি দুটি নিভে গেল। জানালার গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে দেখি মজিদ মিঞা চেয়ারে বসে আগের মতই ঝিমাচ্ছে। ওখানে বিদ্যুত আছে। তারমানে বাতি দুটি নষ্ট। কিন্তু একসাথে দুটোই নষ্ট হতে হবে কেন? মোবাইলের আলো দিয়ে মোমবাতিটা খুঁজে বের করলাম। এবার একটু ভয় ভয় লাগছে। মোমের আলোতে লাশ কাটব নাকি ভাবছি। এত রাতে বাতি ঠিক করাও সম্ভব না। সকালে আবার পুলিশ আসবে, লাশ পোস্টমর্টেম হল কিনা দেখার জন্য। মোমবাতি জ্বালাতেই রুমে কারো উপস্থিতী টের পেলাম। মনে ভয় থাকলেও ভয়কে আমলে নিলাম না। আগুন যেহেতু আছে আগুনের কাছে ভূত পেত্নি আসবে না। -চাচা... কে যেন ডাক দিল। আমার মনের ভুল হবে নিশ্চয়। -চাচা এই লাশটা কাটবেন না। ডানে বামে তাকিয়ে কাউকে দেখলাম না। আমার এবার প্রচন্ড ভয় করছে। ইচ্ছে করছে দৌড়ে বের হয়ে যাই রুম থেকে। কিন্তু রুমের দরজা খুলতে গেলে পিছন থেকে জাপটে ধরবে না তো? -চাচা সে আমার ভালোবাসা। আমি কোনোদিন তার শরীর দেখিনি। আপনি লাশ কাটতে গিয়ে তো আমার ভালোবাসার পবিত্র শরীর দেখে ফেলবেন। -কে? কে তুমি? দেখো আমি কিন্তু একদম ভয় পাই না। সাহস থাকলে সামনে এসো। একহাতে চাকু আর একহাতে মোমবাতি নিয়ে জোরগলায় কথাগুলো বললেও আমার ভিতরটা ভয়ে চুপসে গেছে। আর কোনো শব্দ পাচ্ছি না। আমি এখন কী করব ভেবে পাচ্ছিনা। পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে ছিটকিনি খুললাম। বাইরের আলোর একাংশ রুমে ঢুকল। ভিতরে লাশ ছাড়া আর কেউ নেই। একটা গরম বাতাস আমার শরীরে শিহরন তুলে বের হয়ে গেল। হাতের লোমগুলো দাড়িয়ে আছে। আমি দরজা বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

মজিদ মিঞাকে দুই ডাক দিতেই মাথা তুলে তাকাল। তাকে বললাম আমাকে একটু সহযোগীতা করতে। রুমের বাতি নষ্ট হয়ে গেছে, লাশ কাটা যাবে না। কাল সকালে কাটতে হবে। মজিদ মিঞা কিছুতেই রাজী হচ্ছে না। তার নাকি ভয় করে। এত ভয় মানুষের আসে কোথা থেকে? অবশ্য একটু আগে আমারো খুব ভয় করছিল। রাতের বেলা মজিদ মিঞা ঘুমালেও আমি কারো কাছে কিছু বলতে পারব না। এমন চুক্তির শর্তে মজিদ মিঞাকে রাজী করলাম আমার সাথে যেতে। আমি আর মজিদ মিঞা মিলে লাশটি আবারো ফ্রিজের বাক্সে রেখে দিলাম। আমি বাড়ির দিকে যাচ্ছি। বিশ টাকা রিক্সাভাড়া লাগবে বাসাইল শাপলা চত্বরে যেতে। গরম পানি দিয়ে গোসল করে একটু ঘুমাতে হবে। সকালে পুলিশ আসার আগেই হাসপাতালে পৌঁছতে হবে।

ঝুমা একটি ছেলের পিছনে মোটরসাইকেলে বসে আছে। ছেলেটি ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে ঝুমার দিকে। ছেলেটি কত সুন্দর। কিন্তু রহমতের ছেলে রায়হান আমাকে বলেছে ছেলেটা ভালো না, নেশা করে। নেশাখোর ছেলে দেখতে এত সুন্দর? সামনে একটি রডবাহী ট্রাক। আমি ছেলেটিকে ডাকছি, "এই ছেলে সামনে ট্রাক, আমার মেয়েকে মারবে নাকি? এই ছেলে?" ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঝুমার মা রান্নাঘর থেকে ডাকছে। "এই ঝুমার বাপ, কোন ছেলেকে ডাকছ?"

আমি আবারো গোসল করলাম। সকাল সাড়ে আটটা বাজে। পুলিশ যাওয়ার আগে আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। ঝুমা বসে আছে তার রুমে। আমি ঝুমাকে শুনিয়ে তার মা'কে বললাম, "তোমার মেয়েকে বুঝাও। এই নেশাখোর ছেলের ভূত মাথা থেকে যেন নামায়।"

জালাল আমাকে দেখে এগিয়ে এল। -ভাই রাতে লাশ কাটেননি কেন? ডাক্তার এসে তো রাগারাগি করল। পুলিশ আসবে দশটায়। রাতে বাতি নষ্ট হয়ে গেছে। বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। রাতে আমি বাতির সুইচ অফ করিনি। বাতি দুটো এখনো জ্বলছে। জালালকে নিয়ে আবারো লাশটি বের করলাম। পুলিশ আসার আগেই কাটাকাটি শেষ করতে হবে। জালালও আমার সাথে সহযোগীতা করছে। ছুড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমি স্পষ্ট দেখেছি একটা মানুষের ছায়া আমার পিছন থেকে সরে গেল। জালাল আবার বলল, "ভাই কাটেন তো তাড়াতাড়ি, পুলিশ চলে আসবে।" পোস্টমর্টেম শেষে জালাল চার ইঞ্চি সুঁই দিয়ে লাশের পেট আর মাথা সেলাই করছে। বাড়ি থেকে ছেলেটার ফোন আসাতে মোবাইল বের করে কল রিসিভ করলাম। -আব্বা ঝুমা বিষ খাইছে। কোনো কথা বলছে না। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। জালাল জানতে চাইল কী হয়েছে? আমি কথার জবাব না দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে রিক্সা নিলাম।

বাড়ি ভর্তি মানুষ। পুলিশ ঝুমার লাশ একটি ভ্যানে তুলছে। আমার ছেলেটা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। ঝুমার মা চিৎকার করে কেঁদে বলছে আমার মেয়েকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? পুলিশ বলল, পোস্টমর্টেম করতে হবে। আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। পোস্টমর্টেমের কথা শুনে বুক কেঁপে উঠল। সদর হাসপাতালে এখনো জালাল আছে। জালাল আমার মেয়ের লাশ কাটাকাটি করবে। গতরাতের কথা মনে পড়ে গেল। মর্গের রুমে কেউ একজন বলছিল লাশ কাটতে গিয়ে আমার ভালোবাসার পবিত্র শরীর তো দেখে ফেলবেন। একজন পুলিশ যাবার পথে পিছন ফিরে তাকাল। তাকে আমি চিনি। গতরাতে তাকে স্বপ্নে দেখেছি। তার পিছনে মোটরসাইকেলে বসা ছিল আমার মেয়েটি। আমি বলেছিলাম আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলবে নাকি? মেরেই তো ফেলল। এখন নিয়ে যাচ্ছে পোস্টমর্টেম করতে।

0 comments
Enjoy
Free
E-Books
on
Just Another Bangladeshi
By
Famous Writers, Scientists, and Philosophers 
click here.gif
click here.gif

Click Here to Get  E-Books

lgbt-bangladesh.png
bottom of page