top of page

দ্বিতীয়_মৃত্যু

লেখকঃ Dr. M Ashik Awal

প্রথমবারের মত আমি খুব কাছে থেকে মানুষের মৃত্যু দেখেছিলাম ঢাকা মেডিকেলের ক্যাজুয়ালটি সার্জারী ওয়ার্ডে। ২০০৭ সালে, আমার ইন্টার্র্নির সময়। ঢাকা ডেন্টাল কলেজে পড়লেও, সেসময় আমাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একমাস ক্যাজুয়ালটি সার্জারীতে প্লেসমেন্ট থাকতো। সেখানে কোন এক এডমিশন নাইটে আমি প্রথম মৃত্যুটা দেখি। রোড ট্রাফিক এক্সিডেন্টের এক নাম না জানা মহিলা রোগী আমার চোখের সামনে সারারাত ছটফট করে ভোরবেলায় মারা যায়। রাত তিনটা থেকে ভোর পর্যন্ত তার মৃত্যুযন্ত্রণা আর ছটফটানি এখনও আমার দুঃস্বপ্নে ভেসে উঠে।

এরপর ঢাকা মেডিকেল ও বিএসএমএমইউ এর মেডিসিন ও সার্জারী ওয়ার্ডে, এইচডিইউ ও আইসিইউ তে অনেক মৃত্যু দেখেছি। ধুঁকে ধুঁকে মারা যেতে দেখেছি, হঠাৎ মৃত্যুও দেখেছি। এভাবে মৃত্যু আমার কাছে খুব সাধারন ও সহজ ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। ইন্টার্নির পর আমি বহুবার ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছি; কিন্তু জরুরী বিভাগ আর ক্যাজুয়ালটি সার্জারি এড়িয়ে গেছি সবসময়। কিন্তু এক যুগ পর আবার ক্যাজুয়ালিটি সার্জারির সেই ১০২ ওয়ার্ডেই আমার তিন মাসের প্লেসমেন্ট। দ্বিতীয় মৃত্যুর ঘটনা এই এখানেই।

সেদিন আমার ওয়ার্ডে ইভিনিং ডিউটি। টুকটাক ঝামেলা ছাড়া ওয়ার্ডের ডিউটি প্রায় শুয়ে বসে সময় কাটানোরই মতো। দুপুরে খেয়ে দেয়ে আড়াইটায় ডিউটি রুমের বিছানায় আধাশোয়া হয়ে মোবাইল গুতাচ্ছি। তিনটা বাজে, চারটা বাজে, পাঁচটা বাজে। মোবাইল গুতানো বন্ধ করে একটু পড়ি, তারপর একটু ঘুমাই। আমি জানি ওয়ার্ডে একাধিক খারাপ রোগী আছে, যারা যে কোন সময় আমার ঘুম এবং ঘাম ছুটিয়ে দিতে পারে। সাড়ে ছয়টায় আমার খোঁজ শুরু হলো। ৭ নম্বর বেডের রোগীর রক্ত দেয়া হচ্ছিলো, এখন কাপুনি হচ্ছে। সিস্টারই এসব ম্যানেজ করে, আমি গিয়ে শুধু দেখে এলাম। এরপর এর রিপোর্ট দেখা, তার জ্বর, ওর ড্রেসিং ছুটে গেছে, এরকমই চলছিল।

৭ টা বেজে গেছে, আর একঘন্টা। রাতের ডিউটি থোরাসিক সার্জারীর রেসিডেন্ট, ডাঃ তন্ময়ের। ও আগেই আমাকে আশ্বাস দিয়েছে তাড়াতাড়ি আসবে, দেরী করবে না। ঠিক সাড়ে সাতটায় ১১ নম্বর বেডের রোগির শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। চার তলা থেকে পরে গিয়ে, এই রোগীর ফুসফুসে ও লিভারে আঘাত লেগে বুকে ও পেটের ভেতর রক্তপাত হচ্ছিলো এবং মুত্রনালীও ছিড়ে গিয়েছিলো। সাথে বুকের দুপাশে পাজরের হাড় ভাঙ্গা, কোমড়ের হাড় ভাঙ্গা, পায়ের হাড় ভাঙ্গা। রোগীর বুকের দুপাশেই চেস্টড্রেইন দেয়া, ব্লাডারে এসপিসি করা। সকাল থেকেই মাঝে মধ্যে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। রাউন্ডের সময়ই স্যার আইসিইউ রেফার করেছিল, কিন্তু রোগী আইসিইউ খালি পাচ্ছে না। রোগীর বয়স মাত্র আঠারো। রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। সাথে আছে তার বোন আর খালা। পুরুষ মানুষ কেউ নেই। যারা আছে তারা শুধু দোয়া দরুদ পড়তে পারে, কান্নাকাটি করতে পারে আর রোগীর পায়ের পাতায় মালিশ করতে পারে। তারা আইসিইউ ও চেনে না, ঔষধের দোকানও চেনে না।

সাড়ে সাতটায় রোগীর বোন দৌড়ে এলো, স্যার আমার ভাইএর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। স্টেথো নিয়ে দ্রুত গেলাম। লম্বা ছিপছিপে একহারা গড়ন, গায়ে একফোটা মেদ নেই, তরতাজা যুবক। সত্যিই শ্বাস নিতে পারছে না। চেস্ট ড্রেইন ঠিক আছে। ব্যাথা আছে হয়ত। ছেলেটা ডাঙ্গায় তোলা মাছের মত বাতাস গেলার চেষ্টা করছে। দ্রুত সিস্টারকে ডাকলাম, অক্সিজেন চালু করা হল। ব্যাথার ইঞ্জেকশন দেয়া হল। পালস বেশী, প্রেশার কম। অক্সিজেন চালু করার পর তার মাছের মত খাবি খাওয়া কমলো, কিন্তু স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিতে পারছিলো না তখনও। স্টেথো বুকে লাগানোর পর আমি শুধু তার ধাম ধাম শব্দে হার্টবিট শুনতে পাই, লাং সাউন্ড পাই না। সে তখন লড়াই করে যাচ্ছে বুক ভরে শ্বাস নেবার জন্য। ওয়ার্ডে কোন পালস অক্সিমিটার (রক্তে অক্সিজেনের পরিমান মাপার যন্ত্র) নাই। আবার প্রেশার মাপলাম, প্রেশার আরো কমে গেছে। আমি ঘামতে শুরু করলাম। বুঝতে পারছি না, পাজরের হারভাঙ্গা রোগীকে সিপিআর দেয়া যাবে কিনা? এর মধ্যে রাতের ডাক্টারও চলে এসেছে। বুকে বল পেলাম। ও রোগীর হ্যান্ডোভার নিলো। আমি ফাইল নিয়ে বসলাম, নতুন করে আইসিইউ কল লিখলাম। কল লেখা শেষ হতে না হতেই ডাঃ তন্ময় আমাকে ডাকতে লাগলো।

আমরা দুইজন রোগীর বেডের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছি। রোগির ছোট বোন গলা ছেড়ে কাঁদছে। রোগির খালা ছেলেটার পায়ের পাতা সজোরে মালিশ করে যাচ্ছে আর দোয়া দরুদ পড়ছে। রোগী শ্বাস নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, পারছে না। তার চোখ দুটো ঠিকরে বেড়িয়ে আসছে। দুহাত মুঠি করে রেখেছে। নাকের উপর আমরা অক্সিজেন মাস্ক চেপে ধরে আছি। সে মাছের মত বাতাস গেলার চেষ্টা করছে ক্লান্ত ভাবে। আমি তার ডান হাত ধরে আছি, তার পালস পাচ্ছি না। একটু আগেও ছিলো। ডাঃ তন্ময় আবার প্রেশার মাপার চেষ্টা করলো, তার দামি স্টেথোস্কোপেও সে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। সে বলে আউয়াল ভাই, প্রেশার পাচ্ছি না। মাত্র ৫ মিনিটে ঘটে গেলো এসব। রোগী নিস্পলক দৃষ্টিতে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পালস নাই, হার্টবিট নাই, ব্লাড প্রেশার নন রেকর্ডেবল। রোগীর বোন আরেকবার গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে মাটিতে পরে গেলো।

সিস্টারকে দুইটা ইঞ্জেকশন দিতে বলে আমি দৌড়ে গেলাম সিএ-এর রুমে। ভাগ্য ভালো সেখানে সার্জারীর মেডিকেল অফিসার ছিলেন। ডেকে নিয়ে এলাম তাকে। এসে দেখি ডাঃ তন্ময় হাটু গেড়ে রোগির বিছানার পাশে বসে আছে। গভীর মনযোগে প্রেশার মাপার চেষ্টা করছে। বড়ভাই এসে রগিকে শোয়া থেকে উঠিয়ে বসালেন। দুজন ধরে রাখলাম দুপাশ থেকে। উনি পিঠে হালকা করে থাবা দিলেন চার পাঁচটা। প্রায় ৩০ সেকেন্ড পর আবার কাশি দিয়ে উঠলো ছেলেটা। শ্বাস নিলো দুবার। আমরা আবার অক্সিজেন মাস্কটা চেপে ধরে রাখলাম। মিনিট খানেক পর তার শ্বাস-প্রশ্বাস চালু হল আবার। পালস পেলাম, হার্ট বিটও ফিরে এলো। আমরা তিনজন হাপ ছেড়ে বাচলাম যেন। কিন্তু তার দরকার অতিদ্রুত কৃত্তিম শ্বাস-প্রশ্বাস চালু করা। যেটা আইসিইউ ছাড়া সম্ভব নয়।

বড়ভাইকে রুগীর বিছানায় রেখে এবার দুজনে রোগীর ফাইল নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে গেলাম আইসিইউ তে। ভেতরে ঢুকে এসিস্টেন্ট প্রফেসর স্যারকে বললাম রোগীর অবস্থা। স্যার জানালেন, ওখানে কোন বেডই ফাঁকা নেই, তবে এইমাত্র একটা রোগী মারা গেছে, ডেডবডি এখনও নামানো হয়নি। আমাদের জোড়াজুড়িতে তিনি রাজী হলেন ওয়ার্ডের রোগীকে সেই বেডে দিতে। একটা কেনাকাটার লিস্ট ধরিয়ে দিলেন তিনি, আর ফাইলে সিল মেরে দিলেন। আবার সেই ফাইল নিয়ে আমরা দুজনেই ইএমও স্যারের ফরোয়ার্ডিং নিয়ে ওয়ার্ডে এলাম। সিস্টারকে ফাইল দিয়ে রোগীর লোকজনকে বললাম এক্ষুণি রোগীকে আইসিইউ তে নেয়ার ব্যবস্থা করতে আর দ্রুত লিস্ট অনুযায়ী জিনিসপত্র কিনে আনতে।

কিন্তু কে করবে এসব? পাশের বেডের একজন রাজী হল ঔষধপত্র কিনে আনতে। আর রোগীর খালা গেল ট্রলির খোঁজ করতে। পাঁচ মিনিট পরও তার কোন খোঁজ নাই। ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে দেখি সে সিড়ির গোড়ায় উদ্ভ্রান্তের মত দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় ট্রলির খোঁজ করতে হবে এ ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র ধারনা নেই। একজন ওয়ার্ডবয়কে পাঠালাম ট্রলি আনতে। রোগী তখন মোটামুটি স্টাবল। কষ্ট হচ্ছে খুবই, কিন্তু সে শ্বাস নিচ্ছে। প্রায় ২০ মিনিট পর ট্রলি এলো, সিস্টারকে বললাম অক্সিজেন সিলিন্ডার বের করতে। সিস্টার বলে, ডক্টর, ওয়ার্ডে কোন অক্সিজেন সিলিন্ডার নাই! সেন্ট্রাল লাইন থেকে রোগীর বেডে ডাইরেক্ট অক্সিজেন দেয়া হয় বলে এই ওয়ার্ডে কোন অক্সিজেন সিলিন্ডার নাই। আকাশ থেকে পড়লাম আমি। এখন উপায়? অক্সিজেন ছাড়া একে আইসিইউ পর্যন্ত নেব কিভাবে? গেলাম নতুন চালু হওয়া One-stop emergency centre (OSEC ) এর মেডিকেল অফিসারের কাছে। কিন্তু তিনি ডিরেকটরের অনুমতি ছাড়া অক্সিজেন সিলিন্ডার দেবেন না। আবার গেলাম আইসিইউ এর স্যারের কাছে। বললাম স্যার, এখন কি করবো? তিনি বললেন, কি আর করবা? শুধু মাস্ক মুখে লাগিয়ে আম্বু ব্যাগ চেপে চেপে নিয়ে আসো। পাঁচ মিনিট টিকলেই হয়।

ফেসমাস্ক, আম্বুব্যাগ এলো। রোগীকে ট্রলিতে উঠানো হলো। একজন ফেসমাস্ক চেপে ধরলাম, আরেকজন আম্বু ব্যাগ চাপতে লাগলাম। শুধু ফেসমাস্ক ও আম্বু ব্যাগে আসলে কিছুই হয়না। আমি কোনভাবেই সাহস পাচ্ছিলাম না। আল্লাহর নাম নিয়ে বের হলাম ওয়ার্ড থেকে। করিডোরের ভীড় ঠেলে লিফটের সামন পর্যন্ত যেতে তিন মিনিট লাগলো। রোগী তখনও নিঃশ্বাস নিচ্ছে। এবার লিফটে ওঠার প্রতিযোগিতা। কে মৃত্যু পথযাত্রী, কে ট্রলিতে, কে হুইল চেয়ারে; কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। হাসপাতালে আসা দর্শনার্থী কে কার আগে লিফটে উঠবে তার প্রতিযোগিতায় নামে। ওয়ার্ডবয়ের সহযোগীতায় আর আমাদের চেচামেচিতে দুমিনিটের মাথায় রোগীকে লিফটে উঠাতে পারলাম। কিন্তু ততক্ষণে তার আবার খাবি খাওয়া শুরু হলো। অক্সিজেন খোলার পর মূল্যবান ৫ মিনিট পার হয়ে গেছে। পালস অক্সিমিটার ছাড়াই আমি বুঝতে পারছি, তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমতে কমতে শূন্যর দিকে এগুচ্ছে।

তিনতলায় ট্রলি নামাতে নামাতে আবার সে হারিয়ে গেলো। নিস্পলক দৃষ্টতে তাকিয়ে রইলো ছাদের দিকে। তারপরও এক সেকেন্ড নষ্ট না করে ইন্টারভেনশন রুমে নিয়ে অক্সিজেন চালু করা হলো। কিন্তু নাহ, আর কিছুই করা গেলো না। লিফটেই সে মারা গেছে দ্বিতীয়বারের মত। আইসিইউ এর স্যার আর তাকে ফিরিয়ে আনতে পারলেন না। তারপরও আরো পাঁচ মিনিট চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার পালস আর ফিরলো না, বিপি আর পাওয়া গেলোনা, হার্টবিট আর শোনা গেলোনা। ইসিজির লাইনটা স্ট্রেট-ই থেকে গেলো। বড় বড় চোখে সে ছাদের দিকে তাকিয়েই থাকলো। আমি আর তন্ময় বিদ্ধস্ত বোধ করতে লাগলাম, ওয়ার্ড বয় বিরক্ত এবং আইসিইউ এর স্যার অন্য রোগির কাছে ব্যস্ত হয়ে পরলেন।

সাড়ে আটটা বাজে। ওয়ার্ডে ফিরে এলাম। ডিউটি রুম থেকে ব্যাগটা পিঠে নিয়ে হাটতে হাটতে বেড়িয়ে এলাম ১০২ নাম্বার ওয়ার্ড থেকে। হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে হেটে চললাম অন্ধকার শহরের দিকে।



0 comments

Recent Posts

See All
Enjoy
Free
E-Books
on
Just Another Bangladeshi
By
Famous Writers, Scientists, and Philosophers 
click here.gif
click here.gif

Click Here to Get  E-Books

lgbt-bangladesh.png
bottom of page