top of page

একটা অদ্ভুত ঘটনা


প্রতিদিনের মত আজও ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঢুলু ঢুলু চোখে বাথরুমে আয়নার সামনে দাড়িয়েছি। ব্রাশে পেস্ট মেখে আয়নার দিকে তাকাতেই নিজের চেহারায় কিছু পরিবর্তন চোখে লাগলো। বলতে নেই পুরুষ মানুষ হয়েও সুযোগ পেলেই আয়নায় নিজেকে খুটিয়ে খু্টিয়ে দেখি। আজকের পরিবর্তনগুলো চোখে লাগার মতই প্রকট। মাথার চুলগুলো বেশ ঘন মনে হচ্ছে। এরকম ছিলোনা। চুলে কমে গিয়ে দুপাশে টাক বের হয়ে গিয়েছিলো। সেই টাক ঢাকার গবেষনার প্রতিদিনের কিছুটা সময় ব্যয় হতো। জুলফীর চুলগুলো সাদা ছিলো, এখন সেগুলোও কালো। গলার কাছে কিছু রিংকেল ছিলো। সেগুলোও আর নেই। একটু শুকনাও কি লাগছে নিজেকে ! আমি কি কোন স্বপ্নের মধ্যে আছি? স্বপ্নে এরকম হয়। অনেক অসম্ভব জিনিস স্বপ্নে খুব স্বাভাবিক ভাবে আসে। একবারতো এরকমই দেখলাম যে আমি সুপারম্যানের মত আকশে উড়ছি। যেখানে খুশি সেখানে যাচ্ছি। একবার সন্দেহ হলো এটা স্বপ্ন নয়তো ! স্বপ্ন যে স্বপ্ন না এটা প্রমান করার জন্য প্রচলিত নিয়ম হলো হাতে চিমটি কাটা। আমিও চিমটি কেটে প্রমান করলাম যে এটা স্বপ্ন না। কাজেই আমি বেশ মজা নিয়ে আরো উড়াউড়ি করলাম, এবং সকাল বেলায় ঘুম ভেঙ্গে যখন বুঝতে পারলাম এটা স্বপ্নই ছিলো তখন কিছুক্ষন মুখ লম্বা করে বসে রইলাম। আজকের ব্যাপারটা স্লিপ ওয়াকিং এর মত কিছু হবে হয়তো। অথবা আয়নায় কোন সমস্যা থাকতে পারে। আয়না ঘোলা থাকলে চেহারাও ঘোলা লাগে, তখন চেহারার খুত গুলো চোখে পড়েনা।

ঝটপট অফিসে যাওয়ার জন্য রেডী হলাম। শোবার ঘরে উকি দিয়ে দেখি কেয়া ডিসেম্বরের হালকা শীতে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছেনা। হয়তো লেপের মধ্যে ঢুকে আছে। ওর স্কুল বন্ধ। নইলে এতোক্ষনে হুলুস্থুল শুরু হয়ে যেতো। বিদায় নিতে যেয়ে ওদের ঘুম ভাঙ্গানোর কোন মানে হয়না। আমি গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আর তখনই দ্বিতীয় অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটলো। যেটা ছিলো ভয়ের।

আমার অফিস বাসা থেকে খুব কাছে, পাঁচ মিনিটের পথ, কিন্তু আমি চলে এলাম আধাঘন্টা দুরত্বে আমার পুরানো অফিসে। যেন আমি গাড়ী চালাইনি, গাড়ীই আমাকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে। বছর দশেক আগে এই অফিসে কাজ করতাম আমি। কিন্তু আজ আমাকে দেখে কেউ অবাক হলোনা। যেন আমি এখানে এখনও কাজ করি। প্রতিদিনই আসি। রুমের দরজায় নেমপ্লেটে এখনও আমার নাম লেখা 'ইমন চৌধুরী'। আমি রুমে ঢুকলাম না। ধীর পায়ে কিচেনের দিকে গেলাম।

কিচেনে মেরি জেইন এর সাথে দেখা। কোম্পানির মালিক। আমকে দেখে একটু জোরেই গুড মর্নিং বললেন। যার মানে হলো ‘তুমি আজকেও লেইট’। কফি মেকারে ফ্রেশ কফি ব্রিউ করছিলেন। আমার দিকে ফিরে বললেন -কফি চাও ইমন? আমি হ্যা সুচক মাথা নাড়লাম। আমার দিকে কফির মগ এগিয়ে দিতে দিতে বললেন -খেয়া কেমন আছে? এরা ক উচ্চারন করতে পারেনা। ক কে খ এর মত শোনায়। -ভালো -ও ডিও কবে?

একটু ভাবলাম। কেয়াতো প্রেগ্নেন্ট না। আমার মেয়ের বয়স এখন নয় চলছে, কিন্তু আমার মুখ থেকে বের হয়ে এলো -এইতো জানুরারীতেই ডেট। -অললোস্ট দেয়ার। শোন, বাচ্চা হওয়ার পর তুমিতো অবশ্যই পেরেন্টাল লিভ নেবে। তার আগে যদি কোন প্রজেক্টের ডেডলাইন থাকে সেগুলো শেষ কোরো। অথবা জেসিকাকে তোমার পেন্ডিং কাজ গুলো বুঝিয়ে দিয়ে যেও।

আমি আচ্ছা বলার ভঙ্গিতে মাথা ঝাকালাম। কফি নিয়ে রুমে ফেরার সময় পকেট থেকে সেলফোন বের করলাম। মোটোরোলার সেই পুরানো ফ্লিপ ফোন। ফ্লিপ করতেই কেয়া'র বিয়ের প্রথম দিকের সময়কার একটা ছবি স্ক্রীনে ভেসে উঠলো। স্ক্রীনে ডেট এর জায়গায় আজকের তারিখ। কিন্তু সালটা দশ বছর আগের। কিভাবে সম্ভব এটা ! আমি ডিসেম্বরের শুন্য তাপমাত্রার শীতে কুলকুল করে ঘামতে থাকি।

একসময় কম্পিউটার চালু করি। ওপেনিং পাসওয়ার্ড চাচ্ছে। আমার আঙ্গুল যেন পাসওয়ার্ড জানে এভাবেই আমি টাইপ করলাম। কম্পিউটার চালু হল। কম্পিউটারের নীচে ঝুলে আছে কিছু স্টিকি নোটস। আজকের ‘টূ ডু’ লিস্ট। আমারই হাতের লেখা। আমিও কেমন করে যেন কাজ করতে শুরু করে দিলাম যেন আমি এই কাজ প্রতিদিনই করি, যেন আমি এই সময়েই থাকি...

সারাদিনে যথারীতি কয়েকবার কেয়া'র ফোন আসলো। দুপুরে লাঞ্চে যেন বিফ না খাই। সেটা মনে করিয়ে দিলো। আর বিকেল পাঁচটায় এলারম বাজার মত কেয়া'র ফোন আসলো -কি বের হইছো অফিস থেকে? এখনও বের হওনায়? বিকেলে বাসায় ফিরে এলে কেয়া দরজা খুলে দিলো। উচু হয়ে থাকা পেটের নীচে একটা হাত রেখে ঘুর ঘুর করেছে। যেন হাতটা সরালেই পেট ফুরে বাচ্চাটা পড়ে যাবে। আহা ! মায়ের জাত।

ঘুমাতে যাওয়ার সময় আমরা হালকা কথাবার্তা বলি। কেয়া আহ্লাদী গলায় বলে -আমি চাই আমাদের মেয়েটা তোমার চেহারা পাক। মেয়েরা বাবার চেহারা পেলে লক্ষ্মী হয়।

তখনই আমার মেয়েটার কথা মনে পড়লো। বুকটা হু হু করে উঠলো। কেয়াকে বলতে চাইলামে 'কেয়া, তোমার মেয়ে দেখতে তোমার মত সুন্দর হবে, তুমি তার নাম রাখবে ইলেন, আমার নামের সাথে মিলিয়ে'। কিন্তু কিছুই বললাম না। কেয়াকে কোন কনফিউশন দিতে চাইনা।

আমি নিশ্চয়ই আমি কোন দীর্ঘ দুঃস্বপ্ন দেখছি। কাল ঘুম থেকে উঠে দেখবো সব বর্তমান সময়ে চলে এসেছে। আর আমি এই গল্প সবাইকে মজা করে বলবো। মানুষ অবাক হয়ে বলবে ; এমনও হয় !

মনে একটা ক্ষীন সন্দেহ রয়েই গেলো, এমনও কি হতে পারে কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবো আমি আরো পেছনের সময়ে চলে গেছি...

২. সকালে ঘুম ভাঙ্গলো একটানা সুর করে পড়ার শব্দে। আমি চোখ খুলেই আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম। যা দেখছি তা পরিচিতি কিন্তু অনেক পুরানো। পল্লব নাটকের রিহারসেল করার মত করে নিউমেরিক্যাল এনালাইসেইসের দীর্ঘ সুত্র পড়ছে রুমের ভেতর পায়চারী করতে করতে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের খানজাহান আলী হলের ৩২০ নাম্বার রুম। চার কোনায় চারোটা খাট। তারই একটাতে আমি শুয়ে আছি।

আমাকে চোখ মেলতে দেখে পল্লব ভানু’র গলায় বললো

-কি মশাই উঠছো? অখন খাইয়া পড়তে বসবা, নাকি পইড়া খাইতা যাবা?

আমি ভয়ে সিধিয়ে যাচ্ছি নিজের ভেতর। হচ্ছে কি এসব ! ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে আছি ওর দিকে

-কিরে তোকে দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিন কোমায় থাকার পর তোর জ্ঞান ফিরে এসেছে। এখন কি শাবানার মত বলবি

-আমি এখানে কেন? আমার কি হয়েছে? হা হা

কিছুক্ষনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, আমি আরো দশ বছর পেছনে চলে এসেছি। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। পি এল চলছে। পরশু পরীক্ষা।

হঠাত কেয়া'র কথা মনে পড়লো। ও কি টরেন্টোতে রয়ে গেছে একা? ইলেন কি ওর কাছে আছে ! আমাকে ইতিউতি তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে দেখে পল্লব জিজ্ঞেস করলো

-কি খুঁজিস?

আমার সেল ফোন

পল্লব ঘর কাপিয়ে হাসতে শুরু করলো

-তোর ঘুমের ঘোর এখনও কাটেনিরে। কাল রাতে মনে হয় হেভী কোপ দিছিস। তুই বরং আরেকটু ঘুমা

আমি মনের অজান্তেন্তেই হাসলাম। কোপ শব্দটা বিশ বছর পরে শুনলাম। ক্যাম্পাসে পড়াকে কোপ দেয়া বলতাম

এরপর আমাকে দেখা গেলো সারাদিন হেভী কোপ দিতে। পরশু পরীক্ষা। রাতে মিঠুর কাছ থেকে চোথা নিয়ে এলাম। পাশের রুম থেকে নিলু এলো পড়া বুঝতে। টুটুল দিনভর ঘুমিয়ে রাতে আসলো চোথা নিতে। টিভি রুম থেকে ‘টিপ টিপ বরসা পানি’ গান শুরু হলে কেউ একজন সাউন্ড বাড়িয়ে দিলে আমরা হুড়মুড় করে নীচে নেমে এলাম গানটা দেখার জন্যে। কয়েকবার নীচে নামলাম চা খেতে, আর প্রতিবারই যারা রুমে রুমে পড়ছিলো তাদের ক্ষেপালাম

-কিরে শালা এতো কোপাচ্ছিস কেন? যতই চেষ্টা করিস, A+ এর বেশী তো পাবিনা

রাতে ঘুমানোর সময় আবার আমার মনে পড়লো আমি একটা ব্যাকওয়ার্ড জার্নি’র মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমি ভীষন অসহায় বোধ করছি। পাশের খাটে শুয়ে থাকা পল্লবকে ফিসফিস করে বললাম

-পল্লব, কাল আমি চলে যাচ্ছি

-কোথায়

-দশ বছর আগে আমার ছেলেবেলায়, আমার ফ্যামিলির সবাইকে একসাথে পাবো এক বাসায়। স্কুলে ক্লাস ফাইভে ক্লাস করবো। কপাল খারাপ থাকলে মাওলানা স্যারের হাতে মারও খেতে পারি। ছুটির পর মাঠে ফুটবল খেলবো। বৃষ্টি নামলে কাঁদা পানি মেখে ফুটবল খেলবো, সন্ধ্যা নামলে পড়তে বসবো, পাঠ্য বই এর নীচে আরব্য রজনী’ বই পড়বো লুকিয়ে। রাতে সবার একসাথে মেঝেতে মাদুর পেতে ভাত খাবো

পল্লব আমার দিকে তাকালো, যেন আমি গাঁজা খেয়ে ভুলভাল বকছি এবং এ বিষয়ে সে একশত ভাগ নিশ্চিত

-পল্লব জানিস, তুই একসময় ফেসবুকে লেখালেখি করবি। অনেক মানুষ তোর লেখা পছন্দ করবে

-ফেসবুক কি জিনিস, কোন সাহিত্য পত্রিকা?

আমি ওর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় এক হাসি দিলাম

-মডেলদের মতো দেখতে একটা মেয়ের সাথে তোর বিয়ে হবে। সাদা দাড়িতে তোকে চল্লিশেই বুড়ো দেখাবে, অথচ তোর বউকে তখনও কিশোরীর মত দেখাবে, একবার তুই প্যানিক এটাক নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে ডাক্তার তোর বউকে জিজ্ঞেস করবে, আপনি কি রোগীর মেয়ে? হা হা হা

হেভী ফি্লিংসে আছিসরে ! কার সাথে গাঞ্জা খেয়েছিস আজ? নেক্সট টাইম গেলে আমাকে নিয়ে যাস হা হা হা

পল্লব পাশ ফিরে একটা বড়সড় হাই তুলে ঘুমিয়ে গেলো।আমার ঘুমাতে ভয় করছে। আবার পুলকও লাগছে। আজ রাতে ঘুমালে কাল সকালে আবারো দশ বছর পিছিয়ে পড়বো। ফিরে যাবো আমার দশ বছর বয়সের ছেলেবেলায়, যে ছেলেবেলায় কল্পনায় কত ফিরে যেতে চেয়েছি ! পরিবারের সবাইকে একসাথে ফিরে পাবো। আমি কি আব্বাকে জড়িয়ে ধরে রাখবো। নিন্মবিত্ত বাবারা কথায় কথায় ছেলেমেয়েদের জড়িয়ে ধরেনা। হয়তো ধমক দিয়ে বলবে

ছাড় হারামজাদা, হইছে কি তোর?

রাতে সবাই মেঝেতে মাদুর পেতে খেতে বসবো। মা সামনে বসে ভাত তরকারী বেড়ে দেবেন। সবাই ভর্তা ভাজি ডাল খেলেও আমার পাতে হয়তো থাকবে গতদিনের তুলে রাখা এক টুকরো মাছ। পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য হিসাবে এই বাড়তি পাওনা।

সে রাতে আব্ব আম্মা'’র মাঝখানে ঘুমাবো। পরের দিন সকালে সময় আরো দশ বছর পিছিয়ে যাবে যখন আমার বয়স শুন্য...

0 comments

Recent Posts

See All
Enjoy
Free
E-Books
on
Just Another Bangladeshi
By
Famous Writers, Scientists, and Philosophers 
click here.gif
click here.gif

Click Here to Get  E-Books

lgbt-bangladesh.png
bottom of page