top of page

অবশেষে এক মাঝরাতে সেই ফোনটি এল

অবশেষে এক মাঝরাতে সেই ফোনটি এল যার আশংকায় আমি ঘুমাতে পারছিলাম না আজ বহু রাত! আমার মায়ের বৃদ্ধাশ্রম থেকে ফোন করে জানানো হলো তাঁর সময় শেষ হয়ে এসেছে! ডাক্তার নিকটতম আত্মীয় স্বজনদের খবর দিতে বলেছেন! তাঁর ধারণা আজকের রাতটা কাটবে না! ভোর হবার আগেই ভালমন্দ একটা কিছু ঘটে যাবে !

ভেবেছিলাম এই দিনটির জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম! এখন বুঝলাম আমি প্রস্তুত নই! রাতের খালি রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে আমার দু চোখ বারবার জলে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে!আরও খারাপ লাগছে মা এর জীবনের শেষের কয়েকটি দিন আমি তাঁর সাথে কাটাতে পারলাম না বলে! এটি অবশ্য আমার ইচ্ছায় হয় নি! আসলে বিবাহিত জীবনে অনেক ঝামেলা থাকে ! আমরা যা করতে চাই, সবসময় তা করতে পারি না! আমরা খালি চোখে কত জুটিকে দেখে ভাবি, আহা এরা কত সুখেই না আছে! কিন্তু সত্যি কথা হলো বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে যখন স্বামী স্ত্রী নিজেদের বেডরুমের দরজা বন্ধ করে, তখনই শিকারী পশুদের মতো নখগুলো সব বেড়িয়ে আসে! স্বামী স্ত্রীর এই নগ্ন রুপ বাইরের কেউ কল্পনাই করতে পারবে না!দিনের বেলা অভিনয়ে এরা হুমায়ুন ফরীদি বা সুবর্ণা মুস্তফাকে হার মানিয়ে দিবে! এমনই এক কুৎসিত ঝগড়ার রাতে আমার স্ত্রী ঘোষণা দেয়, আমার মায়ের সাথে সে আর থাকতে পারছে না! উনি নাকি সব কিছুতে নাক গলান! বাচ্চা কোন স্কুলে ভর্তি হবে থেকে শুরু করে, আজকে কি রান্না হবে সব! “তুমি কাল সকালে উনাকে ছোট চাচার বাসায় রেখে আসবে! আমি কাল দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করব! এর মাঝে তুমি আমার কথা না শুনলে আমি মা এর বাসায় চলে যাব বাচ্চাদের নিয়ে। “ “আস্তে কথা বলো, মা শুনতে পাবেন! “ “আমি চাই উনি শুনুক। আমি কি উনাকে ভয় পাই নাকি? খারাপ আর কি হবে? তুমি আমাকে ডিভোর্স দিবে? দাও! আমি এখন সবকিছুর জন্য প্রস্তুত। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল! “ এরপর আর কোন কথা থাকে না! আমি আসন্ন ডিভোর্সের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা শুরু করলাম! এই জীবনে আমি সব পারব, কিন্তু মা কে ছাড়া বাঁচতে পারব না! খুব ছোট বেলায় আমার বাবা মারা যান! তখন মা নতুন করে বিয়ে না করে একলা হাতে আমাকে মানুষ করেন! সেই মা কে আমি কি করে বলি আমার অসহায় সময়ে তুমি আমাকে ছাতার মতো ঢেকে ছিলে কিন্ত তোমার এই অসহায় সময়ে আমি তোমাার পাশে থাকতে পারব না! আমার স্ত্রী আমার বাচ্চারা যেই স্কুলে পড়ে, সেই স্কুলের শিক্ষিকা। ওদের মর্নিং শিফট। বাচ্চাদের নিয়ে তাই ও ভোর না হতেই স্কুলে চলে গেছে! নাস্তার টেবিলে আমি কিছুতেই মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। মা কি কাল রাতে আমাদের কথোপকথন কিছু শুনতে পেয়েছিলেন?

নীরবতা ভেঙে মা ই প্রথম কথা বলে উঠলেন, “অফিস যাবার পথে তুই আমাকে তোর ছোট চাচার বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাবি! “ “ হঠাৎ? “ “হঠাৎ মানে? তুই জানিস না কেন যাচ্ছি? “ আমার তখন নির্মলেন্দু গুণের সেই কবিতাটি মনে পড়ে গেল, “হে পৃথিবী তুমি দ্বিধা হও,আমি তোমার ভেতরে প্রবেশ করে বাঁচি! “ “ দেখ তোর বউ একবার যখন বলেছে ডিভোর্সের কথা, তখন ডিভোর্স ওর মনে আছে! একটা মেয়ে কখনো স্বামীকে ভয় দেখানোর জন্য এই কথা বলবে না। এখন তোকে যা করতে হবে তা হলো তোর বিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে! না হলে তোর বাচ্চাদেরও তোর মতো বাবা ছাড়া বড় হতে হবে! তুই কি তোর সন্তানদের জন্য বাবা ছাড়া সেই একাকী জীবন চাস? “ “না মা,কিন্তু তোমার কি হবে? “ “আমার কিছুই হবে না! তুই আমাকে তোর চাচার বাসায় রেখে আমার জন্য একটা বৃদ্ধাশ্রম খুঁজে বের করবি। আমি এখানেও আমার ঘরে দোয়া কালাম পড়ে কাটাতাম, ওখানেও তাই করব। বরং ওখানে আমি সমবয়সী আরো অনেক মহিলা পাব, যাদের সাথে গল্প করে আমার সময় ভালই কেটে যাবে! “ আমার মায়ের যুক্তির সামনে আমি কখনোই ধোপে টিকতে পারি না। আজও তার ব্যাতিক্রম কিছু হলো না! আমি মায়ের কথামতো তাকে ঢাকার অদূরে একটি বৃদ্ধাশ্রমে তুলে দিয়ে এলাম এক ছুটির দিনে! তাও প্রায় বছর খানেক হতে চলেছে! প্রতিটি রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে যখনই ফোন বেজে উঠেছে, আমার মনে হয়েছে এই বুঝি সেই দুঃসংবাদ এলো! এভাবে আতংকিত হয়ে বেঁচে থাকা খুবই কষ্টকর একটি ব্যাপার! একটি উটের পিঠে আপনি যদি ক্রমাগত খড় চাপাতে থাকেন, তবে এমন একটা সময় আসবে, যখন সামান্য একটি খড়ের ভার অত বড় পশুটি আর নিতে পারবে না! সেই একটি মাত্র খড়ের ভারে উটটি বসে পড়বে! আমার কাছে কেন যেন মনে হয় আমার থেকে বিচ্ছেদ আমার মা এর জীবনে শেষ খড়কুটোর মতো এসেছিল। তাঁর সমস্ত জীবনী শক্তি নিংড়ে নিয়ে গেছে! এই ঘটনাটি তাঁর জীবনে না ঘটলে তিনি বুঝি আরো বহুদিন বাঁচতেন! কলাবাগান থেকে সাভারের দূরত্ব খুব একটা বেশী নয়! কিন্ত এই সামান্য পথটুকুই আমার কাছে লংগেষ্ট হান্ড্রেড মাইলের মতো মনে হচ্ছে! বিশেষ করে কেন যেন মনে হচ্ছে পৌঁছে মাকে আমি আর জীবিত পাব না। দাঁত থাকতে আমরা যেমন দাঁতের মর্যাদা বুঝি না, আমাদের বাবা মা যখন বেঁচে থাকেন,তখন আমরা বুঝতেই পারি না ছায়ার মতো তাঁরা কেমন করে আমাদের জড়িয়ে রাখেন এক নিরাপত্তার চাদরে! আমি যখন সাভারের উপকন্ঠে পৌঁছলাম তখন মাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে! সাভারের মতো ছোট একটি জায়গায় যে এত মসজিদ থাকতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিলো। সেই মসজিদগুলো থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি আমার রাতজাগার ক্লান্তি দূর করে দিলো! কায়কোবাদ আজানের ধ্বনি নিয়ে যে কবিতা লিখেছিলেন তাতে তিনি ধমনীর নেচে উঠার কথা বলেছেন! আসন্ন বিপর্যয়ের কারণেই হোক কিংবা কানে ঢুকতে থাকা আজানের ধ্বনির গুনেই হোক, আমার প্রতিটি লোহিত কণা তখন প্রবল বেগে আমার মস্তিষ্কের দিকে ধাবিত হচ্ছে! আমি যখন বৃদ্ধাশ্রমটির চৌহদ্দির ভিতরে ঢুকলাম তখন পার্শ্ববর্তী মসজিদ থেকে ভেসে আসা আরবী কথাগুলোর বাংলা করলে যা অর্থ হয় তা হলো, ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম! এই প্রচন্ড বিপর্যয়ের সময় ঘুমের প্রশ্নই আসে না! বারান্দার একগাদা সিঁড়ি ভেঙে আমি যখন মায়ের ঘরটিতে পৌঁছলাম, আমার আশংকাকে ভুল প্রমাণ করে তিনি তখনও বেঁচে রয়েছেন! শুনেছি প্রদীপ নিভে যাবার আগে নাকি দপ করে জ্বলে উঠে! আমার মা এরও তখন সেই অবস্থা! যে প্রচন্ড শক্তিতে তিনি আমার হাতটি চেপে ধরলেন তা আমাকে বিস্মিত করলো! “আয় বাবা, তোর জন্যই বেঁচে ছিলাম! আমার বারবার মনে হচ্ছিল তোর সাথে আর দেখা হবে না! তোকে কিছু কথা বলছি, কথাগুলো মনে রাখবি আর সেই ভাবে কাজ করবি। আমার বালিশের নীচে তোর বাবার কবরের দলিলটি আছে। তুই আমাকে ঐ একই কবরে কবর দিবি! তাঁকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছিলো! কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য,তাঁর সাথে বেশী সময় কাটাতে পারি নাই! আর শোন বউ এর সাথে কোন রকম ঝামেলায় জড়াবি না! সব সময় মনে রাখবি এই পৃথিবীর সব বিবাহযোগ্য ছেলে বাদ দিয়ে সে তোকে পছন্দ করেছিল বিবাহের জন্য! “ “ বাদ দাও ওর কথা, তোমার জন্য আমি কি আর কিছু করতে পারি? “ “ এখানে কোন পাংখা নেই, গরমের দিনগুলোতে খুব কষ্ট পেয়েছি। আর পারলে সব গুলো ঘরে একটি করে ছোট্ট ফ্রিজের ব্যবস্হা করে দিস। এরা সন্ধ্যার মুখে রাতের খাবার দিয়ে দেয়! গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ক্ষুধায় খুব কষ্ট পেতাম! তখন মনে হতো একটা ফ্রিজ থাকলে কিছু খাওয়া রেখে দিতে পারতাম! আমি জানি এটা তোর মন্ত্রনালয় না, তবে এটা যে বিভাগের তাঁদের দিয়ে কাজটি করিয়ে রাখবি, ভুলবি না কিন্তু! “ “কই আগে তো কখনো কিছু বলো নি, এখন এই শেষ সময়ে এগুলো কেন বলছো মা? “ “আমার কষ্ট হয়েছে, তবে তোকে বিরক্ত করতে চাই নি। তোর কত ঝামেলা! আমি আর নতুন করে ঝামেলা বাড়াতে চাই নি! তবে কি জানিস?ইতিহাসে একই ঘটনা ঘুরে ফিরে বারবার ঘটে! আমার ভয় হয় তোর সন্তানেরা বৃদ্ধ বয়সে যদি তোকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়, তবে এই কষ্ট তুই সহ্য করতে পারবি না! ছোটবেলা থেকেই তুই গরম আর ক্ষুধা একদম সহ্য করতে পারিস না! “ কথাগুলো বলতে বলতে আমার মা এর হাতের সেই কঠিন বন্ধন শিথিল হয়ে গেল!তিনি এমন এক অজানা পৃথিবীর দিকে রওনা দিলেন যেখানে সন্তানের কোন অসুবিধা তাঁকে আর বিব্রত করতে পারবে না! হহ আকাশ যখন মেঘের ভার আর নিতে পারে না, তখন নাকি বৃষ্টি নামে! তেমনি আমাদের মন যখন কষ্টের বোঝা আর বইতে পারে না, তখনই কষ্টগুলো কান্না হয়ে চোখ বেয়ে নেমে আসে! কাকতলীয় ভাবে আমার মা মারা যাবার সাথে সাথে এই দুটো হ মায়ের মারা যাবার কষ্টেই বুঝি বা আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল! আমি যখন আমার মায়ের লাশ নিয়ে জুরাইন গোরস্থানে পৌঁছলাম, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে! সারাদিন বৃষ্টি হয়ে আকাশ বের পরিষ্কার দেখাচ্ছে! নদীর খুব কাছে হবার কারণেই কিনা কিংবা বর্ষাকাল হবার কারণে মা এর জন্য খোড়া কবরটি থৈ থৈ করছে পানিতে! এই পানির মাঝে কি ভাবে মাকে শুইয়ে দিব? আমি কবর কাটছিল যে লোকটি, তাকে অনুরোধ করলাম কবরের অর্ধেক আরও গভীর করে বাকি অর্ধেক সেই মাটি দিয়ে উঁচু করে দিতে! অতঃপর আমি কবরে নেমে সেই উঁচু জায়গাটিতে পরম মমতায় সেই নিথর নিষ্প্রাণ শরীরটিকে শুইয়ে দিলাম, একদিন আমি যার অংশ ছিলাম! আর পুরোটা সময় উঁচু স্বরে আমি যে দোয়াটি পড়ছিলাম তা বাংলা করলে যা দাঁড়ায় তা হলো, হে আমার প্রতিপালক, আমার পিতামাতার প্রতি দয়া করো,যেমন তারা দয়া,মায়া,মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে লালন পালন করেছেন! “

0 comments

Recent Posts

See All
Enjoy
Free
E-Books
on
Just Another Bangladeshi
By
Famous Writers, Scientists, and Philosophers 
click here.gif
click here.gif

Click Here to Get  E-Books

lgbt-bangladesh.png
bottom of page