top of page
Writer's pictureJust Another Bangladeshi

বাংলার দুই মা

বঙ্গদেশে বিধবা বিবাহ আন্দোলন তখন তুঙ্গে। তখন তাঁদের ছেলে বিধবাদের বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। গাঁয়ের পণ্ডিতসমাজ ছ্যা-ছ্যা করছেন। যুক্তির যুদ্ধে তাঁরা হেরেছেন বটে, কিন্তু ঘুরপথে নাকাল করতে ছাড়ছেন না তাঁরা। তাই দিনের পর দিন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন সমাজসংস্কারক ছেলের প্রবীণ বাবা-মা। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। মা ভগবতী দেবী। তাঁদের পুত্র পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।


রোজই বীরসিংহ গ্রামের বাড়িতে উৎপাতের অন্ত ছিলনা। কোনদিন বাড়ির দরজার সামনে সামনে ডাঁই করে রাখা থাকত কাঁটাগাছ, তো কোনদিন আবার ডাঁই করা থাকত এক গাদা জীবজন্তুর লাশ! ঠাকুরদাস না হয় পুরুষ মানুষ, কিন্তু ভগবতী দেবী? নাঃ, তাঁরও কোন ভয়ডর তো ছিল না, এমনকি ভ্রুক্ষেপও করতেন না। তখন ও সব যেন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল তাঁর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি তাঁর জীবনে একটি আলোকস্তম্ভের মতো। ভগবতী দেবীই ঈশ্বরচন্দ্রকে বহু যত্নে কারুণ্য ও কোমলতায় মণ্ডিত করেছিলেন বলে শোনা যায়। তাঁকে লাগাতার হেনস্থা করার খবর পৌঁছেছিল বিদ্যাসাগরের শ্বশুরমশাই শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কাছে। তিনি আবার ক্ষমতাবান ব্যক্তি ছিলেন। গাঁয়ের লোক তাঁকে সমীহ তো করেই, ভয়ও পেত। খবর পেয়ে তিনি সটান হাজির হয়েছিলেন বীরসিংহ গ্রামে। রীতিমতো কড়া ভাষায় সাবধান করে দিয়েছিলেন গোঁড়া পণ্ডিতসমাজকে। কিন্তু তাতেও যে পুরোপুরি টনক নড়েছিল পণ্ডিতকুলের, তেমন নয়। তবুও উৎপাত চলছিল। এর পরে খবর যায় জাহানাবাদের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষালের কাছে। তিনি আবার বিদ্যাসাগরের বিশেষ সুহৃদ ছিলেন। ঘোষালমশাই ছদ্মবেশে বীরসিংহে এসেছিলেন। সব দেখেশুনে ঠাকুরদাসের কাছে পণ্ডিতদের নাম চেয়েছিলেন। ঠাকুরদাস কিছুতেই নামধাম দিতে রাজি হননি। ভগবতী দেবীও তাই। কিন্তু কেন? দিনের পর দিন যা নয় তাই অত্যাচার করে যাঁরা তাঁদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন, তাঁদের নাম দিতে কীসের সঙ্কোচ ছিল তাঁদের? গ্রামের ‘নিরীহ’ মানুষগুলো যদি সরকারি রোষে পড়ে যান, তাহলে তাঁদের বাঁচাবেন কী করে! তাই নাম দিতে তো নারাজ হয়েছিলেনই, উপরন্তু কোনও সূত্রে যদি সরকারি তরফে সবটা জানাজানি হয়ে যায়, তাই ঘুম ছুটে যাওয়ার দশা হয়েছিল ঠাকুরদাস-ভগবতীর। শেষমেশ একটা উপায় বের করেছিলেন ভগবতীদেবী নিজেই। যাঁরা প্রতিদিন উৎপাত শুরু করেছিলেন, প্রত্যেকের বাড়ি-বাড়ি হাজির হয়েছিলেন ভগবতীদেবী। নেমন্তন্ন করেছিলেন সকলকেই। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল একটাই। হাকিম সাহেবের যেন মনে হয়, কোথাও কোনও গোলমাল নেই। পণ্ডিতকুলের কিন্তু লাজলজ্জা বলে কিছুই ছিলনা, তা ছাড়া সরকারি তল্লাশির খবরও ততক্ষণে তাঁদের কানে চলে গিয়েছিল - ফলে ভগবতীদেবীর ডাকে সাড়া দিয়ে সুড়সুড় করে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে চলে এসেছিলেন তাঁরা। এমনটাই ছিলেন ভগবতী দেবী।

ছেলেবেলা থেকেই ভগবতী দেবী এমনই ব্যতিক্রমী ছিলেন। তাঁর পিতা, রমাকান্ত তর্কবাগীশ ছিলেন হুগলী জেলার গোঘাটের বাসিন্দা। মা, গঙ্গামণি দেবী। ধর্মকর্মের জেরে সংসারে মতি ছিল না রমাকান্তের। জামাইয়ের মতিগতি ভাল নয় বুঝে মেয়ের বাড়ির সকলকে পাতুল গ্রামে নিয়ে এসেছিলেন পণ্ডিত পঞ্চানন বিদ্যাবাগীশ। মামার বাড়িতেই বড় হয়েছিলেন ভগবতীদেবী। ছোট থেকেই পল্লিসমাজের জাতপাত, ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারে কোনও ভ্রুক্ষেপই ছিল না তাঁর। বামুনপাড়ার থেকে বেশ খানিকটা দূরে তেওর, বাগ্‌দি পাড়াগুলোতেই তাঁকে বেশি দেখতে পাওয়া যেত। তবে ছোট ভগবতীর এই স্বভাবে তাঁর দাদুর প্রশ্রয়ও ছিল খানিকটা। পরে বিদ্যাসাগরের বড় হওয়ার পিছনেও তো ভগবতীদেবীর অতলান্ত প্রশ্রয়।

ভগবতী দেবী। ছেলের পরিচয়ই আজও তাঁর একমাত্র পরিচয়। তার আড়ালে আশ্চর্য ওই মানবীর জীবনের আখ্যানটুকু কয়জনই জানেন।

এই ঘটনার আরও আগে, তখন বিদ্যাসাগর আঁতিপাঁতি করে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন বিধবাবিবাহের সপক্ষে শাস্ত্রের কোথায় কী বিধান আছে। পরাশর সংহিতা থেকে বিধান পেয়ে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু এর পরেও কিঞ্চিৎ দোনামোনায় ছিলেন তিনি। সেই দোনামোনা কাটাতে গিয়েছিলেন মা’য়ের কাছে। জানা যায়, সব শুনে ভগবতীদেবীর একটাই উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘এক বার যখন কাজ শুরু করেছ, সমাজের কর্তাদের ভয়ে পিছিয়ে এসো না, উপায় একটা বেরোবেই।’’ তিনি ছেলেকে আরও বলেছিলেন, ‘‘আমি প্রসন্ন মনে আশীর্বাদ করিতেছি। আহা! জন্মদুঃখিনীদের যদি কোনও গতি করিতে পারো, তাহা বাবা এখনই করো।’’

ঈশ্বরচন্দ্রের শৈশব জীবনের অনেক ঘটনায় ভগবতীদেবীর বেশ কিছু আখ্যান পাওয়া যায়।

একবার ঈশ্বরচন্দ্র পাড়ার এক ছেলের সঙ্গে খেলতে খেলতে দেখলেন তাঁর বন্ধুর পরনের কাপড়টি প্রায় ছেঁড়া। অমনি নিজের কাপড় বন্ধুকে দিয়ে, ছেঁড়া কাপড় পরে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। ভগবতীদেবী সব শুনে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, চরকায় সুতো কেটে তাঁর জন্য নতুন একটা কাপড় তিনি তৈরি করে দেবেন।

ছেলেরও আব্দার মেটাতে মা ভগবতীকে এক-এক সময় অদ্ভুত সব কাণ্ড করতে হয়েছিল। একবার যেমন, বিদ্যাসাগরের খুব শখ হয়েছিল, নিজের মা’য়ের একখানা ছবি সঙ্গে রাখবেন। পাইকপাড়ার রাজার বাড়িতে এক জন ভাল ‘পোটো’ এসেছেন বলে খবর পেয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে মা’কে লিখেছিলেন কলকাতায় আসতে, সেই পোটো তাঁর মায়ের ছবি আঁকবেন। এ দিকে ভগবতী কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। লোকলজ্জা ছিল যে! কিন্তু ছেলেও ছিলেন নাছোড়। শেষে হার মেনেছিলেন তিনি। কথা দিয়েছিলেন আসবেন কলকাতায়। তবে সাথে শর্তও ছিল, ছেলেকেও সঙ্গে থাকতে হবে। সেই শর্ত মেনেই মায়ের কাছে আব্দার আদায় করেছিলেন পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র।

অন্যের দুঃখে কাতর হওয়া ছিল ভগবতীদেবীর স্বভাব। তা নিয়েও অনেক গল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়।

১৮৬৮ সালের ঘটনা। তখন হ্যারিসন নামে এক সাহেব আয়কর দফতরের কমিশনার পদে সদ্য যোগ দিয়েছেন। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর ভারী খাতির ছিল। এক দিন বিদ্যাসাগর সাহেবকে তাঁর বীরসিংহ গ্রামের বাড়ি যেতে খুব অনুরোধ করলেন। ওদিকে সাহেব ছিলেন বেজায় রসিক। তিনি জানালেন, হিন্দু বাড়িতে কর্তা বা কর্তা-মা নেমন্তন্ন না করলে তিনি তা রক্ষা করেন না। বিদ্যাসাগর সেবারেও শরণাপন্ন হয়েছিলেন তাঁর মা’য়ের। ভগবতী দেবী কিন্তু স্বচ্ছন্দে নেমন্তন্ন করেছিলেন সাহেবকে। তখনকার দিনে গোঁড়া হিন্দু পরিবারে সাহেবসুবো মানে ম্লেচ্ছ। তাঁদের ছোঁয়াচ এড়িয়ে চলে গোঁড়া সমাজ। কিন্তু ভগবতীদেবী এ সব তোয়াক্কা করতেন না। সাহেব গিয়েছিলেন বীরসিংহের বাড়ি। ভগবতীদেবীকে দেখেই তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেছিলেন সাহেব, তাঁকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেছিলেন ভগবতীদেবীও। ঝানু সাহেবের মতলবটি ছিল অবশ্য অন্য ছিল - তিনি ভগবতীদেবীর হাবেভাবে বুঝে নিতে চেয়েছিলেন, উনিশ শতকের মহান সমাজ-সংস্কারকের বাড়ির অন্দরের চিত্রটা ঠিক কেমন। ভগবতীদেবীকে খানিক ঠাহর করেই হ্যারিসন সাহেব বুঝেছিলেন, বিদ্যাসাগরের বীরসিংহের বাড়ি পল্লিসমাজের আর পাঁচটা বাড়ির মতো নয়। তারপরে একসময় পাত পেড়ে খেতে বসেছিলেন সাহেব। এবং খেতে বসে আরও অবাক হয়েছিলেন। কারণ পাখা হাতে চেয়ারের উপর বসে ছিলেন স্বয়ং ভগবতীদেবী, অতিথির খাওয়াদাওয়ার তদারকি করেছিলেন তিনি নিজেই। সাহেবের তা’ও যাচাই করা থামে নি। তাঁর ছিল আয়করি বুদ্ধি। তিনি গেরস্থের ধনরত্নের খবর নেবেন না, তাও কি হয়? ভগবতীদেবীকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘বাড়িতে কত ধন আছে আপনার?’’ সেই প্রশ্নের উত্তরে রসিকতা করতে ছাড়েন নি ভগবতীদেবীও। বলেছিলেন, ‘‘চার ঘড়া।’’ ভগবতীদেবীর এহেন জবাবে একেবারে হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন সাহেব। দরিদ্র পণ্ডিতের বাড়িতে এত সম্পদ! এও আবার সম্ভব নাকি! কী বলতে চান এই গৃহিণী? সাহেবের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ভগবতীদেবী নিজেই রহস্য ফাঁস করেছিলেন। তাঁর চার পুত্রের দিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘এই যে! এই আমার চার ঘড়া ধন।’’ অতিথি সেবা শেষ হল। সাহেব চলে যাবেন অল্প বাদে। তার মাঝে ভগবতীদেবী কমিশনার সাহেবকে অনুরোধ করেছিলেন, গাঁয়ে সবই প্রায় গরিবগুর্বো মানুষ। সাহেবের জন্য তাঁদের যেন কখনও হেনস্তা না হয়। এটুকু অনুরোধ তিনি যেন রাখেন।  শোনা যায়, ভগবতীর অনুরোধ নাকি মেনেওছিলেন সাহেব হ্যারিসন। পরে বিদ্যাসাগরকে লেখা একটি চিঠিতে ভগবতী দেবীর সেই অনুরোধের কথা উল্লেখও করেছিলেন তিনি।

১৮৬৯ সালের ঘটনা। সেই কালে বাঙালির কাছে কাশী যাত্রা ছিল বিশেষ পছন্দের। ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তখন কাশীতে রয়েছেন। বিদ্যাসাগর মা’কেও পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু কাশীতে এসে কিছুতেই মন টিকল না ভগবতীদেবীর। অচিরেই তাঁর মনখারাপ হল। বিমর্ষ স্ত্রী’কে দেখে ঠাকুরদাস জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কী হয়েছে?’’ উত্তরে ভগবতীদেবী জানিয়েছিলেন, বীরসিংহের দরিদ্র মানুষগুলির জন্য মন কেমন করছে। মনে হচ্ছে কত দিন নিজের হাতে রেঁধে খাওয়ানো হয়নি তাঁদের। ভগবতীদেবী বলতেন, ‘‘বীরসিংহ আমার কাশী, সেখানেই আমার বিশ্বেশ্বর।’’ নিজের ঠাঁই, তাঁর মানুষজনকে এ ভাবেই ভালবাসতেন ভগবতীদেবী।

১৮৭৫ সালে দেশ জুড়ে অনাবৃষ্টি দেখা দিয়েছিল। সেবার চাষাবাদ কিছুমাত্র হয়নি। গাঁ জুড়ে শুরু হয়েছিল ভাতের আকাল। ভগবতীদেবী সে বার খুলে বসেছিলেন অন্নসত্রতলা। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সেখানে এসে ভিড় জমাতেন নিরন্ন মানুষের দল। সকলকে যত্ন-আত্তি, সেবা না করে ভগবতীদেবীর যেন শান্তি ছিলনা। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে ছাপাও হয়েছিল সে কথা। সেখান থেকেই জানা যায়, সেই বছর ভগবতীদেবী প্রতি দিন বাড়িতে চার-পাঁচ’শ লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এমনকি প্রয়োজনে অকাতরে টাকা ধার দিতেও কসুর করতেন না তিনি। তবে সময়ে সময়ে তা আবার সংসারে বিপদও ডেকে আনত। একবার বাড়িতে টাকা নেই, চালও বাড়ন্ত। ভগবতীদেবী বেরোলেন গাঁয়ের পথে - টাকা আদায় করতে। সকলেই তাঁকে খাতির-যত্ন করতে শুরু করলেন, মিষ্টি কথা বলতে থাকলেন। তাঁদের কথাতে ভগবতীদেবী বেমালুম ভুলে গেলেন টাকার কথা। উল্টে অভ্যাসমতো বলে দিয়েছিলেন, ‘‘ও বেলা বাড়িতে আসিস, প্রসাদ নিতে।’’

আর পাঁচটা গ্রামীন গৃহবধূর মতন, ছেলেবেলায় প্রচণ্ড দারিদ্রের মধ্যে বড় হওয়া ভগবতীর গয়নাগাটির দিকে ঝোঁক ছিল ভালই। কিন্তু বয়স বাড়তে সে সব যেন হঠাৎই উধাও হয়ে যায়। তখন এমনকী বাড়ির মেয়ে, বউদেরও গয়না নিয়েও আদিখ্যেতা মোটেও পছন্দ করতেন না তিনি। একবার বিদ্যাসাগরের ভারী ইচ্ছে হয়েছিল তিনি মা’কে গয়না পরাবেন। তিনি তখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। মাস গেলে মাইনে পেতেন ৩০০ টাকা। এক সুযোগে মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কেমন গয়না তোমার ভাল লাগে?’’ উত্তরে ভগবতীদেবী বলেছিলেন, তিনটি গয়না গড়িয়ে দিতে হবে। মায়ের এই উত্তরে বিদ্যাসাগর মহা খুশি হয়েছিলেন। এত দিন পর মা’কে কিছু দেওয়ার সুযোগ হয়েছে! তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন কী কী গয়না? ভগবতীদেবী বলেছিলেন, ‘‘গ্রামে একটি অবৈতনিক স্কুল, দাতব্য চিকিৎসালয়, আর একটি অন্নসত্র প্রতিষ্ঠা করো।’’ পরের দিন দেখা গিয়েছিল বিদ্যাসাগর অন্য ভাইদের সঙ্গে কোদাল হাতে মাটি কোপাচ্ছেন। কারণ স্কুলবাড়ির ভিত তৈরি করতে হবে যে! সেটাই যে তাঁর মায়ের প্রথম গয়না!

একবার নাতি নারায়ণচন্দ্রকে নিয়ে কলকাতায় আসছিলেন ভগবতীদেবী। খানিক দূর যেতে না যেতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। কোথা থেকে যেন কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে! নাতি নারায়ণচন্দ্রকে পথের ধারে বসিয়ে রেখে দেখতে গেলেন কী হয়েছে। চোখে পড়ল সামনেই একটি গৃহস্থ বাড়ি। কান্নার আওয়াজ আসছে সেখান থেকেই। ভগবতী গেলেন সে-বাড়ি। দেখলেন পরিবারের এক ছেলের মৃত্যু হয়েছে। গোটা বাড়ি তাঁরই শোকে বিহ্বল। কলকাতায় যাওয়া মাথায় উঠেছিল তাঁর। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি পরিবারের সঙ্গে শোক ভাগ করে নিতে ভগবতীদেবীও হয়ে পড়েছিলেন তাঁদের সঙ্গী। ও দিকে পথেই বসে ছিলেন তাঁর নাতি নারায়ণচন্দ্র।

বীরসিংহ গ্রামে বামনি নামে একটি পুকুরে প্রতিদিন স্নানে যেতেন ভগবতীদেবী। এক দিন দেখলেন এক ব্রাহ্মণ পুকুরপাড়ের ঝোপ থেকে পাটভাঙা পোশাক পরে কোথায় যেন চলেছেন। ব্রাহ্মণ তো চলে গেলেন। কিন্তু মাটিতে পড়ে এটি কী! তিনি উঁকি মেরে দেখলেন, একটি পুঁটলি। কী আছে তাতে? ভগবতীদেবী খুলে ফেললেন পুঁটলি। দেখলেন খান কতক পোশাক। সামান্য কিছু টাকা। আর গুটিকয় সোনার গয়না। কিন্তু কে এর মালিক? কাছেপিঠে তো আর কেউ নেই। তা হলে? কী করবেন এটি নিয়ে? ভগবতীদেবী পড়লেন মহা চিন্তায়। সময় কাটতে লাগল। পুঁটলি আগলে বসে রইলেন ভগবতীদেবী। একসময় সকাল গড়িয়ে বিকেল এল। তবু পুঁটলির মালিকের দেখা নেই। অনেক পরে দেখেন সকালের সেই ব্রাহ্মণ উদয় হলেন। রীতিমতো কাঁদতে কাঁদতে তিনি পুকুরপাড়ে এসে পৌঁছলেন। তাঁর মুখে সব শুনে ভগবতীর বুঝতে অসুবিধে হল না যে, ওই পুঁটলিটা ব্রাহ্মণেরই। পুঁটলির ভিতর গচ্ছিত ছিল তাঁর মেয়ের বিয়ের জিনিসপত্র। হারানো সেই পুঁটলি হাতে পেয়ে ব্রাহ্মণের যেন ধড়ে প্রাণ এল। স্বস্তি পেলেন ভগবতী।  কথায় কথায় শুনলেন, এই পুঁটলির চিন্তায় দিনভর কিছু খাননি ব্রাহ্মণ। ভগবতী তখন তাঁকে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়ি। শুধু তাই-ই নয়, খাওয়া-দাওয়ার পর ব্রাহ্মণকে বলেছিলেন, ওই পরিমাণ টাকায় আপনার মেয়ের বিয়ে কী করে সম্ভব? শুনে ব্রাহ্মণ মৌন ছিলেন। তাঁর মুখ দেখে সব বুঝেছিলেন ভগবতী। নিজের সঞ্চয়ের কুড়িটি মুদ্রা ব্রাহ্মণকে দান করে ব্রাহ্মণকে বিদায় দিয়েছিলেন তিনি।

সে বার কলকাতা থেকে বাড়ির সবার জন্য ছ’টা লেপ পাঠিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। ভগবতী কিন্তু নতুন লেপগুলি পেয়ে সব বিলিয়ে দিয়েছিলেন গাঁয়ের লোকজনকে। বাড়ির জন্য একটিও রাখেননি। বরং ছেলেকে ফের আরও লেপ পাঠানোর জন্য চিঠি লিখেছিলেন। নিজের মা’কে বিলক্ষণ চিনতেন বিদ্যাসাগর। শুধু তিনি জানতে চেয়েছিলেন, কতগুলো লেপ তিনি পাঠাবেন। সঙ্গে এমন একটি সংখ্যা বলেছিলেন, যাতে গ্রামের সকল দুঃখীকে দিয়েথুয়ে, ও-বাড়িরও সবার জন্য রেখেও মা’য়ের লেপের যেন অভাব না হয়।

একবার স্কুল-ইনস্পেক্টর প্রতাপনারায়ণ সিংহ এসেছেন বীরসিংহের বাড়িতে। সেকালে সব বাড়িতে গিয়ে সবাই শালপাতায় খাওয়া-দাওয়া করতেন। বড় পরিবারে অত বাসনকোসন কোথায় মিলবে, তাই। খাওয়ার জন্য থালা-বাটি তখন রীতিমতো বিলাসিতা ছিল। কিন্তু প্রতাপবাবুর জন্য কিন্তু ভগবতী খুঁজে পেতে কোথা থেকে ঠিক জোগাড় করে এনেছিলেন একটি থালা। তাতেই সাজিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর খাবার। কারণ, অতিথি যে নারায়ণ! তাঁর জন্য কোনও কিছুই দুর্মূল্য নয়।

উপস্থিত বুদ্ধিতেও ভগবতীদেবীর জুড়ি মেলা ভার। এক বার বিদ্যাসাগর বাড়িতে এসে অকাতরে টাকা-পয়সা দান করছিলেন দুঃখী মানুষদের। সেই খবর পৌঁছেছিল ডাকাতদলের কাছেও। তাঁরা হানা দিয়েছিল বীরসিংহের বাড়িতে। তাতে বিদ্যাসাগরও নাকি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্থিতধী ছিলেন তাঁর মা, ভগবতীদেবী। ডাকাতদলের চোখ এড়িয়ে বুদ্ধি করে ছেলেকে কোনও ক্রমে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়েছিলেন তিনি।

এই ভগবতীদেবীকে চেনে ক’জন?

১২৪০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনে সারদাসুন্দরীর বিবাহ হয়েছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে। তাঁর কন্যা সৌদামিনী ‘পিতৃস্মৃতি’-তে লিখেছিলেন,

"পিতা সর্বদাই বিদেশে কাটাইতেন এই কারণে তিনি (সারদাদেবী) সর্বদাই চিন্তিত হইয়া থাকিতেন। ... গ্রহাচার্যরা স্বস্ত্যয়নাদির দ্বারা পিতার সর্বপ্রকার আপদ দূর করিবার প্রলোভন দেখাইয়া তাঁহার কাছ হইতে সর্বদাই কত যে অর্থ লইয়া যাইত তাহার সীমা নাই।"

পরম ব্রহ্মের সন্ধানে দেবেন্দ্রনাথ পাড়ি দেন হিমালয়ে অথবা গঙ্গাবক্ষে। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে তাঁর স্ত্রীর মনোজগৎটি তাঁর অসীম সাধনার বৃত্তের বাইরেই থাকে আজীবন। বিবাহের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র আট। মাত্র বারো বছর বয়সে মা হতে হল তাঁকে, ধারাবাহিক ভাবে পনেরোটি সন্তানের জন্ম দেন তিনি।

জ্ঞানালোকপিপাসু মহর্ষি কার্যত সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বানিয়ে তুলেছিলেন তাঁকে। অথচ তিনিই ‘পিতা হিসেবে সন্তানদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন অনেক অনেক নতুন আলো।

কেন এই বৈপরীত্য?

এই প্রসঙ্গে তাঁর প্রসঙ্গে উঠে আসে আরও একটি রূঢ় বাস্তব। তাঁকে নিয়ে ঠাকুরবাড়ির যাঁরাই কিছু বলেছেন, তাঁদের কথায় তাঁর অসুস্থতার বিষয়টিই তাঁদের কাছে সব থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

অথচ স্ত্রীর রোগজীর্ণ শরীর দেবেন্দ্রনাথ দেখেও দেখেননি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,

‘‘কর্তাদাদামশায় মহর্ষি হলে কী হবে এদিকে শৌখিন ছিলেন খুব। ... এই বৃদ্ধকালেও তোয়ালে দিয়ে গা রগড়াতেন না, চামড়ায় লাগবে। সেজন্য মসলিনের থান আসত ... তারই টুকরো দিয়ে তিনি গা রগড়াতেন, চোখ পরিষ্কার করতেন।’’

চার মাস আগের টেলিগ্রামে স্ত্রীর শয্যাক্ষতে দগ্ধ ব্যাধিক্লিষ্ট অবস্থার কথা জেনেও খোঁজ নিয়েছেন বলে তথ্যপ্রমাণ নেই। মুমূর্ষু স্ত্রীকে ফেলে রেখে ব্রাহ্ম সম্মিলন ও মাঘোৎসবে যোগদান ও তার পর জমিদারি সামলাতে শিলাইদহে যাত্রা। ফিরে এলেন মৃত্যুর ঠিক আগের দিন। তখন উপাসনায় বসবেন মহর্ষি, তেরো বছরের বালক রবি ঘুমন্ত অবস্থায় চমকে জেগে ওঠেন দাসীর চিৎকারে,

‘ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রে!’ ...

রবীন্দ্রনাথের মনে মায়ের চলে যাওয়া কী প্রভাব ফেলেছিল, তার বর্ণনা পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায়।

সারদাসুন্দরী দেবী ছিলেন যশোরের দক্ষিণডিহি গ্রামের রামনারায়ণ চৌধুরীর মেয়ে। তাঁর জন্ম ঠিক কোন সালে তা জানা যায় না। জানা যায়, ১৮৩৪ সালের মার্চ মাসে সতেরো বছর বয়সী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিবাহের সময় সারদাসুন্দরীর বয়স ছিল আট।

সারদাসুন্দরীর বিবাহ হয়েছিল বেশ অদ্ভুত ভাবে। এ বিষয়ে জানা যায় জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ‘স্মৃতিকথা’ থেকে। সারদাসুন্দরী দেবীর এক কাকা কলকাতায় শুনেছিলেন যে, দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথের  জন্য সুন্দরী মেয়ে খোঁজা হচ্ছে। তিনি সারদাকে কলকাতায় ঠাকুরবাড়ি নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেন। তখন তাঁর মা বাড়ি ছিলেন না। গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন। বাড়ি এসে মেয়েকে তাঁর দেওর না বলে-কয়ে নিয়ে গেছে এবং বিয়ে দিয়ে দিয়েছে শুনে তিনি উঠোনের এক গাছতলায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তারপর সেখানে পড়ে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে মারা গেলেন।

সারদাদেবীর শ্বশুর দ্বারকানাথ ছিলেন কলকাতার প্রথমসারির ধনীদের মধ্যে একজন। অতএব অনুমান করায় যায় যে বিয়েতে কী পরিমাণ জাঁকজমক হয়েছিল।

রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন,

“সারদা দেবীর জীবনে সম্পূর্ণ চিত্রটি আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট নয়, সেকালের বাঙালী পরিবারের অন্তঃপুরচারিণী গৃহবধূর বৈচিত্র্যহীন জীবনে সে স্পষ্টতা আশাও করা যায় না।”

স্বামী দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন রূপবান ও গুণবান। কিন্তু তিন পুত্রের জন্ম হওয়ার পরই দেবেন্দ্রনাথের মনে হঠাৎ করে বিষয় বৈরাগ্যের উদয় হল। নির্জনে ঈশ্বরধ্যানের উদ্দেশ্যে একদিন ঘোর বর্ষায় বেরিয়ে পড়লেন পথে। সারদা দেখতে পেলেন। কেঁদে-কেটে স্বামীর সাথে যেতে চাইলেন সারদাসুন্দরীও। দেবেন্দ্রনাথের শত আপত্তির তোয়াক্কা না করে স্বামীর সঙ্গ নিলেন স্ত্রী। সঙ্গে নিলেন তিন শিশুপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও হেমেন্দ্রনাথকে। এতটাই জেদি ছিলেন সারদাসুন্দরী।

কিন্তু পথে খবর এল, পিতা দ্বারকানাথ মারা গেছেন। যাত্রা অসমাপ্ত রেখে ফিরতে হল কলকাতায়।

পুত্র দেবেন্দ্রনাথ দ্বারকানাথের শ্রাদ্ধ করলেন অপৌত্তলিক মতে। ব্যাস! সমালোচনার ঝড় উঠল। ফলশ্রুতি, আত্মীয়বিচ্ছেদ। এই বিচ্ছেদ সারদাসুন্দরীর বিশেষ মানসিক যন্ত্রণার কারণ হল।

সারদাসুন্দরী ধর্ম নিয়ে পড়েছিলেন বেশ দোলাচলে। স্বামী দেবেন্দ্রনাথ যেমন ছিলেন মূর্তিপূজার বিরোধী তেমনি সারদাসুন্দরী দেবীর শাশুড়ি দিগম্বরী দেবী ও দিদিশাশুড়ি অলকা দেবী ছিলেন ধর্মপ্রাণা মহিলা। এঁদের শিক্ষা এবং ধর্মপ্রবৃত্তি ধীরেধীরে সারদাসুন্দরীকে প্রভাবিত করে।

দ্বারকানাথের সময়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ধুমধাম করে দুর্গাপূজা ও জগদ্ধাত্রী পূজা হত। দেবেন্দ্রনাথ জগদ্ধাত্রী পূজা তুলে দিলেন। আর দুর্গাপূজার সময় বেরিয়ে পড়তেন দেশভ্রমণে। কালক্রমে দুর্গাপূজার পাটও উঠল। দেবেন্দ্রনাথের সেজো ভাই গিরীন্দ্রনাথ অপৌত্তলিক প্রথায় অনুষ্ঠানাদি হতে দেখে গৃহদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দন শিলার সেবার ভার গ্রহণ করে আলাদা হয়ে গেলেন।

সারদাসুন্দরী নিজের ইষ্টমন্ত্র ও হরিনাম জপ করলেও স্বামীর ধর্মব্যাখ্যা শ্রদ্ধা সহকারে মন দিয়ে শুনতেন। শুনতেন ব্রাহ্মসমাজের নানান কথা। আবার এই সারদাই অভ্যেসবশত কখন কখন রমানাথ ঠাকুরের বাটীর দুর্গোৎসবের পূজারী কেনারাম শিরোমণির হাতে স্বামীর অজ্ঞাতে কালীঘাটে ও তারকেশ্বরে পুজো দিয়ে পাঠাতেন।

খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন,

“আমরা প্রাচীনাদের মুখে শুনিয়াছি সারদাদেবী স্বামীর কথায় নূতন ধর্ম্মানুষ্ঠান অনুশীলনে একটু দোদুল্যমান অবস্থায় পড়িয়াছিলেন। তাঁহার চিরদিনের অভ্যস্থ বাহ্যিক পূজা অনুষ্ঠান ৩৫ বৎসর বয়সে স্বামীর মতানুবর্ত্তিনী হইয়া ত্যাগ করিয়াছিলেন। বেদীতে বসিয়া কিন্তু নিজের ইষ্টমন্ত্র ও হরিনাম জপ করিতেন এবং স্বামীর ধর্ম্মব্যাখ্যা শ্রদ্ধার সহিত শ্রবণ করিতেন। আবার চিরদিনের অভ্যাসের ফলে কখন কখন রমানাথ ঠাকুরের বাটীর দুর্গোৎসবের পূজক কেনারাম শিরোমণির হস্তে, স্বামীর অজ্ঞাতে, কালীঘাটে ও তারকেশ্বরে পূজা প্রেরণ করিতেন।”

কন্যা সৌদামিনী দেবী মায়ের স্বামীভক্তির একটি ছবি এঁকেছেন,

“মা আমার সতীসাধ্বী পতিপরায়ণা ছিলেন। পিতা সর্বদাই বিদেশে কাটাইতেন এই কারণে সর্বদাই তিনি চিন্তিত হইয়া থাকিতেন। পূজার সময় কোনোমতেই পিতা বাড়িতে থাকিতেন না। এইজন্য পূজার উৎসবে যাত্রা গান আমোদ যত কিছু হইত তাহাতে আর সকলেই মাতিয়া থাকিতেন কিন্তু মা তাহার মধ্যে কিছুতে যোগ দিতে পারিতেন না। তখন নির্জন ঘরে তিনি একলা বসিয়া থাকিতেন। কাকীমারা আসিয়া তাঁকে কত সাধ্য সাধনা করিতেন, তিনি বাহির হইতেন না। গ্রহাচার্যরা স্বস্ত্যয়নাদির দ্বারা পিতার সর্বপ্রকার আপদ দূর করিবার প্রলোভন দেখাইয়া তাঁহার কাছ হইতে সর্বদাই যে কত অর্থ লইয়া যাইত তাহার সীমা নাই।”

সৌদামিনী দেবীর এক লেখা থেকে জানা যায়, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন সিমলায়। দাঙ্গাহাঙ্গামার কারণে অনেককাল বাড়িতে চিঠিপত্র দিতে পারেননি। তাই গুজব রটে যে সিপাহিরা দেবেন্দ্রনাথকে হত্যা করেছে। ব্যস! সেই শুনে সারদাসুন্দরী দেবী আহারনিদ্রা ত্যাগ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেন।

অনুরূপ একটি ঘটনার বর্ণনা রবীন্দ্রনাথও দিয়েছেন, তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ বইতে:

‘‘বেশ মনে আছে, আমাদের ছেলেবেলায় কোনো-এক সময়ে ইংরেজ গবর্মেণ্টের চিরন্তন জুজু রাসিয়ান-কর্তৃক ভারত-আক্রমণের আশঙ্কা লোকের মুখে আলোচিত হইতেছিল। কোনো হিতৈষিণী আত্মীয়া আমার মায়ের কাছে সেই আসন্ন বিপ্লবের সম্ভাবনাকে মনের সাধে পল্লবিত করিয়া বলিয়াছিলেন। পিতা তখন পাহাড়ে ছিলেন। তিব্বত ভেদ করিয়া হিমালয়ের কোন্‌-একটা ছিদ্রপথ দিয়া যে রুসীয়েরা সহসা ধুমকেতুর মতো প্রকাশ পাইবে, তাহা তো বলা যায় না। এইজন্য মার মনে অত্যন্ত উদ্‌বেগ উপস্থিত হইয়াছিল। বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই কেহ তাঁহার এই উৎকণ্ঠার সমর্থন করেন নাই। মা সেই কারণে পরিণতবয়স্ক দলের সহায়তালাভের চেষ্টায় হতাশ হইয়া শেষকালে এই বালককে আশ্রয় করিলেন। আমাকে বলিলেন, ‘‘রাসিয়ানদের খবর দিয়া কর্তাকে একখানা চিঠি লেখো তো।” মাতার উদ্‌বেগ বহন করিয়া পিতার কাছে সেই আমার প্রথম চিঠি। কেমন করিয়া পাঠ লিখিতে হয়, কী করিতে হয় কিছুই জানি না। দফতরখানায় মহানন্দ মুনশির শরণাপন্ন হইলাম। পাঠ যথাবিহিত হইয়াছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু ভাষাটাতে জমিদারি সেরেস্তার সরস্বতী যে জীর্ণ কাগজের শুষ্ক পদ্মদলে বিহার করেন তাহারই গন্ধ মাখানো ছিল। এই চিঠির উত্তর পাইয়াছিলাম। তাহাতে পিতা লিখিয়াছিলেন-ভয় করিবার কোনো কারণ নাই, রাসিয়ানকে তিনি স্বয়ং তাড়াইয়া দিবেন। এই প্রবল আশ্বাসবাণীতেও মাতার রাসিয়ানভীতি দূর হইল বলিয়া বোধ হইল না- কিন্তু পিতার সম্বন্ধে আমার সাহস খুব বাড়িয়া উঠিল।”

সাংসারিক ব্যাপারেও কিছুটা উদাসীন ছিলেন সারদাসুন্দরী। সেকালের ধনী গৃহস্থের গৃহিনী হিসেবে সেটা অবশ্য অস্বাভাবিক ছিল না। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ভাষায়,

“আমার শাশুড়ীর একটু স্থূল শরীর ছিল, তাই বেশি নড়াচড়া করতে পারতেন না।”

মহর্ষি বাড়ি থাকলে রান্নাঘরে যেতেন। উপাসনার সময় মহর্ষির কাছে গিয়ে বসতেন। জ্ঞানদানন্দিনীর লেখা থেকে আরও জানা যায়,

“আমার মনে পড়ে বাবামশায় (দেবেন্দ্রনাথ) যখন বাড়ী থাকতেন আমার শাশুড়িকে একটু রাত করে ডেকে পাঠাতেন, ছেলেরা সব শুতে গেলে। আর মা একখানি ধোয়া সূতি শাড়ি পরতেন, তারপর একটু আতর মাখতেন; এই ছিল তাঁর রাতের সাজ।”

পনেরো সন্তানের জননী সারদাসুন্দরী যে সন্তানদের প্রতিও যথাযথ মনোযোগ দিতে পারতেন না, সেকথাও ঠাকুরবাড়ির একাধিক সদস্যের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়। তবে কনিষ্ঠ পুত্রটির সঙ্গে তাঁর মায়ের একটু ঘনিষ্ট সম্বন্ধই ছিল। ‘জীবনস্মৃতি’তে রবীন্দ্রনাথ আর এক জায়গায় লিখেছেন,

“পৃথিবীসুদ্ধ লোকে কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ পড়িয়া জীবন কাটায়, আর আমি পিতার কাছে স্বয়ং মহর্ষি বাল্মীকির স্বরচিত অনুষ্টুভ ছন্দের রামায়ণ পড়িয়া আসিয়াছি, এই খবরটাতে মাকে সকলের চেয়ে বেশি বিচলিত করিতে পারিয়াছিলাম। তিনি অত্যন্ত খুশি হইয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা, বাছা, সেই রামায়ণ আমাদের একটু পড়িয়া শোনা দেখি।’

হায়, একে ঋজুপাঠের সামান্য উদ্ধৃত অংশ, তাহার মধ্যে আবার আমার পড়া অতি অল্পই, তাহাও পড়িতে গিয়া দেখি মাঝে মাঝে অনেকখানি অংশ বিস্মৃতিবশত অস্পষ্ট হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু যে-মা পুত্রের বিদ্যাবুদ্ধির অসামান্যতা অনুভব করিয়া আনন্দসম্ভোগ করিবার জন্য উৎসুক হইয়া বসিয়াছেন, তাঁহাকে “ভুলিয়া গেছি” বলিবার মতো শক্তি আমার ছিল না। সুতরাং ঋজুপাঠ হইতে যেটুকু পড়িয়া গেলাম তাহার মধ্যে বাল্মীকির রচনা ও আমার ব্যাখ্যার মধ্যে অনেকটা পরিমাণে অসামঞ্জস্য রহিয়া গেল। স্বর্গ হইতে করুণহৃদয় মহর্ষি বাল্মীকি নিশ্চয়ই জননীর নিকট খ্যাতিপ্রত্যাশী অর্বাচীন বালকের সেই অপরাধ সকৌতুক স্নেহহাস্যে মার্জনা করিয়াছেন, কিন্তু দর্পহারী মধুসূদন আমাকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি দিলেন না।

মা মনে করিলেন, আমার দ্বারা অসাধ্যসাধন হইয়াছে, তাই আর সকলকে বিস্মিত করিয়া দিবার অভিপ্রায়ে তিনি কহিলেন, “একবার দ্বিজেন্দ্রকে শোনা দেখি।” তখন মনে-মনে সমূহ বিপদ গনিয়া প্রচুর আপত্তি করিলাম। মা কোনোমতেই শুনিলেন না। বড়দাদাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। বড়দাদা আসিতেই কহিলেন, “রবি কেমন বাল্মীকির রামায়ণ পড়িতে শিখিয়াছে একবার শোন্‌-না।” পড়িতেই হইল। দয়ালু মধুসূদন তাঁহার দর্পহারিত্বের একটু আভাসমাত্র দিয়া আমাকে এ-যাত্রা ছাড়িয়া দিলেন। বড়দাদা বোধ হয় কোনো-একটা রচনায় নিযুক্ত ছিলেন- বাংলা ব্যাখ্যা শুনিবার জন্য তিনি কোনো আগ্রহ প্রকাশ করিলেন না। গুটিকয়েক শ্লোক শুনিয়াই “বেশ হইয়াছে” বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন।”

তবে মাতা-পুত্রের সম্পর্কের মধুরতম ছবিটি বোধহয় তিনি এঁকেছিলেন অনেক পরে, ‘অসম্ভব কথা’ গল্পে:

“বেশ মনে আছে সেদিন সন্ধ্যাবেলা ঝড়বৃষ্টি হইতেছিল। কলিকাতা শহর একেবারে ভাসিয়া গিয়াছিল। গলির মধ্যে একহাঁটু জল। মনে একান্ত আশা ছিল, আজ আর মাস্টার আসিবে না। কিন্তু তবু তাঁহার আসার নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভীতচিত্তে পথের দিকে চাহিয়া বারান্দায় চৌকি লইয়া বসিয়া আছি। যদি বৃষ্টি একটু ধরিয়া আসিবার উপক্রম হয় তবে একাগ্রচিত্তে প্রার্থনা করি, হে দেবতা আর একটুখানি কোনোমতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পার করিয়া দাও। তখন মনে হইত পৃথিবীতে বৃষ্টির আর কোনো আবশ্যক নাই, কেবল একটিমাত্র সন্ধ্যায় নগরপ্রান্তের একটিমাত্র ব্যাকুল বালককে মাস্টারের করাল হস্ত হইতে রক্ষা করা ছাড়া। পুরাকালে কোনো একটি নির্বাসিত যক্ষও তো মনে করিয়াছিল, আষাঢ়ে মেঘের বড়ো একটা কোনো কাজ নাই, অতএব রামগিরিশিখরের একটিমাত্র বিরহীর দুঃখকথা বিশ্ব পার হইয়া অলকার সৌধবাতায়নের কোনো একটি বিরহিণীর কাছে লইয়া যাওয়া তাহার পক্ষে কিছুমাত্র গুরুতর নহে, বিশেষত পথটি যখন এমন সুরম্য এবং তাহার হৃদয়বেদনা এমন দুঃসহ।

বালকের প্রার্থনামতে না হউক, ধূম-জ্যোতিঃ-সলিল-মরুতের বিশেষ কোনো নিয়মানুসারে বৃষ্টি ছাড়িল না। কিন্তু হায় মাস্টারও ছাড়িল না। গলির মোড়ে ঠিক সময়ে একটি পরিচিত ছাতা দেখা দিল, সমস্ত আশাবাষ্প একমুহূর্তে ফাটিয়া বাহির হইয়া আমার বুকটি যেন পঞ্জরের মধ্যে মিলাইয়া গেল। পরপীড়ন পাপের যদি যথোপযুক্ত শাস্তি থাকে তবে নিশ্চয় পরজন্মে আমি মাস্টার হইয়া এবং আমার মাস্টারমহাশয় ছাত্র হইয়া জন্মিবেন। তাহার বিরুদ্ধে কেবল একটি আপত্তি এই যে, আমাকে মাস্টারমহাশয়ের মাস্টার হইতে গেলে অতিশয় অকালে ইহসংসার হইতে বিদায় লইতে হয়, অতএব আমি তাঁহাকে অন্তরের সহিত মার্জনা করিলাম।

ছাতাটি দেখিবামাত্র ছুটিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলাম। মা তখন দিদিমার সহিত মুখোমুখি বসিয়া প্রদীপালোকে বিন্তি খেলিতেছিলেন। ঝুপ করিয়া একপাশে শুইয়া পড়িলাম। মা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কী হইয়াছে।’ আমি মুখ হাঁড়ির মতো করিয়া কহিলাম, ‘আমার অসুখ করিয়াছে, আজ আর আমি মাস্টারের কাছে পড়িতে যাইব না।’

আশা করি, অপ্রাপ্তবয়স্ক কেহ আমার এ লেখা পড়িবে না, এবং স্কুলের কোনো সিলেকশন-বহিতে আমার এ লেখা উদ্ধৃত হইবে না। কারণ, আমি যে কাজ করিয়াছিলাম তাহা নীতিবিরুদ্ধ এবং সেজন্য কোনো শাস্তিও পাই নাই। বরঞ্চ আমার অভিপ্রায় সিদ্ধ হইল।

মা চাকরকে বলিয়া দিলেন, ‘আজ তবে থাক্‌, মাস্টারকে যেতে বলে দে।’

কিন্তু তিনি যেরূপ নিরুদ্বিগ্নভাবে বিন্তি খেলিতে লাগিলেন, তাহাতে বেশ বোঝা গেল যে মা তাঁহার পুত্রের অসুখের উৎকট লক্ষণগুলি মিলাইয়া দেখিয়া মনে মনে হাসিলেন। আমিও মনের সুখে বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া খুব হাসিলাম- আমাদের উভয়ের মন উভয়ের কাছে অগোচর রহিল না।”

পুত্রবধূ, পৌত্র-পৌত্রী, দৌহিত্র-দৌহিত্রীদের প্রতি তাঁর স্নেহ ছিল অকৃত্রিম। তাঁর এক পুত্রবধূ প্রফুল্লময়ী দেবীর কথায়,

“শাশুড়ীর মতো শাশুড়ী পাইয়াছিলাম। … অত বড় বৃহৎ পরিবারের সমস্ত সংসারের ভার তাঁহারই উপর ছিল, তিনি প্রত্যেককে সমানভাবে আদর যত্নে অতি নিপূণ ভাবে সকলের অভাব, দুঃখ, দূর করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। কাহাকেও কোনও বিষয় হইতে বঞ্চিত করিয়া মনে ব্যথা দিবার কখনও চেষ্টা করিতেন না। তাঁহার মনটি শিশুর মতো কোমল ছিল। এত বড় লোকের পুত্রবধূ এবং গৃহিনী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মনে কোনরকম জাঁক, বা বিলাসিতার ছায়া স্পর্শ করিতে পারে নাই। যতদূর সম্ভব সাদাসিধে ধরণের সাজ পোষাক করিতেন, কিন্তু তাহাতেই তাঁহার দেহের সৌন্দর্য্যকে আরও বাড়াইয়া তুলিত।”

দেবেন্দ্রনাথ ‘দ্বারকানাথ ঠাকুর এস্টেট’-এ সারদাসুন্দরী দেবীর নামে ২৪,৭০০ টাকা দিয়ে একটি ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। তার সমস্ত উপস্বত্ব সারদাসুন্দরীই ভোগ করতেন। এর উপরে ব্যক্তিগত মাসোহারা ছাড়াও কন্যা ও জামাতাদের মাসোহারাও ‘সারদাসুন্দরী দেবী’র খাতে প্রদত্ত হত। এক সময় ঠাকুর এস্টেটে জমিদারির আয় কমে যাওয়ায় দেবেন্দ্রনাথ স্ত্রীকে বলেছিলেন বাড়ির বউদের রাঁধতে শেখানোর কথা।

সারদাসুন্দরীর সন্তানের সংখ্যা ছিল পনেরো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর চোদ্দতম সন্তান। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সময় সারদা দেবীর বয়স ছিল চৌত্রিশ।

রবি ঠাকুর মা সারদাদেবী প্রসঙ্গে এক লেখায় বলছেন,

“মাকে আমরা পাইনি কখনো, তিনি থাকতেন তাঁর ঘরে তক্তাপোশে বসে, খুড়ির সঙ্গে বসে তাস খেলতেন। আমরা যদি দৈবাৎ গিয়ে পড়তুম সেখানে, চাকররা তাড়াতাড়ি আমাদের সরিয়ে আনতেন, যেন আমরা একটা উৎপাত। মা যে কী জিনিস তা জানলুম কই আর। তাইতো তিনি আমার সাহিত্যে স্থান পেলেন না।’’

সন্তানদের ব্যাপারে সারদা দেবীর এই ঔদাসীন্য কিন্তু তাঁর মন থেকে ছিল না, ছিল বনেদী বাড়ির প্রতিষ্ঠিত প্রথা। সরলা দেবী চৌধুরানী লিখছেন,

“সেকালের ধনীগৃহের আর একটি বাঁধা দস্তুর জোড়াসাঁকোয় চলিত ছিল। শিশুরা মাতৃস্তন্যের পরিবর্তে ধাত্রীস্তন্যে পালিত ও পুষ্ট হত।’’

এই নিয়ম মেনে ছোট্ট রবিকেও মায়ের কোল থেকে যেতে হয়েছিল ধাত্রী-মায়ের কোলে। রবিঠাকুরের ধাত্রী মায়ের নাম ছিল 'দিগম্বরী' যিনি 'দিগমী' বলে পরিচিত ছিলেন।

সংসারের একেবারে ছোট সন্তানটি যেন একটু বেশিই আদুরে হয়ে থাকে। রবি ঠাকুর কিন্তু সারদা দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন না। কনিষ্ঠ ছিলেন ‘বুধেন্দ্রনাথ’। বুধেন্দ্রনাথ খুব অল্প বয়েসে মারা যাওয়ার কারণে রবীন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন সংসারের ছোট ছেলে। আদরের মধ্যমণি।

এখানে বলে রাখা ভাল, প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিতা না হলেও, সারদাসুন্দরী নিরক্ষর ছিলেন না। তাঁর অপর কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘আমাদের গৃহে অন্তঃপুর শিক্ষা ও তাহার সংস্কার’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়,

“মাতাঠাকুরাণী ত কাজকর্ম্মের অবসরে সারাদিনই একখানি বই হাতে লইয়া থাকিতেন। চাণক্যশ্লোক তাঁহার বিশেষ প্রিয় পাঠ ছিল, প্রায়ই বইখানি লইয়া শ্লোকগুলি আওড়াইতেন। তাঁহাকে সংস্কৃত রামায়ণ-মহাভারত পড়িয়া শুনাইবার জন্য প্রায়ই কোনো না কোনো দাদার ডাক পড়িত।”

উল্লেখ্য, চাণক্যশ্লোক দেবেন্দ্রনাথেরও খুব প্রিয় ছিল। তবে সেকালের যুগধর্ম ও রক্ষণশীলতা থেকে মুক্ত হতে পারেননি সারদাসুন্দরীও। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর পিতামাতা কলকাতায় ভাড়াবাড়িতে থাকতেন, এই জন্য তিনি জ্ঞানদানন্দিনীকে বাপের বাড়ি আসতে বাধা দিয়েছিলেন। অবশেষে দেবেন্দ্রনাথের হস্তক্ষেপে জ্ঞানদানন্দিনী বাপের বাড়ি আসেন। সত্যেন্দ্রনাথ স্ত্রী-স্বাধীনতার পক্ষপাতী ছিলেন বলে তিনি ছেলেকে ধমকাতেন,

“তুই মেয়েদের নিয়ে মেমদের মত গড়ের মাঠে ব্যাড়াতে যাবি নাকি?”


সত্যেন্দ্রনাথ অবশ্য শুধু গড়ের মাঠ নয়, স্ত্রীকে বিলেত পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন।

পনেরো সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে সারদা দেবী বেশিরভাগ সময়ই অসুস্থ থাকতেন। শেষজীবনে সারদাদেবী অসুস্থ হলে তাঁকে কিছুদিন বোটে করে গঙ্গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়ি ফিরে আসার পর তিনি থাকতেন অন্তঃপুরে তেতলার ঘরে।

১৮৭৫-এর ১১ মার্চ। দীর্ঘ রোগভোগের পর ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে চলে গেলেন ঠাকুরবাড়ির সারদাসুন্দরী। দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী, রবি ঠাকুরের মা। রবির বয়স তখন তেরো বছর দশ মাস।

মৃত্যুর খবর নিয়ে দাসী যখন রবি ঠাকুরদের কামরায় এল তখন বৌঠান কাদম্বরী দেবী দাসীকে ঘর থেকে বের করে দেন, পাছে ছোট বাচ্চাদের মনে হঠাৎ আঘাত লাগে।

সেই মৃত্যুর বিবরণও ধরা পড়েছে রবীন্দ্রনাথেরই লেখায়:

“মা’ র যখন মৃত্যু হয় আমার তখন বয়স অল্প।  অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাঁহার জীবনসংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পাই নাই। এতদিন পর্যন্ত যে-ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন। কিন্তু তাঁহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয়- তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতালার ঘরে থাকিতেন। যে-রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রে।” তখনই বউঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন-পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল। স্তিমিত প্রদীপে, অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল কিন্তু কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না। প্রভাতে উঠিয়া যখন মা’র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে-কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। বাহিরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গণে খাটের উপরে শয়ান। কিন্তু মৃত্যু যে ভয়ংকর সে- দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না- সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর। জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না। কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন এক-দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকন্যার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না। বেলা হইল, শ্মশান হইতে ফিরিয়া আসিলাম; গলির মোড়ে আসিয়া তেতালায় পিতার ঘরের দিকে চাহিয়া দেখিলাম- তিনি তখনো তাঁহার ঘরের সম্মুখের বারান্দায় স্তব্ধ হইয়া উপাসনায় বসিয়া আছেন।’’




(তথ্যসূত্র:

১- পিঞ্জরে বসিয়া, কল্যাণী দত্ত (অভিজিৎ সেন সম্পাদিত), স্ত্রী (১৯৯৬)।

২- বিদ্যাসাগর, বিহারীলাল সরকার, নবপত্র প্রকাশন (২০১৬)।

৩- দিনময়ী সারদাসুন্দরী: কিছু বুজে যাওয়া স্বর, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ (২০১১)।

৪- দিনময়ী সারদাসুন্দরী: কিছু বুজে যাওয়া স্বর, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ।

৫- রবিজীবনী, প্রশান্তকুমার পাল।

৬- বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী, প্রিয়দর্শন হালদার, পাতাবাহার সংস্করণ।)

0 comments

Recent Posts

See All

Commentaires


Enjoy
Free
E-Books
on
Just Another Bangladeshi
By
Famous Writers, Scientists, and Philosophers 
click here.gif
click here.gif

Click Here to Get  E-Books

lgbt-bangladesh.png
bottom of page