Just Another Bangladeshi

Jan 7, 20144 min

বোতল ভুতঃ ৮ম পর্ব

অরু আপা বলেছিল–আমাদের রয়েল বেঙ্গল ফুটবল টিম চ্যাম্পিয়ন হলে সে তার মাথার চুল কেটে ফেলবে। এসব হচ্ছে কথার কথা। আমরা সব সময় বলি। ঐ তো সেদিন আমাদের ক্লাসের মনসুর বলল–সে যদি এক জগ পানি এক চুমুকে খেতে না পারে, তাহলে তার নাম বদলে ফেলবে। আধ জগা খাবার পর চোখাটোখ উল্টে এক কাণ্ড। তার জন্যে তো তার নাম বদলানো হয় নি।

কিন্তু অরু আপা সত্যি সত্যি তার মাথার চুল কেটে ফেলল। আমার মা খুব শান্ত ধরনের মহিলা। সহজে রাগটাগ করেন না। তিনি পর্যন্ত রেগে ভূত। চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে বললেন, কেন চুল কাটলি?

অরু আপা সহজ গলায় বলল, বাজিতে হেরেছি, তাই চুল কাটলাম।

এত সুন্দর চুল কাটতে একটু মায়াও লাগল না?

না, লাগল না।

তুই কি পাগল হয়ে গেলি?

না, হই নি, তবে এখন তোমার চিৎকারে পাগল হব।

চুল কাটায় অরু আপাকে কী যে বিশ্ৰী দেখাচ্ছিল বলার নয়। তাকে দেখাচ্ছিল ছেলেদের মতো। আমার কাছে মনে হলো অরু, আপা চুল না কাটলেও পারত। আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি ঠিকই, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়েছে বোতল ভূতের জন্যে। সে সাহায্য না করলে সবার সাথে ছসাত গোলে হারতাম। কাজেই এই জেতায় ফাকি আছে। ফকির খেলাপ কাবণে বেচাবি অরু আপার সব চুল চলে যাবে তা কি ঠিক?

অরু, আপা অবশ্যি বোতল ভূতের কথা একেবারেই বিশ্বাস করে না। সে সায়েন্সে পড়ে তো, তাই। সায়েন্সে পড়লে সব কিছু অবিশ্বাস করতে হয়। সেদিন বাসায় মন্টু ভাই এসেছিলেন। তিনি বই-টই পড়ে হাত দেখা শিখেছেন। সব সময় তাঁর পকেটে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস থাকে। কেউ যদি হাত দেখাতে চায়। ওমি উনি গম্ভীর মুখে বসে যান। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে কী সব দেখটেখে টেনে টেনে বলেন, বৃহস্পতির ক্ষেত্রটা ভালো মনে হচ্ছে না। তবে মঙ্গলের ক্ষেত্রে যব চিহ্ন আছে। প্রচুর অর্থ লাভ হবে।

মন্টু ভাই এমনভাবে কথা বলেন যে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। আর মনে হয় তিনি যা বলছেন সবই সত্যি। সেই মন্টু ভাইয়ের ম্যাগনিফাইং গ্লাস অরু, আপা একদিন নর্দমায় ফেলে দিয়ে বলল, আপনি এইসব অবৈজ্ঞানিক কথা আর বলবেন না তো মন্টু ভাই। খুব রাগ লাগে।

মন্টু ভাই আহত গলায় বললেন, দুই পাতা বিজ্ঞান পড়ে এই কথা বলছিস? শেক্সপীয়াব কী বলেছেন জনিস? তিনি বলেছেন–দেয়ার আর মেনি থিংস ইন হেভেন এ্যান্ড আর্থ।।

তিনি বিজ্ঞানী ছিলেন না বলে বলেছেন।

আর তুই বুঝি বিরাট সাইন্টিস্ট?

দুজনে বিরাট তর্ক বেঁধে গেল। শেষমেষ রাগ করে মন্টু ভাই চলে গেলেন।

অরু, আপার স্বভাবই হচ্ছে এই, সবার সঙ্গে তর্ক করবে। কোনো কিছু বিশ্বাস করবে: না। চোখের সামনে বোতল ভূতের কাণ্ডকারখানা দেখেও বলছে ভূত বলে কিছু নেই। এবং সে নাকি তা প্রমাণ করে দিতে পারে। বোতলের ভেতর নাকি আছে শুধু বাতাস।

শেষে রাগ করে একদিন বললাম, বেশ প্রমাণ করা যে বোতলে কিছু নেই। তবে তুমি কিন্তু বোতলের মুখ খুলতে পারবে না।

বেশ খুলব না।

প্রমাণটা করবে কীভাবে?

অরু আপা গম্ভব হয়ে বলল, খুব সোজা প্ৰমাণ। ওজন করে প্রমাণ করব। সব জিনিসেরই ওজন আছে। ভূত বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তারও ওজন থাকবে। এবং যত তার বয়স বাড়বে, ততই তার ওজন বাড়বে। কারণ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সে বড় হচ্ছে। আমি যা করব তা হচ্ছে কলেজের ল্যাবরেটরির যে ওজন যন্ত্র আছে তা দিয়ে বোতলটার ওজন সাত দিন পরপর মাপব। যদি দেখা যায় বোতলটার ওজন বাড়ছে না, তাহলে বুঝতে হবে ভূত-প্ৰেত কিছু এই বোতলের মধ্যে নেই।

প্ৰথম সপ্তাহে ওজন হলো সতের দশমিক চার সাত তিন গ্ৰাম। পরের সপ্তাহে ওজন বাড়াব বদলে খানিকটা কমে গেল। ওজন হলো সতের দশমিক চার সাত এক গ্রাম। এব। পরের সপ্তাহে হলো সতের দশমিক চার শূন্য গ্রাম। অরু আপার মুখ শুকিয়ে গেল। বাড়ার বদলে ওজন কমছে। তা তো হবার নয়। আমি বললাম, ভূতদের বেলায় নিয়ম হয়তো অন্য। তারা যতই বড় হয় ততই তাদের ওজন কমে।

অরু আপা বিরক্ত হয়ে বলল, বাজে বকিস না।

তাহলে তুমিই বলো ওজন কমছে কেন?

ওজন নেবার যন্ত্রটা হয়তো ভালো না। এবাব অন্য একটা যন্ত্রে ওজন নেব।

বেশ নাও। সাবধান, বোতল যেন না ভাঙে!

আবার ওজন নেয়া শুরু হলো। এবার দেখা গেল ওজন বাড়ছে। অরু, আপার খুব মেজাজ খারাপ। আমি বললাম, ভূতদের ওজন হয়তো বাড়ে, আবার কমে। আবার বাড়ে, তারপর আবার কমে।

অরু আপা ঝাঁঝাল গলায় বলল, বোকার মতো কথা বলিস না তো। বোকার মতো কথা শুনলে গা জ্বলে যায়।

তুমি তাহলে আমাকে বলো, ওজন বাড়ছে কমছে কেন?

কোথাও কোনো ভুল কবছি, তাই এরকম হচ্ছে।

কী ভুল করছ?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

অরু, আপা আরো কী সব পরীক্ষা করল। বোতল এক সপ্তাহ অন্ধকারে রেখে তারপর ওজন। আলোতে রেখে ওজন। কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই। ফ্রীজে রেখে ঠাণ্ডা করে ওজন নিলে এক রকম ওজন হয়, আবার গরম করলে অন্য রকম ওজন হয়। শেষটায় অরু আপা রাগ করে বলল, তোর এই বোতল নিয়ে বিদেয় হ। শুধু শুধু সময় নষ্ট।

অরু আপার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় একটা লাভ হলো। সবাই জেনে গেল বোতল ভূতের ব্যাপারটা। নিতান্ত অপরিচিত লোকও পথের মাঝখানে আমাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে, এই যে খোকা, তোমার কাছে বোতলের ভেতর নাকি কী আছে। দেখি জিনিসটা।

আমি হাসিমুখে দেখাই। খুব গর্ব বোধ হয়। ভূত পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো তো খুব সহজ ব্যাপার না। হেড স্যার পর্যন্ত একদিন বললেন, দেখি জিনিসটা?

সব ভালো দিকের একটা খারাপ দিকও আছে। একদিন খারাপ দিকটা স্পষ্ট হলো। স্কুল থেকে ফিরছি, কালীতলার মন্দিরটার কাছে বগা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। বগা ভাই। থমথমে গলায় বলল, বের কর।

কী বের করব?

ভূত বের করা। না বের করলে কাদার মধ্যে পুতে ফেলব। তার আগে এমন একটা চড় দেব যে বত্ৰিশটা দাঁত তো পড়বেই, জিব পর্যন্ত পড়ে যাবে।

আমি বোতল বের করলাম। বগা ভাই সেই বোতল টপ করে নিজের পকেটে রেখে দিয়ে বলল, আর কোনো কথা না, সোজা বাড়ি চলে যা। একটা কথা বলেছিস তো ছয়

স্বরি ধোলাই দিয়ে দেব। ছয় নম্বরি ধোলাই কাকে বলে জানিস?

আমি জানতাম না। জানার ইচ্ছাও হলো না। বাড়ির দিকে রওনা হলাম। রাগে-দুঃখে। আমার চোখে পানি এসে গেছে। পুরুষ মানুষের চোখে পানি আসা খুব খারাপ, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও পানি সামলাতে পারছি না। টপটপ করে পানি পড়ছে।

    1