Just Another Bangladeshi

Sep 12, 20135 min

আজ শামিমের বিয়ে

Updated: Aug 9, 2020

বাড়ির এই ছিমছাম পরিবেশে চুপিচুপি ওর বিয়ে পড়ানো হবে। আত্নীয় স্বজন মিলিয়ে অতিথি সংখ্যা দশের বেশি হবে না। সেই দশজন মিলে নীরবে বিয়ে সারবে ওরা।
 
শামিমের বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় প্রহর গুনছেন তিনি। দশটায় বিয়ে পড়ানোর কথা, রাত দশটা বাজতে এখনো দশ মিনিট বাকি। অথচ তাঁর বুক হাপড়ের মত ওঠা নামা করছে দুশ্চিন্তায়, মন বলছে অঘটন একটা ঘটলেও ঘটতে পারে।
 
টুকু ঝুলে আছে শামিমের বাবার কোলে। শামিমের বাবা সম্পর্কে ওর নানা হয়। ঝুলে থাকার যন্ত্রণা নিয়ে ও আজ মাথা ঘামাচ্ছে না। ওর মনে আজ প্রবল আগ্রহ। ক্ষণিক বিরতি দিয়ে ও নানার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে বারবার, "নানু ভাই, নানু ভাই! নতুন বাপি কখন আসবে?"
 
শামিমের বাবা ওকে থামিয়ে দিচ্ছে ধমকে। কখনো বা গালাগাল করছে, অপমান করার চেষ্টা চালাচ্ছে নোংরাভাবে। শিশু মন ওসব বুঝতে পারছে না, কিংবা বোঝার চেষ্টা করছে না।
 
ভেতরে শামিমের মা গল্প জুড়ে দিয়েছে বেশ। ফিসফিসিয়ে বকে যাচ্ছেন এক নাগাড়ে। লেবু জলে গলা ভিজাতে ভিজাতে বলছেন নানান কেচ্ছা, কত ইতিহাস।


 
"বুঝলেন ভাবি, ছেলেটাকে বড় কষ্টে ছিলো। বাচ্চাকালের ভুলের জন্যে যে এমন খেসারত দিতে হবে কখনো আমাদের ভাবনায়ও আসে নি। কি ছেলেটি পাঠিয়েছিলাম আর কি ছেলে ফেরত আসলো..."
 
শামিমের মা কাঁদেন, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন। কৃত্রিম কান্নায় চোখ ভেজে না তার। আত্নীয় স্বজনরা তাকে শান্তনা দেয়। গুনগুন করে গীবত গায়। পাশের ঘর থেকে শামিম সব শুনতে পায়।
 
একটা নিশ্বাস নেয় ঝুমু, দীর্ঘশ্বাস। বুকের একদম ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে উষ্ণ দূষিত বায়ু। তারপর বুক ভরে টেনে নেয় বিশুদ্ধ বাতাস। আয়নার দিকে তাকায় ভালো করে। নিজেকে দেখে অনেকটা সময় ধরে।
 
বয়স কত হয়েছে ওর? গুণে বের করবার চেষ্টা করে ও।
 
পঁচিশ পেরিয়েছে মাসখানেক হলো। আজকালকার ছেলেরা এই বয়সে চাকরির পেছনে দৌড়ে মরে। একটা গদিতে বসত গেড়ে বাবা মায়ের ঋণ শোধ করে তবেই বিয়ের পিড়িতে যায়। অথচ এই বয়সে কিনা ও সমকামীতার মত বড় একটি রগে আক্রান্ত, সে বুঝে পাছে না এটা কী তার জন্ম গত নাকী তার মানোষিক ব্যাধি!
 
জানালার দিকে তাকায় শামীম। বাইরে অমাবস্যার কালো অন্ধকার, ঠিক ওর জীবনের মত। মনে পড়ে ছয় বছর আগে করা ভুলের কথা।
 
সবে এইচ এস সি শেষে এডমিশনের কোচিং করবার দিনগুলো মনে পড়ে ওর। নিয়ম মেনে ক্লাস করা- নোট সংগ্রহ আর পরীক্ষা দেয়া, জীবন চলছিল জীবনের মত। জামানের সঙ্গে ওখানেই পরিচয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র জামান ছিল কোচিংয়ের শিক্ষক। রসায়ন পড়াতে পড়াতে কখন যে ওদের মাঝে রসায়ন জমে গেলো, বুঝতেও পারলো না ও। এক স্বপ্নের জগতে মজে গিয়ে জামানের সাথে শারিরিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েগেল তারা একদিন, নিজের অজান্তেই বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো ও। জলাঞ্জলি দিল বাবার স্বপ্ন, ওদের এতকালের ঋণের বোঝা ফেলে হারিয়ে গেলো শহর থেকে।
 
শামিম আর জামানের লিভ-টুগেদার শুরু হলো। জামানের চাকরি হলো পাশ করে বেরোনোর আগেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করবার সময়টা শামিম কাটালো ঘরে আবদ্ধ হয়ে। দেড় বছর পর ওদের সংসার আলো করে এলো একটি এডপ্টেড শিশু তাও অনেক কাঠ খর পুরিয়ে নেওয়া হয় শামিমের বোন কে লিগাল মা বানিয়ে, বাচ্চার নাম দেওয়া হয় টুকু। টুকুর আগমনে পূর্ণতা পেলো ওদের সংসার। ওদের পরিবারে সুখ যেন নেমে এলো স্বর্গ থেকে। স্বপ্নের মত কেটে যাচ্ছিল সময়, দিনগুলো পেরিয়ে যাচ্ছিল চোখের পলকে।
 
সুখের পর দুঃখ আসে, দুঃখের পর সুখ- এই চিরন্তন সত্য মেনে ওদের সংসারে দেখা দিলো নতুন সমস্যা।
 
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে জামানের নেশা সংক্রান্ত সমস্যা ছিল, যেহেতু সমকামী দুঃখ কাটাতে নেশা ছার আর কন ভাল উপায় ছিল না তার কাছে, তবে তা কখনই নিয়মিত কিছু ছিল না। টুকুর জন্মের এক বছর পর শামিম টের পেলো, জামান নেশাটা আবার ধরেছে। প্রথম বুঝতে দিতে না চাইলেও এক রাতে মাতলামো করবার পর বিষয়টা ঠিক ঠিক স্পষ্ট হলো শামিমের কাছে। কখনো রাতে ফিরে না আসা, বাড়িতে ভাঙচুর করা, সংসারের খরচের টাকা ছড়িয়ে বেড়ানো- এমন কাজ অহরহ ঘটাতে শুরু করলো ও। শামিম বাধা দিতো না, বাধা না দিলেও হাত তোলাটা একটা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে উঠলো জামানের। এই সবকিছুই সহ্য করে যাচ্ছিল ও, কখনো কিছুই বলে নি। সমস্যাটা প্রকট হলো যখন টুকুর উপরও হাত তোলা শুরু করলো।


 
বছরখানেক আগে ঘটে গেলো সবথেকে খারাপ ঘটনা। জামানের চাকরিটা চলে গিয়েছিল এরই মাঝে। টাকার সংকটটা টের পাচ্ছিল হাড়ে হাড়ে। নেশার টাকাটাও ওর পকেটে ছিল না। তাই জিদ চেপে গিয়েছিল মনে। সেই জিদ উগড়ে পড়লো ছোট টুকুর উপর। কিন্তু শামিম কখনই বুঝতে পারে নি কেন এই নেশার ফিরে আশা, হটাৎ করে জানতে পারে জামানের চাকরি চলে গেছে কারণ, অফিসের সবাই যান্তে পারে সে সমকামী ও শামিমের সাথে তার সংসার আছে। শামিম-জামান বাংলাদেশের ওই নিরীহ চেহারার আড়ালে দেখেছিল নিকৃষ্টতম পশুটাকে। ঠিক সেইদিনই জামান ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায় আর প্রায় ৬ মাস কোন খবর দেয় নি সে, হটাত খবর পাওাযায় সে নাকি রাম্পূরা বস্তিতে নেশারুদের সাথে মিশে গেছে ও মানোশিক ভারসাম্ম হারিয়ে ফেলেছে।


 
আনিসা সাথে বিয়ে ঠিক হয় আরো মাসখানেক পড়ে। সদ্য কানাডা থেকে পিএইচডি শেষে দেশে ফিরেছে। আবার চলে যাবে দিনকয়েক পড়ে। যাবার আগে বিয়ে সেরে যাবার ইচ্ছে ওর।
 
ত্রিশের কোটা পেরোনো আনিসার শামিমকে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখেই পছন্দ হয়। ওর সম্বন্ধে সবটা জেনেই বিয়ে করতে রাজি হয় ও। টুকুর সাথে খাতিরও জমিয়েছে বেশ। সব দেখে শুনে ঝুমুও রাজি হয়ে গিয়েছে। আনিসা নিজেও লেসবিয়ান তাই শুধু সামাজিক দায় থেকে একজন পুরুষের সাথে বিয়ে , কানাডাতে তার বন্ধু অপেক্ষা করছে, তাই শামিমের থেকে ভাল কেন্ডিডেট আর হয় না।

রাত দশটারও দশ মিনিট পেরিয়ে যাবার পর আনিসা শামিমদের বাড়ি হাজির হয়। শামিমের বাবা যেন হাফ ছেড়ে বাচেন। ঝুলে থাকা টুকুকে কোল থেকে অবহেলায় নামিয়ে এগিয়ে যান গাড়ির দিকে।
 
আনিসা গাড়ি থেকে নামে। কৈফিয়ত দেয়ার মত করে বলে, "আর বলবেন না, রাস্তায় একটা এক্সিডেন্ট হলো-"
 
"এক্সিডেন্ট?" আনিসার বাবার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রশ্ন করেন শামিমের বাবা। "কোথায়?"
 
"এই তো গলির সামনে মেইন রাস্তায়। এক মাতালের উপর ট্রাক তুলে দিয়েছিল ড্রাইভার। অবশ্য ড্রাইভারের দোষ নেই, মাতালটাই ঝাপিয়ে পড়েছিল হুশ হারিয়ে। ওই নিয়েই লোক জমে গিয়েছে আর কি-"
 
"যাই হোক," আনিসার হাত ধরেন শামিমের বাবা। "ভেতরে যাওয়া যাক।"
 
ওরা ভিতরে গেলো। শামিম ও আনিসাকে একসাথে এনে বসানো হলো। ওদের মাঝে আসন গেড়ে বসলো টুকু, শামিমের বাবা ধমকে উঠলেন, হাত টেনে টুকুকে সরাতে চাইলেন শামিমের মা- অথচ টুকু ঠায় বসে রইলো বোকার মত। কাজি এলেন এরও কিছু সময় পর। বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন দ্রুত।
 
কাজি বললেন, "মা, বলো কবুল?"
 
শামিম বললো না। ঢোক গিললো একবার।
 
কাজি আবার বললেন, "্বাবা কবুল বলো?"
 
~কবুল।
 
এক অজানা স্বস্তি বয়ে গেলো সবার মাঝে। আত্নীয় স্বজনের ফিসফিসানি থেমে গেলো মুহুর্তের মধ্যে। খুব অনাড়ম্বরভাবে, লুকোচুরির মাঝে শেষ হয়ে গেলো ওদের বিয়ে। আত্নীয় স্বজনেরা বেরিয়ে গেলো চুপিচুপি, যেন এক বড় অন্যায়ের সাক্ষী ওরা। সেই অন্যায়ের দায় থেকে বাঁচতে পালিয়ে গা ঢাকা দিচ্ছে ওরা।
 
এক গুমোট অন্ধকার রাতে শুরু হলো শামিমের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়।

পরিশিষ্টঃ সুখ আর দুঃখ একে অন্যের পরিপূরক - এ এক ধ্রুব সত্য। যে সময়ে শামিমদের পরিবারে বয়ে যাচ্ছিল স্বস্তির নিশ্বাস, ঠিক সেই সময়ে শহরের অজানা কোন হাসপাতালে কাতরাচ্ছিল এক অপরিচিত মাতাল। ট্রাকের আঘাতে জীবন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে যাচ্ছিল শেষবারের মত। ঠিক এক বছর আগে যেই পরিবারকে চিরতরে হারিয়েছিল, নিজের দোষে দূরে সরে গিয়েছিল নিজের প্রিয়তমা স্ত্রী আর শিশু- সেই পরিবারকে জোড়া দিতে শেষবার ছুটে এসেছিল ও। কিন্তু অদৃষ্টের কি পরিহাস! স্রষ্টা ওকে ঠেলে দিলো নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। নিজের পরিবার ফিরে পাবার ফিকে স্বপ্নটা শেষ করে দিলো চোখের নিমিষে। এক বুক বোবা কান্না নিয়ে জামান একবার বলে উঠলো, "ঝুমু..."
 
সেই ডাক কেউ শুনলো না। জামানও আর বলবার সুযোগ পেলো না। শেষবারের মত শ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে এলো ওর দূষিত বাতাস। অবহেলায় অপমৃত্যু হলো এক সম্ভাবনাময় ভালোবাসার

    0