top of page

জীবিত মানুষের শ্রাদ্ধ


জীবিত মানুষের শ্রাদ্ধ! কোনো দিন শুনেছেন? এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। কোলকাতায় এক শিক্ষিত বনেদি বাড়ির ১৯ বছরের মেয়ের শ্রাদ্ধর আয়োজন করেছিলেন তার কাকা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। বরিশালের (অধুনা বাংলাদেশে) ব্রাহ্ম পরিবারের উচ্চশিক্ষিত অধ্যাপক, এই নগেন্দ্রনাথই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট মেয়ে মীরার স্বামী। নগেন্দ্রনাথ সেদিন তার দাদা, উপেন্দ্রনাথের কন্যা অরুণাকে মৃতা ঘোষণা করে শ্রাদ্ধের আয়োজন করে, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়দের কাছে বার্তা ছড়িয়ে দেন - 'অরুণার মৃত্যু হয়েছে।' কিন্তু কি ছিল কারন? হঠাৎ করে গোটা পরিবার একটি মেয়ের বিরুদ্ধে চলে গিয়ে, কেন এমন কাণ্ড ঘটিয়েছিল? কি ছিল মেয়েটির অপরাধ? আসলে মেয়েটির অপরাধ - তার থেকে ২৩ বছরের বড় এক মুসলিম আইনজীবীকে বিয়ে করেছিলেন ভালোবেসে! যেই বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, সরোজিনী নাইডু, সি. রাজাগোপাল আচারিয়া, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। মেয়েটির নাম অরুণা গঙ্গোপাধ্যায়। তার সাথে বিয়ে হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী আসফ আলীর...

অরুণা গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯০৯ সালের ১৬ই জুলাই, তৎকালীন পাঞ্জাব প্রদেশের কালকাতে। বাবার নাম উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, মা অম্বালিকা দেবী ব্রাহ্ম সমাজের নেতা ও ব্রহ্ম সঙ্গীত রচয়িতা ত্রৈলোক্যনাথ সান্যালের কন্যা। অরুণার এক কাকা নগেন্দ্রনাথ, আরেক কাকা ধীরেন্দ্রনাথ 'বম্বে টকিজে'র চলচিত্র পরিচালক। অরুণা লাহোরের Sacred Heart Convent স্কুলে পড়াশোনার পরে, নৈনিতালের All Saints’ College থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর কোলকাতার গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেই সময় এলাহাবাদে অরুণার সাথে পরিচয় হয় জাতীয় কংগ্রেসের (INC) নেতা আসফ আলীর। তারপরেই ১৯২৮ সালে তিনি আসফ আলীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ভিন্ন ধর্মে বিয়ে ও বয়সের তফাতের কারনে, অরুণা ও আসফ আলীর বিয়ে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বললেও অরুণা কোনো কথাই আমল দেয়নি। বৃটিশ সরকার 'লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা'র বিচার শুরু করলে, ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত'র হয়ে সওয়াল করেন আসফ আলী। বিয়ের পর থেকেই অরুণা ধীরে ধীরে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩০ সালে গান্ধীজীর নেতৃত্বে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে গ্রেপ্তার হন অরুণা। ১৯৩১ সালে 'Gandhi-Irwin Pact'-এর মাধ্যমে প্রায় সব রাজনৈতিক নেতারা মুক্তি পেলেও, বৃটিশরা অরুণাকে জামিন দিচ্ছিল না। এর প্রতিবাদে জেলবন্দি সব নারীরা আন্দোলন শুরু করলে বৃটিশ সরকার অরুণাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই আবার তাকে গ্রেপ্তার করে তিহার জেলে বন্দি করা হয়। তিহার জেলে বন্দি থাকাকালে তিনি জেলের ভেতরেই বন্দিদের সঠিক চিকিৎসার দাবি করে অনশন শুরু করলে, বৃটিশ সরকার বাধ্য হয় তার দাবি মেনে নিতে। কিছুদিন পর গণআন্দোলনের চাপে বৃটিশ সরকার অরুণাকে মুক্তি দেয়...

১৯৪২ সালের ৮ই আগস্ট, মুম্বই-এ INC'র বিশেষ অধিবেশনে যোগ দেন অরুণা আসফ আলী। সেখানে কমিটির মিটিংয়ে 'বৃটিশ ভারত ছাড়ো' প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এই খবর পাওয়ার সাথে সাথে বৃটিশ সরকার মহাত্মা গান্ধীসহ প্রমুখ দেশনেতাদের গ্রেপ্তার করা শুরু করলে, নেতৃত্বের অভাবে সবাই হতচকিত হয়ে যায়। ঠিক সেই সময় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে অরুণা। ৯ই আগস্ট মুম্বই-এর গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে, ৩৩ বছরের এই মহিয়সী নির্ভয়ে ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে এনে তার জায়গায় ত্রিরঙা পতাকা উড়িয়ে সকল সংগ্রামী মানুষের মাঝে উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলেন। অরুণা দেশবাসীকে এই সংগ্রামটিতে অংশগ্রহণ করতে আহ্বান জানানোর সাথে সাথে চারিদিকে বিদ্রোহ আরম্ভ হয়। দেশের জনতা রাজপথে বেরিয়ে এসে 'বন্দে মাতরম', 'মহাত্মা গান্ধী কী জয়', 'বৃটিশ ভারত ছাড়ো' ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তোলে। এরপরেই বৃটিশ পুলিশ অরুণাকে গ্রেপ্তার করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করলে - জয়প্রকাশ নারায়ণ, রামমনোহর লোহিয়া, অচ্যুৎ পট্টবর্ধন প্রমুখ নেতাদের মতো আত্মগোপন করেন অরুণা। এই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৭০টা রেল স্টেশন, ৫৫০টা পোষ্ট অফিস, ৭০টা পুলিশ স্টেশন, এবং ৮৫টা অন্যান্য সরকারি আবাসগৃহের ক্ষতি সাধন করেন মুক্তিকামী দেশবাসী। অনেক জায়গায় রেল লাইন, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ লাইন সংযোগহীন করে দেওয়া হয়। আত্মগোপনকালীন সময়েও অরুণা, তার বৈপ্লবিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে থাকেন। রামমনোহর লোহিয়া ও অরুণা মাসিক 'ইনক্লাব' পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে ইনক্লাব পত্রিকায় অরুণা লেখেন - "স্বাধীনতার সংগ্রাম সহিংস হবে, নাকি অহিংস - এই নিয়ে বিতর্কের সময় এটা না। আমি চাই - ক্রান্তিকালের এই সন্ধিক্ষণে দেশের সব মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ুক।" বৃটিশ সরকার অরুণার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, তার গ্রেপ্তারির জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। আত্মগোপনের সময় কঠোর পরিশ্রমের কারনে অরুণা অসুস্থ হয়ে পরলে, তার ভগ্নস্বাস্থ্যের কারনে উদ্বিগ্ন হয়ে গান্ধীজী তাকে চিঠি লেখেন - "I have been filled with admiration for your courage and heroism. You are reduced to a skeleton. Do come out and surrender yourself and win the prize offered for your arrest. Reserve the prize money for the Harijan [untouchables] cause”। অবশেষে ১৯৪৬ সালের ২৬শে জানুয়ারি বৃটিশ সরকার অরুণার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রদ করলে, অরুণা আত্মসমর্পণ করেন...

পরবর্তী সময়ে অরুণা আসফ আলী কংগ্রেসের প্রতি আস্থা হারিয়ে সমাজবাদী দলে (Socialist Party) যোগদান করেন। ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর তিনি গরিব জনসাধারণের সাথে মিলে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করলে, Communist Party of India'র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দাবিতে অরুণা আসফ আলীর অবদান চিরস্মরণীয়। ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত রাশিয়া, তাকে 'নেহরু পুরস্কারে' সম্মানিত করে। ১৯৫৮ সালে তিনি দিল্লীর প্রথম মহিলা মেয়র হন। যদিও কিছুদিন পরে সেই পদ ত্যাগ করেন তিনি। মহিলাদের সমান অধিকারের জন্য আন্দোলনে, তিনি জাতীয় মহিলা ফেডারেশনের সভামন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। তিনি জাতীয় মহিলা কনফারেন্সের সাথেও জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৬০ সালে তিনি একটি মিডিয়া পাবলিশিং হাউজের প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজে প্রগতি আর শান্তি আনতে তার প্রচেষ্টার কারনে ১৯৬৪ সালে, তাকে 'লেনিন শান্তি পুরস্কার'-এ ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর তিনি একটি বই লেখেন - 'Words of Freedom'। অরুণা আসফ আলীর জ্ঞান ও দেশের প্রতি তার অবদানের জন্য, তিনি ১৯৯১ সালে 'জওহরলাল নেহরু পুরস্কার' এবং ১৯৯২ সালে 'পদ্মবিভূষণ পুরস্কার'-এ সম্মানিত হন। ১৯৯৭ সালে ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ পুরস্কার 'ভারতরত্ন'-এ ভূষিত করা হয় তাকে। ঐ উপলক্ষে ভারত সরকার একটি ডাকটিকিটও প্রকাশিত করে। কিন্তু তার আগেই ১৯৯৬ সালের ২৯শে জুলাই মৃত্যু হয় বিয়াল্লিশের যুগান্তকারী ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নেতৃত্বের পুরোধা, 'ঝাঁসির রানি লক্ষীবাঈ'-এর উত্তরসূরি অরুণা আসফ আলীর। বর্তমানে দেশের 'নতুন ইতিহাস রচনাকারী'রা, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল 'মুচলেখা' প্রদানকারীদের বীর(!?) উপাধি প্রদান করে 'ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস' বিকৃত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যার ফলে দেশের মানুষদের স্মৃতির মণিকোঠা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে অরুণা আসফ আলীর মতো চিরবিপ্লবীদের অবদান। প্রকৃত 'ভারতমাতা'র ইতিহাস সবার সামনে তুলে ধরার জন্য, আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস...

তথ্যসূত্র - (১) "Short Biography of Aruna Asaf Ali - প্রতিক দাগা (২) "Aruna Asaf Ali Biography" - Lloveindia.com (৩) "ভারতরত্ন" - অজয় কুমার দত্ত

0 comments
Enjoy
Free
E-Books
on
Just Another Bangladeshi
By
Famous Writers, Scientists, and Philosophers 
click here.gif
click here.gif

Click Here to Get  E-Books

lgbt-bangladesh.png
bottom of page