মার্কসবাদী সমাজতন্ত্রের উদ্ভব (Rises of Marxian Socialism)
আগের পর্বে আমরা সমাজতন্ত্র ও ইওটোপিয়ানিজম এর উদ্ভব নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এই পর্বে আমরা মার্কসবাদী সমাজতন্ত্রের উদ্ভব ও এর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করবো।
ফরাসি সমাজতান্ত্রিক ল্যুই ব্ল্যাঁ ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্রী ও আধুনিক সমাজ তন্ত্রের জনক কার্ল মার্ক্স এর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে সমর্থ হন। তিনি বাস্তববাদী সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ইউটোপিয়ান সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা সেন্ট সাইমন (একজন ফরাসি সমাজতন্ত্রী)-এর ন্যায়, "প্রত্যেকেই নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করবে এবং এর বিনিময়ে প্রয়োজন মেটানোর মতো যথেষ্ট পরিমাণ পারিশ্রমিক পাবে"- এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ল্যুই -এর মতে সকল সক্ষম নাগরিককে কাজ করার অধিকার দিতে হবে এবং ব্যাক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ করে শ্রমিক পরিচালিত জাতীয় কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু, অভিজ্ঞতা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এবং লুই বোনাপার্টের বিরোধিতায় ল্যুই ব্ল্যাঁর সেই চেষ্টা সফল হয় নি। ইতিমধ্যেই ইংল্যান্ডে চার্টিস্ট আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের সময়ে পরিচালিত এই আন্দোলন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার আদায় করার প্রয়াস পায়। প্রধান চার্টিস্টগণ ছয়টি সুযোগ-সুবিধা দাবি করেঃ প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার, ব্যালট এর মাধ্যমে ভোট প্রদান,বাৎসরিক পার্লামেন্ট, পার্লামেন্টের সদস্যদের বেতনপ্রদান, পার্লামেন্টের সদস্যভুক্তির জন্য সম্পত্তি-যোগ্যতা
( Property qualification) এবং সমনির্বাচনী এলাকা। তারা নিজেদের প্রতিনিধি পার্লামেন্টে প্রেরনের জন্য দাবি জানায়। এই আন্দোলন বলপূর্বক দমন করা হলেও, এর প্রভাব এখনো ইউরোপীয় রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয়।
প্রগতিবাদী ও বাস্তবধর্মী কার্ল মার্কস এর আবির্ভাবের পূর্বে সমাজতন্ত্রের বিকাশ তেমনভাবে সফলতা লাভ করতে পারে নি। কার্ল মার্ক্স তার অসাধারণ মেধা,ঐতিহাসিক পান্ডিত্য এবং প্রগতিবাদী চিন্তাধারায় সমাজতন্ত্রকে একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দান করেন। একে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বলা হয়। বাস্তবধর্মী ও আধুনিক সমাজতন্ত্রের জন্মদাতা কার্ল মার্কস ছিলেন একজন জার্মান ইহুদি। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে রাইন অঞ্চলের ট্রিয়ার (Trier)নামক স্থানে তাঁর জন্ম হয়। ইহুদি হিসেবে জন্মগ্রহন করলেও এবং পরবর্তীকালে তাঁর পিতামাতা খ্রিস্টধর্ম গ্রহন করলেও তাঁর বিশেষ কোন ধর্মমত ছিল না। তিনি বন ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করে আইন অপেক্ষা দর্শনের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং প্রখ্যাত দার্শনিক হেগেলের মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। হেগেলের প্রবর্তিত ইতিহাসের ক্রমবিবর্তন (Evolution) গতিধারায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইপিকিউরাসের দর্শন (Philosophy of Eoicurus) সম্পর্কে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করে জেনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। শিক্ষকতার প্রতি তার প্রবল আকর্ষন ছিল।কিন্তু প্রথম জীবনে তাকে সাংবাদিকতা গ্রহণ করতে হয়। উদারপন্থী একটি পত্রিকা রেনিস গেজেট (Rheinische Zeitung) -এর সম্পাদক ছিলেন তিনি। প্রুশিয়া সরকার মার্কসের প্রগতিশীল মতবাদের জন্য পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়।
স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে কার্ল মার্কস ফ্রান্সে আশ্রয় গ্রহন করেন এবং সেখানে তিনি Proudhon, Heinrick Heine, Pierre leroux প্রমুখ প্রখ্যাত সমাজত্রীদের সংস্পর্শে আসেন।
১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে মার্কস তাঁর সহকর্মী ফ্রেডরিক এঙ্গেলস নামে একজন জার্মান সমাজতন্ত্রীর সঙ্গে পরিচিত হন। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রুসেলস-এ অবস্থানকালে তিনি কমিউনিস্ট লীগ নামে একটি সমাজতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।
এই লীগের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বক্তৃতা, প্রচারণা ও সংগঠনমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে মূলধন ও ধনতান্ত্রিকতার অবসান ঘটিয়ে কমিউনিজমের ভাবধারা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে এঙ্গেলস এর সহায়তায় মার্কস তাঁর বিখ্যাত প্রচারপত্র কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো (Communist Manifesto) প্রকাশ করেন। চারটি পর্যায়ে বিভক্ত এই পুস্তকে তিনি সমাজের বিবর্তন, শোষকদের দ্বারা শোষিত সমাজের রূপ, কমিউনিস্ট পার্টির মূল ভাবধারা, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাকে সমাজতান্ত্রিক অথবা কমিউনিজমে রূপান্তরিত করার পদ্ধতি প্রভৃতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কার্ল মার্কসের সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব ছিল তাঁর বিখ্যাত রচনা 'ড্যাস ক্যাপিটাল' (Das Capital)। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে মার্কস এই গ্রন্থে সমসাময়িক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনা করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজতন্ত্রীদের বাইবেল নামে খ্যাত 'ড্যাস ক্যাপিটাল' একটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনরাজনৈতিক মতবাদ প্রকাশ করে এবং এর ফলে Capitalism এর পরিপন্থী কমিউনিজম সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। রুশোর 'সামাজিক চুক্তির মতবাদ' যেমন ফরাসি বিপ্লবের প্রেরণা দান করে, সেরূপ মার্কসের 'ড্যাস ক্যাপিটাল' রুশ বিপ্লবের প্রেরণা জোগায়। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে তাঁর মৃত্যু হয়।
------------------------০--------------------
পরবর্তী পর্বে আমরা মার্কসবাদের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করবো। প্রথম পর্বের লিংক নিচে কমেন্টে।
Comments