চিনা মুসলিম উইঘুরদের আগমনের নেপথ্য ও বর্তমান পরিস্থিতিঃ
চীনের সিনকিয়াং (নতুন নাম জিনজিয়াং) প্রদেশে অনেক মুসলিম বসবাস করে তারা উইঘুর নামে পরিচিত। এই উইঘুররা আবার তুর্কী জাতির বংশধর। তারা এই অঞ্চলকে পূর্ব তুর্কিস্তান নামে ডাকে। চীনের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩% মুসলিম।
কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাস্ট্র চীনে সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস কারী এসব মুসলিমদের আগমন কিভাবে হল নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে চীনে মুসলিমদের আগমন ঘটে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। নবী মোহাম্মদ এর জন্মের বহুকাল পূর্ব হতে চীন দেশের সঙ্গে আরবদের বানিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।বিশেষ করে সিরিয়া ও লেভান্ট বন্দরসমূহে আরবীয় পণ্য প্রাচ্যদেশীয় দেশসমূহের মধ্যে আদান-প্রদান করা হতো। ৬ষ্ঠ শতকে শ্রীলঙ্কার মাধ্যমে চীন ও আরব দেশের মধ্যে ব্যবসা বানিজ্যের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছিল। সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে আরব, পারস্য ও চীন দেশের মধ্যে ব্যপক ব্যবসা বানিজ্য হয়। পারস্য উপসাগরীয় বন্দর সমূহে চিনা বনিকগণ বানিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যপক যাতায়ত করে এবং বানিজ্যে প্রসার লাভ করে। এভাবে আরব বনিকদের মাধ্যমে চীনা ব্যবসায়ী ও রাজারা আরবদেশে নতুন মুসলিম শক্তির অভ্যূদয়ের কথা জানতে পারে।
কোয়াংট্যাং রাজবংশের শাসনামলে চীন দেশে সর্বপ্রথম মুসলিম প্রচারকগণ ইসলাম প্রচারের জন্য গমন করে। এ সকল আগন্তুক সৃষ্টি কর্তার উপাসনা করে। তাদের উপাসনালয়ে কোন দেব-দেবীর মূর্তি,প্রতিমা কিংবা কোন পূজার অস্তিত্ব নেই। তারা মদ্যপান করে না,শুকরের মাংস আহার করে না এবং নিজেদের বিধিসম্মত জবেহ করা প্রাণী ব্যতিত অন্যান্য প্রাণীর মাংস অপবিত্র মনে করে স্পর্শ পর্যন্ত করে না। নির্ভরযোগ্য ঐঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায় যে,পারস্য দেশের মাধ্যমে আরব ও চীনদেশের মধ্যে স্থলপথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। পারস্যের সাসানীয় রাজবংশের সর্বশেষ সম্রাট ইয়াজিদ এর পতনের পর তাঁর উত্তরাধিকারী আরবীয় যুদ্ধাভিযানের বিরুদ্ধে চীনা সম্রাটের সাহায্য প্রার্থনা করে দূত পাঠিয়ে ছিলেন। আরব ঐতিহাসিকদের মতে ৭২৬ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া খলিফা হিসাম সুলায়মান নামক এক মুসলিম ব্যাক্তিকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে চীন সম্রাট সুয়াংটাং এর দরবারে প্রেরণ করেন। সম্রাট সুয়াংটাং আরব দূতের সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ ও উপঢৌকনসহ তাকে সম্মানপ্রদর্শন করেন। ফলে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এক নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়। চীনের অরাজকতা চলাকালে ৭৫৬ খ্রিঃ সম্রাট সু-সাং আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুরের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। সে আবেদনে সাড়া দিয়ে আল মনসুর একটি সেনা ইউনিট চিনে প্রেরণ করে বিদ্রোহীদের কবল হতে সি-নাগানফু ও হু নানফু নামক দুটি শহর পুনরুদ্ধারে সম্রাটকে সহায়তা করেন। যুদ্ধশেষে আরব সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সদস্য চিনে থেকে যায় এবং চিনা মহিলাদের বিবাহ করে স্থায়ী বসবাস করে। এভাবে চিনে মুসলিম প্রবেশ এবং স্থায়ী মুসলিম বসতি বিস্তার লাভ করে। আরব সৈন্যদের সরকার হতে জমি ও বসতবাড়ি দেয়া হয় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য।
আবার চিন দেশে ইসলাম প্রচারের একটি কাহিনীতে বর্ণিত আছে যে, চিন দেশে ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন নবী মোহাম্মদ এর মামা এবং ক্যান্টনে তার মাজার আছে যা সেখানকার লোকজন সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকেন।
কালে কালে মুসলিমগন চীনা সম্রাটদের অনুমতিক্রমে সেখানে স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম প্রচার,ধর্মান্তর ও ধর্মান্তরকরণ কাজ স্বাধীনভাবে স্বচ্ছন্দ গতিতে চালিয়ে যেতে থাকে। তারা সেখানে বহু সংখ্যক মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। চিনা মুসলমানগন সুখ-শান্তিতে বসবাস করে। তবে ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে চিনের শাসনক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কান-সু প্রদেশে প্রথম মুসলিম বিদ্রোহ ও অসন্তোষ দেখা দেয়। এটাই সম্ভবত চিন সরকারের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সর্বপ্রথম বিক্ষোভ ও সশস্ত্র আন্দোলন। তবে উনিশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম আন্দোলন ও বিদ্রোহ তেমন কোন ধ্বংসাত্মক রূপ নেয়নি। তারপরও তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিলো। চিনা সরকার ও মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান সুসম্পর্ক সম্বন্ধে ১৭৩১ খ্রি. সম্রাট ইয়েন চেনের এক রাজকীয় ফরমানে বলেন, " বহু শতাব্দী ধরে চিন দেশের বিভিন্ন প্রদেশে বহুসংখ্যক মুসলমান বসবাস করছে। তারা এদেশের সন্তান এবং আমি তাদের চীনাদের মত সন্তান বৎ মনে করি। তাদের ধর্মবিশ্বাস ও যারা তাদের ধর্মে বিশ্বাসী নয়, উভয়ের মধ্যে কোন প্রকার বৈষম্য আছে বলে আমি মনে করি না
মুসলমানদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীদের গোপন রিপোর্ট আমার নিকট এসেছে। তাতে বলা হয়েছে যে,তাদের ধর্মমত চিনাদের ধর্মমত হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন,তারা চিনা ভাষায় কথা বলে না এবং তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ চিনদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তারা চরম উগ্রপন্থী এবং সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে না মর্মে অভিযোগ রয়েছে। তারা উচ্ছৃঙখল ও বিদ্রোহী ভাবাপন্ন বিধায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আমারা সুপারিশ করছি। এ সকল অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত করে আমি বুঝতে পারি যে,এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই বরং সেগুলো অমূলক ও মিথ্যা। তাই তাদের অন্যায়ভাবে শাস্তি দিতে পারি না।"
সম্রাট ইয়েন চিয়েনের রাজত্বের ত্রিশ বছর পর তার উত্তরাধিকারী সম্রাট কিয়েন-লং আরও পরিষ্কারভাবে মুসলমানদের প্রতি সমর্থন ও আনুকূল্য প্রদর্শন করেন। ফলে চিনে ইসলাম প্রচারের ধারা সর্বদা নীরবে নিরবিচ্ছিন্ন গতিতে চলতে থাকে -তাতে কোন অসারতা ছিল না। যদি ঝাঁকজমকের সঙ্গে প্রচারকার্য পরিচালিত হত, আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারকার্য চলতো, তা হলে অবশ্যই চিনা সম্রাটের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হত এবং অন্য চোখে দেখত।
কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে চিনে ইসলামের প্রভাব ও আকর্ষন বহুলাংশে হারিয়ে ফেলেছে। এর কারণ হল সমাজতন্ত্রের উথান।
চিনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে মুসলিম ধর্ম ও কৃষ্টি কালচারের ওপর আঘাত আসে। ইসলাম প্রচারকার্য বাঁধাগ্রস্ত হয়। তবে বর্তমানে চিনের সরকার ধর্মীয় উদারনীতি গ্রহনের ফলে চিন দেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের পথ সুগম হয়। গনপ্রজাতন্ত্রী চিন মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য এমন অদ্ভুত স্বাধীনতার ব্যবস্থা করেছে যার নজির পূর্ববর্তী কোনো সরকারের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে উইঘুর ও লুই রা সংখ্যায় আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে এবং তারা প্রতিনিয়ত অনিয়ন্ত্রিত ভাবে জন্মহার বৃদ্ধি করে চলেছে যা কম্যূনিস্টদের নীতিবহির্ভূত।
জনসংখ্যায় বৃদ্ধি পেয়ে কম্যূনিস্ট যাতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে উইঘুররা এখন দিনকে দিন মুক্তিকামী ও জিহাদি হয়ে ওঠছে যেটা যেকোনো সমাজতান্ত্রিক সরকারের মাথা ব্যাথার কারণ হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে চিনা সরকার তাদেরকে জন্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এটাকে মুসলিমরা যদি সংখ্যালঘু নির্যাতন বলে প্রচার করার চেষ্টা করে তাহলে এর চেয়ে মুর্খতা আর কি হতে পারে?
তারা সরকারের নীতির প্রতি আনুগত্য স্বীকার করবে না, তাদের সেই পুরাতন মান্দাতে আমলের নিজস্ব ধর্মীয় কৃষ্টি কালচার নিয়ে পরে থাকবে, ঘরে ৫-৬ টা করে বাচ্চা জন্ম দিবে, আর ভেতরে ভেতরে জিহাদের কৃমি সৃষ্টি করবে, এরকম পরিস্থিতিতে কি চিনা সরকার বসে বসে ললিপপ চুষবে??
আসলেই বর্তমানে বিশ্বের উন্নত ও সভ্য দেশগুলোতে ইসলাম একটা সমস্যা, একটা আতংকের নাম।
コメント