শ্রাদ্ধ কি? কেন আমরা শ্রাদ্ধ করি?
"প্রেতত্ত্ব মুক্তয়ে বাপি বিরাটং বাচয়েদব্ধুধঃ

(মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস কর্তৃক রচিত মহাভারতের অন্তর্গত বিরাট পর্বতে এই শ্লোকটি উচ্চারণেও পাপনাশ হয় ও প্রেতমুক্তি ঘটে)
প্রেত আত্মার তৃপ্তির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার সহিত পিন্ড, জল ও দ্রব্যাদি দান করার নাম শ্রাদ্ধ। শ্রাস্ত্রে উল্লেখ আছে মৃতের আত্মার উর্দ্ধগতি প্রাপ্তির নিমিত্তে পিন্ডাদি দান করা হয়।
শ্রীমদ্ভগবদ গীতা, শ্রী ভগবান উবাচ - "শুক্লকৃষ্ণে গতী হ্যেতে জগতঃ শাশ্বতে মতে একয়া যাত্যনাবৃত্তিমন্যয়াবর্ততে পুনঃ।।" ৮অঃ ২৬ শ্লোক
অনুবাদঃ শ্রী ভগবান বলেছেন, যেহেতু জগতের দেবযান ও পিতৃযান মার্গ দুটি সনাতন বলে বলা হয়। দেবযান মার্গে গতি হলে অনাবৃত্তি অর্থাৎ মোক্ষ হয়। অন্যটি অর্থাৎ পিতৃযানের দ্বারা পুনরায় প্রত্যাবর্তন করে অর্থাৎ জন্মগ্রহণ করে। মার্গ দুটি সনাতন। কারণ প্রবাহাকারে সংসার নিত্য। অনাদিকাল ধরে চলছে। কে পূর্নজন্ম বিশ্বাস করল বা কে করল না তাতে কিছু আসে যায় না।
মৃত্যু হলেই কর্ম অনুসারে গতিদুটির একটি প্রাপ্ত হবে।শুক্ল জ্ঞান প্রকাশ অর্থে দেবযান আর পিতৃযান অজ্ঞানাবৃত বলে কৃষ্ণ ( অন্ধকার অর্থে)। এর পূর্বে মৃতের আত্মা মনুষ্য লোকের এক বৎসর দেবলোকের একদিন। আত্মা পিতৃলোকের পূর্বে প্রেতলোকে অবস্থান করে। এই প্রেতলোকের আত্মার তৃপ্তির জন্য পিন্ড ও উদক (জল) ও দ্রব্যাদি অর্পন করাই শ্রাদ্ধ।
শ্রীভগবান উবাচ; পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবানি যুগে যুগে।। ৪র্থ অ. ৮ম শ্লোক অনুবাদ- শ্রীভগবান বলেছেন, সাধুগনের রক্ষার জন্য, দুষ্কৃতকারীদের বিনাশও ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি যুগে যুগে অবতার রূপ ধারণ করি।
সনাতন ধর্মের মানুষ জন্মান্তরবাদ বিশ্বাস করে। জন্ম ও মৃত্যুরকাল চক্রে ঘুর্ণীয়মান। চতুর্যোগে ঈশ্বর মায়া শক্তিকে আশ্রয় করে লোক শিক্ষার্থে অবতার রূপ ধারণ করে ধরায় অবতির্ণ হন।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ অনু্যায়ী, মহর্ষি বাল্মীকি মুনি কর্তৃক বিরচিত রামায়ণের অযোধ্যাকান্ডে শ্রীরামচন্দ্র শ্রাদ্ধনিমিত্ত দশরথ রাজার মৃত্যুর পর বনবাস হতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং স্বয়ং শ্রীরাম কল্গুনদীর তীরে পিতৃ পিন্ড সমর্পণ করেন। এ শ্রাদ্ধের পৌরোহিত্য করেন মহর্ষি বশিষ্ঠ।
রামায়ণের বর্ণিত আছে, " রাম লক্ষ্মণ সীতা ত্বরিত হইলেন কল্গুনদীর তীরে স্নানান্ত্রে নাম গোত্র লইয়া করিলেন তর্পণ।"
রামায়ণের বনপর্বতে উল্লেখ আছে, " গতশ্চাহো দিব্যং রাজা বনস্থঃ সগুরু মর্মঃ রামং প্রতীক্ষে বাজায় সহি রাজা মহাশয়" (রাম সীতা রহিলেন পর্বত উপরে, হেথা দশরথ রাজার হইল সাংবাৎসরিক) সাংবাৎসর বলতে বুঝায়- পৃথিবীতে মৃত্যুর পর এক বছর পূর্ণ হলে মৃতের প্রেত মোচন করিবার জন্য যে শ্রাদ্ধ করা হয় তা সাংবাৎসরিক শ্রাদ্ধ নামে পরিচিত।
রামায়ণে আরো উল্লেখ আছে, সাংবাৎসরিক শ্রাদ্ধের সময় দশরথ রাজার প্রেতলোক হতে সীতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পিন্ডদানের কথা বলেন। সীতা দেবী রামচন্দ্রের অনুপস্থিতিতে দশরথ রাজার নির্দেশে ব্রাহ্মণ, তুলসী, কল্গু নদী ও বটবৃক্ষকে সাক্ষী রেখে কল্গুনদীতে বালু দ্বারা দশরথ রাজা ( প্রেত আত্মার) উদ্দেশ্যে পিন্ড দান করেন। পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ, তুলসী রামচন্দ্রের নিকট মিথ্যা সাক্ষ্য দানের জন্য সীতা দেবী তাদের অভিশাপ দেন এবং বট বৃক্ষ সত্য সাক্ষী দেওয়ায় আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়। বিষ্ণু পুরাণ অনুযায়ী,
মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস প্রণীত বিষ্ণুপুরাণ এর দশম অধ্যায়ে জাত কর্মাদি ক্রিয়া কন্যালক্ষণ ও বিবাহ বিধিতে পুত্র জন্ম লাভ করলে জাতকর্ম করতে হয় অর্থাৎ দশসংস্কারের উল্লেখ রয়েছে। এই দশ সংস্কারের ক্রিয়াকান্ডে পিতৃগণ উদ্দেশ্যে অভূদায়িক শ্রাদ্ধ করতে হয়। অনুপ্রমাণ, জাতকরণ, উপনয়ন ও বিবাহ অনুষ্ঠানে দেব ও পিতৃ যজ্ঞের উল্লেখ আছে। অভ্যুদায়িকের অপর নাম শ্রাদ্ধ।
আবার বিষ্ণু পুরাণের ত্রয়োদশ অধ্যায়ে- মৃতের দাহ, অশৌচ, একাদিষ্ট ও সপিন্ড করণের ব্যবস্থার কথা বর্ণিত আছে। তৎভিন্ন প্রেত ক্রিয়ার বিধিও বর্ণিত আছে। এখানে প্রতিদিন অশৌচান্তে পিন্ডদানের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তৎভিন্ন চতুর্বণের অশৌচ নির্ণয় সম্পর্কে বর্ণনা আছে। বিধিতে উল্ল্যেখ করা হয়েছে যে, শ্রাদ্ধ দিনে বিষ্ণু পূজা, ব্রাহ্মণ স্থাপন (এখানে পূজক ব্রাহ্মণ অর্থা নয়) এবং প্রেতের উদ্দ্যেশে পিন্ড দান করিয়া বিপ্র ভোজনের পর শুদ্ধির কথা বলা আছে। বর্ণিত অধ্যায়ে দেবলোক, পিতৃলোক ও প্রেতলোকের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে পিন্ডদানের অধিকারীর কথাও দৃষ্ট হয়।
বিষ্ণু পুরাণের পঞ্চাদশ অধ্যায়ে- শ্রাদ্ধের বিপ্র নিরূপণ ও শ্রাদ্ধ কর্তার নিয়ম উল্লেখ্য আছে। বিষ্ণু পুরাণের ষোড়শ অধ্যায়ে- শ্রাদ্ধের দ্রব্যাদি প্রয়োগের কথা বর্ণিত আছে, আবার গয়া তীর্থে পিতৃগণ উদ্দেশ্যে পিন্ডদানের কথাও বলা হয়েছে। শাস্ত্রে ( সনাতন ধর্মের ব্যবস্থাপত্রে) অপকর্ষের বিধান বর্ণিত আছে৷ অর্থাৎ কাল অশৌচ থাকাকালীন সময়ে কন্যার বিবাহ বা পুত্রের উপনয়ন দানের সময় উপস্থিত হলে কাল অশৌচ অপকর্ষের মাধ্যমে শুদ্ধ হয়ে (গয়াধামে পিন্ডদান পূর্বক) সংষ্কার কাজ সম্পন্ন করা যায়।
মহর্ষি বেদব্যাস প্রণীত মূল সংষ্কৃত হইতে পন্ডিত কাশীরাম দাস কর্তৃক রচিত মহাভারতের শান্তি পর্বে-
যুধিষ্ঠির নিকট মহর্ষি নারদের আগমন ও তীর্থস্থানের ফল বর্ণায় পিতৃ শ্রাদ্ধের কথা উল্লেখ আছে। পাপ বিশেষ নরক বিশেষ গমন পর্বে শ্রাদ্ধের কথা পরিলক্ষিত হয়।
গয়াক্ষেত্রের উপাখ্যান পর্বেঃ গয়াসুরের বর প্রার্থনা স্বয়ং বিষ্ণু গয়াসুরকে গয়া তীর্থে পাশান রূপে তার মাথায় পদ রাখার কথা বর্ণনা আছে। এখানে পাশান রূপে অবস্থিত গয়াসুরের মুখে পিন্ডদান করার বিধান বর্ণনা আছে। এখানে উল্লেখ্য যে, গয়াসুরের সঙ্গে স্বয়ং বিষ্ণুর যুদ্ধ হয়েছিল। তখন গয়াসুর বিষ্ণুকে বর প্রার্থনা করতে বলায় স্বয়ং বিষ্ণু গয়াসুরের মাথায় পদ রাখায় গয়াসুরের মৃত্যু হয় এবং এখন মৃতের আত্মার (প্রেতের) পিন্ডদানে দেবযান মার্গে গমনের কথা উক্ত হয়।
মহাভারতের কথাগুলো নিম্মে প্রকাশ করা হলোঃ "শিলারূপ হয়ে থাকি যাবৎ ধরণী আমার মস্তকে পদ দেহ নারায়ণ।। পিতৃলোকে পিন্ডদান করিবে যে জন সর্ব্ব পাপে মুক্ত হবে তার পিতৃগণ।।" দৈত্যের মস্তকে পদ করেন স্থাপন শিলারূপে হয়ে দৈত্য আছে চিরকাল।।
( যে দিন গয়াসুরকে কোন পিন্ডদান হবে না সেই দিনেই পৃথিবীতে প্রলয় হবে কথাটি ব্যক্ত আছে। মহাভারতের শান্তি পর্বে পঞ্চ প্রেতোপাখ্যানে পিতৃ যজ্ঞ ও দেব যজ্ঞের কথা বর্ণনা আছে। পিতৃ যজ্ঞ পিতামাতার জীবদ্দশায় ভরণপোষণ প্রদান পরলোকগমণ করলে শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। মহাভারতের আশ্রমিক পর্বে যুধিষ্ঠির হস্তিনায় প্রত্যাগমণ পরে ও তপোবনে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তি এবং সঞ্জয়ের যজ্ঞাগ্নিতে মৃত বর্ণনায় এখানে শ্রাদ্ধের কথা উল্লেখ আছে।
শ্রী হরিদাস সিদ্ধান্ত বাগীশ ভট্টাচার্য্য কর্তৃক প্রণীত " স্মৃতি চিন্তামনি সনাতন ধর্মের আইন নামক গ্রন্থে উপাসনা, পূজা পার্বণ, সংস্কার, পিন্ডদানের অধিকারী, অশৌচ বিধি, তিথিতত্ত্ব, প্রায়শ্চিত্ত, দেনাপাওনা সম্পর্কিত আইন। দানসাগর, আদ্যশ্রাদ্ধ, বৃষোৎসর্গ ও ধেনুদান বিভিন্ন প্রকার শ্রাদ্ধের নিয়মকানুন বিধি রচনা রচিত আছে। তাছাড়া উক্ত বিধির শ্রাদ্ধ পরিচ্ছেদ সপিন্ডকরণ প্রেত তর্পণে অধিকার সম্পর্কিত আইন সমূহ লিপিবদ্ধ আছে৷
"মনুসংহিতা" ভগবান মনু কর্তৃক রচিত ও মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায় শাস্ত্রী সুলভ সংস্করণ বিধিঃ
মনুসংহিতা সনাতন ধর্মের আইন নামক গ্রন্থে বর্ণনা আছেঃ তৃতীয় অধ্যায়ে সংষ্কার প্রকরণে শ্রাদ্ধ ও শ্রাদ্ধের কর্তব্যাকর্তব্য, শ্রাদ্ধের ব্রাহ্মণ নিমন্ত্রন, শ্রাদ্ধার্থে নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণের কর্তব্য, পিতৃগণ, পিতৃকার্যের কর্তব্যতা শ্রাদ্ধাদেশ নির্ণয় ও শ্রাদ্ধের ইতি কর্তব্যতা সম্পর্কে লিপিবদ্ধ আছে। সনাতন ধর্মের বিধি আচার নিষ্ঠা, নিয়মকানুন ও ধর্মীয় আইন মনুসংহিতায় পরিলক্ষিত হয়।
ความคิดเห็น