মা জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী ভদ্রলোক পত্রিকা থেকে মুখ তুলে কাউকে দেখলেন না। পত্রিকার পাতায় মনোযোগ ছিল বিধায় পাত্তা দিলেন না। পরক্ষণেই আবার কান খাঁড়া করে ফেললেন। স্বর্ণকারদের সমূহ বিপদ। সাবধান না থাকলে যে কোন সময় চুরি হতে পারে।
'আংকেল, আমি এখানে। ওই যে সোনালী আংটিটার দাম কতো?'
ভদ্রলোক পত্রিকা রেখে টেবিলের ওপাশে উঁকি দিলেন। দোকানের ঝকঝকে মেঝেতে ছোট একটা ৮/৯ বছরের ছেলে দাঁড়ানো। ক্যাশ কাউন্টারের টেবিল উঁচু বলে দেখতে পাননি।
সুন্দর চেহারা বাচ্চাটির। পরনে মার্জিত টিশার্ট ও জিন্স। চুল একদিকে সিঁথি করা। চোখে চশমা। দেখেই বলে দেওয়া যায় ক্লাসের ভালো ও ভদ্র ছাত্রদের একজন এই ছেলেটি। দোকানদার ভদ্রলোক গুরুত্ব দিতে না চাইলেও ছেলেটির ভালো মানুষের মতো চেহারা গুরুত্ব দিতে বাধ্য করলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি নাম তোমার আংকেল?
'আরমান। এই যে আংটিটা দেখা যাচ্ছে। এটার দাম কতো?'
দোকানদার ভদ্রলোকের পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেলো। নতুন নতুন দোকান দিয়েছেন তখন। এখন যেমন জাঁকজমকপূর্ণ ভাবসাব আছে তখন এসব ছিলো না। নিতান্তই সাদামাটা এক স্বর্ণকারের দোকান। মাঝে মাঝে বাচ্চাকাচ্চা আসতো কাস্টোমারদের সাথে। অনেকেই বিভিন্ন গহনা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতো, এটার দাম কতো আংকেল?
তবে সেসব বাচ্চাকাচ্চাদের মধ্যে মেয়েদের আধিক্য ছিলো বেশি। এই ছেলেটি হঠাৎ কোন আগ্রহ বশে আংটির দাম জিজ্ঞেস করছে কে জানে। হয়তো কোন কাস্টোমারের সাথে এসেছে। উনারা বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, বাচ্চাটি আগেই ভেতরে চলে এসেছে।
তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার আব্বু কোথায় আংকেল?
সে বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলো, আব্বু অফিসে। এটার দাম কতো বলেন না...
দোকানদার বিরক্তি উৎপাদন করতে চাইলেন না। তিনি বললেন, এটার দাম একুশ হাজার নয়শো টাকা।
আরমানের নিরীহ প্রশ্ন, এটা কি স্বর্ণের?
লোকটি হাসলেন। বললেন, হ্যাঁ। বাইশ ক্যারেট স্বর্ণের... উপরে ওই যে পাথর দেখা যাচ্ছে...
কাকে কি বোঝাচ্ছেন! এই ছেলেটি স্বর্ণের কিছু বোঝে? তবে ছেলেটি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে তিনি কথা শেষ করলেন, ওই পাথরগুলোও অনেক দামী।
আরমান কিছু ভাবলো। ভাবুক মুখে জিজ্ঞেস করলো, এটা কি এঙ্গেজমেন্টের আংটি নাকি বিয়ের আংটি?
দোকানদার দোটানায় পড়ে গেলেন। এটা বিয়ের রিং। কিন্তু এঙ্গেজমেন্ট রিং হিসেবে ব্যবহার করতে বাঁধা নেই। তিনি বললেন, দুটোই। কার জন্য নিবে আংকেল?
'আম্মুর জন্য' ছেলেটির গম্ভীর উত্তর।
'ও। তা তোমার আম্মু কোথায়?'
'আম্মুও অফিসে। আচ্ছা, এটা এঙ্গেজমেন্ট আংটি হিসেবে খারাপ হবে?'
দোকানদার লোকটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কার এঙ্গেজমেন্ট?
আরমানের আরও গম্ভীর উত্তর, আম্মুরও... আব্বুরও...
দোকানদার এবার পুরোপুরি ধন্দে পড়ে গেলেন। আব্বু আর আম্মুর এঙ্গেজমেন্ট! মশকারি করছে নাকি ছেলেটা? নাকি সে জানেই না এঙ্গেজমেন্ট কাকে বলে! তিনি ভাবলেন অনেক সময় দিয়ে দিয়েছি তোমাকে, বেঁচাকেনা নেই, তাই বলে আজাইরা টাইমও নেই। সেলসম্যান ছেলে দুটো গেছে কুরিয়ার অফিসে। ওরা থাকলে না হয় ওরা কথা বলতো এর সাথে।
তিনি কিছু বলবেন তার আগেই আরমান নাম্নী পিচ্চিটি বললো, আচ্ছা এটাই দিন তাহলে। টাকা এখান থেকে রাখেন...
বলে সে একটি ক্রেডিট কার্ড বাড়িয়ে ধরলো। দোকানদার আরও হতভম্ব হয়ে গেলেন! বাচ্চা একটা ছেলের কাছে ক্রেডিট কার্ড! সে আবার প্রায় বাইশ হাজার টাকা দামের এঙ্গেজমেন্ট রিং কিনছে।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এটা কার কার্ড?
'আব্বুর। পিন লাগবে? সেটা জানি আমি। মেশিনটা দেন, আমি পিন দিচ্ছি।'
বাহ। ঝানু পিচ্চি।
'কিন্তু তোমার আব্বুকে ছাড়া দেই কিভাবে বলো তো। উনি কিছু বলবেন না?'
আরমানের মনে ডুগডুগি বাজা আরম্ভ হলো। সে কার্ডটা না বলেই এনেছে। তবু কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে সে বললো, সমস্যা নেই। আব্বুই পাঠিয়েছে আমাকে।
দোকানদার ভদ্রলোক কার্ড পাঞ্চ করলেন। পিন চাইলো না। আংটিটি তিনি ছোট বক্সে ভরে প্যাকেট করে ছেলেটির হাতে দুরুদুরু বুকে দিয়ে দিলেন। মনে মনে ভাবলেন ছেলেটির আত্মীয় স্বজন এবার এসে উনাকে না ধরলেই হলো।
আত্মীয়-স্বজন না, কিছুক্ষণ পর ছেলেটিই আবার ফিরে এলো! আপদ!
আবারও ডেস্কের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, আংকেল একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখেছেন?
'না তো। কোন মেয়ে?'
'নিজের গলা সমান উচ্চতায় হাত ধরে বললো, এতটুকু একটা মেয়ে। আমার ছোট বোন। দেখেছেন?'
'না তো। তোমার সাথে এসেছিলো?'
'না। ও বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। এখন খুঁজে পাচ্ছি না।'
'বলো কি! কার সাথে দাঁড়িয়ে ছিলো?'
'একা।'
ছেলেটার চেহারা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো। দেখে মায়া লাগলো। আহারে। বাচ্চা একটা ছেলে, তারচেয়েও বাচ্চা একটা বোনকে হারিয়ে বিপদে পড়ে গেছে। দোকানদার ভদ্রলোক বললেন, আংকেল, আমার দোকানে তো এখন কেউ নাই। আমি বের হতে পারছি না। ট্রাফিক পুলিশকে বলে দিচ্ছি। সে খুঁজে দেখবে।
দোকানের সামনে মাঝ রাস্তার ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশ হাত উঁচিয়ে গাড়িগুলোকে লাইনে আনছেন। উনার মুখে প্রচন্ড বিরক্তি। ড্রাইভার গুলো যদি একটু নিয়ম মেনে চলতো! রাস্তার ধারে আরেক পুলিশ ভদ্রলোক বাইকের উপর বসে আছেন। সানগ্লাস চোখে স্মার্ট একজন তরুণ। সার্জেন্ট হবেন হয়তো। বেয়াড়া বাইকারগণ উনাকে দেখে মাঝ রাস্তায় চলে যাচ্ছে মামলা খাওয়ার ভয়ে।
দোকানী লোকটি সেই সার্জেন্টকে ডাকলেন। ডেকে বললেন, স্যার, এই ছেলেটি ওর বোনকে হারিয়ে ফেলেছে। একটু দেখবেন?
উনি সন্দেহের চোখে একবার দোকানীকে দেখলেন, আবার ছেলেটাকে দেখলেন, তারপর বললেন, আপনি কে?
'আমি এই দোকানের মালিক। এই ছেলেটা এসেছিলো আমার দোকানে। এখন ছোট বোনকে পাচ্ছে না।' দোকানদার ইচ্ছা করেই আংটি কেনার বিষয়টা এড়িয়ে গেলেন। এই বাচ্চা ক্রেডিট কার্ড পেলো কোথায় সেটা আবার আরেক ঝামেলা পাঁকাতে পারে। ক্রেডিট কার্ড দিয়েছে বলে এতটুকু পিচ্চির কাছে অতো দামের একটা আংটিই বা বিক্রি করতে হবে কেন, এমন প্রশ্নও উঠতে পারে।
এবার আরমানকে জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে হারিয়েছে?
আরমান বললো, এখান থেকেই। আমি দোকানে ঢুকেছিলাম। বের হয়ে দেখি নেই।
'কোথায় গেছে?'
আরমান নিরীহ মুখ করে বললো, জানি না। আমি বলেছিলাম এখান থেকে না যেতে। কিন্তু...
'আচ্ছা। নাম কি?'
'আরমান।'
'তোমার বোনের নাম...'
'সুমি।'
'বয়স কত?'
আরমান মনে মনে হিসাব করে বললো, ছয় বছর।
'স্কুলে পড়ে? স্কুল ড্রেস ছিলো গায়ে?'
'না আংকেল। লাল জামা পরা ছিলো।'
'হুঁ।' সার্জেন্ট ভদ্রলোক কাঁধের কাছে মুখ নিয়ে ওয়াকিটকিতে কিছু একটা বলে আবার জিজ্ঞেস করলেন, কতক্ষণ হলো হারিয়েছে?
আরমান আবারও কিছুক্ষণ হিসাব করে বললো, এক ঘন্টা।
'হুঁ। তুমি আসো আমার সাথে।'
সার্জেন্ট গিয়ে আবারও বাইকের উপর বসলেন। আরমানকেও পেছনে বসিয়ে এই গলি দিয়ে ঢুকে অন্য গলি দিয়ে বের হয়ে এই রাস্তায় ওই রাস্তায় খুঁজতে লাগলেন লাল জামা গায়ের পিচ্চি মেয়েটাকে।
এদিকে সুমি তখন আছে মহা বিস্ময়ে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে অনেক হাতি দেখেছে সে। এমনকি চিড়িয়াখানার খাঁচাতে এই বিশাল জন্তুকে আটকে রাখা হয়েছে। সে জানে হাতি থাকে জঙ্গলে। কোন হাতি যদি দুষ্টুমি করে তবে সেটাকে ধরে চিড়িয়াখানায় বন্দী করা হয়। কিন্তু ঢাকার রাস্তায় হাতি?! রিকশা, গাড়ি, বাইক কোনকিছুর তোয়াক্কা না করে সে আপন মনে চলেছে! মাঝেমাঝে এই গাড়ি ওই গাড়ির জানালা দিয়ে লম্বা শুড় বাড়িয়ে ধরছে। যাত্রী বা ড্রাইভাররা সম্ভ্রমের সাথে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়।
পিঠের উপর আবার বাচ্চা মতোন এক ছেলে বসে হাতিকে ধমকাচ্ছে, মারছে! সুমির ছোট সদ্য জানতে আরম্ভ করা মনে হাতিটার জন্য মায়া লেগে গেলো। আহারে, কি সুন্দর চোখ। চোখ ভেজা ভেজা। জ্বল উপচে পড়ছে। ব্যাথা পেয়ে কাঁদছে মনে হয়। ইশ, বোবা প্রাণীটা কথা বলতে পারে না দেখে বলতেও পারছে না যে ওর ব্যাথা লাগছে।
হাতিটার পেছন পেছন সেও চলতে লাগলো। চেঁচিয়ে কয়েকবার ছেলেটাকেও বললো, মেরো না। ব্যাথা পাচ্ছে। মেরো না।
মাহুত ছেলেটা যেন ওকে দেখানোর জন্যই সপাং সপাং করে আরও কয়েক ঘা চাবুক বসিয়ে দিলো! উদাস দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে যেন বুঝিয়ে দিলো, বড় লোক মাইয়ার ঢং দেখো!
সুমি দেখলো একটু দূরে এক পুলিশ আংকেল চা খাচ্ছে। সে দৌঁড়ে পুলিশ আংকেলকে গিয়ে বললো, দেখেন আংকেল, হাতিটাকে ওই পঁচা ছেলেটা মারছে। হাতিটা ব্যাথা পাচ্ছে। ওকে মারতে না করেন না আংকেল...
অবাক হওয়া কনস্টেবল ভদ্রলোক কিছু বলার সুযোগ পেলেন না, তার আগেই সুমি কেঁদে দিলো। ইনিয়েবিনিয়ে আরও কিছু বললো, তবে মানে বোধগম্য হলো না। কান্নার তোড়ে সেসব মিশে গেলো। কনস্টেবল লোকটি একটু বয়স্ক। সন্তানাদি থেকে থাকবে হয়তো। মেয়েটার কান্না মন গলিয়ে দিলো। তিনি ওকে সান্ত্বনা দিলেন, আচ্ছা কান্না কইরো না মামণি। আমি এখনই ধমকে দিচ্ছি।
সুমির হাত ধরে তিনি হাতিটার কাছে গিয়ে ছেলেটাকে বললেন, ওই, মারিস না। দেখোস না হাতি কান্তাছে?
অভদ্র ছেলেটা হেসে দিলো। তবে মারলো না আর। সে যে কাজ করছে তা বেআইনী। পুলিশকে সমঝে চলতে হবে। তবে ধমকানো থামলো না। হুর হুর হাট হাট করে গরু তাড়ানোর মতো তাড়িয়ে নিয়ে চললো সে তার বিশ ত্রিশ গুণ বড় পোষা হাতিকে।
সুমির কান্না বন্ধ হলো। তবে কান্নার ইফেক্ট হিসেবে হেঁচকি তোলা বন্ধ হলো না। কনস্টেবল লোকটি ওকে একটা চিপস কিনে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আম্মু নাম কি তোমার?
কান্নাজড়িত আদুরে কণ্ঠে উত্তর, সুমি।
'তোমার আব্বু আম্মু কোথায়?'
'অফিসে।' বলে এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজলো বোধয়। না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, গয়নার দোকান কোথায় আংকেল?
'কেন বলো তো...'
'আমার ভাইয়া ওখানে।'
'আচ্ছা। চিপস খাও। তারপর নিয়ে যাচ্ছি।'
আশেপাশে লোক ভীড় করেছিলো কিছু। ঢাকায় অলস লোকের সংখ্যা প্রচুর। অকর্মণ্যের ঢেঁকি এসব লোকগুলো সুমির হাতি সংক্রান্ত কান্না দেখে থাকবে হয়তো। আরও মজা দেখার জন্য ভীড় করেছে আশেপাশে। কনস্টেবল লোকটি তাড়িয়ে দিলেন সবাইকে। নিজে অর্ধসমাপ্ত চা শেষ করলেন। তারপর নিয়ে চললেন কাছে পিঠে কোথায় গয়নার দোকান আছে সেটা খুঁজতে।
সমস্যাটা বাঁধলো তখন যখন কোনও গয়নার দোকানই সুমি চিনতে পারলো না। যেটাই দেখে, বলে এটা না। দোকানের নামও বলতে পারছে না ঠিকমতো। অনেকদূর পর্যন্ত গিয়ে খুঁজাখুঁজি করেও লাভ হলো না। সুমি কোন রাস্তা ধরে এসেছে সেটাও বলতে পারছে না। শুধু বলছে গয়নার দোকান। গয়নার দোকানের তো অভাব নেই। তবে কোনটিই সেই কাঙ্ক্ষিত গয়নার দোকান নয়।
কনস্টেবল লোকটি ভাবলেন এরচেয়ে বরং ওর বাসায় পৌঁছে দেই। সেটাই ভালো হবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মামণি তোমার বাসা কোথায়?
সে বলতে পারলো না। জলভরা চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে একদিকে আঙ্গুল তাক করলো। সেটা রাস্তাও হতে পারে, আবার রেস্টুরেন্টও হতে পারে! ক্ষুধা লেগেছে নাকি কে জানে। কনস্টেবল লোকটি টেনশনে পড়ে গেলেন। ইতোমধ্যে দুয়েকজন যেচে পড়ে সাহায্য করতে এসেছিলো। সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেসও করেছে, মেয়েটি কে? কয়েক চক্কর দেওয়া হয়ে গেছে এই অল্প জায়গাতে। মেয়েটা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এখন কেউ যদি ছেলেধরা বলে গণধোলাই দিয়ে দেয়, কিছু করার থাকবে না। তারচেয়ে থানায় নিয়ে গেলে বোধয় ভালো হবে। তিনি সুমির হাত ধরে নিয়ে চললেন থানার পথে।
অন্যদিকে সাগর আছে ব্যাপক পেরেশানিতে। অফিসে কাজের চাপ প্রচুর। এই ফাইল দেখতে হচ্ছে তো আবার ওই হিসাব মিলাতে হচ্ছে। একাউন্টস সেকশনে চাকরিরত অধিকাংশ মানুষের মাথায় কেন চুল নাই তা কাজের পরিমাণ দেখলে বোঝা যায়। সারাদিন হিসাবকিতাবের জের টেনে একদিন নিজেরও জের টানা হয়ে যায়। তবু হিসাব মেলে না। কাজের ফাঁকে সে দেখে ফোনে ব্যাংকের ম্যাসেজ এসেছে যে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে একটি সফল লেনদেন হয়েছে। কার্ড ব্যবহারের জন্য ধন্যবাদ!
সে কেনাকাটা করেনি। মানিব্যাগ হাতড়ে কার্ড পাওয়া গেলো না। হারিয়ে গেছে নাকি? আরমান ও সুমি বাসায় আছে। ওদের সাথে মাঝেমাঝে কথা বলার জন্য বাসায় টেলিফোন বসিয়েছে সে। সেটাতে কল করলো, রিসিভ হলো না। আবার কল, নো আন্সার। বাসায় কোন বিপদ হলো না তো? সাগরের গ্রামের বাড়ি থেকে এক দুঃসম্পর্কের নিঃসন্তান খালা এসে রয়েছেন বাসায়। তিনিও গ্রামে গেছেন ঘুরতে। দারোয়ানকে ফোন করলো সাগর। দারোয়ান জানালো আরমান ও সুমি বেশ অনেকক্ষণ আগেই বাসা থেকে বের হয়েছে। দারোয়ান জিজ্ঞেস করাতে ওরা বলেছে, বাবার কাছে যাচ্ছে!
সাগরের পাগলপ্রায় দশা। সিঙ্গেল প্যারেন্টিংয়ের হ্যাপা অনেক। ওদের মা বেঁচে থাকলে আজ এই টেনশনে পড়তে হতো না। নিজেকে উজাড় করে আগলে রাখতো ওদের। গত কয়েকদিন যাবত ওদের গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর নজরে পড়েছে। গোপন কোন একটা পরিকল্পনা আঁটছিলো দুজন মিলে। মা হলে এসবের মধ্যে নাক গলানো যায়। বাবা হয়ে ওদের পারসোনাল ব্যাপারে নাক গলানো ঠিক হয় না। তাছাড়া সে হচ্ছে বাবা। বাবাদের একটু গুরুগম্ভীর হতে হয়। কিন্তু তাই বলে কঠোর হওয়া যাবে না। এমনিতেই মা নেই দুজনের। সেই প্রভাব যেন বাচ্চাদের উপর না পড়ে তারজন্য আপ্রাণ চেষ্টা আছে সাগরের।
এখন তাহলে গেলো কোথাও? কার্ড কি ওরাই নিয়েছে? কিন্তু ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কেনাকাটা করার মতো বুদ্ধি কি হয়েছে ওদের? নাকি কার্ড পেয়ে ভেবেছে সরাসরি বাবাকে ফেরত দিয়ে বাহবা আদায় করবে? পথে কোন বিপদ হলো না তো? চাকরির গুল্লি মারি।
হন্তদন্ত হয়ে সাগর ছুটলো বাসায়। বেরোবার পথে ব্যাংকে ফোন দিয়ে বললো কার্ডটা হাতছাড়া হয়ে গেছে। ওটা বন্ধ করে দিতে। পাশাপাশি আরেকজনকে ফোন করলো। মায়া। বন্ধুর কলিগ। আরমান ও সুমির মা মারা যাওয়ার পর এই প্রথম কোন নারীর সাথে অল্প একটু ঘনিষ্টতা হয়েছে। বাচ্চাদের কথা ভেবে পিছিয়ে আসতে চেয়েছে, কিন্তু মায়া যেন দুই ধাপ এগিয়ে এসেছে। পিছিয়ে পড়তে গিয়েই বরঞ্চ দুজনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নিয়মিতই সে সাগরের বাসায় আসে। খারাপ উদ্দেশ্যে নয়। আরমান ও সুমির মায়ের অভাব সে যেন একাই পূরণ করে দিবে। ওদের দেখভাল, পড়ালেখা, আনন্দ ও শিশুসুলভ দুঃখের ভার ভাগাভাগি করে নিচ্ছে।
সাগরের খালা গ্রামের মানুষ। বিয়ে ছাড়া দুটি প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের মেলামেশা তিনি সহজ চোখে দেখেন না। তিনি গাঁইগুঁই করলেও বাসায় অবাধ আসা-যাওয়া মেনে নিলেন বাচ্চা দুটির কথা ভেবে। সত্যি বলতে মেয়েটা খারাপ না। দোষের মধ্যে ওই একটাই দোষ, এতো বয়স হয়ে গেছে, এখনও বিয়ে করছে না কেন?!
যাহোক, মায়াও ছুটে এলো বাসায়। এদিক-সেদিক বাসার আশেপাশে খুঁজলো দুজনে বেশ কিছুক্ষণ। শেষমেশ ফোন করলো ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি নাম্বার ৯৯৯ এ। প্রয়োজনীয় তথ্যাদি দিয়ে থম মেরে বসে রইলো বাসায়। মায়ার বন্ধু আছে ঢাকা মেডিকেলে। সেখানেও খোঁজ নিলো সে। বিভিন্ন হসপিটালেও খোঁজ নিতে বললো। বিপদের কথা বলা যায় না।
প্রায় তিন'ঘন্টা পর, সন্ধ্যা হবে হবে, থানা থেকে জানালো বাচ্চাদের পাওয়া গেছে। নিরাপদেই আছে। থানা থেকে একটা গাড়ি বাসায় পৌঁছে দিবে। অলরেডি রওনা হয়ে গেছে গাড়ি। একটি পুলিশের গাড়িতে করে আরমান ও সুমি এলো। বাসার প্রতিবেশী কয়েকজনের সাথে সাগর ও মায়া দুজনেই অপেক্ষা করছিলো বাসার সামনে। গাড়ি থামতেই মায়া হাউমাউ করে দুজনকে জড়িয়ে ধরলো। মায়ার এমন কান্নাকাটি ও বাবার গম্ভীর মুখ দেখে আরমান ভড়কে গেলো! চোরের মন পুলিশ পুলিশ। বাবা হয়তো টের পেয়েছে ক্রেডিট কার্ডের কথা। মারধোর জোটে কিনা!
সুমি একজন মহিলা পুলিশের কোলে বসে ছিলো। আইসক্রিম খাচ্ছে বসে। আরেক হাতে চিপস। আসলে থানা হেফাজতে ওর সময়টা ভালো কেটেছে। পুলিশ সদস্যরা ওর যত্নের ঘাটতি রাখেনি। থানার সেকেন্ড অফিসারের সাথে এই অল্প সময়ের মধ্যেই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। সুমি এখন জানে, ক্লাসের দুষ্টু মেয়েটা যদি আবার ওকে বিরক্ত করে, তাহলে সে পুলিশকে জানাবে। আর পুলিশে ওর এক আংকেল বন্ধু আছে। মেয়ে পুলিশেরা সুমিকে কোলছাড়া করতেই চাচ্ছিলো না। পাশাপাশি আফসোস করেছে, এমন মিষ্টি একটা মেয়ে যদি হতো তাদের! কি মিষ্টি করে কথা বলে। ছোট ছোট দাঁত দেখিয়ে হাসি দিলে মাতৃত্ব জেগে উঠে। সে যে হারিয়ে গেছে, এমন কথা মনেই হয়নি সুমির। পুলিশের কাড়াকাড়ি ও আদরযত্নে সময় কেটে গেছে।
সার্জেন্ট ভদ্রলোক যখন ছেলেটাকে নিয়ে ওর বাসায় বা থানায় যাওয়ার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন, তখন খবর পেলেন দুজন বাচ্চা ভাইবোন মিসিং। ছেলেটার নাম আরমান। তিনি আরমানকে আবারও জিজ্ঞেস করে সিউর হলেন, হ্যাঁ ছেলেটার নাম আরমান, হারিয়ে যাওয়া বোনের নাম সুমি। সুমি ইতোমধ্যে থানা হেফাজতে আছে। সার্জেন্ট জানালেন, আরমান আছে তার সাথে।
বাসায় ঢোকার পর সাগর কিঞ্চিৎ কঠিন হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো আরমানকে, কোথায় গেছিলি?
মায়া ওকে সরিয়ে দিলো। বললো, এখন না, প্লিজ।
মায়া রান্নাবান্না করলো সবার জন্য। একসাথে বসে থমথমে মুখে খেয়ে উঠলো। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আরমান ও সুমি নিজেদের রুমে চলে গেলো। মায়া বিছানা করে দিয়েছে। কাজকর্ম শেষ করে সাগর আর মায়া গা এলিয়ে অলস বসে রইলো সোফায়। অনেক ধকল গেছে দুজনের উপর। মানসিক চাপ প্রায় নিস্তেজ করে দিয়েছে দুজনকে। ধীরেধীরে মায়ার মাথা সাগরের কাঁধ স্পর্শ করলো। পরম নিশ্চিন্তে সেখানেই পড়ে রইলো ওভাবেই নীরব বসে রইলো দুজন। বেশ কিছু সময়।
হঠাৎ আরমান ও সুমির রুমের দরজা খুলে গেলো। মহা যন্ত্রণা! ছিটকে সাগর ও মায়া দুই প্রান্তে চলে গেলো। অপ্রস্তুত মুখভঙ্গি। আরমান ও সুমি অপরাধীর মতোন সামনে এসে দাঁড়ালো। মায়া জিজ্ঞেস করলো, কিছু বলবে?
আরমান মাথা ঝাঁকালো। বলবে।
সুমিকে হাত দিয়ে খোঁচা দিতেই সে মুখস্থ পড়া বলছে এমন করে বলতে লাগলো, আমরা বাবাকে অনেক ভালোবাসি! আমাদের বাবা অনেক ভালো। আমরা জানি তুমিও আমাদের বাবাকে ভালোবাসো। আমাদেরকেও অনেক ভালোবাসো। তুমিও অনেক ভালো... তুমি... আমাদের...
পড়া ভুলে গেলে যেমন জড়তা আসে, তেমন আমতা-আমতা করতে লাগলো সুমি। আরমান অধৈর্য হয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেই আংটির বক্সটি বের করে এক হাটু গেড়ে বসে পড়লো। ভাইয়ের দেখাদেখি সুমিও। ভাইয়া ডান হাটু গেড়ে বসেছে দেখে সেও আবার দাঁড়িয়ে ডান হাটু গেড়ে বসলো! আরমান কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি আমাদের আম্মু হবে?
সাগর হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। বাচ্চা দুজনের কান্ডকারখানা দেখে হাসতে হাসতে কাত হয়ে পড়ে যাওয়ার দশা মায়ার! বহুকষ্টে হাসি চেপে রেখে মায়া হাসির দমকে কিংবা আনন্দের আতিশয্যে এসে যাওয়া চোখের জল মুছে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালো। সে রাজি। হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করলো, আমি রাজি হলেই হবে? তোমাদের আব্বুর রাজি হতে হবে না?
আরমান ও সুমি যথাক্রমে মায়া ও সাগরের মুখপানে তাকালো। প্ল্যান করার সময় এই কথাতো মাথায় আসেনি! এখন আবার বাবাকে রাজি করাতে হবে? কিভাবে? এমনিতেই বাবা অনেক রেগে আছেন।
সাগর ওদের নিরীহ মুখ দেখে ঘরদোর কাঁপিয়ে হেসে দিলো! হাসতে হাসতে সে আরমান ও সুমির পাশে একইভাবে হাটু গেড়ে বসে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে এই পরিকল্পনাই করেছিস দুজন মিলে? হাহাহা... মিস মায়াদেবী, আপনি তো ওদের কথা শুনলেন... আমিও রাজি। আর্জি রাখবেন? আপনি কি ওদের আম্মু হবেন? ইয়ে... আমিও আপনাকে... ভালোবাসি আর কি...
মায়ার শরীর অবশ হয়ে গেলো। একইসাথে পিতা ও তার সন্তানেরা ওকে আপন করে চাইছে। অবুঝ দুটো বাচ্চা ওকে মা হিসেবে পেতে চাইছে। কি সুন্দর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। এরচেয়ে উদ্ভট বিয়ের প্রস্তাব আর হয় না! আবারও চোখের জল মুছে সে হাত বাড়িয়ে দিলো। তিনজন মিলে হাতের অনামিকা আঙ্গুলে পরিয়ে দিলো আংটি।
এ যেন এক কঠিন সত্য। করুন সামাজিক পরিস্থিতির নবরুপায়ন