স্বার্থপর
অামার অাট বছরের মেয়েকে নিয়ে বিয়ে বাড়ির সামনে চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে অাছি। বিয়েটা ইতির মায়ের, অামার স্ত্রীর। অামাকে তালাক দিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। ইতি সবকিছু না বুঝলেও এতটুকু বুঝছে ভেতরে কারো বিয়ে। তার চোখে-মুখে কান্নার ছাপ নেই। সে জানেই না তার মা অাছে। নিজের স্ত্রীর বিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছি। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। ইতি বলে উঠলো, 'বাবা তুমি কাঁদছ কেন?' অামি নিজেকে সামলে নিয়ে ইতিকে কোলে নিলাম। ইতি অামার চোখের পানি মুছে দিলো। অামি তাকে জড়িয়ে ধরলাম, শক্ত করে। ইতি বলে উঠলো, 'বাবা, চলো না অামরা বিয়ের বাড়ির ভেতরে যাই।' অামি নিজের চোখের পানিকে অাড়াল করে বললাম, 'না মা, দাওয়াত ছাড়া বিয়ের বাড়িতে যেতে হয় না।' 'অামাদের দাওয়াত দেয়নি কেন বাবা?' 'অামরা যে তাদের অপরিচিত, সেজন্য।' 'ওহ।'
ইতি চুপ করে রইল। তানিয়াকে দূর থেকে দেখছি। পরীর মতো লাগছে। অামার সাথে সংসার করার সময় তাকে তো তেমন কিছু দিতে পারিনি। যার কারণে তার এমন সৌন্দর্য দেখার সুযোগও হয়নি। যা দিয়েছি সেটুকু কষ্ট। অামি শুধু চেয়েছিলাম ছোট্ট একটা সংসার। যে সংসারে টানাপোড়নের মধ্যে ভালোবাসার কোনো কমতি থাকবে না। অফিস থেকে ফিরে অাসতেই ও বলে উঠবে, 'ইশ! ঘেমে গেছ। দাঁড়াও একটু লেবুর শরবত করে দেই।' কিংবা জ্বরে পড়ে থাকলে বলবে, 'চলো না ডাক্তারের কাছে যাই।' অামি নিজেকে সামলে নিয়ে হয়তো বলতাম, 'অারে লাগবে না। এমনিই সেরে যাবে।' সেসময় তার রাগী ভাবটা ফুটে উঠবে, 'বলছি না চলো।' অামি তো সেরকম একটা সংসারের স্বপ্ন দেখেছিলাম। হয়তো এটাই অামার দোষ, অন্যায়। তানিয়া হয়তো অনেক বেশি ধন-সম্পদ কিংবা টাকার স্বপ্ন দেখতো। যে সংসারে থাকবে অনেক টাকা। মাসে দু'তিনবার শপিংয়ে যাওয়া যাবে। সপ্তাহে অন্তত একদিন পার্লারে সাজতেই হবে। পার্টি, ড্রাইভিং কত কী! এতকিছু তো অামি ওকে দিতে পারিনি। যার কারণে ও ওর বাবার কথা শুনতে বাধ্য হয়েছিল। হঠাৎ সুসজ্জিত একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো গেটের সামনে। বর বেশে মধ্যবয়সী লোকটাকে দারুণ লাগছে। হয়তো মধ্যবয়সী লোকটা টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজের বয়সের দিকে তাকানোর সময় পাননি। পাঞ্জাবীতে তার বয়স ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। নাহ! অার দেখতে পারছি না। ইতিকে নিয়ে খুব জোরে হাঁটা দিলাম। যাক অালহামদুলিল্লাহ! অামার জীবনের স্পন্দনকে একনজর তো দেখলাম। . ইতিকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। শুইয়ে দেয়ার অাগে ভাত খাইয়ে দিলাম। মেয়েটাও হয়েছে খুব দুষ্টু। অামার হাতে ছাড়া ভাত খাবে না। ঠিক ওর মায়ের মতো। অামাদের সংসার শুরুর সময়গুলোতে অভিমান করে মাঝেমাঝে বলতো, 'রিফাত, অামি তোমার উপর মন খারাপ করেছি, অভিমান করেছি।' অামি অবাক হয়ে বলতাম, 'কেন? কেন?' 'বলবো না। অার কিছুই খাইনি।' তারপর অামি খাবার নিয়ে এক প্লেটেই খেতাম। অামি ওকে খাইয়ে দিতাম অার ও অামাকে খাইয়ে দিতো। সে সময়গুলোতে ভাবতাম অামার মতো সুখী মানুষ মনে হয় পৃথিবীকে অার দ্বিতীয়টা নেই। ইতি ঘুমুচ্ছে। অামি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কী নিষ্পাপ ঘুম! এতক্ষণে তানিয়া হয়তো অন্যকারোর হয়ে গেছে। তালাক হওয়ার পরেও ভেবেছিলাম, যদি সে অাবার ফিরে অাসে তাহলে সব ভুলে তাকে অামার বুকের মধ্যিখানে ঠাঁই দিবো। কিন্তু শেষ মোমবাতির অালোটুকু নিভে গেল। . বাবার বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল তানিয়া। অামি তখন মেসে একলা থাকি। বাবা-মা ছোটবেলায় মারা গেছেন। পৃথিবী তখন তানিয়া বলতে অার কেউ ছিল না অামার। ছোট্ট একটা জব করতাম। তাতেই হয়ে যেত। সে জবের টাকা দিয়ে দু'জনে টানাটানি করে চলা যেত। তানিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, 'তুমি যদি অাজকেই অামাকে বিয়ে না করো তাহলে অামার অাত্মহত্যা করা ছাড়া অার কোনো পথ খোলা থাকবে না। অামি বাসায় চিঠি লিখে রেখে এসেছি। অামি অার ফিরব না। অামি বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবো না।' সেদিন খুব বিপদে পড়েছিলাম। কী করবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। মেসের এক বড় ভাইকে ব্যাপারটা জানালাম। ভাই তানিয়ার সাথে অামার জোড়া বেঁধে দিলেন। একটা বাসাও ঠিক করে দিলেন। অালহামদুলিল্লাহ খুব ভালো ছিলাম। সুখের কোনো ত্রুটি ছিল না সংসারে। শুধু মাস শেষে একটু টানাপোড়া। সেটাও খুব সহজে মেনে নিয়েছিল সে। হঠাৎ এগারো মাস পর একদিন খুশিতে গদগদ হয়ে অামাকে জড়িয়ে ধরলো। ইতি এমনি তো রোজ জড়িয়ে ধরে। অামি কোনো কথা জিজ্ঞেস করলাম না। শুধু কপালে চুমু এঁকে দিলাম। ও নিজের থেকে বললো, 'জানতে চাইলে না এত খুশীর কারণ কী?' অামার হাসিমুখে বললাম, 'কারণ কী?' ও কানে কানে বললো, 'তুমি বাবা হতে চলেছ।' বলেই মুখটা ঢেকে ধরলো। মনে হচ্ছে খুব লজ্জা পেয়েছে। বাবা হচ্ছি এখবর শুনে খুশিতে রীতিমতো লাফাতে শুরু করলাম। বিছানায় গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। তানিয়াকে কোলে তুলে বললাম, 'জানো, এখন অামার কী করতে ইচ্ছে করছে?' মাথা নাড়িয়ে বললো, 'নাহ।' অামি কানে কানে বললাম, 'তোমাকে অাদর করতে ইচ্ছে করছে।' ও লজ্জা পেয়ে অামার বুকের মধ্যে অালতো করে কিল-ঘুষি দিতে লাগলো। অামি হাসতে লাগলাম। . ইতি অামাদের সংসার অালো করে অাসলো। দেখতে ওর মায়ের মতোই হয়েছে। দেখতে কার মতো হোক, সেটা মুখ্য নয়, ও অামার সন্তান এটাই বড় বিষয়। ইতির জন্মের পর হঠাৎ একদিন অামার শ্বশুরবাড়ির কয়েকজন লোকের অাগমন ঘটলো। অামি অবাক হলাম। গত দেড় বছরে তো এদিনও খোঁজ-খবর নেয়নি। হঠাৎ তাদের দেখে অামি যেমন অবাক হয়েছি তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে তানিয়া। তেমনি খুশিও হয়েছে। নাতনিকে দেখতে এসেছে। বাবা-মাকে কাছে পেয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো তানিয়া। ক্ষমা চেয়ে সব মিটমাট করে নিলো। অামাকে দেখে ত্যাড়া চোখে তাকালো শ্বশুর মশাই। তবুও সেটা সহ্য করে বাজার-সদাই করে অানলাম। তানিয়ার বাড়ির লোকেরা এসেছে বলে কথা। তাদের তো অার অসম্মান করতে পারি না। বাজার-সদাই করে অানার সময় শ্বশুর মশাইয়ের গলার অাওয়াজ শুনতে পেলাম। তিনি বলছেন, 'হ্যাঁ রে তানিয়া, তুই এসি ছাড়া থাকতে পারিস? চুলোয় রান্না করতে পারিস? অামি তো ভাবতেই পারছি না মা।' তানিয়া হেসে হেসে উত্তর দিচ্ছে, 'সহ্য হয়ে গেছে বাবা। ভালোই তো অাছি।' 'কেমন ভালো অাছিস দেখতেই তো পারছি।' শ্বশুর মশাইয়ের নাক সিটকানো দেখে খারাপ লাগলো। উনি উপর থেকে যতই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলুক না কেন, উনি অামাকে মন থেকে মেনে নেননি। সেটা অামি ঢের বুঝতে পারছি। অামার টাকায় অানা খাবার খেলেন না। চলে গেলেন। অামার এতগুলো টাকা অতিরিক্ত নষ্ট হওয়া দেখেও তানিয়ার বিন্দুমাত্র বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। উনারা যাবার পর বাবার প্রশংসা শুরু করলো। ইতির হাতে স্বর্ণের অাংটি দিয়ে দোয়া করেছে নাকি। অাংটিটা দেখছে অার বাবাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছে। অামি তার এহেন কাণ্ড দেখে কিছুই বললাম না। চুপচাপ তার কাণ্ড দেখতে লাগলাম। . কিছুদিনের মধ্যে হাসিমুখে তানিয়া অামাকে বললো, 'বাবা একটা বাসা অামাদেরকে থাকতে দিয়েছেন। ওখানে গিয়ে উঠতে বলেছেন। কিছুদিন পর বাড়িটা অামাদের মেয়ের নামে করে দেবে।' শ্বশুরের বাসায় থাকবো! ব্যাপারটাতে খারাপ লাগা শুরু করলো। এদিকে জোরাজুরি করছে তানিয়া। 'কবে উঠবো সেখানে? দু'তলা বাসা।' অামি অন্যমনষ্ক হয়ে বললাম, 'অামি এখানে থাকবো। তোমার বাবার বাসায় উঠবো না।' সেদিন দু'জনের মধ্যে অনেকক্ষণ ঝগড়া হলো। অামার চোখে পানি চলে এলো। যখন তানিয়া বললো, 'তুমি অামাকে জীবনে কী দিয়েছ? থাকা-খাওয়ার সুখ দিতে পেরেছ কি? এখন অামার বাবা বাসা দিচ্ছেন, তাও নিচ্ছো না।' তানিয়ার কথায় সেদিন অার কিছু বলিনি। চুপ ছিলাম। অামার ধারণা ছিল কিছুক্ষণের মধ্যে তানিয়া ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো অামাকে জড়িয়ে ধরে বলবে, 'ভালোবাসি তোমায়।' কিন্তু কয়েকদিন পর্যন্ত ঠিকভাবে কথা বললো না। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কথা বললো না। ইতিমধ্যে একদিন বাসায় এসি, ফ্রিজ, ওভেন ইত্যাদি দামী দামী জিনিস অাসলো। শ্বশুর মশাই পাঠিয়েছেন। অামি পিকঅাপটার লোককে বললাম, 'কী এসব?' উনি বললেন, 'অাপনার শ্বশুর পাঠিয়েছেন।' 'অাপনি এসব নিয়ে যান। অামার চাই না। অামরা ভালো অাছি।' হঠাৎ তানিয়া বের হয়ে বললো, 'ভাই অাপনি নামান। ঘরে সেট করে দিয়ে যান।' অামি তানিয়ার উপর ভীষণ বিরক্ত হলাম। তাকে বললাম, 'তানিয়া এসব অামি এলাও করবো না।' 'কিন্তু অামি এলাও করবো।' অাবারও ঝগড়া হলো। অামার সাথে রাগ করে বাবার বাড়িতে চলে গেল। ছোট ছোট অভিমানগুলো যেন রাগে পরিণত হলো। দু'দিন পর প্রথম শ্বশুরবাড়িতে অাসলাম। ইতি ঘুমিয়েছে। তানিয়া অামাকে দেখে কোনো কথা বললো না। ভীষণ অাত্মসম্মানবোধে লাগলো। অাগ বাড়িয়ে অামিই কথা বললাম, 'তানিয়া বাড়ি চলো।' গম্ভীর মুখে বললো, 'অামি যাব না।' 'তোমাকে অার ইতিকে ভীষণ মিস করছি অামি।' 'তোমার মেয়েকে তুমি নিয়ে চলে চাও। অামি ওই বাড়িতে ফিরবো না। যদি ফ্লাটে উঠো, তাহলে যাব।' অামি কোনো কথা না বলে ইতিকে কোলে নিলাম। শ্বশুর মশাই হঠাৎ কোথা থেকে যেন অাসলেন। অামি সালাম দিলাম। অামাকে বললেন, 'তানিয়া তোমাকে কী বলেছে শোননি?' 'অাব্বা ও কি অার যাবে না?' 'অাব্বা! কার অাব্বা? তোমাকে অামি জামাই বলে স্বীকার করেছি? ছোটলোকের বাচ্চা।' অামি তিনি গালি দিলেন অথচ তানিয়া কিছুই বললো না। চোখে পানি টলমল করতে লাগলো। কোনদিন অামার ছোট ছোট রাগগুলো তানিয়াকে বিষিয়ে তুলেছে, ভাবতে পারিনি। অামি ইতিকে নিয়ে বের হয়ে অাসলাম। অথচ মেয়েকে তার কাছে রাখার কোনো কথাই বললো না। হায়রে স্বার্থপর মা! কিছুদিন পর তালাকনামার কাগজ পেলাম। তালাকনামার কাগজ পেয়ে নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল অামার। অনেক কষ্টে সাইন করে দিয়েছি। যেহেতু তানিয়া অামাকে চায় না সেহেতু অামি কী করে তার মতামতকে অগ্রাহ্য করি! যদি সে কষ্ট পায়। যত কষ্ট হোক অামারই হোক। . চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। পুরাতন কথাগুলো মনে পড়লো। চোখের পানি গাল গড়িয়ে ইতির চোখে পড়েছে হয়তো। নাহলে ইতি অামাকে কেন বলবে, 'বাবা তুমি কাঁদছ কেন?' অামি নিজেকে ফের সামলে নিলাম। বললাম, 'কাঁদছি না তো মা। তুমি ঘুমাওনি?' 'না বাবা। অামি দেখেছি তুমি কাঁদছিলে।' অামি ইতিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। ইতি জানে ওর মা ওকে জন্ম দেয়ার সময় মারা গেছে। অামিই ওর মা, ওর বাবা। ইতিই অামার স্পন্দন অামার পৃথিবী। ওকে নিয়েই ভালো থাকতে চাই, বাকিটা জীবন।
Comments