সাধ ও সাধের ব্যর্থতা
১৯৮৩ এর মাঝামাঝি সময়। নতুন হলে এসে উঠেছি তখন। একদিন দুপুরে চৌরাস্তার মোড়ে গায়ে সাদা এপ্রোন আর গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে এক অপরিচিত তরুণের নির্বিকার মুখে চায়ের কাপে তিন চামচ চিনি মেশানো দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমি রীতিমতো চেঁচামেচি শুরু করলাম- 'আর এক চামচ চিনি দিলে দুইটা চড় মারবো। চা কি শরবত নাকি?' ছেলেটা আমার দিকে না তাকিয়েই বলল- 'আজ আমার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। মায়ের চেহারাটাও আমি ঠিকমতো মনে করতে পারি না, আমি তখন খুব ছোট। তাও কেন জানিনা এই দিনটাতে কেমন অদ্ভুত একটা কষ্ট হয়। মন ভালো করার জন্য একেকজনের একেকরকম টেকনিক থাকে। আমার এই টেকনিক। চায়ে তিন চামচ চিনি মেশালে মন ভালো হয়ে যায়।'
আমি সেই তরুণের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। সে একবারো আমার দিকে তাকাচ্ছে না। চায়ের কাপ হাতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের দীর্ঘ পাঁপড়ির কোণে একবিন্দু অশ্রু। কি মায়াময় সে ভঙ্গি! আমার হঠাৎ একটা অদ্ভুত ইচ্ছা হলো। হাত বাড়িয়ে চোখটা মুছে দিতে গিয়েও আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। নাহ, সব ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দিতে নেই।
তারপর কেটে গেছে দীর্ঘকাল। সেদিনের সেই তরুণের সাথে আর দেখা হয় নি। এজীবনে আর হয়তো কোনোদিন দেখা হবেও না। সেই তরুণ কোনদিন জানবে না, মন খারাপ হলে আমিও চায়ে তিন চামচ চিনি মেশায়। মাঝরাতে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। মনটা হঠাৎ করেই ভালো হয়ে যায়।
জীবনানন্দের কবিতার মতো আবার পঁচিশ বছর পর সেই তরুণের সাথে দেখা হয় যদি, আমি তাকে বলবো- 'আমাকে দশ মিনিট সময় দিবেন প্লিজ। আমি ছয় চামচ চিনি দিয়ে দুকাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসবো। চা শেষ করে আপনি আমার সামনে বসে কাঁদবেন, চিৎকার করে কাঁদবেন। কান্না চেপে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
ঐ এক বিন্দু অশ্রুতে আমার হৃদয়টা এমন অকেজো করে দিয়েছিলেন কেন ডাক্তারসাহেব? সহস্রকোটি বছর থেকে আমি একটা তীব্র ইচ্ছা বুকে পুষে রেখেছি। আমি শুধু একবার আপনার চোখের জল মুছে দিতে চাই। জীবনের কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নাই।'
Commentaires