সীতা হওয়ার মূল্য কি (Part 2)
সীতার পাতাল প্রবেশ
সীতার সতীত্ব নিয়ে রামরাজ্যে কানাঘুষো শুরু হয়, এখানে ওখানে আলোচনা চলতে থাকে।রামচন্দ্র তার সভাসদ ভদ্রের কাছ থেকে তা জানতে পারেন। ভদ্র বলেন,
“ রাজন! বন, উপবন, দোকান, প্রাঙ্গন এবং পথিমধ্যে পুরবাসীরা যেসকল ভালো এবং মন্দ কথা বলে, আপনি তা শুনুন, ‘রাম সাগরে দুষ্কর সেতু বন্ধন করিয়াছেন, ইহা কি রাজা, কি দানব, কি দেবতা কেহই কখনো শুনে নাই। রাম সৈন্য এবং বাহনের সহিত দুর্ধর্ষ রাবণকে বধ করিয়াছেন, এমনকি ভল্লুক রাক্ষস এবং বানরগণকে আপনার বশে আনিয়াছেন। রঘুনন্দন রাম রাবণকে নিহত করিয়া , রাবণ যে সীতাকে স্পর্শ করিয়াছিল, তার জন্য কিছুমাত্র কুপিত না হইয়া সীতাকে নিজ পুরীতে আনিয়াছেন। রাবণ পূর্বে সীতাকে বলপূর্বক হরণ করিয়া লঙ্কা পুরীতে লইয়া যাওয়া সত্ত্বেও রামের হৃদয়ে সীতা সম্ভোগ জনিত সুখ কি প্রকারে হইতেছে? সীতা রাক্ষসগণের বশীভূত হইয়া অশোক কাননে ছিলেন তথাচ রাম কেন তাহাকে ঘৃণা করেন না?”
রামরাজ্যের নিম্ন মানসিকতার লোকজনের কাছে সীতার অপহৃত হওয়া যেন সীতার নিজেরই অপরাধ! তাই তারা রামের আচরণে বিস্মিত, ‘রাম কেন সীতাকে ঘৃণা করেন না!’ তারা হয়তো জানে না, ইতিপূর্বেই রাম, যার মানসিকতা, চিন্তাধারা তাদেরই মত নিম্নমানের, তিনি সীতার সতীত্ব পরীক্ষা করেই তাকে নিজ গৃহে এনেছেন। কে জানে! তারা জানতেও পারে, রাম নাকি লোকলজ্জ্বার ভয়ে সীতার সতীত্ব পরীক্ষা করেছিলেন! তাহলে এই ঘটনা লোকের অজানা থাকার কথা নয়। তারপরেও রামরাজ্যের তৃতীয় শ্রেণির বসবাসকারীদের অভ্যন্তরীন চুলকুনি শেষ হয় না। তারপরেও তারা বিস্মিত,
” তথাচ রাম কেন তাহাকে ঘৃণা করেন না”
ভদ্রের ভাষ্য অনুযায়ী রাজ্যবাসীরা বলতে থাকে, (অবশ্য, রাজ্যবাসী বলতে অধিকাংশক্ষেত্রেই সেই রাজ্যবাসীরা পুরুষ হয়ে থাকবে যারা এইধরণের কথা বলে)
সীতা রাক্ষসগণের বশীভূত হইয়া অশোকবনে ছিলেন, তারপরেও রাম কেন তাকে ঘৃণা করেন না। রাজা যাহা করেন, প্রজারা তাহারই অনুসরণ করিয়া থাকে, সুতরাং আমাদিগকেও স্ত্রীগণের এরূপ দোষ সহিতে হইবে।“
সীতার অপহৃতা হওয়ায়,রাবণের অশোক কাননে বন্দি থাকায়, সীতার দোষ কোথায় সেটা বোধগম্য হয় না। রাম ও তার রাজ্যের পুরুষেরা নিজেদের চরিত্রের চাইতে তাদের স্ত্রীদের চরিত্র নিয়ে দেখি অতিমাত্রায় চিন্তিত। তারা একের পর এক বিবাহ করেছে; রামের পিতা দশরথেরই বহু পত্নী ছিল। তাদের জন্য পতিতালয়,বারাঙ্গনা,দাসী সবই রয়েছে,তারপরেও তাদের চরিত্র কলুষিত হয় না! আর একজন নারী কোনো পুরুষের নিকট অপহৃতা-বন্দি অবস্থায় থাকায় তার চরিত্র নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ থাকে না! সীতা যদি রাবণ কর্তৃক ধর্ষিতা হতেন, তবে যে রাম ও তার ‘রামরাজ্যবাসীদের’ কিরকম প্রতিক্রিয়া হত তা সহজেই অনুমেয়।সভাসদ ভদ্রের কথা শোনার পর রাম তার ভাইদের ডেকে এনে বলেন,“ তোমরা সকলেই শাস্ত্রার্থ পারদর্শী সুতরাং বুদ্ধি দ্বারা স্থির নিশ্চয় করিয়া আমি যে কথা বলিব তোমরা তাহার অনুসরণ করিবে।“এবার সীতাকে ত্যাগের কারণ হিসাবে, রাম বলেন,
“তোমাদের মঙ্গল হউক, আমার ইচ্ছার অন্যথাচারণ করিও না। পুরবাসীরা সীতার সম্বন্ধে যাহা বলিয়া থাকে তাহা শুন- “ আমি মহাত্মা ইক্ষ্বাকুদিগের মহান বংশে জন্মিয়াছি, সীতাও মহাত্মা জনকের পবিত্রকূলে জন্মিয়াছেন। সুতরাং পুরবাসীরা ও জনপদবাসীরা আমার নামে যে নিরতিশয় অপবাদ দেন, সেই নিন্দাবাদই আমার মর্ম বেদনা দিতেছে। সৌম্য! বিজন দণ্ডকাননে রাবণ যেরূপে সীতাকে হরণ করিয়াছিল এবং যেরূপে আমি তাহাকে বধ করিয়াছি, তাহা তুমি সকলই জান। সেই সময়ে জনক দুহিতা সীতার সম্বন্ধে আমার এরূপ মনে উদয় হইয়াছিল যে, ‘সীতাকে কিরূপে ঘরে লইয়া যাব? লক্ষণ! সীতা তখন পতিব্রাত্যধর্মের পরীক্ষা দিবার জন্য তোমার সাক্ষাতেই অগ্নিমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন; তখন অগ্নি দেবতাগণের নিকটে মৈথেলীকে নিষ্পাপ বলিয়া পরিচয় দিয়াছিলেন। অধিক কি, চন্দ্র, সূর্য এবং বায়ুও পূর্বে দেবতাদিগের নিকটে জানকীর পবিত্রতার পরিচয় দিয়াছিলেন। দেবরাজ মহেন্দ্র লঙ্কাদ্বীপে এইরূপ পবিত্র চরিত্রা সীতাকে আমার করে সমর্পণ করেন। বিশেষত আমার অন্তরাত্মাও সীতাকে শুদ্ধ বলিয়া জানে। এই জন্যই আমি সীতাকে লইয়া অযোধ্যায় আসিয়াছি। কিন্তু পুরবাসী ও জনপদবাসী ব্যক্তিগণের এইরূপ ঘোরতর নিন্দাবাদ শুনিলে আমার হৃদয়ে যৎপরোনাস্তি কষ্ট হইয়া থাকে। দেবগণ অকীর্তির নিন্দা করেন এবং কীর্তি সকল লোকেই পূজিতা হয়, এই কারণে মহাত্মাগণ কীর্তির জন্যই নিয়ত লালায়িত।আমি লোকনিন্দাভয়ে জীবন এবং তোমাদিগকেও পরিত্যাগ করিতে পারি, জানকীর ত কথাই নাই। এক্ষণে তোমরা দেখ আমি কিরূপে অকীর্তির শোকসাগরে পড়িয়াছি। বিশেষতঃ ইহা অপেক্ষা অধিক দুঃখ কোনজীবেই কিছুমাত্র দেখি না।
সীতার সতীত্ব পরীক্ষার পরও রাম পুরবাসীদের নিন্দা অপবাদ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। রামের কাছে নিজের নিরপরাধ পত্নীর চাইতে নির্বোধ পুরবাসীর দেয়া অপবাদ মুখ্য হয়ে ওঠে এবং রামচন্দ্র নিজমুখেই বলেন, “মহাত্মাগণ কীর্তির জন্যই নিয়ত লালায়িত”, কীর্তি রক্ষার খাতিরে এবং অকীর্তি হতে মুক্তির জন্য রামচন্দ্র সীতাকে এমনকি নিজের ভাইদেরও ত্যাগ করতে পারেন! অবতার হিসাবে যেখানে রামের সাধারণ পুরবাসীকে সঠিক পথ দেখানো উচিত, সেখানে রাম পুরবাসীদের পথেই গা ভাসিয়ে দেন। তার কাজকর্ম দেখে আর যাই মনে হউক, কোনো ন্যায়নিষ্ঠ ভগবান একদমই মনে হয় না।
তারপরে রাম লক্ষণকে বলেন, সীতাকে বাল্মীকির আশ্রমে ত্যাগ করে আসতে। এবং এই বিষয়ে লক্ষ্মণকে একপ্রকার বাধ্যই করেন বলা চলে। রাম লক্ষ্মণকে বলেন-
সীতার পরিত্যাগ বিষয়ে কিছুমাত্র দ্বিধা বোধ করিবে না। আমার কথা পালন কর। লক্ষ্মণ এই বিষয়ে কোনোরূপ স্থির না করিয়াই তুমি সীতাকে লইয়া প্রস্থান কর, কেননা আমার এই আদেশমত কার্য না করিলে, আমার প্রতি অবজ্ঞা দেখান হইবে। আমি তোমাদিগকে আমার পাদদ্বয় এবং প্রাণের দিব্য দিয়া বলিতেছি, যাহারা আমার কথায় কিছুমাত্র প্রতিবাদ করিবে, তাহারা আমার অহিতাচারী বলিয়া পরিগণিত হইবে। তোমরা যদি আমার শাসনে থাকিতে চাও তো সমাদরে আমার কথা পালন কর- অদ্যই এখান হইতে সীতাকে লইয়া যাও।
সীতা পূর্বে রামকে বলেছিলেন, তিনি গঙ্গার পাড়ের মুনিদের আশ্রম দেখতে ইচ্ছুক। রাম সীতাকে আশ্রম দেখানোর নাম করে ,সীতাকে সেখানে ত্যাগ করে আসতে বলেন লক্ষ্মণকে।
রামের কথা মত লক্ষ্মণ সীতাকে গিয়ে বলেন,
“ দেবী আপনি পূর্বে মহারাজের নিকট আশ্রম দর্শনের প্রার্থনা করিয়াছিলেন, এতএব আপনাকে আশ্রমে লইয়া যাইবার জন্য আমার প্রতি আদেশ করিয়াছেন সুতরাং দেবী আপনি গঙ্গাতীরে মুনিগণের পবিত্র আশ্রমে অবিলম্বে গমন করুন। আমি রাজার শাসনানুসারে আপনাকে মুনিনিযেবিত তপোবনে লইয়া যাইব।”
লক্ষ্মণের কথা শুনে সীতা অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং লক্ষ্মণের সাথে আশ্রম দেখতে যেতে সম্মত হন।
তারপর লক্ষ্মণ সীতাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। নৌকায় করে তারা গঙ্গা পার হন।
গঙ্গা অতিক্রম করে লক্ষ্মণ সীতাকে বলেন,
“ বৈদেহী! ধীমান আর্য তোমাকে লোকনিন্দিত নিদারুণ এই ক্রুর কার্যে নিযুক্ত করিয়া লোকসমাজে আমাকে নিন্দাভাজন করিয়াছেন। সুতরাং আমার হৃদয়ে সুমহাত শল্য বিদ্ধ হইতেছে। এখন এই অবস্থায় আমার মূর্ছা বা মৃত্যুই শ্রেয়ঃ তথাপি এইরূপ লোক নিন্দিত কার্যে নিযুক্ত থাকা উচিত নহে। সুতরাং শোভনে আমার প্রতি দোষ লইবেন না, আমার প্রতি প্রসন্ন হউন।”
লক্ষ্মণ এইকথা বলে হাতজোড় করে মাটিতে পড়েন।
সীতা লক্ষ্মণের এইরূপ অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন,
“ লক্ষ্মণ! আমি তোমার ক্রন্দনের কোনো কারণই বুঝিতেছি না, সুতরাং কি হইয়াছে যথার্থ করিয়া বল, তোমাকেও অস্বস্ত দেখিতেছি,- মহারাজের মঙ্গল তো? আমার বোধ হইতেছে রাজা তোমাকে অভিসম্পাত করিয়াছেন, তাহাতেই তুমি এইরূপ শোকে অধীর হইতেছ। আমি তোমাকে অনুরোধ করিতেছি আমার নিকটে সকল কথা বল”।
লক্ষ্মণ, সীতার এই কথা শুনে বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে মাথা নিচু করে বলেন,
“জনক তনয়ে! নগরে এবং জনপদে আপনার নিদারুণ অপবাদের কথা সভামধ্যে শুনিয়া রাম সর্বতোভাবে সন্তপ্ত হইয়া আমার নিকট ব্যক্ত করত গৃহে প্রবেশ করিয়াছেন। দেবী রাজা ক্রোধে যেসকল কথা মুখ থেকে বাহির করিয়াছেন, তাহা আমি আপনার নিকটে বলিতে পারিব না।অতএব, সেই সকল কথা বলিতে বিরত হইলাম। দেবী রাজা আমার নিকটে আপনার নির্দোষিতার কথা বলেছেন কেবল পুরবাসী নিন্দাভয়ে আপনাকে পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। সুতরাং আপনি তাহা প্রকৃত বলিয়া মনে করিবেন না। গর্ভিণীর দেহাদপূরণ রাজার আজ্ঞাপালন অবশ্য কর্তব্য । ইহা আমি জানি এই কারণে আমি আশ্রমপ্রান্তে আপনাকে পরিত্যাগ করিয়া যাইব। শুভে! গঙ্গা তীরে মহর্ষি গণের তপোবন, ইহা পরম রমণীয় এবং পবিত্র, সুতরাং আপনি এখানে থাকুন, দুঃখিত হইবেন না। মহাযশা, দ্বিজবর, মুনিপুংগব বাল্মীকি আমার পিতা মহারাজ দশরথের পরম বন্ধু, সুতরাং দেবী আপনি সেই মহর্ষির পাদমূলে উপনিতা হইয়া একাগ্রচিত্তে উপাসনা করত সুখে বাস করুন। দেবী আপনি পাতিব্রাত্য ধর্ম অবলম্বন করিয়া হৃদয়ে সর্বদা রামের ধ্যান ক্রুন, তাহা হইলেই আপনার পরম মঙ্গল হইবে।
সীতা লক্ষ্মণের নিদারুণ কথা শুনে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান। পরে জ্ঞান ফিরলে কাঁদতে কাঁদতে লক্ষ্মণকে বলতে থাকেন,
“লক্ষ্মণ! বিধাতা দুঃখভোগের জন্যই আমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন; সেই কারণে আজ আবার দুঃখরাশি মূর্তিমান হইয়া আমার নিকটে উপস্থিত হইল। বোধহয় আমি পূর্ব জন্মে কোনো মহাপাপ করিয়াছিলাম, কোনো ব্যক্তির স্ত্রীবিচ্ছেদ ঘটাইয়া দিয়াছিলাম! সেই কারণ বশতঃ আমি সতী এবং পবিত্র স্বভাবা হইলেও রাজা আমাকে পরিত্যাগ করলেন। পূর্বে আমি স্বেচ্ছায় বনবাস ক্লেশ সহিয়াও, রামের সহিত রামের পাদচ্ছায়ায় বাস করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলাম। সৌম! এখন আমি প্রিয়জন বিরহে একাকিনী কিরূপে আশ্রমে বাস করিব এবং একান্ত দুঃখিতা হইয়াই বা বিজন বনে কাহাকে নিজের দুঃখের কথা বলিব? প্রভো মহাত্মা রঘুনন্দন রামচন্দ্র তোমাকে কিজন্য পরিত্যাগ করিয়াছেন? তুমিই বা কি অসৎ কার্য করিয়াছ? মুনিগণ এইকথা যখন জিজ্ঞাসা করিবেন, তখন আমি তাহাদিগকে কি উত্তর দিব? লক্ষ্মণ আমার গর্ভে সন্তান রহিয়াছে সুতরাং এক্ষণে প্রাণত্যাগ করিলে আমার স্বামীর বংশলোপ হইবে; তাহা না হইলে আজই জাহ্নবী জলে প্রাণ বিসর্জন করিতাম। লক্ষ্মণ রাজা তোমাকে যেইরূপ আদেশ করিয়াছেন, তাহা তুমি পালন কর, আমি নিতান্ত দুঃখিনী সুতরাং আমাকে অরণ্যে পরিত্যাগ করিয়া রাজ আদেশ পালন কর।”
সীতা চরিত্রের মধ্যে বিন্দুমাত্র বিদ্রোহ পরিলক্ষিত হয় না। এতটা যাতনা সহ্য করার পরেও সীতা প্রতিবাদী হয় না। তার মস্তিষ্কও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সতীত্ব,পতিব্রাত্য ইত্যাদিতে ভরপুর। সীতা নীরবে সব সহ্য করে যান বলেই হিন্দুসমাজে সীতার মত নারীরই কদর রয়েছে, যারা মুখ বুজে সব নির্যাতন সহ্য করে যেতে পারে।
এইবলে একাকিনী সীতা বনের মধ্যে বিলাপ করতে থাকেন।
তখন মুনিকুমারেরা সীতাকে বিলাপ করতে দেখে ঋষি বাল্মীকির কাছে উপস্থিত হন। বাল্মীকিকে সীতার কথা জানালে, বাল্মীকি সীতাকে আশ্রয় দেন।
সীতাকে পরিত্যাগ করে ফেরার সময় লক্ষ্মণ অনুতাপ করে বলেন,
পূর্বে পিতার অনুজ্ঞাক্রমে দণ্ড নামক ঘোর অরণ্যে চতুর্দশ বৎসর বাস করিয়া রাম যে দুঃখ ভোগ করিয়াছিলেন, তাহা তাহার উচিতই হইয়াছিল, কারণ তাহাতে পিতার আদেশ প্রতিপালিত হইয়াছে। কিন্তু পুরবাসীগণের কথায় রামচন্দ্র যে, সীতাদেবীকে পুনরায় নির্বাসিত করিলেন ইহা অতি নৃশংস কার্য বলিয়া মনে করিতেছি। সুমন্ত্র! পৌরগণের অন্যায় কথায় সীতা পরিত্যাগ রূপ কার্য করিয়া রাম কোন ধর্ম রক্ষা করিলেন?
আমাদের মনেও একই প্রশ্ন জাগে-
পৌরগণের অন্যায় কথায় সীতা পরিত্যাগ রূপ কার্য করিয়া রাম কোন ধর্ম রক্ষা করিলেন?
বাল্মীকির আশ্রমে সীতা দুটি পুত্র প্রসব করেন। বাল্মীকি তাদের নাম রাখেন লব ও কুশ।
এভাবে অনেকদিন কেটে যায়। একদিন রাম অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলে তাতে বাল্মীকি ,লব-কুশ ও অন্যান্য শিষ্যদের নিয়ে হাজির হন।
বাল্মীকি লব-কুশকে বলেন রামায়ণ গান করতে। লব কুশ রামায়ণ গান করতে থাকে। লবকুশের রামায়ণ গান শুনে রাম জানতে পারেন লব কুশ তারই পুত্র। রাম তার দূতকে বলেন,
“ তোমরা বাল্মীকির কাছে গিয়ে এই কথা গুলি বল, ‘জানকীর চরিত্র যদি বিশুদ্ধ ও নিষ্পাপ হয় তাহা হইলে তিনি মহর্ষির অনুমতি নিয়ে তার বিশুদ্ধতার পরিচয় দিন। তোমরা মহর্ষি এবং সীতার মনোগত অভিপ্রায় জানিয়া সীতা যদি বিশুদ্ধতার পরিচয় দিতে সম্মত হন, তাহলে শীঘ্র আমাকে আসিয়া বলিবে। তাহলে কাল সকালেই জানকী সভামধ্যে শপথ করুন।“
আবারো রামের মনে সীতার সতীত্ব নিয়ে সংশয় জাগে। তিনি নিজেই লক্ষ্মণকে তার পিতার বয়সি বাল্মীকির আশ্রমে সীতাকে ত্যাগ করে আসতে বলেছিলেন। এখন তিনি সীতা ও বাল্মীকির মধ্যে কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কিনা তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। এই হল দেবতা!এনার চিন্তাধারা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কোনো সাধারণ পুরুষের ব্যতিক্রম নয়! এই অবতারেরা নাকি ধর্ম সংস্থাপন করার জন্য পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন! কিন্তু এরা তো দেখি, নারীদের জীবনকে নরক বানিয়ে রাখার উদ্দেশ্য নিয়েই পৃথিবীতে আসেন!
দূত বাল্মীকির কাছে গিয়ে রামের কথা জানালে বাল্মীকি রামের মনোভাব বুঝতে পেরে বলেন,
“ তোমাদের মঙ্গল হউক, পতিই স্ত্রীলোকের দেবতা সুতরাং রামচন্দ্র যাহা বলিয়াছেন, তাহাই হইবে, সীতা সভামধ্যে শপথ করিবেন”।
পতিই স্ত্রীলোকের দেবতা- এই কথাটির আরেকটি অর্থ করা যায়, পতিরাই (পুরুষেরাই) এইসব পিতৃতান্ত্রিক দেবতাদের স্রষ্টা। তাই তো সেই সমাজের দেবতার চিন্তাধারা পুরুষদের চিন্তাধারার সাথে এতটা মিলে যায়!
যাইহোক, দূত বাল্মীকির কথা গিয়ে রামকে জানান, রাম আনন্দিত হয়ে সভাস্থ মহর্ষি ও রাজাদের বলেন,
“ ভগবন, মহর্ষি গণ ও তাদের অনুচরগণ! আপনারা এবং আর যাহার ইচ্ছা হয় সকলেই সীতাকে শপথ করিতে দেখিবেন”।
নিজের স্ত্রীকে অন্যদের সামনে হেনস্থা করার মত পৈশাচিক আনন্দ কেবল রামই জানবেন!উনিই এরূপ কাজ বারে বারে করতে পারেন।
রামচন্দ্রের এই কথা শুনে মহর্ষিরা সাধু সাধু বলে ওঠেন, মহাবল রাজারা রামচন্দ্রের প্রশংসা করে বলেন,
“ এইরূপ কার্য আপনাতেই সম্ভবপর হইতে পারে”।
আহা কি মহৎ কার্য! স্ত্রীজাতির এরূপ অবমাননা, হেনস্থার অপেক্ষা মহৎ কার্য আর কি হতে পারে! সাধু! ঋষিগণ সাধু!
যাইহোক, ঋষিরা বিদায় নিলে পরদিন প্রভাতে রামচন্দ্র বশিষ্ট, জাবালি, কশ্যপ, বিশ্বামিত্র, দুর্বাসা, নারদ সকলের সাথে উপস্থিত হন। নানান স্থানের লোক একত্রিত হন সীতার সতীত্ব পরীক্ষা দেখবে বলে। সবাই উপস্থিত হলে পরে বাল্মীকি সভায় উপস্থিত হন এবং সীতা রামকে মনে মনে স্মরণ করতে করতে বাল্মীকির পেছন পেছন সভায় উপস্থিত হন। বাল্মীকি রামকে সকলের সামনে বলেন,
“দাশরথি রাম, সীতা পতিব্রতা ধর্মচারিণী হইলেও তুমি লোকনিন্দার ভয়ে ইহাকে আমার আশ্রমে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, কিন্তু মহাব্রত! তুমি লোকাপবাদ ভয়ে ভীত , অতএব লোকাপবাদ যাতে দূর হয় তিনি এমন প্রত্যয় দিবেন, তুমি তাকে অনুমতি দাও। রাম আমি সত্য বলিতেছি, জানকীর গর্ভ জাত দুর্ধর্ষ যমজ তোমারই তনয়। আমি শপথ করিয়া বলিতেছি সীতা যদি দুশ্চরিত্রা হন তবে আমি বহুসহস্র বৎসর ধরিয়া যে তপস্যা করিয়াছি তাহা নষ্ট হবে। জানকী যদি নিষ্পাপা না হন , তাহলে আমি কায়মনোবাক্যে যে পাপকর্ম করি নাই তাহার বল পাব। রাম, সীতার পঞ্চভূতের সমষ্টিরূপ মন শরীর এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে বিন্দুমাত্র পাপ নাই,ইহা আমি বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিয়াই ইহাকে আমার আশ্রমে স্থান দিয়াছিলাম। তুমি লোকাপবাদভয়ে ভীত হইয়াছ বলেই এই শুদ্ধচারিণী নিষ্পাপা পতিদেবতা সীতা আজ তোমার সম্মুখে প্রত্যয় করিবেন”।
বাল্মীকির কথা শোনার পরেও সীতার সতীত্ব পরীক্ষার জন্য জোর দিয়ে রাম বলেন,
“ মহাভাগ! হে ব্রহ্মজ্ঞ! আপনি যা বললেন, সেইরূপই বটে। আপনার নির্মল বাক্যে আমার বিশ্বাস হইয়াছে। ব্রহ্মন! বৈদেহী পূর্বেও দেবগণের সমক্ষে প্রত্যয় প্রদান এবং শপথ করিয়াছিলেন বলিয়াই আমি ইহাকে গৃহে আনিয়াছিলাম। ব্রহ্মন! লোকনিন্দা অতি বলবান, সেই ভয়েই আমি সীতাকে নিষ্পাপা জানিয়াও পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। এক্ষণই আপনি আমার অপরাধ ক্ষমা করুন। এই যমজাত কুশ এবং লব যে আমারই পুত্র তাহাও আমি জানি,তথাপি বৈদেহী ত্রিভুবনবাসী সকলের নিকট বিশুদ্ধা বলিয়া পরিচিতা এবং আমার প্রীতিভাজন হউন।
সীতার সতীত্ব-পরীক্ষা দেখতে সকলেই উপস্থিত হয়েছেন দেখে রাম পুনরায় বলতে থাকেন,
“ দেবগণ! মহর্ষি গণ! রাজাগণ! মুনিবরগণ! যদিও বাল্মীকির নির্মল বাক্যে সীতার বিশুদ্ধতা বিষয়ে আমার অনুমাত্রও সন্দেহ নাই তথাপি আপনারা সকলে ইহার শপথ দেখিতে আসিয়াছেন সুতরাং সীতা আপনাদের নিকটে বিশুদ্ধ বলিয়া পরিচিত হইয়া আমার প্রীতি প্রার্থী হউন।
“মহর্ষি! রাজাগণ! সীতা এক যন্ত্রবিশেষ। এই যন্ত্রের নাম সতীযন্ত্র। এই যন্ত্রের সুইচ টিপে দিলেই বারে বারে সতীত্বের পরীক্ষা দেখানো শুরু করে দেয়! আর আপনারা সকলে যখন সীতারূপ সতীযন্ত্রের শপথ দেখতে এসেছেনই,তখন সেই শপথ দেখেই যান! আমি সুইচ টিপে দিলাম”- রাম হয়তোবা এইজাতীয় কিছুই বলতে চাইছিলেন!
সীতা সকলকে উপস্থিত দেখে নতমুখে ভূতলে তাকিয়ে করজোড়ে বলতে থাকেন,
“ আমি রাম ভিন্ন অন্য কাহাকেও কখনো মনেও স্থান দিই নাই, এই সত্যবলে ভগবতী বসুন্ধরা আমাকে তাহার গর্ভে বিবর দান করুক। আমি কায়মনোবাক্যে সতত কেবল রামেরই অর্চনা করিয়াছি। সেই সত্যবলেই ভগবতী বসুন্ধরা আমাকে তার গর্ভে স্থান দান করুক।”
সীতা এরূপ শপথ করলে পৃথিবী বিদীর্ণ হয়, পাতাল থেকে এক সিংহাসন উঠে আসে। সীতা সেই সিংহাসনে আরোহণ করে রসাতলে (পাতালে) প্রবেশ করেন।
Comments