সংগ্রামের অগ্নিযুগ
ভারতবর্ষে তখন স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিযুগ। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকীদের আত্মোৎসর্গের ঘটনায় সারা দেশের অসংখ্য তরুণের চেতনায় জাগ্রত হয়েছিল বৃটিশদের অধীনতা থেকে ভারতমাতার শৃঙ্খল মোচনের আকাঙ্ক্ষা। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম সম্ভবপর নয় মনে করে বেশ কিছু মানুষ যখন স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন, তখন পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে অনড় বিপ্লবীরা। ‘যুগান্তর’, ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রভৃতি সংগঠনের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে, বৃটিশদের এদেশ থেকে তাড়ানোর জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন ভারতমাতার বীর সন্তানরা। নিজেদের জীবনের বিনিময়ে সারা ভারত জুড়ে বিপ্লবীদের বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে ইংরেজরা তখন ভীষণভাবে তটস্থ। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে ইংরেজদের অনুগত বাহিনীর দমন-পীড়ন এবং তাদের কিছু ভারতীয় দালালদের তৎপরতা। আলীপুর ও মুরারীপুকুর বোমা হামলাসহ অন্যান্য মামলায় ইংরেজ সরকার পক্ষের উকিল ছিলেন আশুতোষ বিশ্বাস। বিভিন্ন বিপ্লবীর শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য ইংরেজের পক্ষ নিয়ে শুধুমাত্র সওয়াল-জবাব করেই ক্ষান্ত হতেন না 'আশু উকিল', তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহে নিজেই আগ্রহী হয়ে কাজ করতেন বৃটিশদের একনিষ্ঠ ভক্ত এই কুখ্যাত আইনজীবী। তার দাপ্তরিক কাজের বাইরেও স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে বৃটিশ পুলিশকে বিভিন্ন রকম সহায়তা করতেন স্বদেশী আন্দোলনকারীদের ধরার জন্য। আশু উকিলের এই জঘন্য কর্মকাণ্ড, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকা হিসেবে পরিগণিত হয়। তিনি 'বিশ্বাসঘাতক' বলে বিপ্লবী মহলে পরিচিতি পান। ক্রমেই বঙ্গজ বিপ্লবীদের ত্রাস হয়ে উঠলেন আশুবাবু। সিদ্ধান্ত হয়, বৃটিশদের দালাল আশু উকিলকে, তার কৃতকর্মের ফল পেতেই হবে। কিন্তু করবে কে কাজটা? দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে, দেশদ্রোহী আশু উকিলকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য এগিয়ে এলেন জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধী শীর্ণকায় দুর্বল শরীরের ২০ বছরের তরুণ বিপ্লবী চারুচন্দ্র বসু।
১৮৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চারুচন্দ্র বসু জন্মগ্রহণ করেছিলেন খুলনা জেলার (অধুনা বাংলাদেশ) ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা গ্রামে। তার বাবার নাম ছিল কেশবচন্দ্র বসু। চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় চারু বসুর ডান হাতটি ছোটবেলা থেকেই ছিল হাঁসের পায়ের পাতার মতো, অসার। খর্বকায়, অসুস্থ, ছিপছিপে পাতলা দেহগড়নের এই তরুণ স্বভাবে ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, ক্ষুরধার ও প্রতিবাদী। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, চারুচন্দ্রের জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। কি ভাবে তিনি বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্বেও কি ভাবে রিভলবার ছোঁড়ার শিক্ষা নেন, কোন বিপ্লবী সংগঠনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন, এসব কোনও তথ্যই তাকে নিয়ে পাওয়া যায় না! যতদূর জানা যায়, চারু হাওড়ায় একটি প্রেসের সাধারণ কর্মী ছিলেন। চারুর দাদা শৈলেন্দ্রনাথ বসু বগুলা স্টেশনের বুকিং ক্লার্ক ছিলেন। চারু নিজে কলকাতার রসা রোডে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকলেও প্রায়ই বগুলা যেতেন। সেই সময় বাঘাযতীন কলকাতা থেকে কুষ্ঠিয়া যাতায়াত করতেন। বগুলা ছিল কলকাতা থেকে কুষ্ঠিয়ার মধ্যবর্তী একটি স্টেশন। তাই বাঘাযতীনের সাথে খুব সম্ভবত তার যোগাযোগ ছিল। যদিও পুলিশের রিপোর্টে কোন নেতাকেই চারুর মন্ত্রনাগুরু বলা হয়নি...
১৯০৯ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি, তেরো বছরের কিরণবালার সাথে চারুচন্দ্র বসুর বিয়ের দিন হিসাবে স্থির হয়েছিল। কিন্তু সংসারী হবার কোনও বাসনা ছিল না তার। নিজের লক্ষ্যে অবিচল, চারুচন্দ্র বিয়ে করেন নি। তিনি চান নি যে, তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় এক নারীর উপরে কোনও কলঙ্কের দাগ লাগুক। হবু স্ত্রীকে স্বাধীনতা সংগ্রামের কঠিন পথে চলার কথা বলে বিয়ের নির্ধারিত দিনের আগেই তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। ১০ই ফেব্রুয়ারি, সাধারণ গ্রাম্য যুবকের বেশে গায়ে চাদর জড়িয়ে আলিপুর আদালতে উপস্থিত হন সকালবেলায়। তার আগেই নিজের পঙ্গু ডান হাতে খুব শক্ত করে বেঁধে নিয়েছেন একটা লজঝড়ে ওয়েবলি মার্ক ফোর রিভলবার। তিনি তার লক্ষ্য ও উপযুক্ত সময়ের জন্য প্রবল ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন আমজনতার ভিড়ে। সাজ এত নিখুঁত হয়েছে, সন্দেহ করার কোন কারন খুঁজে পায়নি আদালতের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো পুলিশও। অবশেষে বিকেল চারটের দিকে আদালতের পশ্চিম দিকে চারুচন্দ্র দেখতে পেলেন আশু উকিলকে। ছুটে গেলেন তরুণ চারু, যমদূতের মত দাঁড়ালেন তার সামনে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাম হাত দিয়ে নির্ভুল নিশানায় ট্রিগার চাপলেন চারু। চাদরের নীচে থাকা রিভলবার গর্জে উঠলো। বুলেট গিয়ে বিঁধলো আশু উকিলের ডান কাঁধে। গুলিবিদ্ধ হয়ে হতচকিত ও আহত আশু প্রাণভয়ে 'বাঁচাও বাঁচাও' বলে তারস্বরে চিৎকার করতে করতে দৌড়াতে থাকেন।ঘটনার আকস্মিকতায় ও প্রাণভয়ে আদালতে থাকা ব্যক্তিরাও তখন নিজেরাই পালাতে ব্যস্ত। কিন্তু বেশি দূর দৌঁড়াতে পারেন নি আশু উকিল। আশু উকিলের পিছু নিয়ে আবার গর্জে উঠেছিল চারু বসুর চাদরের নীচে পঙ্গু ডান হাতে বেঁধে রাখা রিভলবার। এবারে লক্ষ্যে অব্যর্থ। দ্বিতীয় বুলেট, আশুর হৃদপিন্ড ফুঁড়ে দেয়, ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে বিশ্বাসঘাতক আশু উকিলের। ততক্ষণে সশস্ত্র পুলিশবাহিনী ঢুকে পড়েছে আদালত চত্বরে। চারু বিশ্বাস পালানোর বা পাল্টা আক্রমণের কোনও চেষ্টা করেন নি। ঘটনাস্থলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। চারুচন্দ্র বসুর মুখে তখন তৃপ্তি আর যুদ্ধ জয়ের হাসি।
বৃটিশ সরকার চারুচন্দ্র বসুকে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করে। বিপ্লবীদের সম্পর্কে তথ্য বের করার জন্য জেলখানায় তার উপর ভয়ানক রকম অকথ্য নির্যাতন চালানো হলেও, শারীরিক প্রতিবন্ধী চারুচন্দ্র সেই নির্মম শারীরিক নির্যাতন মুখ বুঁজে সহ্য করেছিলেন। তার কোনও সহকর্মী এবং সংগঠন সম্পর্কে একবিন্দু তথ্যও তার মুখ থেকে বের করতে পারেনি বৃটিশ পুলিশ। শারীরিক দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কোন রকম অনুকম্পা প্রার্থনা না করে বরং সর্বদা নিজের আদর্শের প্রতি সুগভীর আস্থা রেখেছিলেন। কম বয়স ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করে তার আইনজীবী বলেছিলেন, "তুমি অস্বীকার করবে যে, তুমি খুন করোনি।" কিন্তু স্বাধীনতার উদগ্র বাসনায় টগবগে তরুণ চারুচন্দ্র বসু আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেন, "ওই আইনজীবী দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধী, বিপ্লবীদের বিপক্ষে কাজ করছেন। তিনি দেশের শত্রু, তাই আমি তাকে হত্যা করেছি।" আলিপুর আদালতে ২৪ পরগণা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাম্পসকে লক্ষ্য করে চারুচন্দ্র বসু চিৎকার করে বলেছিলেন, "না কিছুই আমি চাইনে। কোনো সেশন-টেশনের প্রয়োজন নেই। বিচার করে কালই আমাকে ফাঁসি দাও। এটা ভবিতব্য ছিল যে, আশবাবু আমার গুলিতে নিহত হবেন এবং আমি ফাঁসিকাঠে প্রাণ দেব দেশের জন্য।"
বিচারের নামে প্রহসন করে বৃটিশরা। খুব দ্রুততার সাথে সম্পন্ন হয়েছিল তার বিচারপর্ব। ১৫ই ফেব্রুয়ারী আলিপুর কোর্টের বিচারক এফ.আর.রো তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। ১৯০৯ সালের ১৯ শে মার্চ মাত্র ২০ বছর বয়সে ফাঁসির দিন ধার্য হয় চারুচন্দ্র বসুর। তার বাড়ির লোকেরা শেষ একটা চেষ্টা করেছিলেন। ১৯০৯ সালের ২রা মার্চ, তার বিচার হাইকোর্টে তোলা হয়। তার পক্ষের উকিল তাকে জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধী দেখিয়ে, এই হত্যাকাণ্ড তার পক্ষে সম্ভব নয় বলে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চারুচন্দ্র ছিলেন নিজের বক্তব্যে অটল। কিছুতেই তিনি তার বক্তব্য পরিবর্তন করেন নি। হাইকোর্টও আলিপুর আদালতের রায় বহাল রাখে। ১৯০৯ সালের ১৯ মার্চ আলিপুর কেন্দ্রীয় জেলখানায়, ঊনিশ বছর এক মাস বয়সের এই দেশপ্রেমিক মৃত্যুঞ্জয়ী বিপ্লবীকে বৃটিশ সরকার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
"ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান"-এর দীর্ঘ তালিকায় যুক্ত হল চারুচন্দ্র বসুর নাম। ক্ষুদিরাম বসু , কানাইলাল দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পর তিনিই ছিলেন চতুর্থ বাঙালি বিপ্লবী, যিনি দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জন্য ফাঁসিতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। আজ কেউ মনে রাখেনি তার কথা! চারুচন্দ্র বসু একা নন, তার মত এমন যে কত নাম-না-জানা, না-দেখা, না-চেনা... যারা অগ্রপশ্চাৎ ভাবেননি দেশের জন্য হাসতে হাসতে জীবন বাজি রাখার আগে, হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অন্তরালে। যাদের ছিল না অমরত্বের প্রত্যাশা, ছিল না ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়ার সুপ্ত বাসনা। যাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে ধারাবাহিক কার্পণ্য করেছে ইতিহাসও। তাই 'অগ্নিযুগের বিপ্লবী' চারুচন্দ্র বসুর চরণে আমার এই প্রণাম...
তথ্যসূত্র :- (১) "সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান", সুবোধ সেনগুপ্ত ও ও অঞ্জলি বসু। (২) "জেলে ত্রিশ বছর, পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম", ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। (৩) "বাঙলার বিপ্লবী পটভূমি", আহমদ শরীফ। (৪) "অগ্নিযুগের বিপ্লবী মামলা", চিন্ময় চৌধুরী। (৫) "অগ্নিযুগের স্বাধীনতা সংগ্রাম", রূপময় পাল।
Hozzászólások