শেখ মুজিবই পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যেতে বলেছেন !
পার্বত্য চট্টগ্রামকে নাকি সামরিকায়ন করে অস্থির এলাকা করেছে জিয়াউর রহমান!!! এবং এটাই নাকি পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সকল সমস্যার মূলে!!
এই পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সমস্যার শুরু তো কাপ্তাই জলবিদ্যুত কেন্দ্র বানানো নিয়ে ব্যাপক হারে চাষযোগ্য জমি তলিয়ে যাওয়া এবং হাজার হাজার পাহাড়ির উদ্বাস্তু হওয়া থেকে। ১৯৫৬ সালে যখন আমেরিকার অর্থায়নে নির্মিত হতে শুরু করে, তখন শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতিরোধ এবং গ্রামীণ সহায়তা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ২৩০ মেগাওয়াট। এটা ময়মনসিংহ গ্যাস টারবাইন বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুতের সমান। এই বিদ্যুত এতো কম সেটা বুঝার জন্য বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমান ২২,০৫৯ মেগাওয়াটের সাথে তুলনা করেন। আমাদের কি সত্যিই এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দরকার আছে?
এবার আসেন তাঁদের দ্বিতীয় অসন্তোষের শুরু কোথায় সেটা দেখি। বাংলাদেশকে বাঙালির রাষ্ট্র বানাতে চাওয়া আর তাদের উপর সেই বাঙালিয়ানা চাপায় দিতে চাওয়াটা থেকেই দ্বিতীয় অসন্তোষের শুরু। শেখ মুজিবই পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যেতে বলেছিলেন। এটা করেছেন তো আপনারাই যারা হাজার বছরের বাঙালিত্ব সেলিব্রেট করেন। আর আপনারাই তো বলেন ১৯৭২ সালের সংবিধান নাকি ম্যালা প্রগতিশীল সংবিধান?
এবার আসেন সামরিকায়ন প্রসঙ্গ। এই সামরিকায়ন করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। এটা বুঝার জন্য ভারত পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কী কী কৌশলগত চিন্তা আছে সেটা নিয়ে আলোচনা করা দরকার।
মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই ভারত বরাবর মনে করতো, পার্বত্য চট্টগ্রামে নাগা ও মিজো সংগঠকরা যে লুকিয়ে আছে তারা পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সহায়তায় কাজ করে। এর পাল্টা কর্মসূচী হিসেবে পূর্ব-পাকিস্তানকে দেশটির মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে নিজস্ব গোয়েন্দাদের সবুজ সংকেত দেয় ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা। ‘র’-এর কর্মকর্তা বি. রমন এ সম্পর্কে বলেছিলেন, “পূর্ব-পাকিস্তান থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আইএসআই’র চালানো কার্যক্রমের অবসান ঘটাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব-পাকিস্তানের বাংলাভাষীদের পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সহায়তার সিদ্ধান্ত নেন।”
ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একটা বিশেষ বাহিনী তৈরি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম দিয়ে তাঁদের অপারেশনে পাঠিয়েছিল। এই বাহিনীর নাম ছিল স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স। জেনারেল উবান ছিলেন এই ফোর্সের প্রথম ইন্সপেক্টর জেনারেল। ১৯৬২ সালের শেষ দিকে এই ফোর্স গড়ে ওঠে। এই জেনারেল উবানই ছিলেন মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষক।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চূড়ান্ত অপারেশনের সময় কেবল মুজিব বাহিনী নয়, স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স নামের সেই আন-কনভেনশনাল আরেকটি ফোর্সকেও ভারতীয়রা পার্বত্য চট্টগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করায়। এই ফোর্সের দায়িত্ব ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারত নিয়ন্ত্রিত মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের খুঁজে বের করা এবং নিশ্চিহ্ন করা।
এই স্পেশাল ফোর্স গড়ে ওঠার সময় সমস্ত আর্থিক, অবকাঠামো ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দিয়েছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। দেরাদুনের অবকাঠামোর প্রায় সবই সিআইএ’র সহায়তা তৈরি হয় মূলত ওই স্পেশাল ফোর্সকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যই। স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম দিয়ে অভিযান শুরু হয় নভেম্বরের শেষে।
বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী চলে যাওয়ার সময় তাদের একটি ব্রিগেড রেখে দেয়া হয়েছিল কক্সবাজারে এবং ওই ব্রিগেড ১৯৭২ সালের জুলাই পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘অপারেশন’ চালিয়ে তবেই দেশে প্রত্যাবর্তন করে। কক্সবাজারে ভারতীয় একটি ব্রিগেডের উপস্থিতি গোপন রেখেই বাহাত্তরের ১২ মার্চ জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে সব ভারতীয় সৈন্য চলে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুদিন পর মার্চের শেষে এই বিষয়টি গণমাধ্যমে নিয়ে আসেন তরুণ এক মার্কিন সাংবাদিক। সরকার প্রথমে গণমাধ্যমের ওই প্রতিবেদনের সত্যতা অস্বীকার করলেও পরে অধিকতর বিব্রত অবস্থা এড়াতে পূর্বতন ভাষ্য প্রত্যাহার করে নেয়।
যখন ভারতের সাথে আমাদের ২৫ বছর সো-কল্ড বন্ধুত্ব চুক্তি বলবৎ ছিলো, তখন ভারত চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে শান্তিবাহিনীকে সামরিক সহায়তা এবং আশ্রয় দেয়। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ভারতের সব সময়েই সামরিক কৌশলগত ইন্টারেস্ট আছে। সেকারণেই ইন্ডিয়ার মাউথপিস বাংলাদেশের সো-কল্ড বাম ও স্যেকুলারেরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে বিচ্ছিন্ন হতে চাওয়া জাতিগোষ্ঠির আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্খা হিসেবে তুলে ধরতে চায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা এটা নয় যে তাঁরা বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় আর বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাঁদের জোর করে ধরে রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা কাপ্তাই জলবিদ্যুত কেন্দ্রের কারণে জমি হারানো আর ভারতের অব্যাহত সামরিক উস্কানি। এখানে জিয়াউর রহমান কোথা থেকে আসেন?
পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টা স্বতন্ত্র উপজাতির শতাধিক গোত্র আছে এবং সংখ্যায় তাঁরা পাঁচ লক্ষের কম। কেবল নিজেরাই পণ্য বানাবো আর সেই পণ্য নিজেরাই কিনব – এমন বুদ্ধির ইকোনমি একটা আলাদা রাষ্ট্র বানায়ে এই জনসংখ্যায় টিকানো অসম্ভব। এরচেয়ে পাহাড়ি-সমতলি পণ্য বিনিময়ের একটা অর্থনীতিতে ৫ লাখ পাহাড়িরা পেতে পারে ১৬ কোটির ভোক্তা বাজার। যে কোন পাহাড়ি পণ্যের ক্ষেত্রে একথা সত্য।
ট্রাইব্যাল সিস্টেমে চলা একটা অতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি একটা রাষ্ট্র গড়ার লড়াই করতেছে এই কষ্ট কল্পনা বাংলাদেশের বেকুব বাম আর সেক্যুলার ছাড়া আর কেউ করবেনা। কারণ এরা তো রাষ্ট্র বিষয়টাই বুঝেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কি সমস্যা নাই? আছে, অবশ্যই আছে। পাহাড়িদের প্রেফারেন্স বা প্রায়রিটি নিশ্চিত করার একটা দিক আছে যেটা নিয়ে কাজ করতে হবে। অবশ্যই পাহাড়িরা বলতে পারেন, আপনাদের এলাকায় খোদ আপনারাই যেন মারজিনালাইড না হয়ে যান। নির্ধারক সাংস্কৃতিক আধিপত্য যেন কমে না যায়; সংস্কৃতি যেন রক্ষা পায়, বৈষ্যমের শিকার যেন না হন, মানবাধিকার যেন লংঘন না হয়। সবাই আছে এটার সাথে।
সমাধান একটাই, আমরা একসাথে বসে যেই ভবিষ্যতের রিপাবলিক বানাবো সেই রিপাবলিকে সম নাগরিক অধিকার নিয়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী থাকবে। সেজন্য তো ডায়ালগ করতে হবে, সমতলের রাজনৈতিক শক্তির সাথে ভাব দেয়ানেয়া করতে হবে। সেটা না করে শুধু দাবী করলে তো চলবেনা যে একমাত্র তাঁদের বাতলানো পথেই সমাধান করে দিতে হবে। বাস্তবে সেটা হবেও না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন সমস্যাই থাকবে না, যদি কোন হৃদয়বান এবং বুদ্ধিমান রাষ্ট্রনায়ক আর পাহাড়িরা আন্তরিকতা আর বাস্তববুদ্ধি নিয়ে সো-কল্ড বেকুব সেক্যুলার, বাম আর ইন্ডিয়ার উস্কানিকে পাত্তা না দিয়ে সমস্যার সমাধানে অগ্রসর হন।
জোতির্ময় বড়ুয়ারা বলেছে, যারা কাশ্মীর নিয়ে কথা বলে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে জানতে চায়না। জোতির্ময় বড়ুয়ারা নিজেরাই কি পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিয়ে জানেন?
Comments