যারা বিবর্তন চাক্ষুস দেখতে চান
অনেকেই বলেন তাহলে বিবর্তন আমরা এখন দেখি না কেন? ডারউইন বলেছিলেন প্রাকৃতিক নির্বাচনের কথা। তাতে সময় লাগে হাজার/লক্ষ/কোটি বছর। বিজ্ঞানীরা সেটাকে তরান্বিত করতে ব্যবহার করছেন কৃত্রিম নির্বাচন। প্রাকৃতিক নির্বাচন ও কৃত্রিম নির্বাচনের ভিতরে জিনগত প্রক্রিয়ার কোন পার্থক্য নেই। নির্বাচন প্রক্রিয়াটিকে তখনই ‘কৃত্রিম’ বলা হয় যখন কোন নির্দিষ্ট প্রজাতির বিবর্তনে মানব সংশ্লিষ্টতার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকে। মানুষ কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে যে বিবর্তন ঘটাচ্ছে তা হয়তো কখনোই হতো না। মানুষ শুধু প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করেই নিজেদের স্বার্থে প্রয়োজনীয় বিবর্তন ঘটাচ্ছে। কয়েকটি উদাহরণ দেখতে পারি-
নাইলোটিকা মাছ
নাইলোটিকা বা গিফট তেলাপিয়ার সম্পূর্ণ নাম—জেনিটিক্যালি ইম্প্রুভড ফার্মড তেলাপিয়া। প্রকৃতিগতভাবেই পুরুষ নাইলোটিকা মাছের দৈহিক বৃদ্ধির হার বেশি। এ ধারণাকেই কাজে লাগিয়ে হরমোন প্রয়োগ করে হ্যাচারির সব নাইলোটিকাকে পুরুষে রূপান্তরিত করে গিফট মাছ তৈরি করেছেন মৎস্যবিজ্ঞানীরা। গিফট তেলাপিয়ার জাতটি বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত তেলাপিয়া নাইলোটিকার ৮টি জার্মপ্লাজমের মধ্যে পুঞ্জীভূত নির্বাচন (mass selection) পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে World Fish Centre কর্তৃক ফিলিপাইনে প্রথম উদ্ভাবন করা হয়েছে। এই ধারাতেই বেশ কিছু কার্ফু মাছ, পাংগাস, পাবদাসহ বিভিন্ন জাতের মাছের জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে উচ্চ ফলনশীল মাছ তৈরি করা হয়েছে পরীক্ষাগারে। তাতে লবণ পানির মাছ চাষ হচ্ছে মিঠা পানিতে।
ব্রাহমা গরু
একেকটি গরুর ওজন ১ টনের বেশি। কিভাবে এই দানবাকৃতির গুরু উৎপাদন করা হল মাংশের জন্য। ১৮৫৪ সাল থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ২২৬ টি ষাঁড় ও ২২টি গাভীর মধ্যে ধারাবাহিক ক্রস ঘটিয়ে এবং জিনেটিক পরিবর্তন ঘটিয়ে কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমেই তৈরি করা হয়েছে ব্রাহমা জাতের গরু। এখন আরো উন্নত ও বেশি মাংস উৎপাদনের প্রচেষ্টায় আসছে আরো নতুন নতুন প্রজাতি। ব্রাহমা জাতের গাভীতে আনুপাতিক দুধ হয় না। আবার দুধের জন্য বিবর্তন ঘটানো হয়েছে গাভীর। আজ বিভিন্ন জাতের গরুতেই ৩০/৪০ কেজি দুধ হচ্ছে যা কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে ও জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে অর্থাৎ কৃত্রিম বিবর্তন ঘটানোর কারণেই সম্ভব হয়েছে।
বয়লার মুরগি
বয়লার মুরগি কি প্রকৃতিতে ছিল? এতো ভারী ও ধীর গতির কোন মুরগিই প্রকৃতিতে বাঁচবে না।সবচেয়ে মাংশল ও সবচেয়ে ধীর গতির মুরগির ক্রস করতে করতে, জিনেটিক পরিবর্ত ঘটাতে ঘটাতে আজকের বয়লার মুরগি। অর্থাৎ তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে প্রচন্ড নির্বাচন এবং বংশগতি ধারার বিশেষ ক্রম অনুসারে। পাঁচ থেকে সাত সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা থেকে মাংসের জন্য উপযোগী ব্রয়লার মুরগি তৈরি হচেছ খামারে। পৃথিবীতে এখন মুরগির সংখ্যা মানুষের কয়েকগুণ হবে। কিন্তু বনে জঙ্গলে বন্য মুরগি/মোরগ কয়টা আছে? এখন বাড়িতে মুরগি পালনের প্রচলনও অনেক কমে গেছে। পঞ্চাশের দশকে কৃত্রিমভাবে মুরগির আকৃতি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই থেকে ওজনে ও আকৃতিতে মুরগির অবিশ্বাস্য পরিবর্তন হয়েছে।
হরি ধান
ঝিনাইদহের কৃষক হরিপদ কাপালী নিজের ধান ক্ষেতে একটি ধানের ছড়া দেখলেন যার গোছা বেশ পুষ্ট, দীর্ঘ ও গাছের সংখ্যা বেশি। ধান পাকলে তিনি ওই ছড়ার বীজ ধান হিসেবে আলাদা করে রেখে দিলেন। এই ধানটুকু তিনি আলাদাভাবে রোপন করতে থাকলেন। এভাবে এক নতুন প্রজাতির ধান উদ্ভাবন করলেন যা দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে হরিধান নামে খ্যাতি পেয়েছে। কৃষকগণ দীর্ঘকাল যাবৎই এভাবে উন্নত জাতের ধান সংগ্রহ করে ফলন বৃদ্ধি করতেন। ডারউইনের বিবর্তনবাদেরই কৃত্রিম নির্বাচনের একটি সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন হরিপদ কাপালী। এছাড়াও পরীক্ষাগারে অনবরত জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন নতুন ধান উৎপাদন করছেন বিজ্ঞানীরা। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন প্রজাতির ধান উৎপাদন করছেন কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে ও জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে।
Comentários