মৃত্যুর আগে
ডক্টর বাসুদেব চক্রবর্তি, লোকে তাকে বাসু বলে ডাকে তিনি এইমাত্র হাসপাতালে শেষ রাউণ্ড দিয়ে
এলেন।আজ এক বড় অপারেশন ছিল।সাত বছরের
বাচ্চার বাইপাস সার্জারি। খুব ক্লান্ত ছিলেন উনি।ফ্রেস হয়ে নিয়ে রিভলভিং চেয়ারে গাটা এলিয়ে বসেছিলেন তিনি।ভাবছিলেন বাচ্চাটার কথা।একটু তন্দ্রা মতন এসেছিল।কলিং বেল বেজে উঠতেই এক ঝটকায় তন্দ্রার দফারফা হয়ে গেল।প্রথমে মনে মনে একটু বিরক্তই হলেন তিনি। হাজার হলেও মানুষ তো।উনারও তো একটু বিশ্রাম দরকার।কিন্তু ক্ষণিকের দুর্বলতায় লজ্জিত হন তিনি। "কীভাবে ভুলে গেলাম যে আমি একজন ডাক্তার।আমি শপথ নিয়েছি যতক্ষণ পর্যন্ত রুগীর শেষ নিঃশ্বাস না পড়ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি লড়াই চালিয়ে যাব," লজ্জিত হয়ে মনে মনে বললেন তিনি।দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে তিনি দরজা খুলতেই একজন ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকে এলেন।ঘরের তাপমাত্রা পঁয়ত্রিশ দেখে ডক্টর বাসু এ.সি চালিয়ে ছিলেন। অথচ মুহূর্তে দরজার পাশ দিয়ে যেন একটা হিমশীতল দমকা হাওয়া আছড়ে পড়ল ঘরে।কোথাও থেকে যেন এক তীব্র পোড়া গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারছে উনার।কার বাড়িতে কী পুড়ছে কে জানে?
ডক্টর বাসু সামনে আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে ঢাকা নারীমূর্তির দিকে তাকিয়ে বললেন," আপনি কে? কী হয়েছে আপনার? এত গরমে আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে ঢাকা দিয়ে রেখেছেন কেন?"ফ্যাসফ্যাসে গলায় উত্তর এলো," ডাক্তারবাবু,আপনার হাসপাতালে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা পোড়া রুগী আসবে।বাঁচানোর সাধ্য কারোরই নেই।তবে যারা নিয়ে আসবে তারা এক বিশাল নাটক করবে।আপনাকে বলবে রুগীর এই অবস্থা স্টোভ বার্স্ট করে হয়েছে।তার স্বামী নিজের পোড়া হাত দেখিয়ে,ধর্মের দোহাই দিয়ে ময়নাতদন্ত করা থেকে বিরত করার চেষ্টা করবে আপনাকে ।এমনকি আপনার সঙ্গে না পেরে ডোমকেও কেনার চেষ্টা করবে।আপনি শুধু জানবেন মেয়েটাকে বিষ দেওয়া হয়েছে, খাবারের সাথে।আমার কাছ থেকে ডিভোর্স না পেয়ে আমাকে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিতে বাধ্য করল ওরা সবাই মিলে।
আমি ওদের শাস্তি নিজের চোখে দেখে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা না করে যেতে চাইনা। আমি ওদের শেষ দেখে যেতে চাই।আসলে আমার স্বামী আমাকে সন্দেহ করত।আজ কাল দোল ছিল।আমার স্বামীর ভাই,মানে আমার দেওর আমাকে আবীর দিতে আসে।ব্যাস শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার আমার উপরে।অবশ্য উনিও অবৈধসম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন আরও টাকার লোভে।কিন্তু আমার আর সময় নেই।ওই ওরা এল বলে।আমি উঠি।আমার গলায়,বুকে ও পেটে বড় জ্বালা ডাক্তার বাবু।একবার আমার মুখটা দেখবেন নাকি? দেখুন কী করেছে ওরা।আমার নামটা বলে রাখী,মুখ দেখে তো চিনতে পারবেন না।আমার নাম দিব্যা।"
মুহূর্তে এক দমকা হাওয়ায় উড়ে যায় চাদরখানা।
ডক্টর বাসু তার এই দশবছরের চাকুরী জীবনে এমন বীভৎস পোড়া দেখেননি বোধহয়। পুরো মুখটা আগুনে সিদ্ধ হয়ে গেছে।সারা গা ঝলসানো মুরগীর মত।ভিতর টা কেমন করে উঠে ডক্টর বাসুর।বাথরুমের দিকে ছুটে যান তিনি।চোখেমুখে জল দিয়ে নিজের রুমে ফিরে আসতেই দেখলেন নারীমূর্তি কোথাও নেই।সদর দরজাটা খোলা।কিছুতেই মনে করতে পারছেন না তিনি দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন কি না।সাথে সাথেই মোবাইলটা বেজে উঠল।ডাক এসেছে হাসপাতাল থেকে।ইমারজেন্সি কেস।ছুটেই যান একপ্রকার ডক্টর বাসু। গিয়েই তিনি রুগীর স্বামীকে কঠোর গলায় জিজ্ঞাসা করেন," নাম কী আপনার স্ত্রীর? "উত্তর আসে," দিব্যা". একমুহূর্ত দেরি না করে ডক্টর বাসু পুলিশে খবর দেন।উনার সামনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে রুগী।ময়নাতদন্তে ধরা পড়ে তাকে ফলিডল খাওয়ানোর পর আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।পুলিশ গ্রেপ্তার করে দিব্যার স্বামীসহ বাড়ির সকলকে।ডক্টর বাসু চোখ বন্ধ করেন।এতক্ষণে যেন এক অশান্ত আত্মা তৃপ্ত হয়ে শান্ত হাওয়ায় কানেকানে বলে যায়," বিদায়,বন্ধু, বিদায়।"
Comments