মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়টা কী?
বাংলাদেশে বর্তমানে বহুল উচ্চারিত শব্দ “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা”। কিন্তু কখনো প্রশ্ন করা যাবে না, এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়টা কী? প্রশ্ন করলে উত্তরে কেউ কেউ বলেন যে, এটা নিয়ে যারা প্রশ্ন করেন তারা “রাজাকার”। অর্থাৎ তাদের বক্তব্য অনেকটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে জাবরকাটা যাবে, বুঝতে চাওয়া যাবে না; কারণ সেটা ঐশ্বরিক! প্রবণতা দেখে মনে হয়, এভাবেই কিছু মানুষ এটাকে সংজ্ঞায়িত করতে চান।
“মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” এই কী-ওয়ার্ডে গুগলে সার্চ দিয়ে যে লেখাগুলো পাওয়া গেল সেখান থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে যে, এর লেখকরা “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” বলতে কী বোঝেন?
অধ্যাপক মোহিত উল ইসলাম “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জিনিসটা কী” এই প্রসঙ্গে একটা নিবন্ধে লিখেছেন, “চেতনা কার্যত একটি অদৃশ্যমান অনুভূতি, কিন্তু এটার দৃশ্যমান প্রতিফলন হয় বাস্তব জগতে কর্মের মাধ্যমে। কর্মটাকে বুঝলে চেতনাটাকেও বোঝা যাবে। খুব সাদামাটাভাবে বললে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে সেই কর্মটি, যার ফলে বাঙালির স্বশাসিত একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জিত হয়েছে।”
দেখা যাচ্ছে, খুব সুচতুরভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে একটা অদৃশ্যমান অনুভূতি বানিয়ে ফেলা হলো। এতে সুবিধা অনেক। কারণ নিজের পছন্দ আর ইচ্ছামতো যে কোনো কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তকমা লাগিয়ে দিলে কাজটাও উদ্ধার হবে, আবার যেহেতু সেই চেতনা অদৃশ্যমান, তাই সেই চেতনার বাস্তবায়নের দায় নিতে হবে না।
মোহিত উল আলম আরো লিখেছেন: “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ব্রত। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৪০ বছর, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কার্যকারিতা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। খাপছাড়া গোছের শোনাবে কথাটি। কিন্তু যে বৈঠকি আলাপটি সেদিন আমার মন বিষিয়ে দিয়েছিল, সেটাতে যত সুধীজন অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের সবারই প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে।”
তাঁর মানে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেটাই হোক সেটার জন্ম ১৬ই ডিসেম্বরের আগে এবং এই চেতনার ব্রত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু সেই ‘ব্রত’টা কী?
“মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ” শিরোনামে প্রফেসর ড. এম শমশের আলী লিখেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবারই চেতনা।
খুব ভালো কথা। তার মানে, সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের যদি প্রতিবাদ করি তাহলে সেটাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা!!
মুক্তমনা ব্লগে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ’ শিরোনামে মোঃ জানে আলম লিখেছেন, “আমাদের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা চেতনা ও মূল্যবোধগুলোই আমাদের স্বাধীনতার চেতনা হিসাবে বিকশিত হয়ে গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেতা-জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি চার মূলনীতি হিসাবে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধানে গৃহীত হয়েছিল।”
এটাকে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কারণ, আমরা আগেই স্থির করেছি এই চেতনাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং এটা অবশ্যই ২৬শে মার্চের আগের বিষয়। সংবিধান তো রচিত হয়েছে স্বাধীনতার পর।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন লিখেছেন, “শোষণ-জুলুমের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম পরিচালনা করার অগ্নি শপথপুষ্ট চেতনার নামই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।”
তাহলে আজকের গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন কী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা?
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেম ও নতুন প্রজন্ম’ শিরোনামে লিখেছেন মাসিক সুহৃদ: “১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক সেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল যে বোধ বা চেতনাকে কেন্দ্র করে, তারই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি বলিষ্ঠ চেতনা, আত্মপ্রত্যয়ের সুদৃঢ় উচ্চারণ।”
উত্তর কোথাও থেকে পাওয়া গেল না। কোনো কিছুই স্পষ্ট হলো না। বিতর্ক চলাকালে একজন সাবেক ছাত্রনেতা জানালেন, স্বপন কুমার চৌধুরী, যিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। যুদ্ধের আগে সম্ভবত একাত্তরের শুরুতে বা সত্তরের শেষ দিকে তিনি ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’-এর প্রস্তাব করেছিলেন। সেটি গৃহীত হয়েছিল। এটি এসে থাকবে ’৪৭-এ বঙ্গভঙ্গের শেষের লগ্নে শরৎবসু ইত্যাদির প্রাস্তাবিত স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলা থেকে। ১৯৭১ সালের ২রা বা ৩রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনির্দিষ্টভাবে ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ পাঠ করা হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন, প্রস্তাবক ও লড়িয়েরা হচ্ছেন প্রাথমিকভাবে বাঙালি ছাত্রসমাজ; যারা ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-তে শিক্ষা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভূত্থানের মধ্য দিয়ে দারুণ এক পরিপক্বতা নিয়ে জাতির অগ্রসরতম চিন্তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময় বিশ্বব্যাপী ছাত্রদের উত্থান ফ্রান্স থেকে শুরু হলেও ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সে তা বিফল হয়। কিন্তু ১৯৬৯ সালে বাংলায় তা সফল হয়। এটিই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা তৈরি করে। ৬ দফা ও ১১ দফা হচ্ছে ঐতিহাসিক পূর্বগামী ডকুমেন্ট। মার্চের স্বাধীনতার ইশতেহার সচেতন ও স্পষ্ট উচ্চারণ। এখানে কোনো দ্বিধা বা বিতর্কের বিষয় নেই ২৬ মার্চের মতো। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সবচেয়ে অগ্রসর চিন্তা ধারণ করেছিলেন ছাত্ররা- তরুণ প্রজন্ম। এটি বুঝতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ- আগামী দিনের জন্যও।
সাবেক এই ছাত্রনেতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়ে কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট করলেন। তিনি সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ করলেন এটা কোথায় কোথায় খুঁজতে হবে:১. স্বাধীনতার ইশতেহার।২. ৬ দফা৩. ১১ দফা।
যে পূর্বগামী ডকুমেন্ট থেকে ইশতেহার তৈরি, সেগুলো একটু পর্যবেক্ষণ করি। ৬ দফায় যে বিষয়ে দাবি জানানো হয়েছিল সেগুলো ছিল-
১. শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি।২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা।৩. মুদ্রা ও অর্থ বিষয়ক ক্ষমতা।৪. রাজস্ব কর ও শুল্ক বিষয়ক ক্ষমতা।৫. বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা৬. আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা
আরো দেখা যেতে পারে ১১ দফা কর্মসূচি:
১. শিক্ষা সমস্যার আশু সমাধান। অর্থাৎ হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় সমস্ত আইন বাতিল করা এবং ছাত্রদের সকল মাসিক ফি কমিয়ে আনা।২. প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং পত্রিকাগুলোর স্বাধীনতা দেয়া এবং দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনার নিষেধাজ্ঞা তুলে ফেলা।৩. ছয় দফা দাবির প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা।৪. পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশগুলোকে (অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, সিন্ধু) স্বায়ত্তশাসন দিয়ে একটি ফেডারেল সরকার গঠন।৫. ব্যাংক, বীমা, পাটকলসহ সকল বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ।৬. কৃষকদের উপর থেকে কর ও খাজনা হ্রাস এবং পাটের সর্বনিম্ন মূল্য ৪০ টাকা (স্বাধীনতার দলিলপত্রে উল্লেখ রয়েছে) ধার্য করা।৭. শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা এবং শ্রমিক আন্দোলনে অধিকার দান।৮. পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জল সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা গ্রহণ।৯. জরুরি আইন, নিরাপত্তা আইন এবং অন্যান্য নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার।১০. সিয়াটো (SEATO), সেন্ট্রো (CENTRO)-সহ সকল পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং জোট বহির্ভূত নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ।১১. আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত ব্যাক্তিসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মুক্তি ও অন্যান্যদের উপর থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার।
তাহলে ৬ বা ১১ দফায় ‘চেতনা’র চেয়ে অনেক বেশি বৈষয়িক বিষয় পাওয়া এবং আক্ষরিক অর্থেই এই দুই পূর্ববর্তী ডকুমেন্ট থেকে কিন্তু চেতনা বিষয়টা ঠিক সেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এবার স্বাধীনতার ইশতেহারে কী ছিল তা দেখা যেতে পারে:
‘৫৪ হাজার ৫০৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার সাত কোটি মানুষের জন্য আবাসভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ । এই দেশ গঠন করে নিম্নলিখিত তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে:
১. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি সৃষ্টি ও বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতির বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে ।২. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে অঞ্চলে অঞ্চলে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসনকল্পে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষক-শ্রমিক রাজনীতি কায়েম করতে হবে ।৩. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করে ব্যক্তি, বাক্ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে ।
এটাকে যদি আরো বুলেট পয়েন্টে বলতে হয়, তাহলে বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি, বৈষম্যহীন ন্যায়ের সমাজ, গণতন্ত্র।
তাহলে এই পর্যন্ত এসে দাঁড়ালো তিনটা মূল বিষয়; তা হচ্ছে সেই চেতনা যা ছাত্ররা ৩ মার্চ জাতির সামনে তুলে ধরে। এরপর এলো ২৫ মার্চের কালরাত। অতর্কিত হামলার পর তৈরি হলো প্রবাসী সরাকার। ১৭ এপ্রিল ঘোষিত হলো আমাদের প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স। যেটা আমাদের যুদ্ধের বৈধতা দাবি করলো। সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করলো, কেন আমরা এই যুদ্ধ করছি। এবং আমরা যুদ্ধে জিতে কেমন দেশ তৈরি করবো। যেটাকে আগের সবাই ‘ব্রত’ বলেছেন। সেখানে ছিল তিনটা বিষয়:
১. সাম্য
২. মানবসত্তার মর্যাদা
৩. সামাজিক ন্যায়বিচার।
সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে স্বাধীনতার ইশতেহার আর প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স অভিন্ন। এই দু’টোকে এক করে আমাদের সহজ বোধের ভেতরে নিয়ে আসতে চাইলে বলতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল:
১. বৈষম্যহীন, মুক্ত এবং ন্যায়বিচারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন২. যেই রাষ্ট্রে বলিষ্ঠ জাতি হিসাবে আমাদের বিকাশ ঘটবে এবং৩. সেই রাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা আমাদের মানবসত্তা বিশ্বে মর্যাদা পাবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোনো ধোঁয়াটে অদৃশ্য বিষয় নয়। অত্যন্ত মূর্ত বিষয় এবং বলাই বাহুল্য, যেই রাষ্ট্র এবং সমাজ তৈরির লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি। তাই শাসকশ্রেণি সব সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মূর্ত করতে চায় না।
Commentaires