মহাবিশ্ব কি আপনা আপনি সৃষ্টি হতে পারে নাকি এর পেছনে কোন ইশ্বরের হাত আছে ? ২য় পর্ব
এই প্রশ্নের উত্তরে পর্ব-১ এ আমরা জেনেছিলাম কিভাবে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে শূন্য থেকে আমাদের এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে । সেখানে আমাদের একটা বিষয় আজানা রয়ে গিয়েছিলো। সেটা হল মহাবিশ্বের স্ফীতির শুরুটা কীভাবে হয়েছিল ? যারা পর্ব-১ পড়েন নি, এখান থেকে পড়ে নিন -
এই পর্বে আমরা মহাবিশ্বের স্ফীতির শুরু এবং এর কারণ নিয়ে আলোচনা করবো। তাহলে চলুন শুরু করা যাক-
ইনফ্লেশন থিওরি তথা স্ফীতি তত্ত্বের আলোকে আমরা জেনেছি যে আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে কোয়ান্টাম শূন্যতা থেকে ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে । এই শূন্যতা থেকে ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে উৎপন্ন মহাবিশ্বের স্ফীতি কিভাবে শুরু হয়েছিল সেটা জানতে হলে আমাদেরকে আগে নেগেটিভ গ্র্যাভিটি বা ঋনাত্বক মহাকর্ষের ধারণাটা পাকাপোক্ত করে নিতে হবে। মহাকর্ষ ব্যাপারটিকে আমরা এতদিন আকর্ষণমূলক বল বলে জানতাম, কিন্তু এই মহাকর্ষ সুযোগ আর পরিস্থিতি বিচারে কখনো কখনো বিকর্ষণমূলক হয়ে উঠতে পারে এবং সেটা হয়ও। নিউটনের মধ্যাকর্ষন সূত্র থেকে আমরা জানি, মহাকর্ষ বল বস্তুকণাদের ভরের এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের উপর নির্ভর করে। কিন্তু পরবর্তীতে আইন্সটাইনের জেনারেল রিলেটিভিটি'র তত্ত্ব থেকে আমরা বুঝলাম , ব্যাপারটা আসলে পুরোপুরি ঠিক নয়। মাধ্যাকর্ষণ বল কেবল বস্তুর ভরের উপরেই নির্ভর করে না, নির্ভর করে বস্তু কণার মধ্যে লুকিয়ে থাকা শক্তির উপরও। বস্তুর মধ্যস্থিত অণু পরমাণুগুলো কি হারে ছুটোছুটি করছে সেটা আমাদের কাছে শক্তির একটা পরিমাপ হাজির করে। এই ছুটোছুটি আবার নির্ভর করে বস্তুর তাপমাত্রার উপর। তাপমাত্রা বাড়লে অণুদের ছুটোছুটি বাড়ে, সেই সাথে বাড়ে ওজন। অর্থাৎ সহজ কথায়, গতিশক্তি বাড়লে ভর বা ওজন বাড়ে। এভাবে মধ্যাকর্ষন বলের উপর গতিশক্তির যে, প্রভাব আছে তা বিজ্ঞানী নিউটন জানতেন না। আবার আরেকটি বিষয়ও হয়তো নিউটনের অজানা ছিলো, সেটা হল চাপ বাড়লে শক্তি বাড়ে এবং ইহা আকর্ষন বলের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। [যেমনঃ একটি কোকের বোতলে বাতাসকে উচ্চ চাপে আটকে রেখে ওজন করলে যে মান পাওয়া যাবে , বোতলের ছিপি খুলে ওজন করলে তার চেয়ে খানিকটা কম মান পাওয়া যাবে ] এই চাপ আবার ধনাত্মক ও ঋনাত্বক দুই ধরনের হতে পারে। ধনাত্বক চাপ ধনাত্বক মহাকর্ষের জন্য দায়ী এবং ঋনাত্বক চাপ ঋনাত্বক মহাকর্ষের জন্য দায়ী। ধনাত্মক চাপ যেমন ওজন বাড়িয়ে বস্তুকণাকে আকর্ষনের মাধ্যমে টেনে ধরে রাখে, তেমনি ঋনাত্বক চাপ বস্তুকণাকে বিকর্ষনের মাধ্যমে দূরে ঠেলে দিতে পারে। এই ঋনাত্বক বিকর্ষনমূলক শক্তিটাই আমাদের মহাবিশ্বকে তীব্রভাবে প্রসারিত হতে সাহায্য করেছিলো। এই বিকর্ষনমূলক মহাকর্ষ (Repulsive Gravity) তথা নেগেটিভ গ্র্যাভিটি ব্যাপারটা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই বিকর্ষনমূলক মহাকর্ষের উৎপত্তি কোথায় এবং কিভাবে হল ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে স্ফীতি তত্ত্বের জনক বিজ্ঞানী Alan H. Guth কে একধরনের অস্থায়ী ভ্যাকুয়ামের কথা চিন্তা করতে হয়েছিল যার নাম দিয়েছিলেন তিনি ফলস ভ্যাকুয়াম বা মেকি শূন্যতা। এই মেকি শূন্যতার রয়েছে তীব্র বিকর্ষনমূলক শক্তি যা ইহার একটি অদ্ভুত ও অনন্য বৈশিষ্ট। বিজ্ঞানী গুথ হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, ভ্যাকুয়ামের ক্ষেত্রে এই বিকর্ষন শক্তির মান আকর্ষন শক্তির প্রায় তিনগুণ। আসলে মহাবিশ্বের শুরুতে মেকি শূন্যতা নামক তীব্র বিকর্ষনমূলক শক্তির এই অদ্ভুতুরে জিনিসটা ছিলো বলেই আমাদের মহাবিশ্ব এতো দ্রুত প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলো। এখন প্রশ্ন হল এই মেকি শূন্যতা কিভাবে তৈরি হয়েছিল ? সেটা বোঝার জন্য আমাদেরকে হিগস ফিল্ড নামক একধরনের স্কেলার ক্ষেত্রের দ্বারস্থ হতে হবে। ছোট ক্লাসের ফিজিক্স বইয়ে আমরা পড়েছিলাম যেসকল রাশির শুধু মান আছে কিন্তু কোন দিক নেই তাদেরকে স্কেলার রাশি বলে। যেমনঃ তাপমাত্রা একটি স্কেলার রাশি, কারণ এর শুধু মান আছে, দিক নেই। তদ্রুপ হিগস ফিল্ডকেও 'স্কেলার' ক্ষেত্র বলা হয় কারণ এর শুধু সাংখ্যিক মান আছে কিন্তু কোন দিক নেই। হিগস ফিল্ডের নামকরণ করা হয়েছে স্কটল্যান্ড নিবাসী বিজ্ঞানী পিটার হিগস এর নামানুসারে। এই হিগস ফিল্ড আবার নিজেকে প্রকাশ করে থাকে একটি রহস্যময় কণার মাধ্যমে, কণাটির নাম হিগস- বোসন, যা 'ইশ্বর কণা' নামে পরিচিতি পেয়েছে। আরেকটি কথা এখানে বলে রাখা ভালো হিগস ফিল্ড একটি স্কেলার ক্ষেত্র হলেও এর বৈশিষ্ট্য অন্যসব চেনাজানা স্কেলার ক্ষেত্রের চেয়ে আলাদা। অন্য সবার জন্য, বল ক্ষেত্রের মান শূন্য থাকলেই শক্তি ঘনত্ব (Energy density) সবচেয়ে কম পাওয়া যায়। কিন্তু হিগসের ক্ষেত্রে শক্তি ঘনত্ব আমরা সবচেয়ে কম পাই – যখন হিগসের একটি ‘নন জিরো ভ্যালু’ বা অশূন্য মান থাকে। এর মানে হচ্ছে শূন্য স্থানে, যেটাকে আমরা প্রচলিত ভাবে ভ্যাকুয়াম বলে অভিহিত করি – সেখানেও হিগসের একটা মান সবসময়ই পাওয়া যাবে। আমাদের মহাবিশ্বের মেকি শূন্যতার পথ পাড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে প্রকৃত শূন্যতায় এসে পৌঁছানোর ব্যাপারটা যদি সঠিক হয়, তবে সেই প্রকৃত শূন্যতার অবস্থানে হিগসের একটা নির্দিষ্ট মান থাকবে, যেখানে মহাবিশ্বের শক্তি ঘনত্ব হবে সর্বনিম্ন। নিচের ছবিটার দিকে তাকান, এটা একটা ত্রিমাত্রিক ছবির দ্বিমাত্রিক গ্রাফ যা Energy density 'র সাথে Higgs field এর সম্পর্ক নির্দেশ করে।
(পোস্টের নীচে)
ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে, যখন Energy density U এর মান কমতে কমতে শূন্য হয় তখন স্কেলার ক্ষেত্রের মান £ = £° হয়। অর্থাৎ শক্তি ঘনত্ব (U) শূন্য হলেও স্কেলার ক্ষেত্র (হিগস ফিল্ড) £ এর মান শূন্য নয়। এটাই প্রকৃত শূন্যতা ( True Vacuum)। আমাদের মহাবিশ্ব আজ এই জায়গাতেই আছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। কিন্তু অতীতে যখন স্কেলার ক্ষেত্রের মান শূন্য ছিল (£=0 ) তখন তার শক্তি ঘনত্বের মান ছিল U । এই সসীম ঘনত্বের দশাকেই বলা হয় মেকি শূন্যতা (False Vacuum)। চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে, হিগস ফিল্ডের মান যত বাড়তে থাকে শক্তি ঘনত্বের মান একটি মালভূমির ঢাল বেয়ে ততই নীচে নামতে থাকে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের সাথে সাথে হিগস ফিল্ড তার শক্তি ঘনত্ব কমাতে চায়। মালভূমিটি যদি যথেষ্ট সমতল হয় তাহলে বোঝাই যাচ্ছে সেই শক্তি ঘনত্ব কমাতে, অর্থাৎ সর্বনিম্ন শক্তিস্তর (Lower energy state)- এ নেমে আসতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। এই স্বল্প সময়ের জন্য ফলস ভ্যাকুয়াম একধরনের আপাত শূন্যতা হিসেবে কাজ করে অর্থাৎ তার ঘনত্ব সেভাবে কমানো যায় না। এই ব্যাপারটাই সব রহস্যের সমাধান করে দিয়েছিল। হিগস ফিল্ডের মানের সাথে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানী গুথ দেখতে পেলেন হিগস ফিল্ড একধরনের supercool অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়ে তার দশার পরিবর্তন ঘটায়, ফলে সেই সময়টায় প্রতিসাম্যের ভাঙন সাময়িক সময়ের জন্য হলেও যেন চেপেচুপে রাখা যায়। অর্থাৎ তাপমাত্রা ক্রান্তিমানের চেয়ে নিচে নেমে গেলেও প্রতিসাম্যতা বজায় ছিলো,আর মহাবিশ্ব ছিলো সাময়িক সময়ের জন্য অস্থায়ী দশায় অর্থাৎ ফলস ভ্যাকুয়ামে বন্দী হয়ে। আর এ ব্যাপারটা ঘটার জন্য সুপ্ততাপের মাধ্যমে অতিরিক্ত শক্তির যে জোগানটা এসেছিলো, সেটাই দিয়েছিল বিকর্ষনমূলক ধাক্কা। এই তীব্র বিকর্ষনমূলক শক্তি তৈরী হয়েছিলো বলেই মহাবিশ্ব এতোটা দ্রুত সম্প্রসারিত হতে পেরেছিলো। এতোটা দ্রুত বলতে ঠিক কতটা দ্রুত? বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যেই মহাবিশ্বের আকার বেড়ে গিয়েছিল মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন গুন (১ এর পরে ৩০ টা শূন্য)। এই দানবীয় স্ফীতিটাকেই বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন বিগ ব্যাং তথা মহাসম্প্রসারন বা মহাবিস্ফোরণ।
Kommentare