top of page

বিড়াল-প্রেম

Writer's picture: Just Another BangladeshiJust Another Bangladeshi

হুট করে মনে হলো বিড়াল পুষলে কেমন হয়!বাচ্চা একটা বিড়ালকে পেলেপুষে মোটাসোটা নাদুসনুদুস করবো।আয়েশি ভঙ্গিতে জমিদার এর মতন বিড়ালটা ঘুরে বেড়াবে।কল্পনাতে ভালোই লাগছিলো ভাবতে।


বিড়ালপ্রেম জিনিসটা আমার ছিলো না তেমন,রাহার সাথে পরিচয় হবার পর প্রথম দিকে তার মন পাবার চেষ্টাতেই বিড়াল নিয়ে একটু আহ্লাদ এর শুরু।

রাহা!আমাদের ক্লাসের চুপচাপ এক কোণে বসে থাকা শান্ত করে মেয়েটা।বিশেষত্বহীন চেহারার এই একদম শুকনা মেয়েটাকে আমি প্রথম ভালো করে দেখেছিলাম জানুয়ারি মাসের এক শীতের ভোরে প্যাথলজি লেকচার করতে যাবার সময়।আমি কফির কাপ হাতে কৃষ্ণচূড়া গাছটার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, রাহা হেঁটে গিয়েছিলো আমার পাশ দিয়ে,হালকা ধূসর চাদরে মোড়ানো,শীতে কাপাকাপি করা অতি সাধারণ বাঙালী মেয়ের রূপে,আমি সেই দেখাতে প্রেমে পড়ি নি অবশ্যই,তবে ভালো লেগে গিয়েছিলো। ততদিনে এক সাথে ক্লাস করবার বছর তিনেক পার হয়ে গেছে।আমি ততদিনেও রাহাকে কেনো দেখি নি সেই ভেবে অবাক।

আজকের গল্পটা একদম রাহাকে নিয়ে নয়,রাহা কাল চলে যাবে রাজশাহী ছেড়ে।মানব জীবনের সব থেকে সত্য হলো ছেড়ে যাওয়া,আগে হোক বা পরে ছেড়ে যাওয়াই লাগে।

ছোটবেলায় হঠাত করে ঝোঁক উঠলো টিয়া পাখি দরকার আমার।সবুজ আমার অতি প্রিয় রঙ ছিলো।সবুজের ভেতর টকটকা লাল ঠোট, আল্লাহ এর থেকে সুন্দর কোন পাখি বানাইছেন বলে মনে হতো না।অনেক দৌড় ঝাপ করে এক সন্ধ্যায় বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত পাখি বাসায় এলো,আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি তখন।ছয় বছর বয়সী আমার জীবনে এর থেকে আনন্দময় ঘটনা আর ঘটেছিলো বলে মনে নেই।রোজ পাখিকে খাওয়ানো,দেখাশোনা করা এবং কথা শেখাবার ব্যর্থ চেষ্টা,শিক্ষক হিসেবে আমি এতই বাজে ছিলাম যে আমার টিয়া এক শব্দও বলা শেখে নি।ক্লাস টু এর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ,ডিসেম্বরের এক শীতের সকালে উঠে দেখি পাখি ঘুমায়ে আছে।ডাকলাম,নড়ে না।মা বাবা কে নিয়ে এলাম।তারা বললো পাখি মরে গেছে।খুব কাছের কিছু হারিয়ে যাবার দুঃখ তীব্রভাবে বোঝার মতন বয়স তখন ও আমার হয় নি।আমি আর আবির মিলে বাসার পেছনে কবর দিয়ে এলাম ওকে।এরপর আর এই জীবনে কোনদিন পাখি পুষতে মন চায় নি আমার। টিয়া মরে যাবার থেকেও বেশী কষ্ট পেয়েছিলাম মনে হয় ক্লাস থ্রি তে পড়াকালীন আমার শখের সবুজ কালি হওয়া দামী কলমটা হারিয়ে যাবার পর।বৃষ্টিতে ফুটবল খেলে বাসায় যাবার পথে দেখি কলমটা নেই।পুরো মাঠ কাদাপানির ভেতর খুঁজেছিলাম,হারিয়ে ফেলার শোকে ওই বোধহয় প্রথম কান্না করেছিলাম।বাসায় গিয়ে আব্বুকে ধরে মরা কান্না কাঁদলাম,আব্বু বললো পাগল ছেলে,এভাবে কাঁদে নাকি বাবা? মানুষ হয়ে জন্মেছো,এই জীবনে হারাবার ভেতর দিয়েই যেতে হবে সোনা।জীবনে এমন কষ্ট অনেকবার আসবে,শক্ত হতে হয় ছেলেদের বাবা।আমি বুঝি নি যত্নে রাখলেও কেনো হারাবে পছন্দের জিনিস? আজকে তো আমার বেখেয়ালিপনায় কলমটা হারালো।

হারিয়ে যা যাবার তা যাবেই,সে কেউ যতই আঁকড়ে থাকুক না কেনো।আম্মা মারা গেলো যেদিন,আম্মার এক হাতের আঙুল আঁকড়ে ছিলাম আমি।কই তাও তো মারা গেলোই।ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে নানী বাড়ি যাবো।ঘর থেকে বের হবার সময় আম্মা উঠানে জোড়া শালিক দেখে বললো যাত্রা শুভ হবে।আমি এ যাত্রা অশুভ হবার কোনো কারণ ই দেখছি না।আর ঘন্টা খানিকের ভেতর নানী বাড়ি,এরপর মামা,মামাতো ভাই বোন আর অবাধ স্বাধীনতা,এর চেয়ে শুভ আর কী হতে পারে?

আম্মা মারা গেলো জোড়া শালিক দেখার আধঘন্টার ভেতরেই।আমি আম্মার আঙুল ধরে ছিলাম,ট্রাক রিক্সায় ধাক্কা দিলো,আবির একটু দূরে ছিটকে পড়ে হাত পা কেটে ফেললো,আমার তেমন কিছুই হলো না,আমি আম্মার আঙুল ধরে থাকা অবস্থায় খেয়াল করলাম আম্মার মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে।

আম্মা মারা গেলো আমার বয়স তখন ছিলো ১০ বছর,আব্বু বলেছিলো হারিয়ে ফেলা জগতের নিয়ম,নিয়ম শব্দের মানেটাই তখনো বুঝি না আমি।

কলেজে উঠে হঠাত করে কুকুর পালবার বড় শখ হলো,ছোটবেলায় কুকুরের কামড় খেয়ে কুকুর হইতে সাবধান টাইপ মানুষ ছিলাম আমি।হাচিকো নাম রেখেছিলাম কুকুরটার,রোজ নিজ হাতে খাবার দিতাম,ডাকলেই দৌড়ে কোলের ভেতর চলে আসতো। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন,ডিসেম্বর এর এক দুপুর বেলা হাচিকো মরে গেলো। আব্বুর কথা মনে পড়লো আবারো,মানুষ হয়ে জন্মেছো।হারাবার ভেতর দিয়ে যেতে হবে বাবা।এই জীবনে কত কী হারালাম,মানুষ হারালাম,বন্ধু হারালাম,সময় হারালাম,নিজেকেও হারিয়ে ফেললাম।আব্বুর কথার অর্থ বুঝতে কতবছর পার হয়ে গেলো।

রাজশাহী তে আমি এসেছিলাম এক মাথা চুল নিয়ে।বাসায় তখন আব্বু আর আবির ছিলো,ফিরে যাবার সময় হয়ে এলো আমার,অর্ধযুগের বেশী এই সময়ে মাথার চুল হারিয়েছি,বন্ধু হারিয়েছি,আবির এখন ঢাকায় ওর ভার্সিটির হলে থাকে,আব্বুর চোখের পাওয়ার কমেছে।কী পেয়েছি সেই ভাবনা এখন ভাবি না,কী হারাই নি সেটাই বেশী ভাবি।

রাহার সাথে আমি দাঁড়িয়ে আছি টি বাধে।এই জায়গাটায় দাঁড়ালে আমার পাখি হতে ইচ্ছে করে,এত বাতাস বয়ে চলে,মনে হয় ডানা দুটো ভাসিয়ে উড়ে যাই দূরে,দূরে বলতে প্রচণ্ড দূরে,একদম খুঁজে পাওয়া যায় না যেখানে। আমরা দুজন চুপচাপ বসে আছি,কিছু নীরবতা নীরবেই বলে দেয় অনেক কিছু।রাহা টুকটুক করে পেয়ারা মাখা খাচ্ছে,এই তেতুল দিয়ে পেয়ারা মাখা তার অতি পছন্দের খাবার।এত ভালোবাসা নিয়ে খাওয়া দেখলে পেয়ারার মত ফলকেও ভালোবেসে ফেলা যায়। সন্ধ্যে নেমেছে, দূরে পদ্মার ওপারের ছোট্ট গ্রাম গুলোতে টিমটিমে বাতি জ্বলে উঠেছে,পদ্মার শান্ত ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দে নীরবতার ওজন বেড়ে যাচ্ছে আরো কয়েক গুণ।

প্রচণ্ড গুমট মেঘের পর বৈশাখের কালবৈশাখী এবং এক ফোঁটা বৃষ্টি যেমন প্রাণ ফিরিয়ে আনে,শত বছরের নীরবতা ভেঙে তেমনি রাহা কথা বলে উঠলো পেয়ারা খেলে না? নাহ,ভালো লাগে না আমার এতো।তুমি খাও। তা লাগবে কেনো,ভালো জিনিস তোমার কবেই বা ভালো লাগে,ফোকো সিগারেট ই ফোকো। রাহা? হুম আমি নাহয় অপেক্ষা করলাম? আবার ক্ষণিকের নীরবতা,অসহ্যকর নীরবতা। সাকিব,মানুষের সব থেকে বড় ভয় কী জানো? হারিয়ে ফেলার ভয়।মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলার ভয় এত তীব্র হয়ে যায়,যে নিজের করে পেতেও আর ইচ্ছা হয় না কিছু।ছোট্ট একটা জীবনে এক কষ্ট কেই বা আবার পেতে চায় বলোতো?

রাহা যখন কলেজে পড়তো,কোন এক শরৎের বিকেলে প্রথম যৌবনের সমস্ত আবেগ নিয়ে একজনের হাত ধরেছিলো,সেই ছেলেটা রাহার হাত দুটো ধরে রাখতে পারে নি,আর এরপর রাহা সেই ভেঙে যাওয়া জায়গা থেকে আর নিজেকে জোড়া লাগাতে পারে নি,কে জানে,হয়তো চায় নি জোড়া লাগাতে।

রাহা উঠে চলে গেলো বেশ কিছুক্ষণ পরে।আমার বিষণ্ণ লাগতে লাগলো,অদ্ভুত বিষণ্ণতা,গলায় কান্না দলা পাকিয়ে ওঠার মতন।

আমি এক ঘন্টার জন্যে নৌকা ভাড়া করেছি ২৫০ টাকা দিয়ে। অন্ধকারে পদ্মায় চিত হয়ে শুয়ে আছি,রাহার ট্রেন কাল ১১:৩০ এ।প্রায় সাতবছরের রাজশাহী জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে চলে যাবে কাল। মাঝি মামা গান ধরেছে,আশা ছিলো মনে মনেএএ গোল্ডলিফ পুড়ে যাচ্ছে হাতে,আমি গান শুনছি।

যাবার আগে রাহার শেষ কথা ছিলো,যে অপেক্ষায় প্রত্যাশা রাখা যায় না,তার থেকে বিষণ্ণ অপেক্ষা আর হয় না সাকিব। রাহা তো জানে না,আমি বিষণ্ণতা ভালোবাসি।.বিড়াল পোষার চিন্তা থেকে সরে এসেছি,পেলেপুষে বড় করবো,মায়া বাড়বে।একদিন হুট করে চলে যাবে,কষ্ট বাড়বে। আব্বুকে বলেছিলাম,যত্নে রাখলেও কেনো হারাবে? আমি সব আগলে রাখবো।আব্বু বলেছিলো তবু হারাবে বাবা,হারানোটাই নিয়ম।আমি এখন বুঝি,চাইলেই সব ধরে রাখা যায় না।আর যত্নে রাখা ভালোবাসার জিনিস হারালে কষ্টটা বেশী।তাই এর থেকে ভালোবাসার জিনিস,মানুষ এদের বেশী কাছে না যাওয়াই বোধহয় ভালো।

0 comments

Recent Posts

See All

Comments


Enjoy
Free
E-Books
on
Just Another Bangladeshi
By
Famous Writers, Scientists, and Philosophers 
click here.gif
lgbt-bangladesh.png
click here.gif

Click Here to Get  E-Books

bottom of page