বাংলাদেশের হিন্দু
আমার দোকানের সামনে দিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া আসার সময় এক লম্বা দাড়িওয়ালা লোক, রোজ পান খায়। আমি টাকা চাইলেই বলে, "লেইখ্যা রাখ"।
লোকটা সবসময় ধমক দিয়ে কর্কশ ভাষায় কথা বলে, এইজন্য সে পান চাইলে না বলতে সাহস পাইনা। শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে, ওই লোক তার দুই ছেলেকে নিয়ে এসে, আমার দোকান থেকে লজেন্স,বিস্কুট, চানাচুর একের পর এক সে তার ছেলেদের হাতে তুলে দিতে থাকে।
ওই লোক দাম না দিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমি অনেক সাহস করে বলি, "হুজুর এইসব ছাতা নাতা বেইচ্চা মুই প্যাট চালাই। এইগুলাইন মোর গাছের ফল না, কিইন্না আনোন লাগে। মোরে এই বিলে
ঠগাইলে, মোর না খাইয়া মরন লাগবে।"
দাড়িওয়ালা লোকটা বিষধর সাপের মতো ফোঁস করে উঠে বললো,"মালাউনের বাচ্চা তোর এত বড় আস্পর্ধা! তুই মোর নবীরে গাইল দিলি।"
"হুজুর, মুই তো আপনের নবীর নামও মুহে আনি নাই। মুই খালি মোর দোকানের মালের দাম চাইছি।"
নবী-অবমাননার অভিযোগ শুনে মসজিদ ফেরত লোকদের ভিড় জমে গেল। দাড়িওয়ালা লোকটা আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত নবী অবমাননার সঙ্গে যুক্ত করলো কোরআন অবমাননার কাল্পনিক অভিযোগ। আমি নাকি কোরআনের পৃষ্ঠা ছিড়ে ঠোঙা বানিয়েছি।
আমি কাতর কন্ঠে বললাম, কোরআন তো আমি জীবনে চোখেই দেখি নি।
সমবেত জনতা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলো। আমার দোকানটা চোখের নিমিষে লুট হয়ে গেল। আমার শরীরে বৃষ্টির মতো লাথি ঘুষি পড়তে লাগলো। আমি পড়ি কি মরি করে দৌড় দিয়ে আড়াল পেয়ে নর্দমার মধ্যে ঝাঁপ দিলাম। মল-মূত্র ও শহরের যাবতীয় আবর্জনায় পরিপূর্ণ প্রশস্ত কাঁচা নর্দমার মধ্যে সমস্ত শরীর ডুবিয়ে দিয়ে,নাকটা কেবল বাইরে রেখে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দিয়ে - প্রাণ রক্ষা করলাম।
পড়ন্ত বিকেলে বুঝতে পারলাম যে, বিপদ সাময়িকভাবে কেটে গেছে। নর্দমা থেকে উঠে নদীতে গিয়ে দীর্ঘক্ষন ধরে স্নান করতে লাগলাম। কিছুতেই শরীর থেকে নর্দমার দুর্গন্ধ দূর হচ্ছে না। মল-মূত্র আবর্জনার দুর্গন্ধের থেকেও প্রকট - অসহায়ত্বের দুর্গন্ধ। এই অসহায়ত্ব সমগ্ৰ হিন্দু জাতির, যারা ইসলামিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনো যুগোপযোগী মতাদর্শ সৃষ্টি করতে পারেনি।
নদী থেকে উঠে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখি, আমার দোকানটা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি ভাঙ্গা দোকানের সামনে বসে পড়ে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমার যা কিছু আর্থিক অর্জন ও সঞ্চয় সবকিছুই দোকানের মধ্যে ছিল। সব হারিয়ে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। কোন একটা লোক আমার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করল না, আশার বাণী শোনালো না। পাশের এক দোকানদার বলল, "তোরে চিন্তাহরণ সাহাবাবু দ্যাহা হরতে কইছে।"
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী চিন্তাহরণ সাহা হৃদয়খালী শহরের হিন্দু সমাজের সভাপতি। অনেক সাহস করে দুর্গন্ধময় ভেজা গায়ে হিন্দু সমাজের সভা কক্ষে ঢুকে দেখি, শহরের এলিট হিন্দু ব্যক্তিরা সান্ধ্যকালীন আড্ডা দিতে এসে উপস্থিত হয়েছে।
শহরের বিশিষ্ট হিন্দু ব্যক্তিরা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলল, আমি কোথা থেকে এসে উড়ে এসে জুড়ে বসে - হৃদয়খালী শহরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য বিনষ্ট করে ফেলেছি।
আমি যতই বলার চেষ্টা করি যে,নবী কিংবা কোরআনের নাম আমি মুখেও আনি নি, অবমাননা করার কল্পনাও মাথায় আসে নি। বিশিষ্ট হিন্দু ব্যক্তিরা আমার কথা কানে না তুলে, যে যার মত করে বলে যায়, "এই ফাজিল ছেলে কি বলে! এই মূর্খ ছেলে কি বলে! এই অশিক্ষিত ছেলে কি বলে! হারামজাদা, তুই মহাত্মাজীর নাম শুনেছিস! তুই কোথা থেকে শিখবি উদারতা, সহিষ্ণুতা, ধর্মনিরপেক্ষতা। ছোটলোকের বাচ্চা,ঘরে শিক্ষিত কেউ থাকলে না তোকে শেখাবে!... নোয়াখালীতে পার্টিশনের আগে মুসলমানরা বিরাট দাঙ্গা করলো, কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন হিন্দুদের পাইকারি হারে কেটেছে, হিন্দু মেয়েদের রাতভর রেপ করেছে, হিন্দুদের জোর করে মুসলমান বানিয়েছে। তখন ব্রিটিশ আমল। কড়া আইন। পুলিশ এসে দাঙ্গাবাজ মুসলমানদের গ্রেফতার করল। মহাত্মাজী দাবি তুললেন, মুসলমানদের ছেড়ে দিতে হবে। তিনি নিজে নোয়াখালী গেলেন। মুসলমানরা মহাত্মাজীর শরীরে পায়খানা ছুড়ে মারল। তাতে মহাত্মাজীর একটুও ধৈর্যচ্যুতি ঘটে নি। বিহারের হিন্দুরা পাল্টা দাঙ্গা করলো, এবার মহাত্মাজী ব্রিটিশদের বললেন,দাঙ্গাবাজ হিন্দুদের গ্রেফতার করো। একেই বলে উদারতা, সহিষ্ণুতা...হিন্দু অপরাধীদের আটক করতে বলে,মুসলমান অপরাধীদের ছেড়ে দিতে বলা। তাহলে বুঝেছিস, ধর্মনিরপেক্ষতা কী জিনিস..."
আমি নিজের উপর যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে বলে উঠলাম, "ধর্মনিরপেক্ষতার গুষ্টি..(ধর্ষণ করি)"
হিন্দু সমাজের সভাপতি চিন্তাহরণ সাহা চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমার গালে চপেটাঘাত করে বলল, "এতক্ষণ ধরে সবাই মিল্লা তরে কি বুঝাইলো। তুই ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে এতবড় কথা বললি! ইন্দিরাজী ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বানাইছে কী আ্যামনে আ্যামনে! ইন্দিরা গান্ধী কে তুই জানিস! ইন্দিরা গান্ধী হইলো সাক্ষাত দেবী দুর্গা। তুই পণ্ডিতজীর নাম শুনেছিস ?..."
কালু মুহুরী নামক এক বৃদ্ধ লোক আমার দোকানে রোজ পান খেত। সে আমার হাত ধরে বলল, "ছ্যাড়া বাইরে ল। মহাত্মাজী,ইন্দিরা গান্ধী, পণ্ডিতজী এইসব তোর মাথায় ঢোকপে না।"
বাইরে এসে কালু মহুরীর মুখে শুনলাম, হৃদয়খালী শহরের বিশিষ্ট হিন্দু ব্যক্তিরা যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করলো - সেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল মূলত ১৯৫০,১৯৬৪ ও ১৯৭১ সালে তিন দফায় মুসলমান কর্তৃক ঠাণ্ডা মাথায় হৃদয়খালী শহরের হিন্দুদের গণহত্যা, শিশু-বৃদ্ধা নির্বিশেষে হিন্দু নারী ধর্ষণ, হিন্দুদের দোকানপাট বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা, ধর্মান্তরিত করা ও ভারতে তাড়িয়ে দেওয়া।
কালু মহুরী পানের পিক ফেলে ফোকলা দাঁতে হেসে বললো,"শালা শুয়ারের বাচ্চা অপদার্থ জাতি, কোন আত্মমর্যাদাবোধ নাই। ধর্মনিরপেক্ষতা ...(কর্তৃক ধর্ষিত হচ্ছে)। কেউ একটা গারো বা চাকমার গায় হাত দিয়া দ্যাখুক,কেমনে দল বাইন্দা প্রিত্তিবাদ করে,রুইখ্যা দাঁড়ায়। হ্যরা সংখ্যায় অল্প কয়জন! হইলে কি হইবে, হ্যাগো আত্মমর্যাদাবোধ আছে। আরে মরতে তো একদিন হইবেই, হেলে সেকুলার হওনের লইগ্গা এই জাতি, ঘরের ঝি-বউগো ...(ধর্ষিত হওয়ার জন্য) মুসলমানের ধারে পাডায় ক্যান। হেয়ার চাইক্কা লড়াই করইয়া সম্মান লইয়া মরা কী বুদ্ধিমানের কাম না .."
খুবই তথ্যবহুল ব্লগ
ভালো লিখেছেন
এই পোস্টটি পড়ে প্রত্যেকেই নিজের মনের মত প্রতিবাদী মনোভাব তৈরি করা উচিত যাতে কেউ অন্যায় করে পায় না পায়
ধন্যবাদ, চমৎকার পোস্ট করেছেন
সবকিছুর একটা শেষ আছে এসব নির্যাতনগুলো প্রতিবাদ করার একমাত্র উপায় এসব নির্যাতনগুলো শেষ করে দেওয়ার এবং জাতির শান্তি ফিরিয়ে নিয়ে আসার।