বিদায়ের করুণ সুর
অনেক হৈচৈ এর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো ময়নার। তাদের এখানে রাতদিন অনেক রকম আওয়াজ হয়। ঝগড়াঝাঁটি তো লেগেই আছে প্রতিদিন। চার মাস হলো সে এসেছে এই পাড়ায়। তাই প্রথমে বেশি পাত্তা দিলোনা। ঘুমাতে চেষ্টা করলো আবার। কিন্তু হৈচৈ এর শব্দ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলো। যেন তার ঘরের কাছে একটা হাট বসেছে। কৌতুহলের কাছে ঘুম পরাজিত হলো। বিছানা ছেড়ে চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলে দেখে তার ঘরের সামনে একটা লাল রংএর ঝকঝকে গাড়ি দাঁড়ানো। গাড়ির ভেতর গাড়ির মতোই ঝকঝকে চেহারার দুজন পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রমহিলা বসে আছেন। তাদের চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি আর ঘৃণা। দরজা খোলার শব্দে তারা এদিকে তাকালো আর ময়নাকে দেখে চোখ মুখ এমন ভাবে কুঁচকালো যেন নর্দমার দুর্গন্ধময় ময়লা দেখছে। ময়না দেখে অবাক হলো অনেক। তাদের এই পাড়ায় তো সব পুরুষদের আড্ডা। রাত যতো গভীর হয় ততো পুরুষদের মুখঢেকে আনাগোনা বাড়তেই থাকে। আর যখন কোন নতুন মেয়ে আসে তখন তাকে আজীবন এখানেই থাকতে হয়। সেখানে এই ভরদুপুর বেলায় তো গাড়িতে করে কোন ভদ্রমহিলা আসার কথা না। ময়না এগিয়ে গেলো আরো ভালোমতো দেখার জন্য। গিয়ে কুসুমের পাশে দাঁড়ালো। কুসুমও অবাক হয়ে দেখছে সব। পাড়ার সর্দারনী এসে একটা পলিথিনে করে কি যেন ধরিয়ে দিলো গাড়ির ড্রাইভারের হাতে। গাড়িটা সাঁ করে বের হয়ে গেলো পাড়া থেকে। কৌতুহল আর চেপে রাখতে না পেরে ময়না গেলো সর্দারনীর কাছে। সর্দারনীকে সবাই অনেক ভয় করে। তার সাথে নিজে থেকে কথা বলার সাহস শুধু ময়নার আছে কারণ কেন জানি সর্দারনী ময়নাকে একটু স্নেহের চোখে দেখেন।
.
ময়না এসে সোজা জিজ্ঞেস করলো, " এই বড়লোকের বউ দুটা কেন এলো মাসি? কি দিলে তুমি তাদেরকে?" সর্দারনী মুখ বাঁকিয়ে বললো, " চক্রবর্তীদের বাড়ির বউ এরা। সামনে তো দূর্গাপুজা। তাদের অনেকবছরের পারিবারিক পুজা আর মা কে নিজেদের বাড়িতেই বানায়। সেজন্য এসেছিলো এখান থেকে একটু মাটি নিতে। আমাদেরকে সারাবছর ঘৃণা করে দূরে ঠেলে রাখে আবার পুজার সময় আমাদের এখানের একটু মাটি ছাড়া মা কে বানাতে পারেনা। ভগবানের কি বিচার! "
.
ময়নার কাছে এই তথ্য একদম নতুন। তার জানার কথাও না। তার জন্ম তো আর এই পাড়ায় হয়নি। তার আসল নামও ময়না না। বাবা-মা কত শখ করে নাম রেখেছিলো সাবেত্রী। সত্যবানের স্ত্রী সাবেত্রী যে কিনা নিজের স্বামীর জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য যমরাজকে বুদ্ধির জোরে হারিয়েছিলো। ময়নার কপালে সাবেত্রী হয়ে স্বামীকে রক্ষা করা ছিলোনা। বাবা-মা নিজেদের পছন্দের সত্যবানকে খুঁজে এনেছিলো তার সাথে বিয়ে দিতে কিন্তু ময়নার হৃদয়ে সত্যবান হিসেবে ছিলো অন্য কেউ। একদিন রাতে ময়না তার হৃদয়ের সত্যবানের হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে পরলো। ১ সপ্তাহ সংসার করলো তারা। শেষে কলিযুগের সত্যবান নিজে না মরে সাবেত্রী ময়নাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে এই পাড়ায় বিক্রি করে দিয়ে চলে গেলো। সেই থেকে ময়না এখানেই আছে।
.
মাসি তখনো বলেই চলেছে, " মা কে বানাতে লাগে আমাদের মাটি আর আমরা সেই মাকে পুজা দিতে পারিনা। সব পুরুষ এসে আমাদের নষ্ট করে যায়। সবাই আমাদের ঘৃণা করে। কিন্তু মা নিজের দেহে আমাদের মাটিকে ধারণ করেন। তিনি তো মা তাই তার কোন সন্তানকেই অবহেলা করেন না।"
ময়না তখন বলে উঠলো, " আচ্ছা মাসি সবসময় তো এই পাড়ায় পুরুষরাই আসে। তবে মাটি নিতে চক্রবর্তী বাড়ির বাবুরা না এসে গিন্নিরা আসলেন কেন? "
মাসি উত্তর দেয়ার আগেই কুসুম বললো, " আরে বুঝিস না? বাড়ির ব্যাটাদেরকে পাঠায়নি ভেবেছে খারাপ জায়গা চিনে যাবে। তারা তো আর জানেনা যে তাদের বাড়ির সব ব্যাটাই গভীররাতে আমাদের এখানে আসে।"
.
কুসুমের কথা শুনে মাসি সহ সবাই একসাথে হেসে উঠলো অনেক জোরে। হাসতে হাসতে যে যার ঘরে ঢুকে গেলো।
যতই দিন যাচ্ছে ময়না পৃথিবীর কতো কিছুই যে শিখছে।
.
রাতে ঘুমানোর আগে বাবা-মা এর সাথে কাটানো পুজার দিনগুলোর কথা মনে করে অনেক কাঁদলো ময়না। কতো আনন্দের দিন ছিলো। পুজার সময় মায়ের প্রতিমার সামনে থেকে হাতি দিয়ে টেনেও তাকে উঠানো যেতোনা আর এখন তার কোন অধিকার নেই পুজামন্ডপের আশেপাশে যাওয়ার।
.
দেখতে দেখতে পুজা চলে এলো। সারাদিন ঢাকের আওয়াজ আর পুজা অর্চনা চলছে। সবাই যাচ্ছে প্রতিমা দর্শন করে আশির্বাদ নিতে। শুধু ময়নাদের এই পাড়ায় পুজা আসেনি। দেবী যেন জাত, কুল বাছাই করে সবাইকে আশির্বাদ করবেন। পুজার আনন্দে ছেলে-বুড়ো কারো চোখে ঘুম নেই। ঘুম নেই ময়নার চোখেও। তার মাথায় একটাই চিন্তা। এতোদিন সে দেবী মায়ের আশির্বাদ পেয়েছে কিন্তু এখন কেন পাবেনা? সে নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে? কিন্তু সে তো নিজে নষ্ট হয়নি। তাকে তো কিছু পুরুষ নষ্ট করেছে। সেই পুরুষদের যদি পুজা মন্ডপে যেতে বাধা না থাকে, দেবী মা যদি তাদেরকে আশির্বাদ করতে পারেন তবে ময়নাকে কেন করবেন না? ময়না মনে মনে ঠিক করে ফেললো যেভাবেই হোক সে যাবে পুজামন্ডপে। তার দৃঢ় বিশ্বাস একবার মায়ের পায়ের কাছে বসে তার কষ্টের কথা বললেই হবে। মা তার সব কষ্ট দূর করে দিবেন। কিন্তু কিভাবে যাবে সে? এই পাড়া থেকে তো বের হওয়া নিষেধ তাদের। কিন্তু যেভাবেই হোক তাকে বের হতেই হবে।
.
দশমীর দিন সকাল থেকে ময়না অস্থির বোধ করছে। আজকে পুজা শেষ হয়ে যাবে আর সে এখনো দেবী মায়ের কাছে যেতে পারলোনা। দুপুরবেলা অনেক সাহস করে একটা শাড়ি পরে মুখ ঢেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে এলো ময়না ঘর থেকে। এইসময় তাদের পাড়া থাকে নির্জন। নিজেদের ঘরে বিশ্রাম নেয় সবাই। দ্রুত হেটে ময়না পাড়া থেকে রাস্তায় চলে এলো। দাড়োয়ান কাকার থেকে কথায় কথায় আগেই চিনে নিয়েছিলো চক্রবর্তীদের বাড়ি। আর ঢাকের আওয়াজ এমনিতেও জানান দিচ্ছে কোথায় আছেন দেবী। ময়নার পুজা মন্ডপে পৌছাতে খুব বেশি সময় লাগলোনা। বাড়ির মেয়েরা শেষ আশির্বাদ নিয়ে নিচ্ছে দেবীর কাছ থেকে। একটু পরেই দেবীকে নিয়ে যাওয়া হবে বিসর্জনের জন্য। সুযোগ বুঝে ময়না চলে গেলো দেবীর পায়ের কাছে। মুখ থেকে কখন যে কাপড়টা সরে গিয়েছে খেয়াল ছিলোনা তার। একটা মহিলা এসে তাকে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি কোন বাড়ির? তোমাকে তো চিনলাম না। এখন তো আমাদের পরিবারের সবাই আশির্বাদ নিচ্ছি। আমাদের শেষ হলে তুমি এসো।" ময়না ভয় পেয়ে গেলো। কোনরকমে বললো, " আমি বেশিক্ষণ থাকবোনা। আমাকে একটু মায়ের আশির্বাদ নিতে দিন। আমি চলে যাচ্ছি।" তাদের কথা শুনে আরো কিছু মহিলা এগিয়ে এসেছিলেন। একজন মহিলা তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আঁতকে উঠে বললেন, " হারামজাদি, নিজে তো নরকে যাওয়ার পথেই আছিস এবার কি আমাদের চক্রবর্তী পরিবারকেও নরকে পাঠাবি? তোর সাহস কিভাবে হলো মায়ের কাছে আসার? তোকে দেখেই চিনেছি আমি। মাটি আনার সময় আমাদের গাড়িতে উঁকি দিচ্ছিলি। এক্ষণ বেড় হয়ে যা।"
ময়না অনুনয় করে বলতে লাগলো, " একটিবার আমাকে মায়ের পা স্পর্শ করতে দিন দয়া করে। আমি তো কারো ক্ষতি করিনি। মা তো সবার। "
গোলমাল শুনে বাড়ির কর্তা ব্যক্তিরা এগিয়ে এলেন। প্রায় সবাই ময়নাকে চিনতে পারলেন কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। নরকে যাওয়ার ভয় থেকে এখন মানইজ্জত যাওয়ার ভয় বেশি তাদের। বড়কর্তা শুধু একজন দাড়োয়ানকে ইশারা করলেন ময়নাকে বের করে দেয়ার জন্য। দাড়োয়ান এসে ময়লার বস্তার মতো টানতে টানতে ময়নাকে বাইরে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে এলো।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আশেপাশে বিদায়ের করুণ সুর। একবছর পরে দেবী আবার আসবেন মর্তলোকে। এখন যে বিসর্জন দিতে হবে। নদীতে দেবীকে বিসর্জন দিয়ে সবাই নিজেদের বাসায় ফেরত চলে আসছে। এমন সময় নদীতে গিয়ে ঝাপ দিলো ময়না। ডুবসাঁতার দিয়ে সে দেবীকে খুঁজছে। যেভাবেই হোক দেবীর পায়ে হাত দিয়ে তাকে আশির্বাদ নিতেই হবে।
Коментарі