পার্থিব জীবন ছলনাময় , ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়
ধরে নিন আপনার বয়স ৫৫ বছর । আপনি এখন কোমায় আছেন , আপনার হাসিখুশী আনন্দময় জীবনে হঠাৎ নেমে এসেছে কল্পনাতীত এক দূর্ঘটনা , আপনি স্ট্রোক করেছেন ( brain stem infarction) ......... আপনি আইসিইউতে শয্যাশায়ী । আপনার মস্তিষ্কের রেসপন্স খুবই সামান্য পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা । আপনার চোখের উপর আলো ফেলছেন কিছুক্ষণ পরপর চিকিৎসক ! আপনার চোখের রিয়েকশান কমে আসছে । চিকিৎসক চিন্তিত ! আপনার মস্তিষ্কের ভেতর স্মৃতিকোষ গুলো চিরতরে ঘুমিয়ে যাবার আগে পুরোনো স্মৃতি গুলো রিলে করে নিচ্ছে - এটাই হয়তো শেষবার , সর্বশেষবার !
আপনি হঠাৎ অনুভব করলেন - আপনার পাশে দাঁড়ানো আপনার স্নেহের দুই সন্তান ! আপনার মস্তিষ্ক ঘুমিয়ে যাবার আগে শুনছে আপনার সন্তানদের কথোপকথোন , আপনাকে নিয়ে তাদের ভাবনা । আপনার এক সন্তান বলছে তার ভাইকে - ‘ বাবার আশা ক্ষীণ ! ডাক্তারও তেমন আশাবাদী নন ! কি করবি ভাইয়া ? ‘ আপনার বড় সন্তান বলছে - ‘ আশা দিতে তো পারছেনা ডাক্তাররা ! দেখি আর এক দুই দিন , কি বলিস তুই ? আম্মাকে বলা যাবেনা । কান্নাকাটি করবে । আব্বার বয়েস হইছে , আর কষ্ট না পাক আব্বা ! আমি এটা চাই ! ‘
আপনি ধরে নিবেন আপনি এখন আশাহীনের দলে চলে গেছেন । আপনাকে নিয়ে আপনার আপনজনরাই বড়জোড় ৪৮ ঘন্টা পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে । আপনি আত্মসমর্পণ করেছেন প্রকৃতির করুণার কাছে । আপনাকে নিয়ে আপনার সন্তানরা চিন্তিত , আপনাকে তারা কষ্ট দিতে চাননা ! অর্থাৎ তারা চায় আপনার ব্যাথাহীন অন্তীম পরিণতি । আপনি চিৎকার করে বলতে চাচ্ছেন - ‘ না ! হাল ছাড়িস না তোরা ! আমি তোদের জন্য হাল ছাড়িনি । আমি বাবা হিসেবে কতো শ্রম দিয়েছি , কখোনো ঘন্টার হিসেব করিনি , তোরা অসুস্হ্য হলে কখোনো বলিনি - ‘ ৪৮ ঘন্টা দেখবো ! ‘ এতো নিষ্ঠুর হইসনা তোরা আমার প্রতি ! ‘ আপনি পারছেন না ! আপনার হার্ট বিট বাড়ছে , ঘনঘন শ্বাস পড়ছে ! আপনি চাচ্ছেন বুঝাতে - আপনি কষ্ট পেয়ে হলেও বাঁচতে চান ।
প্রকৃতি আজ আপনার উপর রূঢ় ! প্রকৃতি আপনাকে সুযোগ দিতে চায়না আর ! আপনি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী , বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক , ইয়া বড় ডিগ্রীধারী , বিশিষ্ট বিজ্ঞানী - এসব প্রকৃতির কাছে এখন নস্যি ! আপনার জীবনের মূল্য আর ঐ রাস্তার ঘুমিয়ে থাকা দ্বিগম্বর লুলু পাগলের জীবনের মূল্য প্রকৃতির কাছে এক । প্রকৃতি ইনজাস্টিজ করেনা , করতে পারেনা ।
আপনার মস্তিষ্ক আবারো রিলে করা শুরু করলো , ‘ তাহলে কি নিয়ে আমি অসীমের দিকে যাত্রা করবো ! কি নিয়ে ? ‘ আপনি অনেকের বদ দোয়া গায়ে মাখিয়েছেন । এই তো কিছুদিন আগেও আপনার দারোয়ান রহিমকে বলেছেন - ‘ শুয়োররে বাচ্চা ! গাড়ি মুছিস নি কেনো ? ‘ দারোয়ান চুপ করে বললো - ‘ মাফ করে দেন স্যার ! ‘ আপনি এখন বুঝছেন - রহিমের কাছে মাফ চাওয়া জরুরী , কিন্তু রহিম এখানে নেই ! আপনি যেই বাড়ি বানিয়েছেন গতবছর ইতালিয়ান টাইলস দিয়ে - সেখানের অন্দরমহলও আপনার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে কিছুক্ষণ পরই , আপনার সন্তানরা চাচ্ছেন আপনার চিরবিদায় , তারা রিস্ক নিতে চায়না , ভদ্রভাবে আপনার সামনেই একভাই আরেক ভাইকে বললো - ‘ উঁহু ! বাবাকে আর কষ্ট দিতে চাইনা ! ‘ এটা ডিপ্লোম্যাটিক কথা । একভাই আরেক ভাইয়ের কাছে নিজেকে জাস্টিফাই করলো ।
দিন শেষে আপনি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন - এই যে ডিগ্রী , বাহাদুরী , সব নস্যি ! আপনি অনুভব করলেন - সবই প্রকৃতির চক্র ! যতোক্ষণ মানুষের জীবন , যতোক্ষণ আপনি অর্থের জোগান দাতা - ততোক্ষণই আপনের মূল্যায়ন ! আপনি নিজের কলফ বা আত্মাকে প্রশ্ন করলেন - ‘ আমার নিজের কি আছে ? ‘ আপনার আত্মা চুপ করে বললো - ‘ স্যার ! আপনার ব্যক্তিগত আমল বা সন্চয় প্রায় শূণ্য ! ‘ আপনি ভুলে গিয়েছিলেন আপনার ফুসফুসে - একটা মাম পানির বোতলের সমান ৫০০ মিলি বাতাস দিয়ে আপনি চলতেন , এটুকু বাতাসের উপর ভর দিয়েই আপনার হৃৎপিন্ডও ধুকধুক করতো ! সেই বাতাসটুকুর বাহাদুরীও এখন শেষের পথে ।
আপনি আর ঐ দায়োয়ান রহিম আজ প্রকৃতির কাছে সমান । নো ডিফারেন্সিয়েশান । বরং দারোয়ান রহিম আপনার চেয়ে এগিয়ে । সে মাজলুম বা নির্যাতিত সম্প্রদায় । প্রকৃতি তাকে গরীব বানিয়ে পাঠিয়েছিলো ! সে কাওকে ঠকায়নি / সুযোগ পায়নি । আপনার পার্থিব সম্পদ বেশি - আপনার উপর প্রকৃতির প্রতিশোধ বা জিজ্ঞাসাও হবে বেশি ! প্রকৃতি ছাড় দেয়না , দেবেনা !
এসব ভাবতে ভাবতেই আপনি শুনলেন ডক্টর চিৎকার করে উঠলো - ‘ সিস্টার ! Bradycardia ( হার্টবিট কমে যাচ্ছে ) হচ্ছে ! Adrine ( এড্রেনালিন ) রেডি করেন ! ডিসি শক তৈরি করেন ! ‘ আপনার মস্তিষ্ক শুধু কুয়াশা দেখছে এখন ! কুয়াশার মধ্যেই আপনার দারোয়ান রহিম দাঁড়িয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলছে - ‘ স্যার ! আমি শুয়োরের বাচ্চা ছিলাম না , আমি গরীব , আমিও মানুষ ! ‘
আপনি হাত জোর করে ক্ষমা পেতে চাচ্ছেন ....... সিপিআর চলছে ....... আপনার বুকে একের পর এক ডিসি শক চলছে ........ আপনার হার্ট বিট কমে আসছে ...... ৭০.... ৫৩....... ২৩ .......... ১৩ .....
Comments