প্রশ্নোত্তর
প্রাণের জন্ম কোথা থেকে? প্রাণ এই শরীরে কিভাবে আগমন করে? আত্মা নিজেকে স্বতন্ত্র রেখে কিভাবে এই শরীরে অবস্থান করে? এই প্রাণ কিভাবে এই শরীর হতে বের হয়ে যায়? প্রাণ কিভাবে বাহ্য (আধিভৌত ও আধিদৈব) বিষয়কে ধারণ করে? প্রাণ কিভাবে আধ্যাত্ম (দেহেন্দ্রিয়াদি) বিষয়কে ধারণ করে? (বিঃদ্রঃ প্রাণতত্ত্বে আগ্রহীরা পোস্টের প্রতিটা লাইন পড়তে পারেন)
উত্তরঃ
এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা হতে পারে৷ তবে আমি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বিশ্লেষণ করব প্রশ্ন উপনিষদের "তৃতীয় প্রশ্ন" অংশ থেকে।
আত্মা হতেই এই প্রাণ জন্মলাভ করে। আত্মা হলাম আমি নিজে আর প্রাণ হলো আমি ও আমার শরীর একসাথে যে কাজগুলো করি। ছায়া যেরূপ মানুষের দেহকে আশ্রয় করে থাকে, সেই প্রকার এই প্রাণও আত্মাতেই আশ্রিত আছে। আত্মা ও প্রাণ স্বতন্ত্রভাবে থাকতে পারে না৷
প্রাণকে যদি আমরা সম্রাট চিন্তা করি তবে প্রাণের পাঁচটি প্রাণবায়ু ও ইন্দ্রিয়সমূকে আমরা সামন্ত রাজা হিসেবে চিন্তা করতে পারি। সম্রাট যেমন সামন্ত রাজাদের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন কাজের ভার প্রদান করে মূখ্য প্রাণও তেমন সামন্তস্থানীয় পাঁচটি প্রাণবায়ু এবং ইন্দ্রিয়গণকে দেহের বিভিন্ন অংশের দায়িত্ব প্রধান করে। পাঁচটি প্রাণবায়ুর মধ্যে একটার নামও প্রাণ তাই সম্রাটস্থানীয় প্রাণকে মূখ্য প্রাণ বলা হচ্ছে।
মূখ্যপ্রাণ আপানবায়ুকে মলদ্বার ও জননেন্দ্রিয়ে নিযুক্ত করে। আপানবায়ুর গতি নিম্নমুখী এবং এটার কাজ হচ্ছে বিসর্জন (elimination and excretion). প্রাণবায়ু মখ ও নাসিকা পথে সঞ্চারিত হয়ে চোখ ও কর্ণে অবস্থান করে। এটার গতি উর্ধমুখী এবং কাজ হচ্ছে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করে (respiration/শ্বসন)।
"দ্বাবিমৌ বাতৌ বাত অসিন্ধোরা পরাবতঃ।
দক্ষং তে অন্য আবাতু ব্যহন্যো বাতু যদ রপঃ।।"
- অথর্ববেদ (৪/১৩/১)
অনুবাদঃ প্রাণ বায়ু ও অপান বায়ু দুইই প্রবাহিত হইতাছে৷ অপান বায়ু সমুদ্র সদৃশ গভীর ফুসফুস হইতে আসিতেছে এবং প্রাণবায়ু দূর বায়ুমন্ডল হইতে আসিতেছে। প্রাণবায়ু তোমার জন্য বল সঞ্চয় করিতেছে এবং অপান বায়ু শরীরের রোগ পাপকে শরীর হইতে বাহির করিতেছে।
অর্থাৎ, প্রাণবায়ু ( অক্সিজেন) ও অপান বায়ু (কার্বনডাই-অক্সাইড) এর গ্রহণ ও পরিত্যাগ হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় শ্বসন। অন্যদিকে বল সঞ্চয় ও শরীরের রোগ পাপ শরীর হইতে বের করা হচ্ছে কোষীয় শ্বসন।
সমান বায়ু প্রাণ ও আপানের বায়ুর মধ্যভাগে তথা শরীরের নাভিদেশে অবস্থান করে। এই সমানবায়ু মানুষের জঠরাগ্নী তথা উদরে জীর্ণ খাবারকে রক্ত-রসাদিতে (digestion and assimilation) পরিনত করে দেহপুষ্টি সম্পাদন করে।
হৃদয়াকাশেই আত্মার বসবাস চিন্তা করা হয় কারন যোগীগণ হৃদয়াকাশেই জ্যোতিরূপে আত্মাকে দর্শন করে। এই হৃদপিন্ডে ১০১ টি নাড়ী, প্রত্যেক নাড়ীতে আবার ১০০ শাখা নাড়ী আছে, প্রত্যেক শাখানাড়ী আবার ৭২,০০০ প্রশাখাতে বিভক্ত। এই সকল নাড়ী ও এদের শাখাপ্রশাখায় ব্যানবায়ু বিচরণ করে। এই ব্যানবায়ুর কাজ হচ্ছে রক্তসঞ্চালন (blood circulation), স্নায়বিক শক্তির সঞ্চারণ (transmission of nervous force) এবং বীর্যসাধ্য কাজ (performance of works of muscular strength) করে।
জীবগণ যে মৃত্যুর পর পার্থিব লোক হতে অন্য লোকে গমন করে সেই সঞ্চারণ ক্রিয়া উদানবায়ু দ্বারাই সম্পন্ন হয়ে থাকে। উদানবায়ুই সুষুষ্না নাড়ীপথে উর্ধগামী হয়ে আত্মাকে দেহ হতে মুক্ত করে।
এই পাঁচটি প্রাণবায়ুর বাইরেও আরেকটা প্রাণ থাকে যাকে বাহ্য প্রাণ বলে। সূর্যই বাহ্য প্রাণ কারণ এই প্রাণ জীবদেহের বাইরে অবস্থান করে। মানুষের শরীর অভ্যন্তরে যে প্রাণশক্তি কাজ করতেছে সেই একই প্রাণশক্তি বহির্জগতেও ক্রিয়াশীল। জীনবদেহের যে প্রাণবায়ু চোখে দৃষ্টির অনুভূতি জাগ্রত করে সেটা সূর্যের প্রাণশক্তি কারণ সূর্য উদিত হলেই যেকোন বস্তু দেখার জন্য আলো সৃষ্টি করে। পৃথিবীর অধিষ্ঠাত্রী যে প্রাণ-দেবতা (অগ্নি) সেটাই দেহস্থ আপানবায়ুর অনুঘটক। পৃথিবী যেভাবে সকল বস্তুসমূহকে নিচের দিকে আকর্ষণ করে আপানবায়ুও দেহস্থ বর্জসমূহকে নিচের দিকে নিয়ে আসে। সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যস্থ যে আকাশ সেই আকাশে অধিষ্ঠাতা প্রাণশক্তিই সমানবায়ুর অনুঘটক। বাইরের যে সাধারণ বায়ু তাহার অধিষ্ঠাতা প্রাণশক্তিই ব্যানবায়ুর অনুগ্রাহক। বাহ্য বায়ু যেভাবে সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে বিচরণ করে, ব্যানবায়ুও শরীরের সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে বিচরণ করে।
বাহ্য প্রাণ সূর্যের আগ্নেয় তেজ যে প্রাণশক্তি বিদ্যমান সেটাই উদানবায়ু রূপে জীবদেহে ক্রিয়া করে। উদানবায়ু তেজঃস্বভাব এবং এই উদানবায়ুর কারণে আমাদের শরীর উত্তপ্ত অনুভূত হয়। জীবের মৃত্যুকালে শরীর হতে উদানবায়ু বহির্গত হলেই শরীরের দৈহিক তেজ কমে গিয়ে একসময় শীতল হয়ে যায়।
উদানবায়ু দেহ হতে বহির্গত হওয়ার ফলে জীব যখন মৃত্যুমুখে পতিত হয় তখন সকল ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াগুলো লুপ্ত হয়ে মনের ক্রিয়ার সাথে মিশে যায় এবং তখন কেবল মনের ক্রিয়াই বর্তমান থাকে।
Comments