পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ
সন্তান জন্ম দান ও লালন-পালনকারী পিতা-মাতা বৃদ্ধ বয়সে যাতে সন্তান কর্তৃক অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার না হন সে জন্য পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ পাস হয়। এশিয়ায় ভারত ও সিঙ্গাপুরেও পিতামাতার ভরণপোষণের আইন আছে, উভয় দেশে সন্তান পিতামাতার ভরণপোষণ দিতে আইনত বাধ্য। তবে পার্থক্য হলো, তাদের আইনে আদালত দেওয়ানি প্রতিকার হিসেবে ভরণপোষণ বাবদ নির্দিষ্ট অর্থ প্রদানের আদেশ দিতে পারেন। কিন্তু আমাদের আইনে ভরণপোষণকে যখন অর্থের বদলে সেবা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে এবং তার লঙ্ঘনকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তখন এই আইনটি বাস্তবে কতটুকু প্রয়োগ করা সম্ভব, আর তার ফলে বৃদ্ধ পিতামাতার সামাজিক নিরাপত্তা তাতে কমবে কি না, তা একটি বড় প্রশ্ন।।
পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন কী?
পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন একটি জনকল্যাণকর আইন। বাংলায় প্রণীত এ আইনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, যেহেতু সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয় সেহেতু আইনটি প্রণয়ন করা হলো। অর্থাৎ কোনো সন্তান যদি কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে পিতা-মাতার ভরণপোষণ না করে তাহলে তারা ভরণ-পোষণের জন্য এ আইনের অধীনে লিখিত অভিযোগের মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায় করতে পারবেন। আইনে ভরণপোষণ প্রদানে সন্তান বলতে শুধু পুত্রকেই বোঝায়নি বরং কন্যাকেও বুঝিয়েছে। অর্থাৎ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব শুধু ছেলের একার নয় বরং মেয়েকেও নিতে হবে। আর ভরণপোষণ শুধু কোনো বিশেষ সন্তান নেবে তা নয় বরং সবাইকে নিতে হবে। তবে একাধিক সন্তান থাকলে তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে তাদের পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করবে। কোনো সন্তান পিতা-মাতাকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধাশ্রম বা অন্য কোথাও একত্রে বা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। প্রত্যেক সন্তানকেই তাদের পিতা-মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে এবং চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে। পিতা-মাতা একত্রে বা আলাদা বসবাস করলে প্রত্যেক সন্তানকে সাধ্যমতো তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে।
পিতা-মাতা যদি সন্তানের সঙ্গে বসবাস না করেন তবে তাদের প্রত্যেক সন্তান নিজ নিজ উপার্জন থেকে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ প্রদান করবে।
আইনটি শুধু পিতা-মাতার ভরণপোষণ বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পিতা-মাতার অবর্তমানে দাদা-দাদি ও নানা-নানির ভরণপোষণ বিষয়েও জোর দিয়েছে। পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদিকে এবং মাতার অবর্তমানে নানা-নানিকে পিতা-মাতার মতো ভরণপোষণ দিতে হবে।
কেউ যদি এই বিধানাবলি লঙ্ঘন করে তবে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড হতে পারে। অনাদায়ে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদন্ড প্রদান করতে পারে আদালত। এছাড়া কোনো সন্তানের স্ত্রী বা স্বামী কিংবা পুত্র-কন্যা বা অন্য কোনো নিকটাত্মীয় যদি পিতা-মাতা বা দাদা-দাদি বা নানা-নানির ভরণপোষণ প্রদানে বাধা দেয় বা অসহযোগিতা করে তবে তার সাজাও উপরোল্লিখিত দন্ডের মতোই হবে।
আইনে কেউ অপরাধ করলে অবশ্যই তা আমলযোগ্য। এই আইনের অধীনে দায়েরকৃত মামলায় জামিনও পাওয়া যেতে পারে। মামলায় আপস-মীমাংসারও সুযোগ রয়েছে।
অপরাধের অভিযোগ দায়ের ও বিচার হবে প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। তবে অপরাধের লিখিত অভিযোগ পিতা-মাতাকেই দায়ের করতে হবে। অন্যথায় আদালত তা গ্রহণ করবেন না। পিতা-মাতার অবর্তমানে কে লিখিত অভিযোগ করার অধিকারী সে বিষয়ে আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি।
সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিতকরণের লক্ষে প্রণীত আইন ৫/৫ (০১) এবং ৫(২) ধারায় চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার সুহিলপুর পশ্চিম পাড়ার মোঃ লিয়াকত আলী (৬০), তার বড় সন্তান ইয়াসিন রানা (৩০) তার স্ত্রী, শ্বশুর শ্বাশুড়িসহ ৫ জনকে অভিযুক্ত করে চাঁদপুর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ৪ এ মামলা দায়ের করেন। মামলার অভিযোগে মোঃ লিয়াকত আলী উল্লেখ করেন, ১নং বিবাদী মোঃ ইয়াসীন রানা তার ছেলে। বিগত ২০০৪ সালে লিয়াকত আলী .৩৯ একর জমি বিক্রি করে তার সন্তানকে ৩ লাখ টাকা খরচ করে আবুধাবীতে পাঠান। সেখানে ইয়াসিন রানা বাংলাদেশী টাকায় ৫৬ হাজার টাকা বেতনে চাকুরি করে। আবুধাবী যাওয়ার পর অপর আসামীদের কুপরামর্শে বাদী লিয়াকত আলী ও তার স্ত্রী মোসাঃ মাজেদা খাতুন (৫৫)-এর সাথে সে যোগাযোগ, চিকিৎসাসেবা ও ভরণ-পোষন না দিয়ে অপর বিবাদীদের সাথে যোগাযোগ করে বিদেশ থেকে ইয়াসিন রানা টাকা-পয়সা তার স্ত্রী রাশিদা আক্তার রিতার কাছে পাঠাতো। অপর বিবাদীদের আপত্তির কারণে বাদী লিয়াকত আলী ও তার স্ত্রী মাজেদা খাতুনের ভরণ-পোষন না করে বিদেশ থেকে পাঠানো সকল টাকা রাশিদা আক্তার রিতা, তার পিতা শেখ মোঃ বাদল (বাবুল), রিতার মা লুৎফা বেগম ও রিতার ভাই সোহেল তাদের সংসারে ঐসব টাকা খরচ করে দেয়। লিয়াকত আলী ও মাজেদা খাতুন তাদের সন্তানের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে অপর বিবাদীগণের আপত্তির কারণে তারা যোগাযোগ করতে পারেনা। এমতাবস্থায় লিয়াকত আলীর ছেলে আলআমিন ও হাবিবুর রহমান জিলানীর লেখাপড়া এবং তাদের উপার্জন করার কোন পথ না থাকার কারণে অনাহারে অর্ধাহারে থেকে দিন কাটাতে হয়। গত ১ নভেম্বর’২০১৩ সালে ১নং বিবাদী ইয়াসিন রানা দেশে এসে অপর বিবাদীগণের পরামর্শে নিজ বাড়িতে না গিয়ে ঢাকা থেকে ঢাকা নবাবগঞ্জের দেওতলা গ্রামে শ্বশুড় বাড়িতে চলে যায়। সেখান থেকে ১৪ নভেম্বর লিয়াকত আলী বাড়িতে এসে ইয়াসিন রানাসহ অপর বিবাদীগণ তার পিতা-মাতাকে ভরণ-পোষন, চিকিৎসাসেবা না দিয়ে উল্টো বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধমকি দিয়ে জমি-জমা, সহায় সম্পত্তি সকল কিছু ইয়াসিন রানার নামে রেজিস্ট্রি করে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে । না দিলে প্রাণে মেরে ফেলার জন্য দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হুমকি দেয়। এমতাবস্থায় উপায়ন্তর না পেয়ে গত ১৯ নভেম্বর’২০১৩ ইং তারিখে মঙ্গলবার মোঃ লিয়াকত আলী বাদী হয়ে ইয়াসিন রানা, রাশিদা আক্তার রিতা, শেখ মোঃ বাদল, লুৎফা বেগম ও মোঃ সোহেলকে বিবাদী করে চাঁদপুর বিজ্ঞ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৪ এর বিজ্ঞ বিচারক মোঃ শওকত হোসাইনের আদালতে ২০১৩ সনের ৪৯নং আইন সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করণের লক্ষে প্রণীত আইন ৫/৫ (০১) এবং ৫(২) ধারায় অভিযোগ দায়ের করে। বিজ্ঞ বিচারক ঐ অভিযোগের প্রেক্ষিতে মামলার প্রধান আসামী মোঃ ইয়াসীন রানার বিরুদ্ধে সমন জারি করেন।
বাংলাদেশে পিতামাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য আইনের কাঠামোয় আনা হয়েছে। ২০১৩ সালে গৃহীত ‘পিতামাতার ভরণপোষণ আইনে’ দায়িত্ব লঙ্ঘনের অপরাধে দণ্ডিত করার সুযোগ রাখা হয়েছে। আইনটি গ্রহণের পর সাত বছর পেরিয়ে গেছে, এটা নিয়ে খুব একটা বিতর্ক হয়নি।
আইনটি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে পিতা বা মাতার সর্বনিম্ন বয়সসীমা, উপার্জনের উৎস বা আর্থিক সক্ষমতার কথা উল্লেখ করা হয়নি। ‘সন্তান’-এর ক্ষেত্রেও শুধু ‘সক্ষম ও সামর্থ্যবান’ সন্তানকেই বোঝানো হচ্ছে। কোনো বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি।
পিতামাতার যদি বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে থাকে বা তাঁরা যদি পৃথক বসবাস করেন, তখন সন্তানেরা কাকে ভরণপোষণ দেবেন বা কার সঙ্গে বসবাস করবেন ও পরিচর্যা করবেন—এই বিষয়গুলো অস্পষ্ট রয়ে গেছে আইনটিতে।
আইনটিতে ‘সন্তান’-এর সংজ্ঞায় পুত্র বা কন্যাসন্তানের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ রাখা হয়নি। এটি আপাতদৃষ্টিতে স্বস্তিকর হলেও একটি বড় প্রশ্ন কিন্তু থেকে যায়। যেখানে সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পারিবারিক আইনের আওতায় এখনো কন্যাসন্তানকে পিতামাতার সম্পত্তির সমান অংশীদার ভাবা হয় না, সেখানে ভরণপোষণের ব্যয় নির্বাহের বেলায় সেই বিভাজনটির কোনো প্রতিফলন যদি না থাকে, তবে তাতে কন্যাসন্তানের প্রতি আইন দিয়েই অবিচার করা হবে।
ছেলেরা পিতা–মাতাকে দেখাশোনা করার সুযোগ পেলেই যে তা করে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমন ঘটনা সমাজে অহরহ পাওয়া যায়। কিন্তু মেয়েরা এমন সুযোগ পেয়ে করছে না, সে উদাহরণ পাওয়া দুষ্কর।
বিধিমালায় সক্ষম ও সামর্থ্যবান সন্তানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, পরিবারের ভরণপোষণের ব্যয় নির্বাহে সক্ষম সব ব্যক্তি। অর্থাৎ পরিবারের আয়-উপার্জনকারী সন্তানের বয়স ১৮ বছরের নীচে হলেও এই আইনের আওতায় তার ওপর ভরণপোষণের দায়িত্ব বর্তায়।
তা ছাড়া, পিতামাতা যদি সন্তানের প্রতি নির্যাতনপ্রবণ হয় বা সন্তানকে শৈশবেই পরিত্যক্ত করে থাকে, সে ক্ষেত্রে ভরণপোষণের দায়িত্বে কোনো ব্যতিক্রম রাখা হয়নি আইনটিতে।
সামাজিক সমস্যার সমাধান আসলে করতে হবে সামাজিকভাবেই। কঠোর আইন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যায় না।
Comentarios