পরিণাম
আমার আম্মা ছিলেন অতি রুপবতী মহিলা । এমন ডাগর চোখ আর লম্বা বাঁশির মতো নাকের মেয়ে আমি খুব কমই দেখেছি।এই রুপ নিয়ে তার মতো বড়াই বোধহয় আর কেউ করেনি। আমি তখন ছোট, আম্মার একমাত্র সন্তান বলে আমাকে তার নাগালের বাইরে যেতে দিতেন না তিনি কখনো। আমিও তার আঁচল ছেড়ে দূরে কোথাও যেতাম না ।অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল এটা আমার। আমার মায়ের অগুণিত ভালো গুণ থাকলেও অসম্ভব রকমের খারাপ গুণ ছিল একটা। খারাপ গুণটা হলো তিনি কুৎসিত রূপের কাউকে পছন্দ করতেন না।কথাও বলতে চায়তেন না তাদের সাথে।এমনকি তাদের প্রতি যারা দয়া মায়া দেখায় তাদেরকেও তিনি সহ্য করতে পারতেন না। মানুষের কাছে এদের নামে কুৎসা রটনা করে বেড়াতেন।এর সবচেয়ে বড় ভোক্তভোগীটা হলেন আমার ছোট ফুপি নাজমা বেগম।ফুপির চেহারা সুন্দর ছিল না। গায়ের রং ছিল শ্যাম বর্ণের,নাক খানিকটা মোটা।ফুপি যখন ক্লাস টেনে পড়তেন তখন আমি ক্লাস টুয়ে পড়ি।গায়ের রং ভালো না হলেও ফুপির মেধা কিন্তু অসম্ভব ভালো ছিল। আমার খুব ইচ্ছে করতো তখন ফুপির কাছে বসে পড়ি,গল্প করি। কিন্তু আম্মার জন্য তা করা সম্ভব হতো না। আব্বা অবশ্য একদিন নিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন ফুপির পাশে।কী সর্বনাশ!সে রাতে আব্বার ঘরে জায়গা হয়নি। আম্মা সন্ধ্যা থেকেই খিল তুলে রেখেছিলেন ঘরের। আব্বা এসে ডাকলেও খিল খুলে দেয়ার সাহস হয়নি কারোর। সেই রাতে ফুপিকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছি। কাঁদতে কাঁদতে তাকে বলতে শুনেছি,'ও মা,মাগো, তুমি এমন বিচ্ছিরি মেয়ে জন্ম দিয়ে রেখে গেলে কেন? তুমি কী জানতে না এ জগতে কালোদের বড় অবহেলা!ও মা,মা গো, আমার না আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমার তোমার কাছে চলে যেতে মন চায়!' সে রাতে আমিও কেঁদেছিলাম ফুঁপির সাথে। কিন্তু তা ছিল নিরবে, নিভৃতে। কারণ শব্দ করে আমার কাঁদার সাহস হয়নি। মনে খুব ভয় ছিল ,আম্মা যদি আমাকেও ঘর থেকে বের করে দেয় আব্বার মতো।না আম্মা আমায় ঘর থেকে বের করার হুমকি দেয়নি সে রাতে, হুমকি দিয়েছিল ফুপিকে। বলেছিল,'অতই যদি মরার শখ হয় তবে মরছোনা কেন এখনো,যাও মরে যাও। দরজা খুলে দিবো নাকি, ভাইকে সাথে নিয়ে একসাথে মরবে!' ফুপি সে রাতে আর কিছুই বলেননি,কাঁদেনওনি। কাঁদলেও হয়তোবা চুপচাপ কেঁদেছিলেন। কারণ তার মরে যেতে তখন সত্যি সত্যি ইচ্ছে করতো না। তিনি মৃত্যুকে খুব ভয় পেতেন বোধহয়,অথবা আম্মার অহংবোধের একটা শেষ তিনি দেখতে চায়ছিলেন। আমার আব্বা নিজ স্ত্রীর কাছ থেকে এমন উদ্ধত আর নোংরা ব্যবহারের শিকার হয়েও একটু জোরে শ্বাস পর্যন্ত ফেলতে পারেননি তিনি। সবকিছুরই কোন কারণ থাকে এরও একটা কারণ ছিল নিশ্চিত।কারণটার যেটুকু আমি জানতাম তা হলো আম্মার প্রতি আব্বার দূর্বলতা ।আম্মা নাকি ছিলেন ধনীর দুলালি। তার সাথে প্রেম করেই গাঁট ছাঁট বাধা হয়েছিল তাদের বিয়ের।এতে অবশ্য আমার মহা প্রতাপশালী নানারও খানিক ইশারা ছিল। তিনি আব্বার কাছে নানান ওয়াদা দিয়েই তবে নিজের কন্যা তুলে দিয়েছিলেন তার হাতে।এর মাঝে সবচেয়ে বড় ওয়াদা টা ছিল আব্বা আম্মার সাথে কখনো দূর্ব্যবহার করতে পারবেন না। আব্বা করেনওনি কখনো তার সাথে দুর্ব্যবহার। কিন্তু আব্বা নিজে বারবার তার দূর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন। আঘাতের পর আঘাত পেয়েছেন আম্মার কাছ থেকে। আমার দাদিও যে তার দেয়া আঘাত নিয়েই কবরে গিয়েছিলেন সেই কথা আমি শুনেছি পড়শিদের কাছ থেকে। কিন্তু পড়শিরাও এমন ছিল যে আম্মার ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকতো।তারা এই কথা খুব ভালো করেই জেনে গিয়েছিল যে আমার নানার বাড়ির খুব যশ নাম আছে। আম্মার ভাইয়েরা একেকজন মস্ত চাকুরে। তাদের ভয় পাওয়ায় আমার মাকে আরো দাম্ভিক করে তুলে। আগে হয়তোবা তার হাঁটায় খুব একটা আওয়াজ হতো না, এখন আওয়াজ হয়।দপদপ করে মাটি কাঁপে। আমিও বেড়ে উঠতে থাকি আমার দাম্ভিক মায়ের স্নেহের ছায়ায় আর আমার ফুপি বেড়ে উঠেন তার ভাবীর দাম্ভিকতার খোঁচায় খোঁচায়। আম্মার দেয়া আঘাতে ফুপি ব্যথা ফেলেও সে রাতের পর থেকে তিনি আর শব্দ করে কাঁদতেন না।আব্বাও ফুপির পাশে আমায় বসিয়ে দেয়ার মতো এমন দুঃসাহস করেননি আর কখনোই। তারপর একদিন হঠাৎ করেই বাড়িতে দুটো সুসংবাদ আসে- ১-আমার মা সন্তান সম্ভাবা। ২-আমার ফুপির সরকারি প্রাইমারি স্কুলের চাকরি হয়েছে। আমার আব্বার তখন কী যে আনন্দ হলো, আনন্দে তিনি সেদিন ফুপিকে বুকের সাথে আগলে ধরে দরদর করে কেঁদে ফেলেছিলেন। খোদার কী খেয়াল, আমার শ্যাম বর্ণের ফুপি চাকরি পাওয়ার সপ্তাহ তিনেক পরেই কমলার মতো লাল টকটকে বরের সন্ধান পেয়ে যান। আব্বার মুখ থেকে এই কথা শুনে আম্মার সে কি অট্টহাসি। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে চান না আমার ফুপির জন্য এমন কোন ছেলে স্বজ্ঞেনে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসবে। কিন্তু চোখ তো আর সবার সমান না, আমার ফুপির জন্য কিন্তু সেই ছেলেই আত্মীয় স্বজন নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসে। তারপর খুব দ্রুত বিয়ের দিন পাকা করে দেয়। আমার আব্বা, বিয়েটা যদি না হয় এমন ভয়ে একবার পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেননি ছেলের পেশা কী, পরিবার কেমন! আব্বার ইচ্ছে ছিল কোনভাবে একটা সুন্দর ছেলের হাতে বোনকে তুলে দিতে পারলেই হলো, এই হবে আমার আম্মার গালে চপেটাঘাত করা। কিন্তু বিয়ে ঠিক হয়ে গেলেও আব্বা আর কী চপেটাঘাত করবেন তাকে বরং আম্মায় তাকে করলো।এক রাতে আব্বাকে খোঁচা দিয়ে আর পর্দার ও পাশে ফুপিকে শুনিয়ে শুনিয়ে আম্মা বললো,'দ্যাখো আবার,ছেলে চোর চিনতাইকারি না তো!' আব্বা রাগ করে বলেছিলেন,'কী যা তা বলছো,ভাবী হয়ে এমন কথা কেমনে বলতে পারলে তুমি!' আব্বার কথাটা আমিও শুনেছিলাম টেবিলের উপর বসে নিউটনের মহাকর্ষ বল পড়তে পড়তে। কিন্তু কী দূর্ভাগ্য আমার,সে রাতে মহাকর্ষ বল আর আমার শিখা হলো না,আমি রাতের এক তৃতীয়াংশ সময় অতিবাহিত করে যা শিখতে পারলাম তা হলো আমার আম্মার কথার বল।এই কথার বলে বোধহয় শেষের মতো আমার ফুপি আরেকটিবার কেঁদেছিলেনও। কিন্তু সেই কান্না আবার সকালে হাসিতেও পরিণত হয়েছিল যখন ঘটক বাবু এসে বলেছিলেন,পাত্র একটা সরকারি কলেজের লেকচারার।কথাটা প্রথমে আব্বা কিংবা ফুপি শুনেই বিশ্বাস করে ফেলতে পারেননি,একেতো ছেলে দেখতে লাখে একজন আর দ্বিতীয়ত সরকারি কলেজের লেকচারার। কিন্তু পরে খবরাখবর নিয়ে জানা গেল ঘটনা একরত্তিও বানোয়াট নয়। বানোয়াট না হলে কী হবে আমার আম্মার খোঁচা কিন্তু থেমে থাকেনি। তিনি বললেন,'দেখা যাবে কদিন টিকে এ সংসার।এটা তো আর পুতুল খেলা না যে আজ একটা কালো পুতুলের সাথে আমার সুন্দর পুতুলের বিয়ে দিয়ে দিলাম একটু পরে ভেঙে দিবো।' আমার আম্মার অগাধ বিশ্বাস এই বিয়ে ভাঙবেই ভাঙবে। কিন্তু খোদা যদি কলমে আঁচড় দিয়ে লিখে থাকেন কালোর সাথেই কমলা রঙা ছেলের বিয়ে হবে সংসার হবে, সংসার সুখিও হবে। তাহলে মানুষের কী সাধ্য এই ঘর ভাঙ্গার! ফুপির বিয়ে কিন্তু সেবার হয়েই গেল।আর আমার আম্মা অপেক্ষা করতে লাগলেন কবে তাদের সংসার ভাঙবে। সংসার তাদের ভাঙলো না মোটেও,ভাঙলো আমার আম্মার মন। তার প্রচন্ড বিশ্বাস ছিল আম্মার পেট থেকে আকাশের চাঁদের মতো কোনো চাঁদ বের হয়ে আসবে, কিন্তু নয় মাস পর তার পেট থেকে যা বের হলো তা ছিল কৃষ্ণ পক্ষের রাতের মতো কালো। আম্মার মেয়ে বাচ্চা হয়েছে তা আবার কালো এই সংবাদ ফুপি পেয়েছিলেন আব্বার কাছে। কিন্তু তাদের তখন তাড়া। স্বামী স্ত্রী দুজন কানাডায় যাবেন ফুপার বিদেশি এক বন্ধুর বিয়ের নিমন্ত্রণে।আম্মা শুনে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আর কেউ না আসুক, এসে না দেখুক তার এমন কদর্য ফসল।ফুপি সেবার আসতেও পারলেন না। কানাডায়ই প্রথম টের পেলেন তার পেটে নবাগতের আগমন।দেশে ফেরার পর তার শাশুড়ি আর ঘর থেকেই বের হতে দেননি তাকে,পাছে যদি কোন দূর্ঘটনা ঘটে।ফুপিও তাদের কথার বৈরি হননি।কেন হবেন বৈরী,পরের মা যদি তার জন্য এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে বসে তবে কেন তিনি সাত আকাশ মান্য করতে পারবেন না তাকে। এবার আমার মাধ্যমিক পরীক্ষাও হয়ে গেল। লম্বা ছুটি পড়ে আছে আমার।এই ছুটিতে তো কিছুতেই মামার বাড়ি যাবো না আমি, কারণ এতদিনে আমি পরিণত হতে শিখে গেছি।শিখে গেছি প্রতিবাদের কড়াল ভাষা। আম্মাকে বললাম ফুপির বাড়ি যাবো, কদিন ওখানে থেকে ফুপিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবো।আম্মা না বলতে চেয়েও কেন জানি না বলতে পারেননি। হয়তোবা তার অতি নিকটেই কদর্যতা আছে বলে দূরের কদর্যতার কাছে আমায় ছাড়তে তার বাঁধা ঠেকেনি। তারপর আমি ফুপির বাড়ি গেলাম। গিয়ে তো আনন্দে আত্মহারা আমি,এ কি ফুপির মেয়ে তো একেবারে আকাশের চাঁদ! এমন চাঁদ দেখে কী আমার মা সয়তে পারবে? এই চাপা উত্তেজনা মনে নিয়ে পরবর্তী পর্ব দেখার আসায় ফুপিকে সাথে করে নিয়ে একদিন বাড়িতে যাত্রা করলাম, আর তা ছিল আমার ফুপির বাবার বাড়িতে প্রথম নাইওর। গাঁয়ের বাড়িতে এই নাইওরকে ফেরৎ নাইওর ও বলে।আমরা যখন বাড়িতে পৌঁছি তখন বিকেল গড়িয়েছে কেবল। বিকালের তেজহীন আলোয় আমার ফুপি যখন বারান্দায় পা দিলেন তখন তিনি দেখতে পেলেন আম্মার কোলে আমার কালো বোন তার মোটা ঠোঁট মেলে টেও টেও করে কাঁদছে।আর আমার ফুপির মেয়েটা তখন তার আঁচলের নিচ থেকে সদ্য জন্ম নেয়া চাঁদের মতো মুখ তুলে তাকিয়েছে। আমার ফুপি কিন্তু মোটেও অহংকার করলেন না তার ভাইয়ের একমাত্র মেয়েকে।কালো মেয়ে বলে দূরে না এড়িয়ে কীভাবে যে তাকে কোলে তুলে আদর করে চুমু খেলেন এমন চুমু আমার আম্মাকেও দেখিনি আমার বোনকে খেতে। আমার ফুপি তো সুন্দরী মায়ের কালো মেয়েকে ঠিকই সহ্য করতে পারলেন কিন্তু আমার মা কী সহ্য করতে পারলো কালো মায়ের এমন চাঁদ সুন্দর মেয়েকে ?
Comments