top of page

নবজন্ম পর্ব ২


আজ ভোরবেলাটা একটু অন্যরকম... সকাল থেকেই বিয়েবাড়িতে ব্যাস্ততার আমেজ... মলয়ের মনে বিষাদের মেঘ... ছোটবেলা থেকে গা ঘেষাঘেষি করে বড় হয়েও... সুখ দুঃখের সকল অনুভূতি সে ভাগ করে নিতো দিদিভাইয়ের সাথে... আবদার করা বা ঝগড়া করার লোক একটাই ছিল এই বাড়ীতে... দিদিভাইও কাল ওর ঘরে এসে কেঁদে ফেললো... এমনি অর্পিতা মানে অপু খুব এ শক্ত ধাত... জানে ও চলে গেলে ভাই সত্যি খুব একা হয়ে যাবে।


“কিরে দিদি কাঁদছিস কেন...”

“তুই নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি রেখেছিস কেন?”

“কি করব বল...”

“বাবা বলেছে...”


মলয় নিরুত্তর থাকে...


“কিরে আমাকে বল... বাবা বারণ করেছে...”


মলয় মাথা নাড়ে...


“দাঁড়া আমি দেখছি...”


একপ্রকার দিদির জোরাজুরিতে মলয় ঘরের বাইরে বেরোল... দিদির জেদের কাছে হার মেনে সারা দুপুর ধরে দিদিকে মনের মতন করে সাজিয়ে তুলল... সবাই প্রশংসা করল...


অপুর বিয়ে অনুষ্ঠান চলছে... সমু দাঁড়িয়ে রইলো এক কোণে... দিদিভাই কিছুতেই ছাড়লো না...

বিয়ে প্রায় শেষ, সমু দাঁড়িয়ে দেখছিলো দিদিভাইকে কি সুন্দর লাগছে... সিঁদুর পরে... ওর ভিতরের নারী সত্ত্বাটা জেগে ওঠে ভিতর থেকে... নিজেকে বিয়ের কনে রূপে দেখতে ইচ্ছে করে...


বিয়ের শেষে এবার বাসর জাগার পালা... বাসর জমে উঠেছে... অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিদি আর অর্পনদার অনুরোধে মলয় বসেছে বাসরে... সবাই গান, গল্প, ঠাট্টা-ইয়ার্কি করছে...


“ভাই তুমি এবার কিছু একটা করো...”


অর্পনদার বন্ধু নীলাভ এসে মলয়কে অনুরোধ করে... মলয় মাথা নাড়াতে সে আবার অনুরোধ করল... ছেলেটার বলার মধ্যে একটা অবেশ একটা মাদকতা ছিলো... বাসরে মলয়ের নিজের মাসতুতো, খুড়তুতো মামাতো ভাই-বোনেরা ছিলো... মলয় মাথা নিচু করে রইল... সেই সময়ে দিদি ফিসফিস করে বলল...


“ভাই তুই ঘরে যা... এখানে থাকতে হবে না...”


মলয় কথা না বাড়িয়ে বাসর থেকে উঠতে যায়... এমন সময়ে ওর পিসতুতো দাদা এসে পথ আটকায়... এই দাদা কিছুটা হলেও যৌন বিকারগ্রস্ত... অনেকবার মলয়ের সাথে যৌন তৃষ্ণা মেটাতে চেয়েছে... কিন্তু মলয়ের দৃঢ়তার কাছে হার স্বীকার করেছে...


“সেকিরে মলয়... তুই চলে যাচ্ছিস... তোর দিদির বিয়ে বলে কথা... তুই কিছু করবি না... সেটা কি হয়...”


“সখী, ভাবনা কাহারে বলে

সখী, যাতনা কাহারে বলে

তোমরা যে বল দিবস-রজনী

ভালোবাসা, ভালোবাসা

সখী, ভালোবাসা কারে কয়

সে কি কেবলই যাতনাময়

সে কি কেবলই চোখের জল

সে কি কেবলই দুখের শ্বাস

লোকে তবে করে কি সুখেরই তরে

এমন দুখের আশ...”


গান থামার আগেই তার মেয়েলি গলা শুনে অনেকেই হাসতে শুরু করে... বিশেষকরে মলয়ের সেই পিসতুতো দাদা... দিদি আর অর্পনদা সবাইকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু কোন লাভ হয় না...


“আমার চোখে তো সকলই শোভন

সকলই নবীন, সকলই বিমল

সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন

বিশদ জোছনা, কুসুম-কোমল

সকলই আমার মতো

তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়

হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়

না জানে বেদন, না জানে রোদন

না জানে সাধের যাতনা যত...”


মলয় দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে বালিশে মাথা গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়ে... কিছুক্ষণ বাদে বুঝতে পারে কেউ তাকে জড়িয়ে ধরেছে... বুঝতে পারে সেই দাদা... কিন্তু দরজা বন্ধ... সারারাত সেই দাদা মলয়ের শরীরটা নিয়ে ছেলেখেলা করে... রক্ত পড়ে... কিন্তু সমকাম নাছোড়বান্দা...


“ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে

জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়

হাসিতে হাসিতে অলোকসাগরে

আকাশের তারা তেয়াগে কায়

আমার মতন সখী কে আছে

আয় সখী আয় আমার কাছে…”


আসল ঘটনা ঘটল পরেরদিন সকালবেলা... মলয়ের সেই দাদা সবাইকে গত রাতের কথা বলে দেয়... কিছুক্ষণ বাদে মলয়ের বাবা মলয়ের ঘরে আসে...


“তুই আর কতো ক্ষতি করবি আমাদে... তোর জন্য আর কতো মাথা নত করব... তুই মরতে পারিস না...”


বাবা কিছুক্ষণ বেল্ট দিয়ে মেরে ক্লান্ত হয়ে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে বেড়িয়ে যান... কাঁদতে কাঁদতে মলয়ের চোখের জল শুকিয়ে যায়... অচেতন হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে মলয়... দিনের শেষে সুয্যিমামা পাটে গেলেন... দিদি বিদায় নিলো... ভোর হলো কিন্তু কারোর ক্ষমতা হলো না মলয়ের খোঁজ নেবার...


“আমি অমাবস্যার কালো

আমি বুক চাপা কান্না,

তুমি পূর্ণিমা শশী

তুমি একা সম্পূর্ণা।

আমি নিশ্চল তরু

আমি নিভু নিভু বাতি,

তুমি জ্বলন্ত আলো

তুমি স্নায়ু-কাঁপা গতি।

আমি বীভৎস্যহাসি

আমি আগুনের চিতা,

তুমি ফুলশয্যার ফুল

তুমি শূচিনারী সুস্মিতা।

আমি মসজিদ মুখী

আমি মুসলিম রনবীর,

তুমি সনাতনী নারী

তুমি আত্মায় মন্দির।

আমি বাস্তব দুঃখী

আমি বেদনার নীল-ছায়া,

তুমি অনন্ত সুখী

তুমি মরীচিকাময়ী মায়া।

আমি কাল বৈশাখী

আমি দৈত্যের লাল চোখ,

তুমি বসন্ত বায়ু

তুমি স্বর্গের নারী-লোক।

আমি, বিপরীতে আমি

আমি কলুষিত মৃতপাপী,

তুমি পূণ্যের জ্যোতি

তুমি আমরিত বহুরুপী...”


একটা কিংবা কিছু ঘটনা মানুষের জীবন পালটে দেয়... তোলপাড় করে দেয় সবকিছু... মলয়ের ক্ষেত্রেও সেটাই হলো... এই ঘটনা তাকে তার পরিবার-পরিজনদের থেকে অনেকটা দূরে ঠেলে দিলো... আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই চলে গেল... মলয়ের ঘরের দরজা খুললেও সে একবারের জন্যেও ঘোর থেকে বেরোল না... একটা চাপা অভিমান, কষ্ট বুকে নিয়ে বসে রইল...


আজ মলয়ের দিদির বৌভাত... বাড়ির কেউ তাকে যাবার জন্য একবারও বলল না... মলয় ভেবেছিলো হয়ত মা একবার অন্তত বলবে... দিদিভাই ফোন করবে... কিন্তু নাহ...


সবাই এখন বৌভাতে গিয়েছে... বাড়িতে সমু আর কাজের লোক জগাদা... মলয় আস্তে আস্তে দিদিভাইয়ের ঘরে এলো... দিদির ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসল... দিদির প্রসাধন সামগ্রি এলোমেলো ছড়িয়ে আছে... একটা লিপস্টিক তুলে নিলো মলয়... আপনমনে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগালো... নিজেকে নারী মনে হচ্ছিল মলয়ের...


“এই মলয় এটা কি করছিস...”


মলয় দেখে কখন বিকাশ এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে...


“আমি ব্রাত্য বিকাশ... আমার বাবা আমার মরণ কামনা করে... আমি মরতে চাই...”

“এই মলয় তুই পাগলের মতন কি বলছিস... আমার কথা শোন...”

“আমি মরতে চাও বিকাশ... আমি মরতে চাই...”

“শোন এখানে থাকলে তুই বাঁচবি না... তুই পালা এখানে থেকে... একটু পড়ে একটা কলকাতার ট্রেন আছে...”

“অচেনা অজানা জায়গাতে কোথায় যাবো...”

“দেখ... ঠিক একটা কিছু হয়ে যাবে...”

“আর তুই...”

“আমি দেখি কয়েকদিন বাদে যদি কিছু একটা করা যায়...”

“কিন্তু বিকাশ...”

“কোন কিন্তু নয় মলয়... তোকে বাঁচতে হবে... তোর মতন করে বাঁচতে হবে... সেটা এখানে নয়... এটা তোর পৃথিবী নয়... তোর জায়গা আলাদা...”


কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল দুইজনে... তারপরে মলয় উঠে একটা ব্যাগে দিদির সালোয়ার, শাড়ি কিছু অন্তর্বাস ভরল... বিকাশ ওকে কিছু টাকা দিলো... যাবার সময়ে মলয় একটা চিঠি লিখে গেলো...


বাবা,


আমি চিরদিনের মতন তোমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি... আমাকে তোমরা খোঁজার চেষ্টা করো না... আমি দেহে পুরুষ কিন্তু মননে নারী... আমি নিজের সত্তা নিয়ে লজ্জিত নই বরং গর্বিত... কিন্তু আমি চাইনা আমার জন্য তোমরা অপমানিত হও কিংবা তোমাদের মাথা হেঁট হয়... তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিলাম... আমার কারোর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই... আমি অভিমান করেও নেই... তোমরা ভালো থেকেও আর সব ধরণের মানুষকে ভালো রেখো...


ইতি তোমার ঘেন্নার মলয়


রাত এখন ১১টা... মলয় বিকাশের সাথে নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে... ওরা দুইজনে একসাথে স্টেশানে আসে... লাস্ট ট্রেন বেড়িয়ে গিয়েছে... অগত্যা সারারাত অপেক্ষা...


“আমি তোকে খুব ভালোবাসি বিকাশ...”

“আমিও... কিন্তু আমাদের সমাজ কি আমাদের কথা ভাবে...”

“নাহ... ভাবে না...”

“তুই এই নরক থেকে দূরে নিজের মতন করে বেঁচে থাক...”


ভোরবেলায় ট্রেন গুলো ফাঁকাই থাকে... একটা লোকাল ট্রেন এ উঠে পড়... আনমনা হয়ে জানলার ধারে বসে আছে... চোখের জল বাঁধ মানছে না... কামরায় গুটিকয়েক লোক... কেউই কারোর দিকে লক্ষ্য করছে না। ভোরবেলায় বেশিরভাগই ঝিমিয়ে আছে...


কিছুক্ষণ বাদে ওদের সমবয়সী হবে... একটা ছেলে পাশে এসে বসল...


“বাড়ি থেকে পালিয়েছো...”


মলয় নিরুত্তর...


“তোমার কি হয়েছে বলবে... আমি অচেনা অজানা হলেও বন্ধুর মতন... আমাকে বলতে পারো...”

“আমি আসলে...”

“বাড়ি থেকে পালিয়েছো...”

“হ্যাঁ...”

“কোথায় যাবে...”

“জানি না... কোথায় যাবো, কি করব কিছুই জানি না... আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে...”

“মরে গেলে কি সব কিছুর সমাধান হয়ে যাবে...”

“তাহলে...”

“জীবনে নতুনকরে বাঁচতে শিখতে হয়...”


অনেকদিন পর আবার বাকশূন্য হয়ে গেছি ,

চোখের কোনে এক রাশ ক্লান্তি আর

অবাক নয়নে তাকিয়ে সবার হাঁটা-চলা দেখছি,

বাচনভঙ্গি, আচার-আচরন দেখছি ,

সবটা কেমন যেনো অচেনা অচেনা লাগছে,

ঠিক যেনো সদ্য জন্ম নেয়া কোন শিশু

পৃথিবীতে আগমনের পর আধো আধো চোখে

চারপাশে তাকিয়ে বুঝে নিতে চাচ্ছে তার অবস্থান।

তবে কি নব জন্ম হলো আমার আবার ?

নতুন করে কি পরিচয় হলো এই ধরিত্রীর সাথে,

নাকি বিশ্বাস, সত্য , প্রতিশ্রুতিগুলো

নতুন রূপে প্রত্যাবর্তন করলো আমার মাঝে ?

নতুন এই জীবনেই বা কি পরিচয় হবে আমার ?

পুরোনো সেই পরিচয়টাই কি নতুন মোঁড়কে উন্মোচিত হবে ?

আচ্ছা,নবজন্ম বলে সত্যিই কি কিছু আছে পৃথিবীতে ?


কিছুটা সময় বাদে মলয় একটু ধাতস্থ হলো... দুইজনের মধ্যে চললো কথাবার্তা... মলয় খুলে বলল তার সব কথা... তার পুরুষ দেহে নারী সত্তার কথা...


“তোমার নাম কি...”

“আমার নাম তন্ময়...”

“তুমি কোথায় থাকো...”

“কুসুমপুর...”

“সেটা কোথায়...”

“বাংলা আর উড়িষ্যার বর্ডারের একটা গ্রাম...”

“ওই গ্রামে তুমি কি করো...”

“জানো আমি অনাথ... ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের স্নেহ না পেয়ে এবং কলকাতার অনাথাশ্রমের জঘন্য পরিবেশে মানুষ হয়ে আমি অপরাধী হয়ে গিয়েছিলাম... আমাকে রক্ষা করেন আমাদের সংশোধনাগারের সুপার... উনি নিঃসন্তান ছিলেন... উনি আমাকে নতুন জীবনের সন্ধান দেন...”

“তারপর...”

“তারপর আর কি... আমি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক আর গ্র্যাজুয়েশান পাশ করে ওই কুসুমপুরে আছি...”

“ওইখানে কি আছে...”

“যাবে আমার সাথে...”

“কি আছে ওখানে...”

“নতুন জীবন... একটা আলোর দিশা...”

“পাবো আমি বেঁচে থাকার রসদ...”

“সব জায়গাতে আছে... তোমাকে খুঁজে নিতে হবে...”

“তাহলে আমাকে নিয়ে চলো...”


“এই বিকাশ তুই জানিস মলয় কোথায়...”

“আমি জানি না কাকু... তবে আমি ওকে এই নরক থেকে বের করে দিয়েছি...”

“এই বিকাশ...”

“কাকু... ওকে ওর মতন করে বাঁচতে দিন না...”

“এই শুনছ... আমাদের মলয় কি আর কোনদিন ফিরবে না...”

“আমি পুলিশে যাচ্ছি...”


একটা কাল্পনিক কথোপকথন...


“বল তো কত বয়স হল তার?”

“কার?”

“যার মাথাভর্তি সবুজ দেবদারু চুল

যার টলমলে পা কেবল ভুল পথের কাঁটার

উপরে

যার সমস্ত কথাই অস্পষ্ট,

সন্ত্রাসবাদীদেরমত সংকেতময়

এবং বিস্ফোরক

যে কেবল হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়

এমন বাগানে

যেখানে ফুলের গায়ে হাত ছোঁয়ালেই

অট্টহাসির বিদ্যুৎ

যেখানে লতা গুল্মের

আড়ালে পিছলে পড়ার গোলাপী গহ্বর

আর ফুসলিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার খর

জলস্রোত।

বল তো কত বয়স হল তার?”

“তিন বছর...”

“তাহলে মনে আছে তিন বছর আগে ঠিক

এইখানে

ঠিক এইরকম পাশুঁটে সন্ধ্যার

সাড়ে পাঁচটায়

এইরকম আরশোলা রঙের ছেঁড়া পর্দার

আড়ালে

তোমার আর আমার যৌথ উল্লাসে জন্ম

হয়েছিল তার

তোমার প্রথম চিঠিতে তুমি যার নাম

দিয়েছিলে, অসহ্য সুখ

আমার প্রথম চিঠিতে আমি যার নাম

দিয়েছিলাম, নবজন্ম...”


বাস থেকে নেমে একটা ভ্যান রিক্সা নিয়ে তন্ময় আর মলয় যখন কুসুমপুরে তখন আরো একটা দিন পেরিয়ে গিয়েছে... কিছুক্ষণ বাদে ভ্যান এসে থামল ‘শান্তনীড়ের’ গেটে... ওরা ঢুকতেই বিভিন্ন বয়সী একপাল ছেলেমেয়ে দৌড়ে এলো... তন্ময় ওদের হাতে ব্যগগুলো দিয়ে মলয়কে নিয়ে একটা ঘরে এলো...


“এরা কারা...”

“এদেরও কেউ নেই... আমারও কেউ নেই... এই না পাওয়ার মাঝে আমরা দুইজন দুইজনের সাথি মলয়...”

“আমি হতে পারব ওদের কেউ...”

“তুমি চাইলে ওদের বুকে জড়িয়ে নিতে পারবে...”


প্রায় দুই বছর বাদে...


মলয়ের অনেক খোঁজ নেবার চেষ্টা করেছে তার বাড়ির লোক... কিন্তু একদম কর্পুরের মতন উবে গিয়েছে সে... এই বিশাল পৃথিবীতে হয়তবা হারিয়ে গিয়েছে... আসলে বোধহয় হারিয়ে যাবার জন্যেই এই মলয়দের জন্ম হয়... ভগবান বোধহয় সাধারণ জীবনযাপন করবার জন্য এই মলয় কিংবা আরো অসংখ্য মলয়ের সৃষ্টি করেনি... মানুষ হয়ে মানুষের মতন বাঁচার জন্য এদের জন্ম...


একদিন গোধূলি লগ্ন...


“মলয় একটা কথা বলব...”

“হ্যাঁ বলো না...”

“সারাজীবন আমার সাথে থাকবে...”

“কি বলছ তন্ময়...”

“হ্যাঁ মলয়... আমি তোমাকে ভালোবাসি... তুমি সারাজীবন আমার হয়ে থাকবে...”


একদিন জানালায় এসে ভিড় জমিয়েছিল

হাসনাহেনার সৌরভ

হলুদ প্রজাপতির পাখায় ভর করেছিল

রাজ্যের মুগ্ধতা

আর উত্তাল হাওয়ায় ভাসল ভেজা কুয়াশা

আমার নবজন্ম হল।

গান গাইল বাবুই শ্যামা

আর মাতাল হয়ে নাচল জোনাকিরা

আমি জ্যোৎস্নায় ভিজতে শুরু করলাম

আমার মন আমাকে দেখাল এক নতুন দিগন্ত

শুনাল ভালবাসার বিমুগ্ধ কোরাস

আমি অবচেতন হলাম

আর দীর্ঘ এক মহাকাল পর আজ দেখলাম

থেমে গেল সব কোলাহল

বিদায় বেলা সাঙ্গ করে সবাই

পথ ধরল গন্তব্যের

আমি পড়ে রইলাম একা

এক ধুধু প্রান্তরে

আর পৃথিবীর সব কষ্ট বুকে ধরে

বসে রইলাম আমি

গোলাপ হয়ে ফুটব বলে তোমার জানালায়...


“কি হলো মলয় কাঁদছ কেন...”

“আমি জানি না তন্ময়... এটা হয়ত আনন্দের অশ্রু... কিন্তু...”

“তুমি মননে নারী... তুমি যদি...”

“আমি জানি তুমি কি বলবে...”

“কি...”

“সেক্স চেঞ্জ করবার কথা বলছ তো...”

“যদি সম্ভব হয়...”

“তুমি যদি চাও... আমি আমার ভালোবাসার জন্য সব কিছু করতে রাজি...”


তন্ময় মলয়ের মুখটা ধরে... ধীরে ধীরে দুটো শরীর এক হয়ে যায়... সিক্ত হয় ওষ্ঠ...


পরের কয়েকমাস ঝড়ের গতিতে এগোয়... তন্ময় মলয়কে নিয়ে কলকাতার একটা নার্সিংহোমে ভর্তি করায়... দীর্ঘ প্রতিক্ষার পরে মলয় হয় আজকের মল্লিকা... আজ এক সপ্তাহ হলো মলয় কুসুমপুরে ফেরত এসেছে...


“একা একা এখানে কি করছ তুমি...”

“আপনি... আপনাকে তো ঠিক...”

“চিনতে পারলে না তো...”

“না আসলে...”

“আমি তোমার তন্ময়ের পাতানো মা...”

“আপনিই তন্ময়কে...”

“হ্যাঁ আমিই তন্ময়কে মানুষ করেছি...”


মল্লিকা নিচু হয়ে প্রণাম করে...


“কি মিষ্টি মুখখানা...”


মল্লিকা লজ্জায় মুখ নিচু করে নেয়...


“কবে বিয়ে করবে আমার তন্ময়কে...”

“আপনারা যেদিন বলবেন...”

“তন্ময়ের বাবাও এসেছেন... ঠিক আছে কথা বলে একটা দিন ঠিক করে তোমাদের দুই হাত এককরে দেবো...”

“আমি রাজি কাকিমা...”

“একদম না... আমিও তোমার মা...”


মাস দুয়েক বাদে একটা বিয়ের দিন ঠিক হলো... জোরকদমে নিয়ের তোড়জোড় চলছে...


“এই... অমন গোমড়া মুখ করে বসে আছো কেন...”

“জানি না... ভালো লাগছে না...”

“কেন কি হয়েছে...”

“বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে...”

“বুঝলাম... তুমি চাইলে আমরা তোমার বাড়ি যাবো... তোমার আবাব-মায়ের সাথে কথা বলব...”

“লাভ হবে না গিয়ে... আমার বাবা সেকেলে মানুষ... আমাদের এই সম্পর্ক মেনে নেবেন না...”

“না মেনে নিলে চলে আসব...”

“আমার না ভয় করছে...”

“দাঁড়াও আমি এস.ডি.ও-কে নিমন্ত্রন করে এসে কথা বলছি... সেরকম হলে আমরা কালকে যাবো...”

“ঠিক আছে তুমি ঘুরে এসো...”


কিছুক্ষণ বাদে এস.ডি.ও অফিস...


“আসতে পারি স্যার...”

“আরে তম্নয়বাবু... আসুন আসুন...”

“স্যার... আমি বিয়ে করছি...”

“দারুণ খবর... তা পাত্রী কে?”

“মলয়... না মানে মল্লিকা...”

“কি নাম বললেন...”

“আসলে স্যার ওর আগের নাম মলয়... পুরুষ থেকে নারী হয়ে নাম হয়েছে মল্লিকা...”


এস.ডি.ও টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে...


“আপনি আপনার স্ত্রীর কোন ছবি দেখাতে পারেন...”

“আপনি কি চেনেন নাকি...”

“ছবি দেখাতে পারবেন...”


তন্ময় মোবাইল ঘেঁটে মল্লিকার ছবি দেখাতেই এস.ডি.ও চমকে ওঠে...


“স্যার... আপনি চেনেন ওকে...”

“হ্যাঁ... আসলে আমি মলয়কে চিনি...”

“কি বলছেন স্যার...”

“মলয় আমার ছোটবেলার বন্ধু... মলয় আমার...”

“তাহলে স্যার... আজ সন্ধ্যেবেলা আসুন না শান্তনীড়ে... মল্লিকা খুব খুশী হবে...”

“আচ্ছা যাবো...”


সেইদিন সন্ধ্যেবেলা...


বারান্দায় তন্ময় আর মল্লিকা বসে আছে... এমন সময়ে দরজায় নক হয়... মল্লিকা দরজা খুলে চমকে দুইপা পিছিয়ে আসে...


“একি বিকাশ!!! তুমি!!!”

“স্যার সকালেই আমাকে বলেছেন উনি তোমাকে চেনেন...”

“তুমি কেমন আছো বিকাশ...”


মল্লিকা স্থান-কাল ভুলে বিকাশকে জড়িয়ে ধরে... ঘটনায় তন্ময় আর বিকাশ দুইজনেই চমকে ওঠে...


“কোথায় ছিলে এতদিন তুমি...”

“মল্লিকা আমাকে ছাড়... আমি সব বলছি...”

“তন্ময় আমি তোমাকে বলেছিলাম না... আমার প্রথম প্রেম... আমার আগের জীবনের সবকিছু... সেটা এই বিকাশ...”

“তাহলে কি আমি তোমাদের মাঝে বাধা...”

“তন্ময়বাবু... এসব আপনি কি বলছেন... আপনি মল্লিকার বর্তমান... অতীতের জাবর কেটে কি লাভ...”

“কিন্তু আপনি ওকে ভালোবাসোতে শিখিয়েছেন... আপনি ওকে ওই নরক থেকে উদ্ধার করেছেন...”

“হ্যাঁ সেটা আমরা বন্ধু বলে... ভালবাসতাম বলে... কিন্তু তন্ময়বাবু... আপনি মলয়কে নতুন জীবন দিয়েছেন... নতুন রূপ দিয়েছেন... মলয়কে আজকের মল্লিকা বানিয়েছেন... জীবনে নতুন করে বাঁচার রসদ জুগিয়েছেন... আপনি যদি মল্লিকার না হন তাহলে ও আবার অতলে হারিয়ে যাবে...”

“কিন্তু...”

“তন্ময়বাবু... আমি সেইদিন যা পারিনি সেটা আপনি পেরেছেন... আমার সেইদিন সামর্থ ছিলো না... সাহস ছিলো না... কিন্তু আপনি এই সমাজের বুকে ওকে নিজের সত্তা নিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছেন...”

“তন্ময়বাবু... আপনাদের মতন মানুষদের জন্য ভালোবাসা আজো অমর...”


ভালোবাসা - শিরোনামহীন পথে, একরাশ কাশফুল

ভালোবাসা - অশান্ত হৃদয়ে অচেনা পথিকের ভুল

ভালোবাসা - ছন্দ ছোঁয়া, রাগিনীর কিছু রাগ

ভালোবাসা - শেষ বিকেলের প্রজাপতির পরাগ

ভালোবাসা - কিছু অবান্তর কিছু শিরোধার্য রীতি

ভালোবাসা - নয়ন মিলানো অচেনা দু’পথিক

ভালোবাসা - ভাবুকের ভাবনা, ভাবনার নেই ভাষা

ভালোবাসা - অজান্তে বুকে বিঁধেছে কিছু আশা

ভালোবাসা - স্বপ্নচারিনীর, নির্জন বিচরণ

ভালোবাসা - তুমি ছাড়া এ অন্তর দহন

ভালোবাসা - ১৪ই ফেব্রুয়ারি, গোলাপের একখানা ডালি

ভালোবাসা - এক হাতে নয় দু’হাতে বাজানো তালি

ভালোবাসা - তোমার আমার মিতালী পদ্মা-যমুনায়

ভালোবাসা - তোমার টানে ছুটে চলি করাল স্রোতের মোহনায়

ভালোবাসা - আঁচল বিছায়ে আছি, ঝরাও শিউলি ফুল

ভালোবাসা - আঁদারে হারাবো সুদূর, হোক যত ভুল...


সমাপ্ত...

0 comments

Kommentare


Enjoy
Free
E-Books
on
Just Another Bangladeshi
By
Famous Writers, Scientists, and Philosophers 
click here.gif
click here.gif

Click Here to Get  E-Books

lgbt-bangladesh.png
bottom of page