দেশ-বিদেশ ও আগ্রহ
এইবার দেশে গিয়ে একটা বিষয় বুঝতে পেরেছি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের বেশিরভাগ'ই সুযোগ পেলে বিদেশে চলে যেতে আগ্রহী।
এমনকি যারা চাকরি করছে, এদেরও অনেকে'ই পরিবার নিয়ে বিদেশে সেটেল হতে চায়।
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারি।
আমরা যারা বিদেশে থাকি, তাদের বেশিরভাগ'ই দেশে থাকা মানুষ গুলো'কে এমন বার্তা দেই; দূর থেকে দেখে মনে হয়- ইউরোপ-আমেরিকায় আমরা কতো রঙিন জীবন'ই না কাটাচ্ছি!
ছেলে-মেয়ে বিদেশে থাকে; এটাও বাংলাদেশিদের জন্য একটা বিশাল স্ট্যাটাস।
দূর থেকে বাংলাদেশে থাকা মানুষ গুলো মনে করে- বিদেশে গেলে'ই অনেক টাকা; নিরাপদ আর আলোঝলমলে জীবন।
কিন্তু বাস্তবতা কি আসলেই এমন?
এইতো গতকাল'ই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পে'র প্রেস কনফারেন্স দেখছিলাম। সেখানে এক চাইনিজ-আমেরিকান ট্রাম্প'কে প্রশ্ন করেছে
-কেন তুমি আমেরিকার করোনা পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করছ আর বলছ আমেরিকা'ই সেরা? যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে?
উত্তরে আমেরিকার এই প্রেসিডেন্ট বলেছে
-কারন হচ্ছে, মানুষ পৃথিবী জুড়ে'ই মারা আচ্ছে। তুমি বরং এই প্রশ্ন গিয়ে চায়না'কে করো। হয়ত অন্য রকম উত্তর পাবে।
ট্রাম্পের এই মন্তব্য শুনে ভয়ানক অবাক হয়ে গিয়ে ওই নারী সাংবাদিক এরপর প্রশ্ন করেছে
-তুমি আমাকে'ই কেন এই কথা বললে?
ট্রাম্প এরপর ওই প্রেস কনফারেন্স থেকে'ই চলে গিয়েছে কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে।
আমি সরাসরি ওই প্রেস কনফারেন্স দেখেছি। এরপর সেই ভিডিও এখন পর্যন্ত ২১ বার দেখেছি।
দেখার কারন হচ্ছে- আমি বুঝার চেষ্টা করছিলাম চাইনিজ-আমেরিকান ওই মেয়েটির প্রতিক্রিয়া।
দেখে মনে হলো- ওই মন্তব্য শুনে মেয়েটি হতবিহ্বল হয়ে গিয়ে, বুঝতেই পারছিল না- আমেরিকার মতো একটা দেশের প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্য - দিবালোকে এমন মন্তব্য করে বসেছে!
মেয়েটার জন্ম ও বেড়ে উঠা আমেরিকায়। পড়াশুনা আমেরিকায়। কথা বলে সম্পূর্ণ আমেরিকানদের মতো। নামকরা মিডিয়ার সাংবাদিক। এরপরও সে আমেরিকান হতে পারেনি স্রেফ তার চেহারার আদলের কারনে।
প্রকাশ্য- দিবালোকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তাকে বলে বেড়াচ্ছে- আমাকে প্রশ্ন করছ কেন? চায়না'কে গিয়ে করো!
কারন মেয়েটি দেখতে যে চাইনিজদের মতো। তারা বাবা- মা যে চাইনিজ! তাই তার আর আমেরিকান হয়ে উঠা হয়নি।
আমি নিজে ইউরোপে থাকছি ১৭ বছর। গবেষণাও করি অভিবাসীদের'ই নিয়ে।
আপনাদের আমি হলফ করে বলতে পারি, ছোট বেলা থেকে বড় বেলা পর্যন্ত এই মেয়েকে এমন সব বর্ণবাদী অভিজ্ঞতার মাঝে দিয়ে'ই যেতে হয়েছে। আমৃত্যু চলবে তার এই অভিজ্ঞতা।
আমি নিজে প্রতিনিয়ত বুঝতে পারি কিংবা আমাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়- আমি কিন্তু এদের মতো না। আমার সহকর্মী থেকে শুরু করে রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালাত, বাস-ট্রাম, সুপার মার্কেট যেখানেই যাই, সেখানে'ই আমি এই অনুভূতি পেয়ে বেড়াচ্ছি।
আমাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়- তুমি কিন্তু আমাদের মতো নও! তুমি হচ্ছ ভিনদেশি। অর্থাৎ তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক!
আপনি যত বড় শিক্ষক, গবেষক'ই হন কিংবা হোটেল-রেস্টুরেন্টে কাজ করা মানুষ'ই হন। রাস্তায় বের হলে- আপনি বিদেশি। কারন আপনার গায়ের চামড়া যে ওদের মতো না!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে বাংলাদেশে থাকা মানুষ গুলো কেন সবাই বিদেশে যেতে চায়?
কারন হচ্ছে বিদেশে থাকা এই আমরা'ই এমন সব ভুল মেসেজ দেই- দেখে মনে হবে আমরা হয়ত স্বর্গে বাস করছি! আমাদের জীবন হচ্ছে নিরাপদ এবং কোন রকম কষ্ট নেই; শুধু আনন্দ আর আনন্দ!
আসলেই কি তাই?
৯০ ভাগ বাংলাদেশি যারা ইউরোপ-আমেরিকায় থাকে, তারা যেভাবে দিন যাপন করে; যেই কষ্ট দিন থেকে রাত অবদি করে; সেই দৃশ্য যদি আপনি একবার দেখেন; আপনি হয়ত দ্বিতীয়বার আর বিদেশে আসতে চাইবেন না।
সারা দিন রাত হাড় ভাঙা খাটুনি খেটে এরা দেশে পরিবার পরিজনের জন্য টাকা পাঠায়। নিজেরা থাকে বিদেশে গাদাগাদি করে একটা ছোট রুমে।
এরপরও শান্তি নেই। বাসায় এসে মন পড়ে থাকে দেশে ফেলে আসা আত্মীয় পরিজনের জন্য। আর বাইরে বের হলে- ওই যে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক! সেই অভিজ্ঞতা।
এ এক কঠিন জীবন। যারা বিদেশে থাকে কেবল তারা'ই জানে।
সমস্যাটা হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের এই কঠিন জীবনটা দেশে থাকা মানুষ গুলো দেখে না কিংবা বুঝতে পারে না। যার কারনে সবাই মনে করে- বিদেশ মানেই শান্তি!
এই যে করোনা ভাইরাসের এই সময়টায়- সবার প্রথমে কাদের উপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে?
ইউরোপ-আমেরিকায় থাকা এই বিদেশিদের উপর'ই।
সব চাইতে বেশি মারাও যাচ্ছে এরা। আবার চাকরি হারিয়ে এদের অনেক'কে এখন দেশের পথও দেখতে হবে। এক'ই ব্যাপার মধ্যপ্রাচ্যেও!
এরপরও আমাদের বিদেশ প্রীতি যায় না।
এই তো আজ'ই জানলাম বাংলাদেশের একজন ডক্টর সমীর সাহা এবং তার কন্যা মিলে দেশের করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করেছে।
এই বিষয়ে দেশের মিডিয়া এবং ফেসবুকে সাধারণ মানুষ এখন মাতামাতি করছে কি নিয়ে জানেন?
বিল গেটস তার সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে এদের নিয়ে লিখেছে, এদের অভিনন্দন জানিয়েছে। এই নিয়ে এখন আমরা বাংলাদেশিরা মেতে আছি!
বিল গেটস বলে কথা!
কেন? বিল গেটস না বললে কি আমরা এদের মূল্য দিতাম না?
এখন আমেরিকার ধনকুবের সার্টিফিকেট লাগছে এদের মূল্যায়ন করতে?
আমরা আসলে কখনো'ই মেধার মূল্যায়ন ঠিক মতো করতে পারিনি।
মেধা যাচাইয়ের জন্যও আমাদের ব্র্যান্ড লাগে!
এই আমাকে'ই সেই অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছে। এর আগে অনেকবার লিখেছিও এই নিয়ে।
তখন ঢাকার আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। বুয়েটে আবেদন করেছি প্রভাষক পদে।
বুয়েটে যেহেতু সমাজ বিজ্ঞান বলে আলাদা কোন বিভাগ নেই; তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক্সটারনাল এসছে ভাইভার দিন।
এই ভদ্রলোক আমাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস না করে প্রথমে'ই বলেছে
-আপনি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি। আপনি এখানে আবেদন করেছেন কেন? আপনার উচিত সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা।
শুনে আমি এতো অবাক হয়েছি- যা আসলে বলে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা কাউকে নিবেন, এটা আগে থেকে'ই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। অন্য কারো মেধা যাচাইয়ের প্রয়োজনও তিনি মনে করলেন না!
ঢাকার বাইরে পড়ে মনে হয় আমরা অন্যায় করে ফেলেছি!
অথচ তিনি নিজে হয়ত ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়ে এসছেন। তখন ওই সব বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু তাকে জিজ্ঞেস করেনি- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছ! সেটা আবার কোন বিশ্ববিদ্যালয়! তোমাকে তো আমরা নিবো না!
এই হচ্ছে আমাদের মেধা যাচাইয়ের মান!
কেউ বিদেশে পড়লে কিংবা থাকলে আমরা মনে করি বিশাল কিছু! কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে আমরা মনে করি- বিশাল কিছু!
ব্র্যান্ডটাই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে!
মানুষটার ভেতর কি আছে। সে কি কি বিষয়ে কন্ট্রিবিউট করতে পারবে; এর কোন কিছু'ই আমাদের জানার দরকার নেই।
এই অবস্থা আসলে আমাদের ব্যক্তি জীবনেও এসে পড়েছে!
আমরা আজকাল প্রেম-ভালোবাসা পর্যন্ত করি- কে কোথায় পড়ছে, কার কতো টাকা, কে কি চাকরি করে; কার বাবা-মা কি করে এইসব বিবেচনা করে!
অবাক কাণ্ড! প্রেম-ভালোবাসার মতো আবেগের একটা জায়গাতেও আমরা আজকাল এইসব ভাবছি!
এর ফল কি হচ্ছে জানেন?
সম্পর্ক গুলো টিকছে না!
কারন কি, সেটা জানেন তো?
কারন চাকরি আজীবন নাও থাকতে পারে; টাকা আজীবন নাও থাকতে পারে; অর্থ-সম্পদ এইসব যদি কোন কারনে কমে যায় কিংবা চলে যায়; তখন দেখা যায় সম্পর্ক গুলোও জানালা দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে কিংবা ভেঙে যাচ্ছে!
আমি আমার কথা বলতে পারি। এই জীবনে যেই দুই এক জনকে কাছের মানুষ মনে করেছি; ভালোবাসার মানুষ মনে করেছি; কোন দিন ভেবে দেখিনি- সে কোথায় পড়াশুনা করে; তার চাকরি কোথায়, তার ভবিষ্যৎ কি; তার বাবা-মা কি করে বা এইসব বস্তুগত বিষয়।
এটা তো ভালোবাসা কিংবা আবেগের জায়গা।
এখানে তো স্রেফ মানুষটা কেমন, এটাই গুরুত্ব পাওয়ার কথা। মানুষর হাঁটা-চলা, কথা-বার্তা, তার হাত-পা নাড়ানোর ভঙ্গী, তার মন-মানসিকতা, এইসবই না ভালো লাগার কথা। আমার তো তার বস্তুগত অর্জনকে ভালোবাসার দরকার নেই।
আপনি যখন এইসব বস্তুগত কিংবা বৈষয়িক বিষয় দেখে কাউকে ভালবাসবেন; সেই ভালোবাসা বেশি দিন টিকবে না; এটাই তো স্বাভাবিক।
ঠিক তেমনি আপনি যখন ব্র্যান্ড দেখে কারো মেধা যাচাই করবেন; সেই মেধাও এক সময় হারিয়ে যাবে; কিংবা কাজে আসবে না; এটাই স্বাভাবিক।
এই যে আমাদের দেশে এতো দুর্দশা, এর একটা অন্যতম কারন হচ্ছে আমরা না করি মেধার মূল্যায়ন। না আমরা সঠিক মেধাবীদের "মেধাবী" বলছি ! কারন পুরো সিস্টেমে'ই সমস্যা!
দিন শেষে সবাই ছুটছে বিদেশে পাড়ি জমাতে! সেখানেও শান্তি নেই।
এতো বছর বিদেশে থেকে অন্তত এতো টুকু বুঝতে পেরেছি- বিদেশে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে আজীবন মাথা নিচু করে বাঁচার চাইতে নিজ দেশ অনেক অনেক ভালো।
দূর থেকে আলোঝলমলে বিদেশের যেই জীবন আপনারা দেখেন; বাস্তবে সেটা অনেক বেশি'ই ধূসর!
বিদেশে থাকা এই মানুষ গুলোর একটা জীবন কেটে যায় ভাবতে ভাবতে- আহা, যদি দেশে যেতে পারতাম! কিংবা কবে দেশে যাবো!
দিন শেষে এদের অবস্থান না হয় বিদেশে, না হয় নিজ দেশে! এ এক আত্মপরিচয়হীন জীবন!
স্রেফ কিছু বেসিক বিষয় গুলো যদি আমরা পরিবর্তন করে ফেলতে পারতাম- আমি হলফ করে বলতে পারি ইউরোপ-আমেরিকার চাইতে আমাদের দেশ অনেক মায়াময়। অনেক বেশি'ই আপন।
আমাদের চাওয়া-পাওয়া যে খুব কম। কারন, আমরা বাংলাদেশিরা জানি- কি করে অল্পতেই সুখি হওয়া যায়।
Comments