তারকেশ্বর কনফারেন্স
৫ই এপ্রিল, ১৯৪৭ সালে প্রখ্যাত দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয়েছিল হিন্দু-অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির দাবিতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার ঐতিহাসিক তারকেশ্বর কনফারেন্সের পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণী।
"......কলিকাতা কর্পোরেশনের ভূতপূর্ব মেয়র শ্রীযুক্ত সনৎকুমার রায়চৌধুরী বাঙ্গলার হিন্দুর স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের একান্ত প্রয়োজনীয়তার দাবী জানাইয়া প্রস্তাব উত্থাপন প্রসঙ্গে বলেন – জনসংখ্যা, আয়তন ও অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিচার করিলেও এই নবরাষ্ট্র রাষ্ট্রনামের উপযুক্ত।
ঢাকার শ্রীযুক্ত সূর্য্যকুমার বসু প্রস্তাবটি সমর্থন করিতে উঠিয়া বলেন, “মিঃ জিন্নার পাকিস্থান মানিয়া লইলে বাংলায় হিন্দুদের অবস্থা দাসত্বের নামান্তর হইবে। অমুসলমানদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এমনকি নাগরিকদের প্রাথমিক দাবী পর্যন্ত ইসলামের নিকট জলাঞ্জলি দিতে হইবে। পাকিস্থান প্রতিষ্ঠিত হইলে অমুসলমানদিগকে দেশছাড়া হইয়া জিপসিদের মতো ঘৃণ্য জীবনযাপন করিতে বাধ্য করা হইবে। তাই বাঙ্গালী হিন্দুর বৃহত্তর স্বার্থের দিকে তাকাইয়া ও নবনির্মিত রাষ্ট্রে পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের নাগরিক দাবী স্বীকৃত হইবে – এই সকল বিবেচনা করিয়া পূর্ববঙ্গবাসী হইয়াও আমি এই দাবী সমর্থন করিতেছি।"
সুসজ্জিত মণ্ডপমধ্যে সুদৃশ্য বেদীর উপর দণ্ডায়মান হইয়া মেজর জেনারেল এসি চ্যাটার্জি (আইএনএ) বাঙ্গলার স্বতন্ত্র হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বলেন, “ইংরেজ আমাদের উপর অত্যাচার করিয়াছিল সেইজন্য ইংরাজের বিরুদ্ধে আমরা অস্ত্র ধরিয়াছিলাম। আর আজ মুসলিম লীগ আমাদের উপর অত্যাচার শুরু করিয়াছে তাই তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রয়োজন হইয়াছে। আজ অনেকেই নেতাজীর নাম করিয়া অনেক কিছু বলিয়া থাকেন অথচ হিন্দু বলিয়া পরিচয় দিতে দ্বিধা বোধ করেনা। নেতাজী মহাপ্রাণ ছিলেন। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে উনি ধর্ম মানিতেন না। কিন্তু দিনের পর দিন ভোরবেলায় তাঁহার কণ্ঠ হইতে মন্ত্র, স্তোত্র, আবৃত্তি শুনিয়াছি।”
মেজর জেনারেল চ্যাটার্জি আরও বলেন যে, মুসলিম লীগ নিজেদের ভিন্ন জাতি ভিন্ন ভাষাভাষী ও ভিন্ন সংস্কৃতির ধারক বলিয়া পরিচিতি দেয়। স্যার সুরেন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন যে আমরা এক জাতি, এক সংস্কৃতি ও একই ভাষার ধারক ও বাহক। নেতাজী কখনও বিশ্বাস করিতেন না এবং আমিও নিজে করিনা যে আমরা “দুই জাতি” এই নীতির উপর ভিত্তি করিয়া পাকিস্থান কায়েম করিলে সাম্প্রদায়িক সমস্যার কোন সমাধান হইবে।............."
সেই যুগের বাঙ্গালী হিন্দু প্রত্যাঘাত করেছিল ভয়াল, ভয়ঙ্করভাবে - আজকের বাঙ্গালী হিন্দু তার আসন্ন সর্বনাশ রুখতে তার সেই নিজস্ব সহজাত, ধর্মত সংগ্রামের পথে ফিরবে কি?
দেবীশক্তি রাষ্ট্রস্বরূপা - ধর্মের মূল স্রোত!? - রাষ্ট্র।
আর্য সনাতন হিন্দু রাষ্ট্রনৈতিক বিচারে তাই প্রত্যেক অর্থেই রাষ্ট্র/রাজ্য/নৃপতি ও তাঁর দন্ডনীতি ধারণকেই পরাক্রম ও ধর্মাচরণের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভূরূপে মান্যতা প্রাপ্ত।
এবং অবশ্যই ধর্ম অর্থে নিছক পূজাপাঠ, উপাসনা পদ্ধতি নয়। তা সমগ্র জীবনবোধ, কর্তব্যপরায়নতার এক নির্দিষ্ট দিশা যা জন্মমুহূর্ত থেকে মৃত্যুর অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত একজন মানুষকে প্রভাবিত করে। তাই রাষ্ট্রবাদ চর্চার প্রয়োজন সর্বাগ্রে - চিরকালীন, আজ অস্তিত্ব সঙ্কটের প্রায় শেষ প্রহরে তো বটেই।
মরণপন সংগ্রাম, রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের, ২০শে জুন - ১৯৪৭এ। হিন্দু-অধ্যুষিত রাজ্য, হিন্দু স্বার্থরক্ষার অতন্দ্র প্রহরীরূপে যার স্থায়িত্ব একমাত্র লক্ষ্য ছিল তা আজ প্রায় সর্বাংশেই লক্ষ্যভ্রষ্ট ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতার অমানিশা, বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের কাঠিন্যের অভাবে। ফলতঃ, 'আত্মদীপ ভবঃ' মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে সক্রিয় হতে হবে আমাদেরই।
Comments