ডেমক্রেসির ধারণার মধ্যেই টর্চারের দার্শনিক উপাদান লুকিয়ে আছে
গতকাল ছিল টর্চার বা রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে নির্যাতিতদের পক্ষে আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস। কালকে সিরডাপে সেই উপলক্ষ্যে আয়োজিত একটা আলোচনা সভায় আমাকে “অধিকার” একজন আলোচক হিসেবে আমন্ত্রন জানিয়েছিল।

টর্চার করে স্বীকারোক্তি আদায় ছিল দাসদের জন্য একটি গ্রেকো রোমান আইন। এই প্রিজামশন থেকে এই আইনটি তৈরি করা হয়েছিল যে দাস মালিকের ভয়ে দাস এতই ভীত থাকে যে দাসদের কাছে থেকে সত্য স্বীকারোক্তির জন্য আরেকটি মাত্রাতিরিক্ত ভীতি উৎপাদন করতে হয়।
ঐতিহাসিকভাবেই টর্চার করা হয় মুলত কোন অপরাধীকে নয় বরং অপরাধ সম্পর্কে তথ্য থাকতে পারে এমন অপরাধের সাথে সরাসরি সম্পর্কহীন ব্যক্তিদেরকেই। একটা ইন্টারেস্টিং তত্ত্ব আছে অ্যালেন স্কারির। তাঁর একটা বইও আছে বডি ইন পেইন নামে। সেখানে তিনি বলেছেন, টর্চারে মানুষের কনসাস বদলে যায়। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন বদলে যাওয়া কনসাসের একজন মানুষের স্বীকারোক্তির কি আদৌ কোন মুল্য আছে? এই টর্চার ইউরোপে আইন করে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয় ফরাসি বিপ্লবের পর। অথচ এই ফ্রান্সই এর অনেক পরে আলজেরিয়ায় নিরপরাধ মানুষদের উপরে শুধুমাত্র তাদের টেররাইজ করার জন্য টর্চার চালিয়েছিল।
পশ্চিমা লিবারেজমের যে সর্বোচ্চ বিকাশ হয়েছে অ্যামেরিকায় তারাও তো ভয়ানক টর্চার করে। আবু গ্রাইব কারাগার, গুয়াতেনাবো বে এর উজ্জ্বল উদাহরণ। তাহলে সমস্যা কোথায়?
সমস্যা আরো গভীরে। পশ্চিমা গণতন্ত্র দাড়িয়ে আছে স্টুয়ার্ট মিলের উপযোগবাদের উপর। যা সংখ্যাগরিষ্ঠের উপকারের জন্য যে কোন পদক্ষেপকে বৈধতা দেয়। টর্চারের বিরুদ্ধে ইউরোপে সবচেয়ে জোরালো দার্শনিক অবস্থান ছিল কান্টের। কান্টের এথিক্সের একটা বড় অংশ ছিল টর্চারের বৈধতাকে প্রশ্ন করা। কান্ট বলেছিলেন মানুষের নিজস্ব লক্ষ্য আছে, সে নির্যাতনে বাধ্য হয়ে অন্য কারো লক্ষ্য পূরণের উপায় হতে পারেনা। তাই এমন কোন কাল্পনিক থিওরিটিক্যাল অবস্থাও নেই যেখানে টর্চার বৈধতা পেতে পারে। মুশকিল হল কান্টের মতো এতো বিশাল মাপের চিন্তকও এই প্রশ্নে পশ্চিমে কল্কে পেলেন না। পেলেন না এই কারণেই তা উপযোগবাদের মুলকে প্রশ্ন করতে পারেনি।
টর্চারের বা রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের মুলকে উৎপাটন করতে হলে রাষ্ট্র নামের এই প্রপঞ্চ যেই যেই প্রিজামশনের উপর আর দার্শনিক ভিতের উপর দাড়িয়ে থাকে সেটাকেই প্রশ্ন করতে হবে। ডেমক্রেসির ধারণার মধ্যেই টর্চারের দার্শনিক উপাদান লুকিয়ে আছে।
আলোচনা সভায় ফরাসি দুতাবাস থেকে একজন প্রতিনিধি এসেছিলেন। তিনি আমার এই আলোচনায় বিশেষ করে ফ্রান্সের সেই উদাহরনে বেশ লজ্জা পেয়েছেন। তিনি আমার নাম উল্লেখ করেই আলজেরিয়ার ঘটনায় ফ্রান্সের ভুমিকা নিয়ে তাঁর লজ্জা ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, রাষ্ট্রীয় এই টর্চারের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ের পথ অনেক অনেক অনেক লম্বা। এছাড়া আর কী ই বা বলার ছিল উনার?