টোনাটুনির সংসার
আমাদের টোনাটুনির সংসারে সদ্য বেড়াতে আসা আমার ফুপু শ্বাশুড়ি বাজারের ব্যাগে প্রেমপত্র পেয়ে হুলুস্থুল এক কাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলেছেন। তিনি তার ভাতিজার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বারবার। আর আমি ঘটনার আগাগোড়া কিছু বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ফুপু শ্বাশুড়ির কানের দুল কাঁপছে, কপাল টানটান হয়ে আছে আর ফর্সা গাল দুটো টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। এর মানে তার মেজাজ এখন সপ্তমে।
কোমড়ে একটা হাত রেখে চোখ গরম করে তিনি আমাকে বললেন, - দেখছো নতুন বউ? তোমার জামাইয়ের কাণ্ডডা দেখছো? বাজার করতে গিয়া মাছ তরকারির বদলে প্রেমপত্র নিয়া আসে!

এই বলে তিনি তার আরেকটা হাত কপালে ঠেকিয়ে জিহ্বায় কামড় বসিয়ে মাথা নাড়াতে লাগলেন। আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। কারণ আমাকে এখনো বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। খানিকবাদে আমার কোনো প্রতিউত্তর বা প্রতিক্রিয়া না পেয়ে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, - পুরুষ মানুষ এমনই বুঝলা? চোখের সামনে থাকলে এক মানুষ আর চোখের আড়াল হইলেই অন্য মানুষ। তোমার ফুফাও তো... রাগের মাথায় মুখ ফস্কে ফুফার প্রসঙ্গে চলে এলেও সম্বিত ফিরে পেয়ে তিনি ঠিক জায়গায় থেমে গেলেন। আড়চোখে দু'একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, - যাক গে সেসব কথা। জামাইয়ের দিকে নজর দাও। জামাই হাতের বাইরে চইলা যাওয়ার আগে তারে সামলাও। কথা কি কানে গেছে নাকি যায় নাই? আমি ফুপুর হাতজোড়া সহ তার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, - কিন্তু ফুপু, আপনি যে বললেন বাজারের ব্যাগে চিঠি পেয়েছেন। তা বাজারের ব্যাগ কোথায় আর চিঠি কোথায়? হুড়মুড় করে ফুপু তার ঘরে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবার ফিরে আসলেন। - এই যে ধরো, ব্যাগসহ প্রেমের চিঠি। লুকাইয়া রাখছিলাম। ফয়সাল যদি দেইখা ফেলে! পরে যদি তার কাছে নিয়া রাইখা দেয় সেই ভয়ে।
চিঠিটা নাড়াচাড়া করে খুলে পড়তে লাগলাম আমি, "এই যে প্রিয় সুদর্শন, আমাকে নিয়ে ভাবার মতো একটু সময় হবে কি তোমার? আমাকে আর কত অপেক্ষায় রাখবে তুমি? আমার কি ইচ্ছে করে না তোমার মুখে কিছু মিষ্টিমধুর প্রেমালাপ শুনতে? তোমাতে ডুবে থাকতে..."
এইটুকু পড়ে আর পড়তে পারলাম না আমি। চিঠিটা মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেলাম। পেছন ফিরে তাকালে হয়তো দেখতে পারতাম ফুপু শ্বাশুড়ি একজন সফল গোয়েন্দার রূপ ধারণ করে দাপটের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।
প্রতিদিনের মত আজও অফিস থেকে ফেরার পথে বরমশাই ফোন করলেন কিছু আনতে হবে কিনা জানার জন্য। কিন্তু আমি ফোন রিসিভ করলাম না। এতবার ফোন বাজছে দেখে ফুপু জিজ্ঞেস করলেন, - ফোন বাজতেছে, ধরতেছো না যে? আমি চায়ের কাপে চিনি মেশাতে মেশাতে নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে উত্তর দিলাম, - ধরার দরকার নেই। ফুপু কাহিনী বুঝতে পেরে আরেকদফা জ্ঞানের কথা শুনিয়ে দিলেন।
বরমশাই বাসায় ফেরার পর তিনি হাতমুখ ধুয়ে আসলে তার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম, এমন সময় তিনি জানতে চাইলেন, - কি ব্যাপার? আসার সময় এতবার কল দিলাম, রিসিভ করলে না যে? - এমনিই। - ও আচ্ছা। ঠিক আছে, সবসময় যে ফোন ধরতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি তার সামনে থেকে চলে আসলাম।
রাতে খাবার টেবিলে তিনজন একসাথে খেতে বসেছি। বরমশাই নিজের মত করে একা একা কথা বলে যাচ্ছেন। আমি বা ফুপু কেউই তার কথার কোনো উত্তর দিচ্ছি না। বলা ভালো, পাত্তাই দিচ্ছি না। আমাদের এরকম অদ্ভুত আচরণ দেখে বরমশাই জিজ্ঞেস করলেন, - কি হয়েছে তোমাদের? কেউ কোনো কথা বলছো না কেন? সাথে সাথে ফুপু শ্বাশুড়ি ক্ষেপে উঠে দুম করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। যার ফলে বরমশাই ভয় পেয়ে খানিকটা কাত হয়ে গেলেন। আঙুল নেড়ে নেড়ে ফুপু বলতে শুরু করলেন বরমশাইকে, - সাধু সাজতেছোছ্ এখন? কিচ্ছু জানোছ্ না মনে হয়? ঘরে এমন সুন্দরী বউ রাইখা বাইরের দিকে এত নজর যায় ক্যান তোর? তোরে কি আমরা এই শিক্ষা দিছি? আমাদের মুখ তুই এমনে ছোট করবি? আমাদের পরিবারের তো একটা মানসম্মান... প্রায় পাঁচ মিনিটের বক্তৃতা শেষে ফুপু হাঁপিয়ে গিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এদিকে বরমশাই ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে ফুপুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মিনমিন করে প্রশ্ন করলেন, - কি বলছো ফুপু এসব? কিছুই তো বুঝতে পারছি না। করেছি কি আমি?
ফুপু সব খুলে বলার পর প্রমাণস্বরূপ চিঠিটা বরমশাইয়ের হাতে গুঁজে দিলেন। বরমশাই চিঠি পড়ে যেন তাজ্জব বনে গেলেন। - এই চিঠি তুমি বাজারের ব্যাগে পেয়েছো ফুপু? ফুপু দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলেন, - হুম। - কিন্তু আমি তো আজ বাজারেই যাই নি। - জানি তো। কিন্তু তাতে কি প্রমাণ হয়? বাজারে কি বউমা যায় নাকি তুই যাছ্? আজকে সকালে ঘুম থাইকা উইঠা ভাবছিলাম তোরে বাজারে পাঠাবো কিছু জিনিস আনতে। তাই রান্নাঘর থাইকা ব্যাগ আনতে গেছিলাম। পরে ব্যাগের ভিতরে এই চিঠি পাইছি। তারপর তুই অফিসে যাওয়ার পর বউমারে দেখাইছি। ফুপু-ভাতিজার কথার মাঝখানে আমি না খেয়ে উঠে চলে আসলাম।
সারাটারাত বরমশাইয়ের সাথে একটা কথাও বললাম না। পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমালাম। বরমশাইও আমার সাথে কথা বলার কোনো দুঃসাহস দেখাননি। হয়তো ভেতরে ভেতরে পুড়ছেন খুব তাই।
পরেরদিনও সকাল, দুপুর, বিকেল গেলো স্বামীর উপর নজরদারি বিষয়ক ফুপু শ্বাশুড়ির জ্ঞানের কথা শুনতে শুনতে। মনোযোগের ভান ধরে সেসব কথা শুনছিলাম আর মনে মনে বরমশাইয়ের চৌদ্দ পুরুষের বংশ উদ্ধার করছিলাম। সমস্যাটা শুরু হলো রাতের বেলা ঘুমোতে যাওয়ার সময়। ঘুমোতে যাওয়ার আগে ফুপু হাজারটা যুক্তি দিয়ে আমাকে বাধ্য করলেন আমার পুরো শরীরে সরিষার তেল লাগিয়ে যেতে। এতে নাকি তাড়াতাড়ি বংশবিস্তার হয়। এমনিতেই আমি সরিষার তেলের গন্ধ নিতে পারি না। কেমন যেন গা গুলিয়ে আসে। তারমধ্যে আমাকে এখন সারারাত এই গন্ধ গায়ে মেখে ঘুমোতে হবে!
ঘরে এসে বরমশাইয়ের পাশে গিয়ে শুতেই বরমশাই নাক ছিটকাতে শুরু করলেন। - উঁহুম, রাত বিরাতে সরিষার তেল মেখে এসেছো কেন? - আমাকে কিছু বলবেন না। যা বলার আপনার ফুপুকে গিয়ে বলুন। - মানে? - মানে তিনিই বলেছেন, রাতে শরীরে সরিষার তেল মেখে বরের কাছে আসলে তাড়াতাড়ি বংশবিস্তার হয়। আর সংসারে একটা বাচ্চা আসলে স্বামীদের বেঁধে রাখতে সুবিধা হয়। বরমশাই রেগে গিয়ে বললেন, - সরিষার তেলের গন্ধে তো তোমার ধারেকাছেই আসতে পারছি না। আবার বাচ্চা আসবে কি করে?
দুপুরবেলা ফুপু শ্বাশুড়ি নামাজে বসলে আমি সুযোগ বুঝে আমার শ্বাশুড়িকে ফোন করলাম। জানতে চাইলাম ফুপু শ্বাশুড়ির এ ধরনের উদ্ভট টোটকা থেকে কি করে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু তিনিও কোনো আশানুরূপ পথ দেখাতে পারেন নি। বললেন, সহ্য করে নিতে। একসময় তার উপর দিয়েও নাকি এই ঝড় গেছে। ফুপু শ্বাশুড়ি কবিরাজি চিকিৎসায় বিশ্বাসী। সেখান থেকেই এধরনের উদ্ভট উদ্ভট টোটকার সন্ধান পান তিনি।
শ্বাশুড়ির সাথে ফিসফিস করে কথা বলছিলাম এতক্ষণ। কথা শেষ করে ফোন রেখে ঘর থেকে বের হতেই দেখি ফুপু শ্বাশুড়ি সামনে দাঁড়িয়ে। থতমত খেয়ে গেলাম আমি। ফুপু সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে বললেন, - খালি কি আমার ভাতিজার দোষ! তোমার মতিগতিও তো আমার কাছে সুবিধার লাগতেছে না। আমি কোনো প্রতিউত্তর করলাম না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। - মাইয়াডার সন্ধান পাইছো? - কোন মেয়েটার? - যার সাথে তোমার বরের এক্কাদোক্কা খেলা চলতাছে। আমি নিচু স্বরে "না" বললাম। ফুপু একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন, যে দীর্ঘশ্বাসের মানে হচ্ছে- বউ হিসেবে আমি অযোগ্য। অকর্মার ঢেঁকি একটা!
বাসায় আসার পর থেকে বরমশাইকে বেশ অস্থির দেখাচ্ছে। আমি তার উপর রাগ করে আছি তাই যেচে গিয়ে কারণ জানতে চাওয়া আত্নসম্মানের ব্যাপার। চুপচাপ রইলাম, কিছু বললাম না। কিন্তু তার অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। এক পর্যায়ে তিনি নিজে এসে আমার সাথে কথা শুরু করলেন, - আচ্ছা প্রিয়তি, তোমারও কি আমার চরিত্র নিয়ে কোনো সন্দেহ আছে? এই ক'দিন তো অনেক ভাবলাম কিন্তু চিঠির মালিককে তো উদ্ধার করতে পারলাম না। কে হতে পারে বলো তো? আমি কোনো উত্তর না দিয়ে বরমশাইয়ের সামনে থেকে দ্রুত প্রস্থান করলাম।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর সব কাজ গুছিয়ে ঘরে এসে আবারো একই প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। এবার আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলাম না। এতদিনের জমে থাকা সবটুকু রাগ ঢেলে দিয়ে বলতে শুরু করলাম, - ভ্যালেন্টাইনস ডে'র পর থেকে ভাবছিলাম আপনাকে "তুমি" করে ডাকতে শুরু করবো। কিন্তু শুরুটা একটু অন্যরকমভাবে করার জন্য অনেক শখ করে চিঠির মাধ্যমে সম্বোধন পাল্টালাম। চিঠিটা বাজারের লিস্টের সাথে গত সপ্তাহে আপনার পকেটে রেখেছিলাম। আর আপনি কিনা এইটা বাজারের ব্যাগে ফেলে রাখলেন! আর নিজের বউয়ের হাতের লিখা চিনেন না আপনি? খানিকটা ধাতস্থ হয়ে বরমশাই কৈফিয়তের সুরে বললেন, - তুমি তো জানো আমি নিজের হাতের লিখাই ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারি না। আর বাজারের লিস্ট আমি সবসময় বাজারের ব্যাগেই ফেলে রাখি, এ ও তো জানো। ঝামেলা মনে করে দেখি না। তাই তো দু'তিনবার বাজারে যেতে হয়।
ততক্ষণে আমার চোখ দিয়ে পানি গড়াতে শুরু করেছে। তা দেখে বরমশাই আমার কাছে এসে চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন, - আচ্ছা ঠিক আছে। আর এমন ভুল হবে না। কিন্তু যখন দেখলে আমি চিঠিটা পড়ি নি, বাজারের ব্যাগ থেকে সরিয়ে রাখলে না কেন? - আমারও কি মনে ছিল নাকি? গত শুক্রবার মামারা এলেন বাসায়, কাজের চাপে ভুলে গিয়েছিলাম।
ভেবেছিলাম বরমশাই আমাকে বুকে জড়িয়ে নিবেন। কিন্তু না, তিনি হুড়মুড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলেন। পিছু ডেকে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, - কোথায় যাচ্ছেন? বরমশাই যথেষ্ট উচ্ছ্বাস নিয়ে উত্তর দিলেন, - ফুপুর কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে যাচ্ছি।
Comments