ছিঁড়ে আসা পর্দা
ওয়ারিতে ১৪০০ স্কয়ার ফুট বাসায় সপ্তম তলায় ভাড়া থাকি আমি, গত ৭ বছর ধরে আমি একাই বাসা নিয়ে থাকি। আমার বর্তমান বাসার বেডরুম অনেক বড়, তিনটা জানালা, ২টা দরজা যার একটা ব্যালকনিতে যাবার জন্য। আমার লম্বা পর্দা খুব ভাল লাগে, তাই সব দরজা-জানালা তে লম্বা পর্দা দেয়া।
কাজের সুবাদে আমাকে রাত জাগতে হয়, প্রায় প্রতিদিনই ভোরে ঘুমাতে যাই। কাল রাতে হঠাত শরীরটা ভাল লাগছিল না, তাই ১২ টার দিকে শুয়ে পড়লাম। সাথে সাথেই ঘুম। কতক্ষণ হয়েছে জানি না, প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভয় পেয়ে গেলাম। বাইরের রাস্তার মিটি মিটি আলো আমার রুমে আবছা আবছা আসছে। প্রচন্ড বাতাস, মনে হচ্ছে আমার রুম উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সব লম্বা লম্বা পর্দা ছাদ ছুঁই ছুঁই করছে। হঠাত একটা পর্দা সিলিং ফ্যানে বেজে ছিঁড়ে চলে আসল। সে এক বীভৎস দৃশ্য। মনে হল পৃথিবী শেষ হয়ে যাচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। কি করব ভেবে পাচ্ছি না। উঠে দাঁড়ালাম, জানালা বন্ধ করতে গেলাম কিন্তু বৃষ্টির ঝাপটার কারণে দাঁড়াতে পারছিলাম না। আবার বিছানায় গিয়ে বসলাম। মিনিট খানেক পরে সব থেমে গেল, একদম ঠাণ্ডা, শীতল। এবার আমি উঠলাম, সম্বিত ফিরে পেলাম আস্তে আস্তে।
এবার উঠে আবার জানাল আটকাতে গেলাম, কেননা ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। জানালা আটকাতে গিয়ে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। রাস্তা একদম খটখটে শুকনো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম কোথাও একটুখানি পানি দেখা যায় কিনা, কিন্তু না! আমি বিছানার দিকে তাকালাম, এখনো সেখানে পড়ে আছে ছিঁড়ে আসা পর্দাটা। আর আমি দাঁড়িয়ে আছি জানালার পাশে ঝাপটা আসা পানির উপড়ে! মনের মধ্যে খচখচ শুরু হল, ঘড়ি দেখলাম – ২.১২। দৌড়ে ডাইনিং রুমে গেলাম, ইন্টারকমে কেয়ারটেকার কে ফোন দিলাম, প্রথম বার ধরল না, দ্বিতীয় বার ধরল। জিজ্ঞেস করলাম যে বাইরে ঝড় বৃষ্টি হয়েছে কিনা। সে বলল, সে ঘুমাচ্ছিল তাই জানেনা, কিন্তু রাস্তাঘাট দেখে তো সে রকম কিছু মনে হয় না। আমি ফোন রেখে ভাবলাম, তুমি ব্যাটা ঘুমাচ্ছিলে, তুমি কিভাবে টের পাবে! আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম এত রাতে আর কাকে ফোন দেয়া যায়, কিন্তু কাউকে পেলাম না। রান্নাঘরে গিয়ে কফি বানালাম। মগে করে কফি নিয়ে আর একটা সিগারেট জ্বালিয়ে লিভিং রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম। আকাশের এক পাশে ঘন কালো মেঘ, অন্য পাশ কিছুটা পরিষ্কার। সেই পাশ থেকে চাঁদের আলো এসে পড়েছে কালো মেঘের উপড়ে। মনে হচ্ছে অমানিশা!
যাই হোক, সকালে উঠে খোজ নিব এই ভেবে সব গুছিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। পৌনে তিনটার মত বাজে তখন। হালকা তন্দ্রার মত আসছে সবে। আবার ও ঘুম ভেঙ্গে গেল। এবার কোন জোড়ে আওয়াজ হয়নি। কিন্তু মনে হচ্ছে ডাইনিং রুমে কেউ হাঁটছে। হেঁটে হেঁটে অন্য রুমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি তার শ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছি। আমি এমনিতে অলৌকিক কোন কিছুতে বিশ্বাস করি না। তাই সবার আগে মাথায় আসল বাসায় কেউ ঢুকেছে কিনা। আমি উঠে ছিঁড়ে যাবার পর্দাটার স্ট্যান্ড হাতে নিলাম। আস্তে আস্তে ডাইনিং রুমের দিকে উঁকি দিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ, কোন সাড়া শব্দ নেই! মিনিট পাঁচেক পড়ে গিয়ে লাইটা জ্বালালাম। অন্য রুম চেক করলাম, কোথাও কইছি নেই। সব রুমের লাইটা জ্বালালাম। আমি স্পষ্ট ফিল করতেছি যে আমার পাশে কেউ হাঁটছে, এ রুম থেকে অন্য রুমে যাচ্ছে। আবার সেই শ্বাসের শব্দও শুনছি আমি। এবার আমার গাইয়ে কাঁটা দিল, সত্যি সত্যি ভয় পেলাম। পিঠ বেঁয়ে শীতল একটা স্রোত বেঁয়ে গেল। আমি বুঝতে পারছি যে আমার পা কাপতেছে। আবার ইন্টারকমে ফোন দিলাম কেয়ারটেকারকে, কিন্তু – লাইন ডেড! মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি নেটওয়ার্ক নেই, আর ওয়াই-ফাই ও বন্ধ! বুঝতে পারছি অদ্ভুত কিছু, ব্যাখ্যাতীত কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ঠিক করলাম বাসার বাইরে চলে যাব। সব ফ্লোরে ৪ ইউনিট। আমার ফ্লোরে বাকি ২ইউনিটে কেউ থাকে না, ভাড়ার জন্য খালি। এর মধ্যে একটা খালি প্রায় ৮ মাস ধরে। বাকি ফ্ল্যাটে ৩টা মেয়ে থাকে, এত রাতে ওদেরকে নক করা যায় না। ঠিক করলাম, নিচের ফ্লোরে আশরাফ আংকেলের বাসায় যাব। ওনারা আমাকে খুবই আদর করেন। ওনার ২ ছেলেও অনেক ভাল।
যেই ভাবা সেই কাজ। চট করে চাবি হাতে নিলাম, সাথে ফোনটা। দরজা খুলে দেখি দরজার বাইরের কমন স্পেসের লাইট বন্ধ। জ্বালানোর চেষ্টা করলাম, দেখি সুইচ অন আছে। মানে লাইট কেটে গেছে তাহলে। অভাগা যেদিকে যায়, সব বাতি নিভে যায় টাইপের আর কি! আমি তড়িঘড়ি করে দরজা আটকাতে গেলাম, দেখি শেষ মুহূর্তে এসে আটকে যাচ্ছে একটু ফাঁকা রেখে। আবার চেষ্টা করলাম – এবার পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে বাসার ভিতর থেকে কেউ টেনে ধরছে! আমি ছেড়ে দিলাম দরজা। আস্তে করে উঁকি দিলাম ভয়ে ভয়ে, কিচ্ছু নেই। এবার দরজা জোড়ে টান দিলাম আটকানোর জন্য, আবারো টেনে ধরল। এবার ভয়ে চিৎকার দিলাম কিন্তু কোন আওয়াজ বের হল বুঝতে পারছি। কোন রকমে দৌড়ে সিঁড়ি বেঁয়ে নিচে নেমে আশরাফ আংকেলের বাসায় বেল বাজালাম। ২-৩ মিনিট পরই খুলল। ঐ বাসায় আরো কিছু গেস্ট ছিল, সবাই উঠে গেছে। আমি হাঁপাচ্ছি। সব খুলে বললাম তাদের। ওনার ছেলে, নাম বাবু, বলল যে সে আর তার কাজিনরা জেগে ছিল, কোন ঝড় বৃষ্টি হয়নি, বরং আজ আরো গরম পড়েছে। ওরা ৫ জন বলল, উপড়ে গিয়ে দেখবে। আমি না করলাম, কিন্তু তবু গেল। মিনিট খানেক পরেই ফিরে এসে বলল যে, ভাই চাবি দেন, দরজা তো লক করা! আমি বুঝতেছি না যে কি বলব! পকেট থেকে চাবি বার করে দিলাম। ওরা আমার বাসায় গিয়ে প্রায় ১৫ মিনিট থেকে আসল, বলল কিচ্ছু নেই, ওরা নাকি লাইট অফ করেও বসে ছিল। জিজ্ঞেস করলাম দরজা লক করেছে কিনা, ওরা বলল হ্যাঁ করেছে। অ্যান্টি রাতে ওনার বাসায়ই থাকতে বলল। রাত আর কোথায়, প্রায় ৪.৩০ বাজে তখন। তবু ওখানেই শুয়ে পড়লাম। দুপুরে ঘুম ভাঙল। ওনাদের বাসায় খেয়ে উপড়ে আসলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে পকেট থেকে চাবি বার করলাম। দরজার সামনে এসে দেখি, দরজা খোলা! আবার বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠল।
দুরু দুরু বুকে বাসায় ঢুকলাম। মোবাইলে দেখলাম নেটওয়ার্ক আছে। ওয়াই-ফাই ও পাচ্ছি, ইন্টারকমে লাইট জ্বলে। মনে হচ্ছে সব ঠিক আছে এখন পর্যন্ত। বাসায় এসেই আবার রুম গুছাতে শুরু করলাম, কিন্তু গত রাতের ঘটনা থেকে বের হতে পারছি না। অনেক কাজও বাকি। যদিও অ্যান্টি রাতের খাবার দিয়ে দিয়েছে কিন্তু তবু আমাকে কাল দুপুরের জন্য রান্না করতে হবে।
গত রাতে ঠিকমত ঘুম হয়নি, আজ রাতে এমনিতেই আগেই ঘুম পাবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত না যে আমি ঘুমাতে পারব কিনা।
Commenti