ক বছর এক দিন
শীতের সকালে চোখমুখ ঢলে ঘুম থেকে উঠেই কোনরকম গোসল করে দৌড়ে এসে অফিসের বাস ধরে অফিসে পৌঁছেছিলাম। যদিও এটাই প্রতিদিনকার রুটিন। আফরিন কিচেন থেকে চিল্লাচ্ছিলো টিফিন নিয়ে যাওয়ার জন্য। ও অসুস্থ তাই ইচ্ছে করেই আজকাল ওকে প্যারা দিচ্ছি না আর। মেয়েটা সাংঘাতিক খাটনি দেয় আমাকে গুছিয়ে রাখতে। আমার মতে আমি আগের চেয়ে অনেক গুছিয়েছি ওর এই এফোর্টে;
এইযে ও না ডাকাতে-ই উঠে পড়লাম, আর গোসল তো সপ্তাহে একবার করলেই অনেক হতো আমার জন্য, এটাও এখন রেগুলার। কিন্তু তাও কেনো যেনো আফরিনের মতে আমি নাকি আরো আউলে গিয়েছি, গোছানোটা নাকি আমার নসিবেই নাই একদম। যাকগে, সারাদিন অফিস করে বের হলাম। নিচে নেমে বাইরের আলো খুব চোখে ধরছিলো। যেনো অন্ধকার এক গর্ত থেকে বহুক্ষণ পর বের হলাম। বিজয় স্মরণীর লম্বা সিগন্যাল দেখে আর ইচ্ছে করলো না উবার ডাকার। সোজা ফুটপাথ ধরে সংসদ ভবনের পেছনের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। . ফোনটা বের করে দেখি আফরিন অনেকবার কল দিয়েছে, উফফ শিট! ফোনটা ড্রয়ারে সাইল্যান্ড মুড করা ছিলো যে খেয়ালই ছিলো না। তাড়াতাড়ি ফোন ব্যাক করলাম, সুইচড অফ দেখাচ্ছে। এখন সিরিয়াসলি টেনশনে পড়ে গেলাম। মেয়েটা অসুস্থ তারউপর একা বাসায়। তাড়াতাড়ি উবার ডাকার চেষ্টা করছি। বেটারা সব অনেক দূর থেকে ফোন রিসিভ করছে। দ্রুত হেঁটে মিরপুর রোডে উঠতে হবে। মাথা নিচু করে হাঁটা শুরু করলাম, হঠাৎ একটা গুলির শব্দ শুনে মাথা তোলে তাকাতেই দেখলাম একটা ছেলে বুকে হাত দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেলো আমার। যে গুলিটা করলো সে রাগী চোখে বডিটা ঘুরিয়ে আঙ্গুলে ফুঁ দিলো। একদম প্রফেশনাল কিলারদের মতো। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আশেপাশে তাকানোর শক্তিটাও পাচ্ছি না। বাট একটা ব্যাপার মাথায় মূহুর্তেই খেলে গেলো আর সেটা হলো কিলারের হাতে কোন পিস্তল ছিলো না। তারমানে কী দিয়ে গুলি করলো? ততক্ষণে দেখলাম দূর থেকে একজন স্ট্যান থেকে ক্যামেরা খুলে নিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়েই চিল্লায়া বলতেছে 'কাট কাট শটটা খুব ভালো হয়েছে।' যে মারা যাচ্ছিলো সেও দেখি উঠে গা'টা ঝাড়ছে। মূল বিষয়টা বুঝতে ভালোই সময় লাগলো আর সেটা হলো নিজ্ঞা জেনারেশন টিকটিক ভিডিও শুট করছিলো এখানে। - আঙ্গুল দিয়ে গুলি করতে পারে কেমনে বালামার! মেজাজটা! যাক, দ্রুত হেঁটে মিরপুর রোডে উঠে একটা বাস ধরলাম। ফোন দিচ্ছি আফরিনকে, এখনো ফোনটা খুলছে না। রাগ করলো কিনা কে জানে। আফরিন প্র্যাগন্যান্ট। এইতো কিছুদিন আগেই হঠাৎ রাতে উঠে আমাকে ডাকছে; - এই উঠো নিভু চোখে বলছিলাম; - কী হলো আফরিন? সমস্যা কী? এতো রাতে বসে আছো কেনো? - আমার দিকে তাকাও তো। কিছু বুঝা যাচ্ছে? অ্যানি চেঞ্জ? - এখন তাকানোর সময় নেই আফরিন, শীতকালে প্রতিদিন এসব ঝামেলা তারউপর ঠান্ডায় ডেইলি গোসল...। - তুমি এতো লুচ্চা ক্যান রবিন? আমি বলতে চাচ্ছি কী আর বুঝতেছো কী? যাও তো ঘুমাও। অসহ্য লাগে। - আচ্ছা স্যরি স্যরি, বলো। এইযে আমি উঠে বসলাম। - না বলবো না। - কান ধরেছি তো!
এবার আফরিন আমার বাহু জরিয়ে অনেকটা কাছে এসে বললো; - তুমি যে বাবা হচ্ছো এটা কিন্তু হাস্যকর লাগছে আমার। নিজেই তো এখনো বড় হওনি। - আমার পৃথিবীটা অন্যরকম লাগছিলো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ও মা হতে যাচ্ছে আর আমি বাবা! এই টুনাটুনির সংসারে আরেকটা পুঁচকু আসতেছে। ক্যান জানি খুশিতে কেঁদে ফেলেছিলাম। সেদিন সারারাত ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলাম। সবটাই একটা ফ্লোতে হয়ে যাচ্ছিলো এই এক দু’বছরে। চাকরি পাওয়া, বিয়ে করা আর এখন বেবি আসা। . বাস থেকে নেমে একরকম কুঁচি দৌড়ে বাসার কাছে আসলাম। লিফট চাপার সময় নেই। সিড়ি বেয়ে দৌড়ে উপরে উঠলাম। বাসায় ঢুকেই আমার মাথা ঘুরছিলো আচমকা আফরিনের এই অবস্থা দেখে; আফরিন ফ্লোরে শুয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে কাঁদতেছে! আমি কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। দৌড়ে ওর কাছে এসে ওকে কোনরকম জাপটে ধরে বললাম; - আফরিন কী হয়েছে লক্ষ্মীটা? ফোন কোথায় ছিলো? আফরিন দাঁতে দাঁত চেপেই বলতেছে; - যাও তুমি অফিসে যাও। আমি মরি, আমাকে মরতে দাও। আমিই ফোন অফ করেছি। চার ঘন্টা ব্যথায় তিলে তিলে মরছি, কল করেছি কয়েকশোবার। কেউ নাই। যাও ভাগো এখান থেকে। - আমি স্যরি সোনা। উঠো হসপিটালে যাবো। - দৌড়ে পাশের ইউনিটের একজন আপুকে গিয়ে নিয়ে আসলাম। এতো কিছুর মধ্যেও ও বলতেছিলো কিছু পরিস্কার তোয়ালে আর কি কি যেনো আলমারিতে রাখা ওসব যেনো খেয়াল করে নেই। আমিও ওসব ঝটপট নিয়ে ল্যাপটপের ব্যাগে ঢুকিয়ে লক্ষ্মী ছেলের মতো বের হয়ে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে আবার আফরিন চিল্লায় বলছিলো; - এইই আমাকে নিবে কে? উফফ! ও আল্লাহ্ এটা কী জুটলো আমার কপালে! - ওহ্ স্যরি স্যরি বাবু আসো। . হসপিটালে আসতে আসতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। আফরিনকে একটা স্যালাইন লাগিয়ে রাখা হয়েছে। অবস্থা দেখে একজন ডাক্তার শিওর করেছেন আজকেই সিজার করা লাগবে। তবে আপাতত শঙ্কামুক্ত, একজন গাইনী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছেন উনি এসে অপারেশনটা করবেন। হাতে আরো সময় আছে। - উফফ! বুঝতে পারছি না কী হবে। আম্মাকে ফোন করবো যেয়ে দেখি ফোনটাও বন্ধ হয়ে গেছে। চার্জ নাই। সারাটাদিন কেমন যে যাচ্ছে বুঝাতে পারবো না। ক্যাবিনের বাইরে এসে একটা বেঞ্চে বসে হাত পা ছড়িয়ে চোখ বুঁজে রইলাম। কখন যে ক্লান্তিতে চোখ লেগে গেলো টেরই পেলাম না। হঠাৎ একটা নার্সের ডাকে লাফিয়ে উঠলাম। নার্স এসে বলছে; - আপনাকে ডাক্তার ম্যাম ডাকছেন উঠেন।
ঢুকলাম ক্যাবিনে। ডাক্তার আমার দিকে তাকাতেই আমি যেনো আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। এতোটা চমকে যাবো সেটা কল্পনাতেও ছিলো না। জাস্ট মুখ ফসকে বললাম; - চিত্রা!
চিত্রা অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে আবার বেশ প্রফেশনাল ওয়েতে নিজেকে কনভার্ট করে বললো; - ইয়েস আ'ম ডক্টর চিত্রা। আপনি মিস্টার রবিন? আপনিই মিসেস আফরিনের হাজব্যান্ড? - হুমম - পেসেন্টের এই হাল কেনো? উনার তো প্রপার কেয়ার নেয়া হয়েছে বলে বুঝা যাচ্ছে না। উনার ব্লাড গ্রুপ জানেন? - আমার আসলে মনে... - খুবই হাস্যকর লাগলো বিষয়টা। আপনার মতো পুরুষদের দ্বারা আসলে... কাইন্ডলি আপনি বের হয়ে যান প্লিজ।
এই বলে চিত্রা নার্সদেরকে পেসেন্ট অটিতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে চলে গেলো ক্যাবিন থেকে। আমি আবার স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। . বর্তমান প্রচলিত শব্দে চিত্রা আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড। আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা। যেখানে আমার ছোটবেলার আবেগটাও মিসে একাকার হয়ে ছিলো। কতশত স্বপ্ন ছিলো এই চিত্রাকে ঘিরে। আমি যেনো আজ বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছি। যেনো চিত্রাই আমাকে বাস্তবতার দুয়ারের বাইরে ঠেলে দিলো। খুব বাজে লাগছে আপাতত। এই চিত্রাই ছিলো একদিন আমার লক্ষ্য। ওকে অর্জন করতে কিনা করলাম। আবার মূহুর্তেই ওকে ঠেলে ফেলে চলে এসেছিলাম সেদিন। - চিত্রার সাথে আমার পরিচয় হয় ফেসবুকে আজ থেকে এগারো বছর আগে। খুব সাদামাটা একটা আইডি ছিলো। যেখানে কোন প্রোফাইল পিক ছিলো না। নামটাই ছিলো ইউনিক 'Ami Jusna'। আমি চ্যালেঞ্জ করেছিলাম এই জোছনাকে আমি খুঁজে বের করবো-ই। জোছনাও বলেছিলো 'আচ্ছা দেখি কীভাবে খুঁজে বের করেন।' আমি বলেছিলাম; ' 'যদি বের করতে পারি?' জোছনা বলেছিলো; 'তবে যা চান পাবেন' আমিও বলেছিলাম; 'আমি আপনাকেই চাইবো দিতে হবে।' জোছনা বলেছিলো খুঁজে তো পান আগে। . কোন এক শীতের কনকনে ঠান্ডার রাতে বের হয়ে গিয়েছিলাম জোছনার খুঁজে। ছোট ছোট কিছু ক্লু আর আবেগের শক্তি নিয়ে তিনদিন লেগেছিলো আমার জোছনাকে খুঁজে বের করতে। তখন চারদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছিলো। গোধূলি ছিলো সেদিনের পাহারাদার। নদীর এক বালুচরে সাদা একটা ওড়না মোড়ে আসছিলো জোছনা। আমার ছিলো রাজ্য জয় করার সুখ ওকে দেখে। এতো মায়াবী একটা মেয়েকে আমি অর্জন করে ফেলেছিলাম। জোছনা হার মানার মতো করেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে বলেছিলো; 'এই পাগলামিটা না করলেও পারতেন।' আমি বলেছিলাম; আমার গিফট কোথায়? জোছনা আমার হাতে একটা নুডলসের বাটি ধরিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। - জোছনাই ছিলো আজকের এই চিত্রা। আমি পেয়েছিলাম আমার সেই জোছনাকে। আগলেও নিয়েছিলাম আমার করে। কিন্তু ঘটনাটা অনেকদিন পর অন্যরকম রুপ ধারন করলো। যা আবেগের ঘোরে আমি টের-ই পাইনি। একদিন আমি একটা চান্সে আর্ম ল্যাপট্যানেন্টের প্রাথমিক ট্রেনিং শেষে ঢাকা থেকে রওনা হয়েছিলাম মানিকগঞ্জের দিকে চিত্রার সাথে দেখা করতে। পায়ের ব্যাথায় পা ফুলে গিয়েছিল কয়েকদিনের ট্রেনিং করে। তাও চিত্রাকে এক পলক দেখতেই হবে। সিলেট থেকে তো আসাটা কষ্টকর ছিলো। সেদিন শেষ বিকেলে নদীর ধারে একটা গাছের নিচে বসেছিলাম আমি আর চিত্রা। পায়ের ব্যাথায় কথা বলতে পারছিলাম না। ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বসে ছিলাম। চিত্রা খুব অপরাধীর মতো করে বলছিলো; আপনি এমন ক্যান? এই অবস্থায় কেনো আসলেন? এতো পাগল ক্যান বলেন তো? আমি বলেছিলাম আমি তোমার জন্যই পাগল। চিত্রা একদম অপরাধীর মতো চেহারা করে বলেছিলো, 'আপনি এখানে কিছুক্ষণ বসেন আমি আসতেছি।' . অনেকক্ষণ পর চিত্রা ওড়নার আড়াল করে শিং জাতীয় কিছু একটা নিয়ে আসলো। বের করে বললো, দেখি তো প্যান্ট একটু হাঁটু অবধি তোলেন। আমি ওর পাগলামি দেখে হাসতেছিলাম আর বলছিলাম, 'কী করছো চিত্রা? এই আধুনিক যুগে এসেও এসব বেদ প্রথা তুমি মানো? তোমরা মেয়েরাও না যা দেখো তাই বিশ্বাস করো। নিশ্চয়ই কোন বেদিনি এসব কুমন্ত্রণা মাথায় ঢুকিয়েছে?' চিত্রা চোখ টিপে কাঁদছিলো। কিছু না বলেই শিংটায় মুখ লাগিয়ে অবিকল বেদদের মতো করে কিছু একটা চুষে বের করার চেষ্টা করছিলো। আমার ব্যাপারটাতে খুব খারাপ লাগছিলো। এবার কেনো যেনো একটা ঘোর থেকে বের হয়ে ওর পরিচয় জানতে বড্ড ইচ্ছে করছে। চিত্রাকে বললাম; তুমি কে চিত্রা? সত্যি করে বলো। - চিত্রার চোখ লাল হয়ে আছে কান্নায়। খুব অপরাধবোধ নিয়ে বলছিলো, 'আমি একজন বেদের সন্তান রবিন।' এই কথাটা শুনার পর ইচ্ছে করছিলো লাথি মেরে ফেলে দেই নদীতে। এতো বড় প্রতারণা আমার সাথে! রাগে দুঃখে ওরে সেদিন খুব বিচ্ছিরি বকা বকেছিলাম। বলেছিলাম; তর এতো বড় স্পর্ধা! নিকৃষ্ট ছোটলোকের বাচ্চা। তদের ধান্দা আর প্রতারণা এতো সুদূরপ্রসারী? আর কোনদিন আমার সাথে যোগাযোগ করবি না। আরো অনেক কিছুই বলেছিলাম রাগের মাথায়। মাথাটা নিচু করে বলেছিলো চিত্রা; আমি আমার এই নিচু সমাজটা থেকেই সব বেড়াজাল টপকে অনেক দূর যেতে চাচ্ছিলাম রবিন। আমি জানি আমার এই দুঃসাহস এই সভ্য সমাজে কাম্য নয়। তাও আপনার ভালোবাসায় আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম। আল্লাহ্র দোহাই লাগে আপনি আমায় একটু সহায়তা করেন। আপনার পায়ের কাছে আমায় একটু ঠাই দেন আমিও এই সমাজে সব কু-প্রতা ভেঙ্গে উঠে দাঁড়াতে চাই। আপনি জানেন আমি এই এলাকায় সেরা রেজাল্টাই করেছি। আমাকে আপনি ভুল বুঝবেননা দয়া করে। আমার অনেকবার ইচ্ছে করছিলো সব সত্যটা বলে দিতে বিশ্বাস করেন সাহসে কুলায় নাই।' এসব বলে পায়ে পড়ে সেদিন অনেক কেঁদেছিলো চিত্রা। একরকম লাথি মেরেই ফেলে চলে এসেছিলাম। একবারের জন্যও এটা ফিল করি নাই যে আমার পায়ের ব্যাথাটা অদ্ভুতভাবে তখনি সেরে গিয়েছিল। জানি এসব বিশ্বাস করাটা বোকামি তাও এই মিরাকলটাই ঘটেছিলো।
তারপর আর বহুদিন যোগাযোগ করিনি চিত্রার সাথে। একবার তাও কেনো জানি খুব টানছিলো বেদের মেয়েটাকে আরেকবার দেখে আসি। যাকে কোনদিন দেখে কেউ বলতে পারবে না সে বেদের মেয়ে। আমি গিয়েছিলাম আরেকবার ওকে খুঁজতে। সেবার আর জিততে পারিনি। পাইনি খুঁজে তাকে আর কোথাও। তারপর খুব ভালো ভাবেই জীবনটা টেনে এখানে নিয়ে আসলাম। চিত্রার চিত্র মুছে গিয়েছিলো কতনা সহজে। . রাত এগারোটা বাজে। হঠাৎ অটি থেকে নার্স বের হয়ে এসে বললো স্যার আপনার একটা বেবিগার্ল হয়েছে। এই কথাটা শুনে প্রাণটা ঠান্ডা হয়ে গেলো। আমার আর আফরিনের দুজনেরই স্বপ্ন ছিলো একটা মেয়ে চাই। একারনে কখনো জানতে চাইনি কী হবে আমাদের। জাস্ট উইশ করছিলাম। নার্সকে বললাম কোথায় আমার মামনিটা? আফরিন কেমন আছে? নার্স বললো, 'দুজনেই সুস্থ্য আছেন। অনেক যত্ন করে দেখলাম আজ চিত্রা ম্যাম একটা অপারেশন করতে। যেনো উনি উনার শরীরটা কেটে বাচ্চা বের করলেন। আপনি কী ম্যামের পরিচিত?' কিছু বলতে পারলামনা। আমি চাচ্ছিনা চিত্রার আর কোন স্মৃতি মনে করতে। আমি খুব ফাইট করছি আমার সাথে। বারবার চিত্রার পায়ে পড়ে কান্নার আকুতিটা চোখে ভাসছে। এই চিত্রাকেই একদিন দুষ্টুমি করে বলেছিলাম আমাকে একটা মেয়ে দিবেন আপনি? ছোট্ট পুঁচকি একটা মেয়ে। চিত্রা মেয়েটা লজ্জায় যেনো মরে যাচ্ছিলো। বলেছিলো, 'আমি দোয়া করে দিবোনে।' সেদিন জড়িয়ে ধরেছিলাম প্রথম। সেই শিহরণটা এখনো গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। নিজেকে পুড়ে চাই করে দিতে ইচ্ছে করছে এখন। আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে কেনো জানি। আচ্ছা এরকম বিচ্ছিরি বাস্তবতায় আপনারা কেউ দাঁড়িয়েছেন? নাকি আমিই একমাত্র ইতিহাসের সাক্ষী? প্রকৃতি যেনো থু ছুড়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে আজ। পারছিলাম না আর। চিত্রা আমার সাথে কোন কথাই বললো না। ক্যাবিনে ঢুকে আমার মেয়েটাকে কোলে নিলাম। আমার স্বপ্নের একটা টুকরো আজ আমার হাতে। আফরিনের কথাটাই যেনো সত্য। আমি নাকি বাবা হবো, এটা হাস্যকর বাট হয়ে গিয়েছি আজ। ওকে ওর মায়ের কাছে রাখলাম। আফরিনের ফোনটা ওর ব্যাগ থেকে খুলে সবাইকে ফোন করে এই খবরটা জানালাম। আম্মা কেনো জানি খুব বকাবকি করলো আমায়। কিছুই খেয়াল করিনি। কাল সবাই আসতেছে শহরে। চিত্রা ঘুরেফিরে ক্যান জানি আমার চিন্তায় ভেসে আসছে। মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। বুকে কি একটা জমে পাথর হয়ে আছে। . বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখি সমস্ত আকাশ ফানুস আর আতশবাজিতে আলোকিত। খুব শকট্ হয়ে গেলাম আবার। ঠিক তখনি মনে পড়লো আজ নতুন বছরের শুরু হয়েছে। খেয়াল'ই ছিলো না। শেষটা আর শুরুটা চমকেই গেলাম শুধু। হঠাৎ চিত্রাকে দেখলাম ক্যাবিনে ঢুকতে। গেলাম পিছু পিছু, চিত্রা আফরিনকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানালো। আমার মেয়েটাকে আর আফরিনকে একটু চেকআপ করে প্রেসক্রিপশন লিখে আবার বের হয়ে গেলো। আমিও পিছে পিছে গেলাম। ডাকলাম, কোন সারা পেলাম না। ওর পিছু পিছু নিচে নামলাম। একদম সামনে গিয়ে দাঁড়াতে থামলো। বললাম, 'কেমন আছেন চিত্রা?' চিত্রা সুন্দর করে একটা হাসি দিয়ে বললো, 'জ্বি অনেক ভালো আছি। মেয়ে এবং বউয়ের যত্ন নিবেন। ঠান্ডাটা একটু ম্যাইন্ট্যান করে চলতে হবে। আর হ্যাঁ আমি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি কালকে। প্যাপার্স শিফট করে দিয়েছি আরেকজন সিনিয়র ডাক্তারের কাছে, উনি চেকআপ করবেন। ভালো থাকুন।' চিত্রা চলে গেলো। আমি পেছনে দাঁড়িয়ে দেখছি একটা বেদের মেয়ে এই নাটকীয় সমাজকে আর আমার মতো ছোটলোককে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জিতে গিয়েছে। এখন অনেক কিছুই তোয়াক্কা করার সময় নেই। এটা স্ল্যাজিং টাইম। টাই'টা খুলে পকেটে ঢুকিয়ে আফরিনের কাছে এগুচ্ছি।
Comments