এক ডাক্তার জ্বীনের বাস্তব ঘটনাঃ ৬ষ্ঠ ( শেষ পর্ব )
মিথিলা বলে, অবশ্যই বলা যাবে, যদিও আমি বলতে চাইনি। বলেই উনি হেসে দিলেন।
আসলে আমি চাচ্ছিলাম যে মিথিলা সিরিয়াস মুডে না থেকে একটু ফানি মুডে আসুক। কারণ, আমি হয়তো উলটাপালটা প্রশ্ন করে উনাকে রাগিয়ে দিয়েছি।
মিথিলা আমাকে জিজ্ঞেস করে, শুনে আমি আবার রাগ করবো কিনা! বলি, নাহ! রাগ করবো কেন?
ও বলে, আসলে আমরা যখন সন্ধ্যাঁর দিকে ইন্ডিয়ান স্ন্যাক্স-এ ছিলাম, মানে যখন ফুচকা খাচ্ছিলাম আরকি, তখন আমি নিশ্চিত হয়েছি আপনি মানুষ। আর আপনার হাতের ওপর যে তেলটুকু পরেছিল, সেটা আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে ফেলেছিলাম। ঐ তেলটা আমি সব সময় সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াই। ছোট্ট ঐ শিশিতে করে রেখে দিই। ওইটা আমাকে মাহদীই দিয়েছিল। ওটা কিসের তেল, কিভাবে তৈরী ঠিক আমি জানিনা। তবে জয়তুনের একটা ঘ্রাণ পাই। জ্বীনেরা কখনো জয়তুনের তেল ছাড়া খেতে পারেনা। কিন্তু যখনই এই জয়তুনে লবণ মেশানো হয়, তখন সেটা ওদের জন্য বিষ বা এসিড আকারে কাজ করে। ছোট্ট বাটিতে আমি এই কারণেই এই তেলের সাথে লবণ মিশিয়েছিলাম। পরে নেবার সময় হালকা করে ভান করে অল্পখানি আপনার হাতে ফেলেছিলাম শুধু এটাই দেখার জন্য যে আপনি আসলে মানুষ কিনা!
আমি এই কথা শুনে উনার দিকে বড় চোখে তাকাই। উনি বলেন, দেখেন কিছু মনে করবেন না, আসলে আমার একটা অনুভূতি ছিল যে আপনিই মাহদী। কিন্তু না!
আমি জিজ্ঞেস করি, তো, আমি জ্বীন হলে ঐ তেলে আমার কি হতো?
মিথিলা বলেন, আপনি জ্বীন হলে আপনার শরীরে ফোসকা পরে যেত সাথে সাথে। আপনার হাত পুড়ে যেত। যেখানেই লাগবে সেখানেই ক্ষত সৃষ্টি করবে।
আমার আবার জিজ্ঞেস করি, তার মানে কি এই যে জ্বীনেরা লবণ খেতে পারেনা?
উনি বলেন, হ্যাঁ তাই। জ্বীনেরা লবণ খেতে পারেনা।
আমার তখন হঠাৎ করে মনে পরে যায় যে মাহদী তো একদিন উনাদের বাসায় এসেছিলেন খাবার খেতে। সেখানে কি তবে ওর মা লবণ ছাড়া রান্না করেছিলেন? অবশ্যই না। তখন তো মিথিলা জানতোই না যে ও একটা জ্বীন। কিভাবে কি? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই উনার কাছে!
মিথিলা বলেন, যে লবণ তরকারিতে মিশে যায়, সেটাতে তেমন ক্ষতি হয়না কিন্তু একটা কথা আপনাকে সে সময় বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ও যখন জেনেছিল যে আমাদের বাসাতে দাওয়াত, আমাকে ও বলে দিয়েছিল তরকারিতে বা কিছু যদি রান্না করি আমরা তাতে যেন লবণ কম দেয়া হয়। ও নাকি লবণ একদমই খেতে পারেনা। আমার মা কে বললে মা ওর জন্য একদম আলাদা করে রান্না করেন। লবণের পরিমাণ অতি অল্প দিয়ে। মা খাবার টেবিলে খেতে খেতে জিজ্ঞেসও করেন যে কিভাবে লবণ ছাড়া খাও? ও বলে, ছোটবেলার অভ্যেস তাই।
ততক্ষণে বাসার কাছেই চলে আসি। এসে একসাথে ডিনার করি। বোন দেখি ততক্ষণে ঘুম। আমার বোনের ছুটি শেষ। ও দুই দিন পরে চলে যাবে ডেনমার্কে। তো যাইহোক, ডিনার করতে করতে উনাকে ঐ তেল একটু দিতে বললাম। সালাদের সাথে হালকা একটু মিশিয়ে নিলাম। পুরো জয়তুনের স্বাদ পেলাম। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, মাহদী কেন আপনাকে এটা দিয়েছিল? মিথিলা বলে, খাওয়ার জন্য আর জ্বীনের হাত থেকে রক্ষা পেতে।
পরদিন আমার সকাল থেকে বিকাল অব্দি ডিউটি ছিল। বেলা সাড়ে চারটার দিকে কথামত মিথিলা আমার বারে চলে আসে। আমরা ৫টার দিকে বের হই। সেখান থেকে লিস, নেদারল্যান্ডস এর বিখ্যাত ফুল বাগানে। ঘুরে দেখা শেষ হলে রটার্ডামে যাই আমরা। যাবার পথে জিজ্ঞেস করি, তো অবশেষে আপনাদের প্রেমের কি হলো?
মিথিলা বলা শুরু করলো আবার,
আসলে এরপরের অধ্যায়টাকে আর প্রেম বলবো না! এর মধ্যে আমরা তখন মেডিকেল থার্ড ইয়ারের মাঝামাঝি। আমাদের প্রেমটা ক্ষয়ে যেতে থাকে! প্রথমদিকে বন্ধুত্ব ব্যপারটাকে মেনে নিতে না পারলেও ওর সান্নিধ্যে থাকতে বন্ধুত্বে নিজেকে আশ্রয় দিই। ক্ষয়ে যাওয়া আবেগ কতখানি অমলিন থাকলে পুরোনো ভালোবাসার দিকে ফিরে তাকালে বুকের মধ্যে ঝড় উঠতে পারে আর সেই আবেগকে প্রশ্রয় দেয়া হলে তা একজনকে কতটা বিদীর্ণ করে দিতে পারে – প্রতিদিন ক্লাসে ওকে না দেখলে বুঝতাম না হয়তো ভালোবাসা কাকে বলে! এর মধ্যেও আমাদের দেখা হয়, কথা হয় কিন্তু প্রেম আর হয়ে ওঠেনা, না হয়ে ওঠাটাই শ্রেয় বিধায় সৃষ্টিকর্তার এমন লীলাখেলা। আমি মেনে নিই। আমার নিজের স্বার্থে। নিজের ভালো থাকার জন্যে!
খবর পেলাম এর মধ্যে ওর অসুস্থ ভাই মারা গিয়েছে। আর সুস্থ হতেই পারেনি। শুনে খারাপ লাগে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে যে ওরা মরে গেলে ওদেরকে কি করে। এই খবর পাবার বেশ কিছুদিন পরে একদিন জিজ্ঞেস করি, তোমরা মরে গেলে তোমাদের কি কবর দেয়া হয় আমাদের মত?
ও বলে, নাহ! আমাদের কবর দেয়া হয়না! আমাদের শরীর আলোতে খেয়ে ফেলে। তবে আমাদের মুসলমান জ্বীনের মধ্যে জানাযা করার বিধান রয়েছে! কোরান ও হাদীস আমাদের জন্যও প্রযোজ্য কিন্তু আমাদের মধ্যে ধর্ম-বিরোধী ও কম নেই। নাস্তিকতার ব্যাপক প্রসার। কেন জ্বীনকে সৃষ্টির সেরা জীব করা হয়নি কিংবা জ্বীন ও মানুষকে কেন একই পাল্লায় রাখা হয়নি, সেটা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক বিতর্ক।
(ধর্মীয় ব্যাপারগুলো এড়িয়ে যাচ্ছি বলে দুঃখিত, তবে ধর্মীয় ব্যাপার ও জ্বীনদের ধর্মীয় আচার ও চিন্তা চেতনা নিয়ে আরেকটি গবেষণা নির্ভর গল্প লিখবো – সেই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি)
আমি আবার মিথিলাকে একটু থামাই। জিজ্ঞেস করি, মিথিলা আপনি কি জানেন জ্বীনদের প্রিয় খাদ্য কি? মিথিলা বলে, মাহদী তো বলেছিল মিষ্টি। সাথে বিভিন্ন-প্রকার ফল-মূল। তবে ওদের প্রধান খাদ্য নাকি আলো! আলো ছাড়া ওরা টিকে থাকতে পারেনা। তবে ওরা আগুনের তৈরী হলেও ওদের দুইটা শ্রেণী আগুনকে ভয় পায়। এক শ্রেণী, অগ্নি-উপাসক বলে, আরেক শ্রেণীর শারীরিক গঠন মাহদীর মায়ের মত হলে।
তো তারপর কি হলো? আপনাদের সম্পর্ক কি মরে গেল ধীরে ধীরে?
হ্যাঁ, ধীরে ধীরে মরেই গেল। কেন সম্পর্ক টিকে থাকবে বলেন? মিথ্যেচারিতার কোন স্থান নেই আমার জীবনে!
একটা সময়ে এসে কোনো এক ভাবে আবিষ্কার করি, আমি আসলে মাহদীর এক্সপেরিমেন্টের বিষয়-বস্তু ছিলাম। মানব-মনে আবেগ ও ভালোবাসা কিভাবে কাজ করে সেটার। একজন মানবীর মানসিকতা, তার চাওয়া-পাওয়া ও ভালোবাসাকে নিখুঁত ভাবে দেখার খুব সাধটা আমাকে দিয়ে সে পূরণ করেছে! আর এই কারণেই বলেছিলাম, জ্বীনেরা মানুষের চাইতে বড় মিথ্যেবাদী। আর মাহদী নিজেও স্বীকার করেছিল যে ওরা আমাদের থেকে নিকৃষ্ট। যেদিন এই কথা বলেছিল, ওকে মুখের ওপর জবাবটাই দিয়েছিলাম যে এই কারণেই তোমরা সৃষ্টির সেরা জীব হতে পারোনি। তোমাদের অহংকার আর এই মিথ্যে আবেগ নিয়ে তোমরা কখনো আমাদের চাইতে উৎকৃষ্ট হতে পারবেনা।
আমি মিথিলা কে জিজ্ঞেস করি, আপনি কিভাবে জেনেছিলেন যে আপনি আসলে ওর ভালোবাসা ছিলেন না? পরীক্ষার বিষয়বস্তু ছিলেন?
মিথিলা বলেন, দেখেন সারাজীবন গানে আর গল্পে উড়োচিঠি শব্দটা শুনে এসেছি! কিন্তু জীবনে যেদিন প্রথম উড়োচিঠি পাই, সেদিন আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম! নাহ, আমার কাছে উড়ে উড়ে আসেনি। কিংবা এমনটাও হয়নি যে আমি ঘুমের ঘোরে বা ঘুম থেকে জেগে হঠাৎ করে পেয়েছি। আসলে আমার কাছে আমারই বাসার ঠিকানাতে চিঠিটা আসে। চিঠিটা খুলি, সব পড়ি এবং নিজের ঘরের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি!
আমি খুবই অবাক হই মিথিলার এই কথা শুনে! বলি, বলেন কি মিথিলা? একটু খুলে বলুন।
হ্যাঁ বলছি, আসলে চিঠিতে নাম ঠিকানা কিছু ছিলনা, আমার নাম ছিল মূল চিঠিতে। আর বলা ছিল মাহদীর সম্পর্কে অনেক কথা! মাহদী ঠিকই মেডিকেলে পড়তে আসে। তবে ওর ভাই অসুস্থ, ওকে ডাক্তার হতে হবে – এসব ভেবে নয়। ওদের যে শান্তি-সংঘ রয়েছে সেখান থেকে ওকে পাঠানো হয়। তবে একটা টাস্ক সহ। সেটা হলো, একজন মানবীর ওপরে পরীক্ষা চালানোর জন্য। হ্যাঁ, এটাই প্রথম নয় আর শুধুই মেয়ে নয়। আমাদের মানুষের ওপর তাদের দীর্ঘদিনের গবেষণা। সেটাই আমার ওপরে করা হয় যে একজন মানবীর মানসিকতা, তার আবেগ-ভালোলাগা-ভালোবাসা কিভাবে কাজ করছে! এটা সব এলাকার জন্য। দুনিয়ার সবখানেই এটা করে ওরা। আর এটা ওদের জন্য আসলে একটা পরীক্ষা। পাস করলে ওদের লাভ আছে কোনো হয়তো!
এখানে আমি ধরে বসি মিথিলাকে। বলি, দেখুন মিথিলা যে কিনা এভাবে আপনাকে ধোঁকা দিল, সে যে তার জাতি সম্পর্কে সব সত্য তথ্য দিয়ে গিয়েছে তার কি প্রমাণ? সে তো মিথ্যে তথ্যও দিতে পারে নাকি? আর যে চিঠিটা পেয়েছিলেন, এমনও তো হতে পারে যে সেটা মিথ্যে ছিল? হয়তো মাহদীই আপনাকে দিয়েছিল আপনি যাতে ওকে ভুলে যান, ঘৃণা করেন এই জন্য?
মিথিলার সাথে যখন আমার এসব নিয়ে কথা হচ্ছে, উনি তখন খুব আনমনা আর মন খারাপ করে বসে আছেন। উনি আমাকে বলেন, ফেরদৌস, আপনার প্রশ্নের জবাব আমি জানিনা। আমার জানা নেই। তবে আমি আজো জানার অপেক্ষাতে আছি। জানতে পারলে মরেও হয়তো শান্তি পাবো!
বলি, পরে আর কি মাহদীর সাথে দেখা হয়নি?
নাহ, মাহদীর সাথে আমার আর দেখা হয়নি! মাহদীকে আর কেউ কোনোদিন ক্যাম্পাসে দেখেনি। আমি বা আমরা কেউই জানিনা যে ও কেমন আছে, কি করছে, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে! তবে আমার বিশ্বাস ও আমাকে দূর থেকে দেখে, সামনে আসেনা! হতে পারে আমার ওপর পরীক্ষা শেষ বলে চলে গিয়েছে, মেডিকেলও অনেক আয়ত্বে নিয়ে এসেছিল, যদিও সে এম বি বি এস ডিগ্রী পাস করেনি, সেটার তো আর প্রয়োজন নেই। আবার এটাও হতে পারে যে দূর থেকে দেখে আমাকে কাঁদে, ঐ চিঠি হয়তো মিথ্যে ছিল। আমি আসলেই কিছুই জানিনা আর জানতেও চাইনা।
শেষ আরেকটা প্রশ্ন করি, বিয়ে করেননি কেন এখনো?
মিথিলা জবাব দেন, মাহদী চলে যাবার পর থেকে তিনি প্রায়ই নাকি একটা স্বপ্ন দেখেন, কাল রাতেও দেখেছেন। স্বপ্নে দেখেন, মাহদী তাকে বলছে, আমার জন্য একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি!
মিথিলার অপেক্ষা চলছে। দশ বছর পার হয়েছে, হয়তো আরো দশ বছর পার হবে! কিংবা আরো বেশি! আমৃত্যু তিনি অপেক্ষা করে যাবেন।
(মিথিলাকে এর ঠিক দুইদিন পরে আমষ্টারডামের শিপুল বিমান-বন্দর থেকে বিদায় জানাই। এরপর আর কখনো কোনোদিন আমাদের যোগাযোগ হয়নি, হয়তো হবেওনা। মিথিলা, আপনি যদি আমার এই লেখা পড়ে থাকেন, তবে আমাকে ফেসবুকে একটা নক করবেন। জানিনা আপনি ফেসবুক ব্যবহার করা শুরু করেছেন কিনা। তা না থাকলেও আমাকে একটা মেইল করবেন অন্তত! আমি এবং আমার হাজারো পাঠক-পাঠিকা, আমরা সবাই জানতে চাই আপনি কেমন আছেন, মাহদী সত্যিই আপনার জীবনে ফিরে এসেছে কিনা
Comments