এই জায়গাটা কি খালি যায় ?
কানের ইয়ারফোনটা খুলে পাশে তাকালাম , মাথায় ময়লা এক মাংকিক্যাপ পড়া এক বুড়ো দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে টুপির থেকেও ময়লা এক চাদর, পরনে তালি মারা এক লুঙ্গি আর পায়ে দুনিয়ার কাদামাটি মাখা হলুদ ব্যান্ডের এক স্পঞ্জ স্যান্ডেল। লোকটার আপাদমস্তক দেখে মেজাজ যথেষ্ট খারাপ হলো। ট্রেনে উঠেছি আগের স্টেশানে, পাশের সিটটা ফাঁকা দেখে ভালোই লেগেছিলো। কিছুদুর অন্তত শান্তিতে যাওয়া যাবে। তখন কে জানতো পাশের সিট এই লোকের হবে ?
" জনাব, আমি বহুক্ষন যাবৎ মালপত্র নিয়া দাঁড়ায়া আছি, এই জায়গার যাত্রী না আসা পর্যন্ত আমি কি এইহানে এট্টু বসতে পারি, যদি আপনের অসুবিধা না হয় ? "
লোকটার দাঁত কেমন কালো কালো, উপরের পাটি যথেষ্ট উঁচু, মাঢ়ি বের যাচ্ছে বার বার। দুইহাতে দুনিয়ার ব্যাগ বস্তা, ট্রেনের মেঝেতেও অনেকগুলো বাক্সপ্যাটরা রাখা। ওকি, লোকটার ডানহাতে বিশাল এক খাঁচা, সেইখানে একটা ময়না, হ্যা ময়নাই তো, ময়না পাখি। আমি সত্যিকার অর্থেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না, আমি এই জাতীয় এক লোকের সামনে বসে আছি। এই লোক এতকিছু নিয়ে কখন আসলো এই বগিতে, আশ্চর্য..!!!
বুড়োটা আমার মৌনতাকে সম্মতি মনে করে পাখির খাঁচাটাকে নিজের কোলের ওপর নিয়ে পাশের সিটে বসে পরলো। আমি নাকটা একটু কুঁচকে সরে বসলাম। আশেপাশে ট্রেনের কোন বয়টয়ও চোখে পরছে না, যখন দরকার নেই তখন দুনিয়ার নাশতা চা চকলেট বিষ্কুট নিয়ে হাজির হয়, এখন কারুর নাম গন্ধ নেই। এই লোককে পাশে নিয়ে জার্নি করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তার ওপর পাখির খাঁচা থেকে বিকট গন্ধ আসছে।
আমাকে খাঁচার দিকে তাকাতে দেখে লোকটা তার কালো দাঁত বের করে দিয়ে বললো, " ছোড মাইয়াটার জন্যি খরিদ করসি জনাব, কেমুন আছো আর ভাত খাইসো এই দুইটা কথা কইতে পারে, শিখাইলে আরো শিখবো। দুইদিন আগে কিনছিলাম জনাব, শালিকও একডা ছিলো দোকানটায়, কিনি নাই। শালিক নাকি পোষ কম মানে। শ্যাষম্যাষ দেহা গেল উড়াল দিসে। মাইয়া আবার পশুপক্ষি খুব ভালো পায়, উইড়া চইলা গেলে মাইয়া আমার কাইন্দাই মইরা যাইবো। " লোকটা দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা বাক্সকে সিটের নিচে উবু হয়ে ঢোকাতে ঢোকাতে সেই অবস্থাতেই বললো, " জনাব বলেন দেখি পাখিডা কত নিসে, দেখি আপনের বিবেচনা। "
আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না, এই লোক নির্ঘাত পাগল, হ্যা পাগলই তো। চারপাঁচটা মিষ্টির প্যাকেট নিজের ডানপায়ের উপর রেখেছে, নিচের প্যাকেটটা পুরো রসে ভেজা, রসে তার লুঙ্গিও ভিজে যাচ্ছে, সেই দিকে লোকটার কোন চিন্তাও নেই। পাখির খাঁচাটা ধরে একটা ঝাকুনি দিয়ে তৃপ্তির স্বরে বললো, " পুরা ছয়শো টেকা নিসে জনাব। লাভ হইসে নাকি লস বুঝলাম না। পাখির গলা দিয়া এখন পর্যন্ত খালি কেমুন আছো শুনিসি জনাব, ভাত খাইসো অহনো বলে নাই। আমার মাইয়ার নাম নসিমন, গতকাল থেইকা খালি এইডার সামনে নসিমন নসিমন কইতাসি, পাখি নসিমনও কয় না। জনাব আপনে কি এট্টু চেশটা করবেন ? আপনের কথা যদি শুনে। "
রাগে দুঃখে চোখ ভিজে গেল। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। অসহ্য..!!! এই লোকের সাথে আমি বসবো না, দরকার হলে নিজে অন্যবগিতে দাঁড়িয়ে যাবো। আশেপাশে এখনো ট্রেনের কোন লোক নেই, থাকলে এই লোককে উঠিয়ে দেওয়া যেত, এমনিতেও লোকটার কাছে কোন টিকিট নেই।
" জনাব আপনের ফোন বাজতেসে মনে হয়। " চমকে উঠে লোকটার দিকে তাকালাম, কেমন মাঢ়ি বের করে বেকুবের মত তাকিয়ে আছে, মেজাজ এত খারাপ হচ্ছিলো ফোনের রিংটোন শুনতেই পাইনি। পকেট থেকে ফোনটা বের করতেও রীতিমত বেগ পেতে হল। লোকটার যন্ত্রনায় বলতে গেলে ট্রেনের দেওয়ালের সাথে চেপ্টে গেছি একেবারে। আব্বু ইজ কলিং..উফফ..!!! এই লোক আবার কেন ফোন করে..!!! আধা ঘন্টা আগেই তো ইনার সাথে একবার কথা হলো। আশ্চর্য..!!! দুনিয়ার সব মানুষের কমনসেন্স কি একসাথে নাই হয়ে গেল..!!!
মুখ শক্ত করে কলটা কেটে দিলাম। এখন আর এর সাথে প্যাঁচাল পারতে ভালো লাগছে না। পাশের লোকটা উঁকি মেরে ফোনটা দেখার চেষ্টা করতে করতে বললো, " জনাব আপনের ফোনটা মাশাল্লা বড়ই সুন্দর। এইটারেই ইশ্মাট ফোন বলে, না জনাব ? " আমি কিছু বললাম না, এই লোকের সাথে এইসব আজাইরা আলাপ শুরু করার কোন মানেই হয় না। পাঁচ মিনিট আর পাঁচটা মিনিট দেখবো। যদি এই লোক এইরকমই অসভ্যতা করতে থাকে তাহলে আমি নিজেই উঠে যাবো। থাকুক এইখানে শালিক পাখি নিয়ে বসে..!!!
" জনাব ফোনটা কি আপনের পরিবারের কেউ করেছিলো ? আপনের মাতাপিতা ? তাহলে জনাব আমার একটা রিকুয়েস্ট, ফোনটা ধরেন। আপনি চলন্ত ট্রেইনে একা একা যাত্রা করতেছেন, বেচারারা বড়ই পেরেশান আছেন। " আমি আর পারলাম না, হাত উঠিয়ে কড়া গলায় বললাম, " দ্যাখনে আমার বাপমা, আমি কথা বলবো কিনা আমার বিষয়, আপনি নাক গলাবেন না। " লোকটা বিপরীতে মধুর এক হাসি হেসে বললো, " জনাব কি পিতামাতার ওপরে নারাজ হয়েছেন ? জনাবের বয়স কম, এখনো বুঝেন না। পিতামাতার ওপর নারাজ করা যায় না। পিতামাতা উপরওয়ালার দান জনাব। "
চোখটা আপনাতেই শক্ত হয়ে বুজে এলো। আচ্ছা এই লোকটা কি বুঝছে না আমি ইনার ওপরে নারাজ ? একটা সাধারন বোধশক্তি তো থাকবে ?
" জনাব এই যে এই বাক্সটা দেখতেছেন " লোকটা তার দুইপায়ের ফাঁকে রাখা কাগজের একটা বাক্স দেখিয়ে বললো, " এইডা আমি আমার মেজো সন্তানের জন্য নিতেসি, আকরাম নাম পোলাডার, গাড়ি আছে এইখানে, লাল গাড়ি। গতবারই নিয়ে যাওয়েনের কথা ছিল, টেকায় কুলায় উঠতি পারি নাই, নিতে পারি নাই। গাড়ি আনি নাই শুইনা আকরামের কি রাগ, বাপরে বাপ। একবার যদি দেখতেন..!! এই আপনের মত নাক ফুলাইতেসিলো জনাব। রাগের চোটে আমার স্যান্ডেল জোড়া নিয়া পুস্কুনিতে ফ্যালাইয়া দিলো। এইবার সবার আগে এই গাড়িখানা কিনসি মার্কেটে গিয়া। আগে গাড়ি তারপরে অন্যসব, আগে আকরাম পরে নসিমন, করিমন, আলাউদ্দিন..!!! " লোকটা মিষ্টির প্যাকেট, পাখির খাঁচাসহ উবু হয়ে বক্সটার দড়িটা ধরার চেষ্টা করতে করতে বললো, " দাঁড়ান জনাব আপনেরে গাড়িটা দেখাই, আড়াইশো টেকা নিসে কিন্তু জিনিষ দিসে ভালো, সুইস দিলে লাইট জ্বালায়া গাড়ি চলে। "
আমি মরিয়া হয়ে লোকটার কাঁধে হাত দিয়ে উনাকে ঠেকালাম, " না না ভাই দেখানো লাগবে না। বুঝতে পারছি। " লোকটা একগাল হেসে বললো, " জনাব উপরে রাখসি ওই যে ওই ব্যাগটা দেখতেসেন, ওতে আমার বড় পোলা আর মাইয়ার জন্য একটা শাট আর একটা লাল পাড়ের শাড়ি নিসি। আমার এই পোলাডা বড়ই শরম করে, একখান মোটে ফুলহাতা শার্ট, গরুতে ঢু মাইরা ফুঁটা কইরা দিসে তাও আমারে কয় না। শাটটাও ভালো হইসে জনাব, সাদার ওপর নীল চেন চেন ডিজাইন। দেখবেন জনাব ? নামাবো ? "
আমি জোর করে খানিকটা হাসির মত করলাম, সামনের স্টেশান আসতে আর দেরি নেই বেশি। পাশের লোকটা মনে হয় ওখান থেকেই উঠবেন। তাই যেন হয় আল্লাহ্..!!! মাঝখানের এইটুকু সময় কোনমতে পার করলেই হলো। এই যন্ত্রনা তার পরিবারের লোকজন সহ্য করে কিভাবে ? পকেট থেকে ইয়ারফোনটা বের করে আবার কানে দিলাম, গান টান শোনার ইচ্ছে সব মাথায় উঠেছে, অন্তত এই লোকটা যদি একটু চুপ থাকে।
" জনাব কি কথা কইবেন কারো সাথে নাকি গান শোনবেন ? জনাব এই একটা জিনিষ আগে এট্টু দ্যাখেন, এই যে এইটা দেখেন, একেবারে খাঁটি খদ্দেরের গায়ে দেয়া চাদর। আমার মায়ের জন্য নিতেসি। কাজটা দেখেন জনাব, দেইখা মনে হয় পত্তেকটা কাজ হাতে করা। আর কাপড়টা দেখেন, এই চাদর গায়ে দিলে শীত ক্যান শীতের বাপেও কিছু করতে পারবো না। কি কন জনাব..!!! " কান থেকে খুলে ফেলা ইয়ারফোনটা হাতে নিয়ে হতাশ হয়ে লোকটার দিকে তাকালাম। আশ্চর্য, লোকটা আমাকে জানেন না চিনেনও না অথচ নিজের মা না খালার জন্য কেনা চাদর কেমন খুলে খুলে দেখাচ্ছেন..!!! একটা মানুষ এত বেকুব হয় কিভাবে..!!!
লোকটা হাসিমুখে চাদরটা ভাঁজ করতে করতে বললো, " পেত্তেক বছর শীতের সুমা আমি একক্ষান কইরা চাদর কিনি জনাব। মা আমার বড়ই শৌখিন মাইয়ামানুষ। নতুন শাল পাইলে যে কি খুশি হইতো..!!! যতদিন বাপজান বাইচা ছিল, বাপে দিসে। অখোন বাপে নাই, আমি হইলাম বড় পোলা বাপমায়ের, দেওয়া তো আমারই উচিৎ, কি বলেন জনাব। "
জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম, বাইরে কি অন্ধকার। বোঝা যায় না কিছু। পরের স্টেশান আসতে কতক্ষন কে জানে। একেকটা সেকেন্ড একেক ঘন্টা মনে হচ্ছে নিজের কাছে। চাদর ভাঁজ করে মেঝেতে রাখা হ্যান্ডব্যাগে রেখে লোকটা কোলে আবার পাখির খাঁচা আর মিষ্টির প্যাকেট উঠিয়ে নিলো। পাখিটা এতক্ষন শুধু ডানা ঝাপটাচ্ছিলো, এখন কেমন ক্যাঁও ক্যাঁও করে বিদঘুটে আওয়াজ করা শুরু করছে। নরক যন্ত্রনা মনে হয় একেই বলে..!!! উঠে যাওয়ার ইচ্ছা যে কত কষ্টে দমন করতেছি সে আমিই জানি। এত সব বোঁচকাবুচকির পাহাড় ডিঙানোও সম্ভব না..!!! উফফ..!!!
লোকটা ট্রেনের সাথে মিল রেখে কেমন দুলতে দুলতে বললো, " জনাব চাদরটার দামই সবচেয়ে বেশি, হাজার দুইশো টেকা নিসে। টেকা দেওনের সুমা মনটা কেমুন কেমুন করতেসিলো, আপনেরে মিথ্যা বলবো না, কিন্তু পরে ভাবলাম বুড়া মা আমার, যদি খুশি হয়..!!! বারশো টেকায় দুইমাসের ঘরভাড়া হয়ে যায় জনাব আমার, তাও মায়ের দাম সবচাইতে বেশি দুনিয়ায়..!!! মইরা গেছে বইলা তো আর ভালোবাসা ছাড়ান দিতি পারি না। "
কপাল চেপে ধরে জানালার বাইরের দিকে চেয়ে ছিলাম, ভালো করে শুনছিলামও না লোকটা কি বলছে, হঠাৎ " মরে গেছে" শুনে চমকে তাকালাম। " কে মরে গেছে ? " লোকটা আমার থেকেও অবাক হয়ে বললো, " আমার মায়..!!! পেরায় অষ্ট বছর আগে মুখে রক্ত উইঠা মইরা গেল না আমার মায় ? " আমি অবাক হয়েই বললাম, " মা মরে গেছে তো এই চাদর নিয়ে কি করবেন? কাকে দিবেন ? " লোকটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে দুঃখী গলায় বললো, " জনাব চাদর তো আমি পেত্তেক বছরই কিনি, মায়ের গোরের উপর রাখি বাড়িত যাইয়াই। বেহেশত থাইকা মায় কি দেহে না এইডা..!!! মায়েরে খুশি করা নিয়া কথা, তা সে মায় বাইচা থাকুক বা মইরা যাক..!!! "
কি সহজ সরল লোকটা ! পকেট থেকে একটা পান বের করে মুখে দিতে গিয়েও দিল না, আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাসিমুখে তাকালো। আমি মাথা নেড়ে না করে দিলাম। লোকটা বিরক্তিকর হতে পারে কিন্তু মানুষ খারাপ না। কেমন যেন মায়া হচ্ছে, একটু হেসে বললাম, " কয় ছেলেমেয়ে আপনার? " লোকটা আঙুলে মাখা চুল জিহ্বায় লাগিয়ে বললো, " জনাব আমার তিন মাইয়া তিন পোলা মাশাল্লাহ..!!! এই দেখেন জনাব এই যে এই প্যাকেটটা, এইখানে আছে একটা ইমিটিশনের গলার হার আর কানের দুল, মেজোটার লাইজ্ঞা..!!! মাইয়া আমার এক লম্বরের ভেউসী। কেলাস এইটে ওঠসে এইবার, পড়াশোনায় মন নাই, সারাদিন আছে সাজার তালে..!!! আর এইখানে আছে দশখান রঙপেন্সিল। খাতার দুকান ঘুরে ঘুরে কিনসি, ছোট পোলার জন্যি। বায়না ধরসিলো গেলোবার। মনে আছে। " লোকটা এবার লাজুক লাজুক মুখে একটা ছোট ব্যাগের দিকে ইশারা করে বললো, " জনাব ওইটায় এক ডজন কাঁচের চুড়ি আর কলাপাতা রঙের শাড়ি, আমার পরিবারের জন্যি। মুখ ফুইটা কখনো কয় না কিন্তু তার কাঁচের চুড়ির বড়ই শখ। "
ট্রেনের ভিতর এনাউন্স হচ্ছে, রবোট রবোট গলায় এক মেয়ে কি সব যেন বলছে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। সামনের স্টেশান আসলো বোধহয়। আমি লোকটার দিকে ভালো করে তাকালাম, চোখের নিচে গাঢ় কালি, কেমন শুকিয়ে যাওয়া চেহারা, কিন্তু সেই চেহারায় কি সুন্দর খুশির ঝলক। লোকটাকে এখন কেন জানি আর খারাপ লাগছে না দেখতে। গলার স্বর নরম করে বললাম, " কি করেন আপনি শহরে ? "
- জনাব ছোটখাটো একটা চাকুরির মত করি, বলার মত কিছু না জনাব। অফিসের কাছেই একখান রুম ভাড়া করি থাকি, ওই রুমেই যা রান্নাবান্না, খাওয়া দাওয়া। মাস গেলে হাজার পাঁচেক টাকা বেতন পাই। বাড়িত পাঠাই, নিজে খাই, কিছু জমাই। চলে যায় জনাব আল্লাহর দয়ায়।
- বাড়ি যাচ্ছেন কতদিন পর ? - জনাব শেষবার গেছিলাম মাস ছয়েকের মত হবে। গেল কুরবানিতে গেসিলাম বাড়িতে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, " ছয় মাস পর ছুটি পেলেন অফিস থেকে ? " লোকটা লজ্জা পেয়ে বললো, " জনাব ছোটখাটো চাকুরী, ছুটি হয়ইইই না বললেই চলে। এতদিন পরে পাইসি ছুটি আলহামদুলিল্লাহ্। এক সপ্তাহের ছুটি। "
বেশ খারাপ লাগলো আমার, এতদিন পরে যাচ্ছে বেচারা ছেলেমেয়েদের কাছে, খুশি তো হবেই। নরম স্বরে বললাম, " বেতন তো সব এই সব কিনতেই শেষ করে ফেললেন মনে হচ্ছে। " লোকটা আমার কথায় আরো লজ্জা পেল, স্বলজ্জ হাসি হেসে বললো, " জনাব আমি গরিব মানুষ, এই কথাটাই দোকানে গেলে ইয়াদ থাকে না। যতক্ষন পকেটে টাকা থাকে কিনতেই থাকি। মন চায় পুরা দোকান সুদ্ধা উঠায় নেই, কি করব জনাব, আল্লাহ্ সেই ক্ষমতা দ্যান নাই। তবুও যা পারি, এই মাসটা একটু কষ্টে যাবে, তাও জনাব মানায় নিতে পারবো ইইলনশাআল্লাহ্..!!! এইবার পুতির মালা কিনবার পারি নাই, ছোটমাইয়াটা বায়না ধরসিলো ঈদের সময়। ট্রেনে ওঠার পর মনে পরসে। জনাব এর পরের বার নিয়ে নিবো ইনশাআল্লাহ্, ভুল হবে না। "
চোখে ছাই কেন জানি পানি চলে আসলো। আশ্চর্য চোখে পানি কেন আসবে। সামান্য একটা লোক, যার জন্য কিছুক্ষন আগে রাগে গা জ্বলতেসিলো তার জন্য এতটা খারাপ লাগার প্রশ্নই আসে না। ট্রেনটার বেগ কমে গেছে, স্টেশান চলে এসেছে সামনে, আস্তে আস্তে থেমে যাচ্ছে ট্রেনটা। লোকটা গায়ের চাদরটা ভালোমত গায়ে পেঁচিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে খানিক হাসলো। আমিও একটু হেসে বললাম," সবার জন্য কিনলেন, নিজের জন্য কিছু কিনলেন না ? "
ট্রেনের এই বগিটায় মানুষ ওঠা শুরু হয়েছে, এই সিটটা থেকে সামনের দরজা দেখা যায় খানিকটা। এই তো একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে এক মহিলা উঠলেন মাত্র। আমার পাশের সিটের যাত্রি কি এই স্টেশান থেকেই উঠবেন ? এখন কেন জানি মনে হচ্ছে না উঠলেই ভালো হয় উনার..!!! লোকটা আমার কথা শুনে কেমন ছেলেভুলানো হাসি দিলেন আমার দিকে চেয়ে, যেন আমি ভারি বাচ্চাছেলে, উনাকে বোকা একটা প্রশ্ন করে ফেলেছি। উনি ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, " জনাব এ সব যা কিনসি সবই তো আমার নিজের , মানুষগুলো কি আমার নিজের না ? "
চুপ করে গেলাম, কেমন যেন ভারি ভারি লাগছে বুকের ভেতরটা। অবাক কথা লোকটাও চুপ করে গেছে..!!! কি জানি নিজের মানুষগুলোর ছয়মাস আগেকার চেহারা মনে পরছে বোধহয়..!!! হাতে ল্যাপটপের ব্যাগ ধরা স্যুট পরা এক লোক এসে দাঁড়ালো সিটটার কাছে, শক্ত গলায় বললো, " এক্সকিউজ মি, ৪৩ নাম্বার সিটটা আমার। " আমার পাশের লোকটা পাখির খাঁচা আর মিষ্টির প্যাকেটগুলো নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, " জনাব এইটাই আপনার সিট, আমি একটু বসছিলাম এইখানে। "
স্যুট পরা লোকটা বিরক্তিকর গলায় বললো, " টিকিট নেই তো বসছিলেন কেন? দুনিয়ার জিনিষপত্র নিয়ে উঠছেন ট্রেনে। রস লাগায়া সিটটাকে তো পুরো ভিজায় ফেলেছেন আপনি। "
লোকটা লজ্জা পেয়ে বোকার মত হাসতে লাগলো, আমি মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরে তাকালাম, এতক্ষন লোকটার আনন্দের হাসি দেখছিলাম এখন আর তার অপমান দেখতে ইচ্ছা করছে না।
স্যুট পরা লোকটা সিটে আয়েশ করে বসলো, আমার চোখে চোখ পরাতে ভদ্রতার হাসি হেসে বললো, " এই সব থার্ডক্লাশ লোকেদের ট্রেনে উঠতেই দেওয়া উচিৎ না। " আমি কিছু বললাম না, কি বলবো ? লোকটাকে প্রথম দেখেও তো আমার এই কথাটাই মনে হয়েছিলো। এখন অদ্ভুত খারাপ লাগছে কেন জানি। ইচ্ছে করছে লোকটা সাথে তার বাচ্চাগুলোর হাসিমুখ দেখে আসতে। এত এত জিনিষ পেয়ে কি খুশিটাই না হবে তারা..!!!
পকেটের ফোনটা আবার বাজছে। আব্বু ইজ কলিং..!!! ফোনটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, ফোনটা নিয়ে একটু দরজার দিকে যাই, আজকে আব্বুর সাথে একটু বেশি সময় নিয়ে কথা বলবো..!!!
Comments