উপায় নাই।
বৃহস্পতিবার রাত। বাণিজ্য মেলার আখেরি দিনেও অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরার খুশিতে পাড়ার ফুচকার দোকানে ঢু মারতে এসেছি। মামা ফুচকা বানাচ্ছে, সাথের দোকানের পিচ্ছি ছেলেটা পরিষ্কারের কাজ করছে। আমাকে প্লেট হাতে ধরিয়ে পিচ্ছি ছেলেটাকে দোকান দেখতে বলে মামা চোখের আড়াল হতেই ছেলেটা টুক করে একটা ফুচকা মুখে পুড়ে দিল। বোঝাই যাচ্ছে তার অসম্ভব খিদে পেয়েছে। আমি কথা শুরু করলাম-
- নাম কি? - সোহেল - ফুচকাওয়ালা কি হয় তোমার? - মামা - আপন মামা? - না, এমনি মামা - কতক্ষন কাজ কর এখানে? - বিকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। তার আগে মামার বাসায় কাজ করি। - সারাদিনে কত পাও? - দিনে ২০ টাকা। - কত! - ২০! আমার খাওয়া শেষ। এই প্রথম ৩৫ টাকা বিল দিতে গিয়ে আমার হাত কাপলো। একটা ৮ বছরের বাচ্চা সকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খেটে পায় ২০ টাকা। যার ডবল এমাউন্ট এক প্লেট ফুচকার দাম।
রাত ১০টা বাজে। মন খারাপ করে হেটে ফিরছিলাম। গলির ভেতর টেইলরের দোকানে আরেক ৮-৯ বছরের পিচ্ছি দিপু সুতা কাটার কাজ করে। ফিরতে ফিরতে দেখছি সামনে সেলাই মেশিন নিয়ে পিচ্ছি ঘুমে ঢুলছে। দোকান বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত খাওয়াও হবেনা। সামনে পহেলা ফাল্গুন, ভ্যালেন্টাইন্স ডে। প্রেসার অনেক।
আপনি জানেন, সকাল থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত খাটা দিপুর মজুরি কত? না, সে কোন মজুরি পায় না। তাকে ঘুমানোর জায়গা আর খাওয়া দেয়া হয় এটুকুই।
রোড সাইড হোটেলেও একই অবস্থা। এখানে বয়রা পেট চুক্তিতে কাজ করে। একটু অভিজ্ঞরা নাম মাত্র মজুরি পায়।
আপনি জানেন, একজন লিফটম্যানের বেতন কত? গ্যারেজে কাজ করা ১৪ বছরের কিশোর কত পায়? লেগুনার পেছনে ঝুকি নিয়ে সারাদিন ঝুলতে থাকা শিশুটি কত পায়? মাঝারি চাইনিজ রেস্তরাতে গলায় বো টাই পড়া ১৭-১৮ বছরের ওয়েটারের বেতন? পাড়ার পার্লারের মেয়েদের বেতন?
এদের আপনি ইউনিফর্ম ছাড়া কখনো রাস্তায় দেখা হলে খেয়াল করে দেখেন..নিজেদের দৈন্যদশা নিয়ে প্রচন্ড বিব্রত অবস্থায় থাকে..অথচ পোশাকের চাকচিক্যে আর ট্রেইন্ড ব্যবহারবিধীর কারনে নিজেদের নামাতে পর্যন্ত পারে না..
অফিস আদালতে G4S এর স্মার্ট যেসব সিকিউরিটি দেখতে পান, আপনি জানেন তাদের মূল বেতন ৪০০০-৬০০০? ওভার টাইম ঘন্টা প্রতি ১৬ টাকা? Are you kidding me?এদের পরিবার চলে কি করে? এই বেতনে একজন মানুষই বা বাচে কি করে?
প্রায়দিন ই ভোরবেলা যখন আমি অফিস আসি, দেখি সারারাত ডিউটি করা ঘুম ঘুম চোখের সিকিউরিটি গার্ড রাতের বাসি ভাত শুধু ঝোল দিয়ে মেখে খেতে। আগ্রহ নিয়ে তাকাই দেখে আমাকে দেখলেই লজ্জ্বায় তারা খাবার লুকানোর জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। আর আমার অসহায় লাগে এদের সাহায্য করতে না পারার কারনে।
ভিক্ষুক কে ভিক্ষা দেয়া সহজ কিন্তু আত্নমররযাদা বেশী থাকায় চাইলেই এই শ্রেণীকে আপনি অর্থ সাহায্য করতে পারবেন না। আমরা ভাবি ভিক্ষুক বা রিকশাওয়ালা সবচেয়ে অসহায়। কিন্তু সত্যি হল, কিছু এক্সেপশনাল বাদে এখন কার দিনে এদের ইনকাম আমার আপনার অনেকের চেয়ে বেশী। তাই যদি সাহায্য করতেই হয় কৌশলী হয়ে এদের উপকার করুন..ঈদে এই বাচ্চাগুলি কে কাপড় উপহার দিন, কোরবানীর ঈদে সিকিউরিটি গার্ডের জন্য মাংস আলাদা করে রাখুন, এক আপুকে দেখতাম প্রায়ই দেশে নিজের জমিতে ফলেছে বলে চাল, ফল, সবজি পাঠাতো পিয়ন, গার্ডকে..এটাও করতে পারেন..চাইলে অনেকভাবেই করা যায় আসলে..
আমার এত কথা বলার উদ্দেশ্য এটাই যদি সাহায্য করতেই হয় অভিনব উপায় তাদের সাহায্য করুন, যাদের প্রয়োজন আছে, কিন্তু মুখ ফুটে প্রকাশের উপায় নাই।
Comments