আজানের সময় কুকুর ডাকে কেন?
আমাদের দেশে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম হবে যারা কখনোই আজানের সময় কুকুরকে অস্বাভাবিকভাবে ডাকতে শোনে নি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ সমূহের মানুষদের মধ্যে এমন অভিজ্ঞতা অনেক স্বাভাবিক। আজানের সময় কুকুর অস্বাভাবিকভাবে ডাকে কেন সেই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে আসে। নাস্তিক হওয়ার পরও আজানের সময় কুকুরের অস্বাভাবিক সুরে ডাকা আমাকে অবাক করতো, বিষয়টি অনেক ভাবিয়েছেও আমাকে। আমার দুই/একজন নাস্তিক/অজ্ঞেয়বাদী বন্ধুও আমাকে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, যদিও আমি তখন যথাযথ উত্তর দিতে পারি নি। কৌতুহলীরা এই কৌতুহলী বিষয়ের প্রকৃত সত্যের খোঁজে থাকেন, তবে বেশিরভাগ মানুষই লোকমুখে শোনা অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যা গ্রহণ করেন এবং ভ্রান্ত বিশ্বাসের নিচে কৌতুহলী মনকে চাপা দেন।
মুসলিমদের মধ্যে এবিষয়ে একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। আজানের সময় কুকুরের এই অস্বাভাবিকভাবে ডাকাকে মুসলিমরা এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, আজানের সময় শয়তান বা খারাপ জ্বীনেরা এদিকসেদিক ছুটতে থাকে আজানের শব্দ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জন্য, কুকুর আজানের সময় শয়তানকে এদিকসেদিক ছুটতে দেখেই ওরকম আওয়াজ করে। একজন কৌতুহলী মুসলিম যদি এই কৌতুহলী বিষয়ে তার কৌতুহল দূর করার জন্য এলাকার কোনো ইমামকে জিজ্ঞেস করেন তাহলে তিনি এই ভ্রান্ত ধারণাটিই উত্তর হিসেবে পাবেন। মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত এই ধারণাটি লোকমুখে প্রচলিত এমন কোনো ধারণা নয় যার সাথে ইসলামের কোনো যোগসূত্র নেই। এই ভ্রান্ত ধারণাটি ইসলাম থেকেই এসেছে। নিচের হাদিস দুটো পড়লেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে:
গ্রন্থঃ সহীহ মুসলিম (হাঃ একাডেমী) অধ্যায়ঃ ৪। সালাত (নামায) (كتاب الصلاة) হাদিস নম্বরঃ ৭৪৫ ৮. আযানের ফাযীলাত এবং আযান শুনে শয়তানের পলায়ন ৭৪৫-(১৯/…) কুতাইবাহ ইবনু সাঈদ (রহঃ) ….. আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ যখন সলাতের আযান দেয়া হয়, শয়তান পিছন ঘুরে বায়ু ছাড়তে ছাড়তে পালিয়ে যায় যেন আযানের শব্দ সে শুনতে না পায়। আযান শেষ হলে সে পুনরায় ফিরে আসে। আবার যখন ইকামাত দেয়া হয় তখন সে পলায়ন করে। ইকামাত শেষ হলে সে পুনরায় ফিরে আসে এবং সালাত আদায়কারীদের মনে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করতে থাকে। সে তাকে বলে, এটা স্মরণ কর, এটা স্মরণ কর। সে কথাগুলো সলাতের আগে তার স্মরণও ছিল না। শেষ পর্যন্ত সালাত আদায়কারী দ্বিধায় পড়ে যে, সে বলতেও পারে না যে, কত রাকাআত পড়ল। (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৭৪৩, ইসলামিক সেন্টারঃ ৭৫৬) হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
গ্রন্থঃ মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) অধ্যায়ঃ পর্ব ২১ঃ খাদ্য (كتاب الأطعمة) হাদিস নম্বরঃ ৪৩০২ ৫. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ – থালা-বাসন ইত্যাদি ঢেকে রাখা প্রসঙ্গে ৪৩০২-[৯] জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যখন তোমরা রাতে কুকুরের চিৎকার এবং গাধার ডাক শুনতে পাবে, তখন আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত শয়তান হতে আশ্রয় চাইবে। কেননা তারা এমন এমন কিছু দেখতে পায়, যা তোমরা দেখতে পাও না। আর রাতে যখন মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে যায় তখন তোমরাও বাইরে যাওয়া কমিয়ে দাও। কেননা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্ট কিছু জীবকে রাত্রিকালে ছেড়ে দেন। তোমরা ঘরের দরজা বন্ধ রাখো, আর আল্লাহর নাম স্মরণ করো। কারণ শয়তান এমন দরজা খুলতে পারে না যা আল্লাহর নাম নিয়ে বন্ধ করা হয়। আর তোমরা ঘটি, মটকা (খাদ্য-পাত্রসমূহ) ঢেকে রাখো, শূন্য পাত্র উপুড় করে রাখ এবং মশকের মুখ বেঁধে রাখো। (শারহুস্ সুন্নাহ্)[1][1] সহীহ : শারহুস্ সুন্নাহ্ ৩০৬০, আল মুসতাদরাক ‘আলাস্ সহীহায়ান ৭৮২৭, আল মু‘জামুল কাবীর লিত্ব ত্ববারানী ৭১৬০, আল আদাবুল মুফরাদ ১২৩৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫৫১৭, মুসনাদে আহমাদ ১৪২৮৩। হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
উল্লেখিত দ্বিতীয় হাদিসটির ব্যাখ্যা:
গ্রন্থঃ মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) অধ্যায়ঃ পর্ব ২১ঃ খাদ্য (كتاب الأطعمة) হাদিস নম্বরঃ ৪৩০২ ৫. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ – থালা-বাসন ইত্যাদি ঢেকে রাখা প্রসঙ্গে ব্যাখ্যাঃ (مِنَ اللَّيْلِ) দ্বারা উদ্দেশ্য রাতের কোন এক অংশে। আর হাকিম-এর বর্ণনায় إِذَا سَمِعْتُمْ نُبَاحَ الْكِلَابِ যখন তোমরা কুকুরের আওয়াজ শুনবে। (فَإِنَّهُنَّ يَرَيْنَ مَا لَا تَرَوْنَ) তারা যা দেখে তোমরা তা দেখতে পাও তা হলো তারা শয়তানকে দেখতে পায়। আর আবূ হুরায়রা -এর বর্ণনায় এসেছে যা বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত- وَإِذَا سَمِعَ صِيَاحَ الدِّيَكَةِ، فَلْيَسْأَلِ اللهَ مِنْ فَضْلِه ; فَإِنَّهَا رَأَتْ مَلَكًا যখন কোন মুরগীর আওয়াজ শুনবে সে যেন আল্লাহর কাছে অনুগ্রহ চায়, কেননা সে মালাক (ফেরেশতা)-কে দেখেছে। কাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ কারণ হলো মালায়িকার (ফেরেশতাগণের) ‘আমীন’ দু‘আতে তাদের ক্ষমা প্রার্থনা কামনা তাদের শাহাদাত বিনয়-নম্রপূর্ণ এবং একনিষ্ঠতা। আর তাতে সৎলোকেদের উপস্থিতির সময় দু‘আ কামনা করা ভালো। অনুরূপ দু‘আ করা ভালো যালিম ও ফাসিককে দর্শনের সময়। মদ্য কথা হলো, নেককার ও ফাসিকদেরকে দেখা ওয়া‘দা ও শাস্তির নিদর্শন শুনার পর্যায়। এমনটি হলে প্রথমে চাইবে দ্বিতীয়তে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। যেমন অন্য সহীহ হাদীসে এসেছে, إِذَا سَمِعْتُمْ أَصْوَاتَ الدِّيَكَةِ فَاسْأَلُوا اللهَ مِنْ فَضْلِه؟ فَإِنَّهَا رَأَتْ مَلَكًا، وَإِذَا سَمِعْتُمْ نَهِيقَ الْحَمِيرِ فَتَعَوَّذُوا بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ؟ فَإِنَّهَا رَأَتْ شَيْطَانًا. যখন তোমরা মোরগের আওয়াজ শুনবে আল্লাহর নিকট অনুগ্রহ কামনা করবে, কারণ সে মালাক (ফেরেশতা)-কে দেখ আর যখন গাধার আওয়াজ শুনবে আল্লাহর কাছে শয়তান হতে আশ্রয় চাইবে, কেননা সে শয়তানকে দেখেছে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
এই ভ্রান্ত ধারণার ওপর নির্ভর করে মুসলিমদের মধ্যে অনেকেই দাবি করে থাকেন যে, আজানের সময় কুকুরের অস্বাভাবিক সুরে ডাকা বা আওয়াজ করা ইসলামের সত্যতার প্রমাণ।
তাহলে বাস্তবতা কি? বাস্তবতা হচ্ছে, কুকুরের ওরকম আর্তনাদ করার সাথে বিশেষভাবে ইসলামের আজানের কোনো যোগসূত্র নেই। একটি কুকুর ওরকম আর্তনাদ ঠিক তখনই করে যখন সে কোনো আওয়াজ শুনে বিরক্ত বোধ করে। তার কারণ কুকুরের শ্রবণশক্তি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সেনসেটিভ। যা আমাদের কানে আসলে আমাদের ভালো লাগে তা হয়তো খুব তাড়াতাড়িই তাদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং তারা তার জবাবে আর্তনাদ করে। অতএব, আজানের সময় কুকুরের আর্তনাদ করা নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে যা প্রচলিত আছে তা ভিত্তিহীন ভ্রান্ত বিশ্বাস ছাড়া কিছু না।
আমি নিচে কিছু ভিডিও তুলে ধরছি যেসকল ভিডিও প্রমাণ করে যে কুকুর কেবল আজানের সময়ই ঐভাবে আর্তনাদ করে না, বরং টেলিফোন বাঁজার শব্দ, এমবুলেন্স সাইরেন, সুশ্রাব্য বাদ্যযন্ত্রের শব্দ, এলার্ম ঘড়ির শব্দ ইত্যাদিতেও কুকুর একইভাবে আর্তনাদ করে:
Ambulance Sirens
Musical Instruments
খুবই ভালো লাগলো পোস্টটি পড়ে
ধন্যবাদ দাদা এগুলো তুলে ধরার জন্য
খুবই চমৎকার লিখেছেন
খুব ভালো হয়েছে আপনার পোস্টটি
খুবই অসাধারণ লিখেছেন…