অরিত্রির আত্মহত্যা, "কপিক্যাট ইফেক্ট" এবং আমাদের ২৬ টি ভুল ধারণা
কপিক্যাট ইফেক্ট ব্যাপারটা কী, মাত্র কদিন আগে আরো অনেকের মতো আমি নিজেও জানতাম না। সপ্তাহ ব্যবধানে ঢাবির ৪ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার পর সুইসাইড নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে আবিষ্কার করি এই ভয়াবহ সত্য। কী ভয়ংকর, বিভৎস একটা ভাইরাস আমাদের ঘিরে রেখেছে আমরা কেউই জানি না। আর জানি না বলেই অরিত্রির আত্মহত্যা হতে যাচ্ছে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কপিক্যাট ইফেক্টের উদাহরণ।

কপিক্যাট ইফেক্ট কী সেটা যথাসময়ে বর্ণনা করা হবে। তার আগে আত্মহত্যার স্বরূপ জানার চেষ্টা করি। লেখাটার উপলক্ষ্য অরিত্রি, লক্ষ্য নয়। অরিত্রিকে তাই কেবলই একটা ফ্যাক্ট হিসেবে ধরে আলোচনা সামনে যাবে।
অরিত্রির আত্মহত্যা ব্যাপারে আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন "কতটা কষ্ট পেলে, কতটা অপমানিত হলে একটা মানুষ আত্মহত্যা করে!"
এই কথার মধ্যেই আত্মহত্যা ব্যাপারে আমাদের ভুল ভাবনার অর্ধেক লুকিয়ে রয়েছে। মানুষ কেন আত্মহত্যা করে এ ব্যাপারে ধারণা স্পষ্ট নয় বলেই শিক্ষামন্ত্রী এরকম একটা মন্তব্য করে ফেলেছেন।
আপনার নিজের কাছেও মনে হতে পারে তিনি তো ঠিকই বলেছেন, ভুল কোথায়? ভুল বাক্যে না, ভুল একটা শব্দে। মানুষ "কষ্ট" পেয়ে আত্মহত্যা করে না, করে "ডিপ্রেশনে" পড়ে কিংবা "ধৈর্য" হারিয়ে।
ব্যাপারটা আরেকটু ব্যাখা করি।
কষ্ট দুই রকম, শারীরিক ও মানসিক। শারীরিক কষ্ট প্রায় সবার ক্ষেত্রে একই প্রভাব ফেলে। ধরুন ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় একই বয়সের একই রকম সামর্থের ১০ জন মানুষকে খোলা মাঠে নিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। কিছু সময় পার হওয়ার পর দেখবেন এদের কেউ একজন কষ্ট পেতে শুরু করেছে, কেউ আর্তনাদ করছে, কেউ অজ্ঞান হয়ে গেছে। সবার প্রতিক্রিয়া কিন্তু কখনোই সমান হবে না। সহজ হিসেবে কেউ একজন প্রথমে পড়ে যাবে, শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকবে অন্য কেউ।
কেন এই পার্থক্য?
শারীরিক কষ্ট কিন্তু দশজনেরই সমান হচ্ছে। রোদের তাপ সবার উপরেই সমানভাবে পড়ছে। পার্থক্যটা হয়েছে মানসিক কষ্টে। মানসিক কষ্ট বলে আলাদা কোনো টার্ম নেই। এটা ডিপ্রেশন এবং ধৈর্যচ্যুতির মিলিত ফল। সাধারণ নিয়মেই বলা যায় আমাদের প্রত্যেকের মেন্টাল টলারেন্স স্কেল আলাদা আলাদা। আমরা কেউ কারো স্কেলে বাস করি না।
শিক্ষামন্ত্রীর বলাটা ভুল না, কিন্তু এটা বলতে গিয়ে তিনি একটা ভুল থিওরীকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। তিনি অরিত্রি নামের মেয়েটির মেন্টাল টলারেন্সের যে দুর্বল স্কেল সেটাকে স্বীকৃতি দিয়ে দিলেন। তিনি একটা দুর্বল মানসম্পন্ন স্কেলকে সার্বজননীন স্কেল বানিয়ে দিয়েছেন।
যারা ভাবছেন আমি অরিত্রিকে দোষী বানাতে বসেছি তার ভুল করছেন। বড় কোনো ক্রিমিনাল ছাড়া পৃথিবীর কোনো আত্মহত্যাকারীকেই আমি দোষী বলি না। কেন বলি না সেটাও আলোচনায় আসবে। একটা ১৪-১৫ বছরের বাচ্চা মেয়ে যে ইতোমধ্যে জীবিত নেই তাকে ব্লেইম করে লিখতে বসার প্রশ্নই আসে না।
শিক্ষামন্ত্রী এমনকি আমাদেরকে হাইকোর্ট যেখানে অরিত্রির দুর্বল মেন্টাল টলারেন্স স্কেলকে সিম্পেথীর চোখে দেখছেন সেখানে বিপরীত ঘটনাও ঘটে। ধরুন এই মেয়েটিই যদি প্রেমের কারণে আত্মহত্যা করত তখন কি ট্রলের বন্যা বয়ে যেত না? তার মৃত্যু খবরে কি হাজার হাজার "হাহা" রিএক্ট পড়ত না? কমেন্ট বক্সে নোংরামীর জাহাজ ডুবে যেত না?
সবই হতো। তখন আমরা যেটা করতাম, এই মেয়েটির দুর্বল মেন্টাল টলারেন্স স্কেলকে উন্নত কারো স্কেল দিয়ে কম্পেয়ার করে ধুয়ে দিতাম। অমুক এই ক্যান্সার জয় করেও দিব্যি বেঁচে আছে, তমুক এত কষ্ট করল জীবনে, তার হাত-পা নেই তাও বেঁচে আছে.. আর তুই কিনা প্রেমের জন্য আত্মহত্যা করলি?
তখন মানুষ ঠিকই ভুলে যেত প্রতিটা মানুষের স্কেল আলাদা। এটা আমাদের শরীরের ইম্যুনিটির চেয়ে ভিন্ন কিছুই না। কেউ কেউ ঠান্ডা খাবার খেলেই অসুস্থ হয়ে যায়, সামান্য সর্দিতে কাহিল হয়ে পড়ে। আবার অনেকেই আছে যারা ফাংগাস ওঠে যাওয়া খাবার খেয়েও দিব্যি সুস্থ থাকে। ইম্যুনিটি স্কেল যে আলাদা এটা আমরা জানি, স্বীকৃতি দিই, ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবেই দেখি। কিন্তু যখন মেন্টাল টলারেন্স স্কেলের হিসেব আসে তখন আমরা ভীষণ জাজমেন্টাল হয়ে যাই। প্রতিটা মানুষ যে আলাদা আলাদা সত্ত্বা নিয়ে বাস করে মানতে কষ্ট হয়।
মেন্টাল টলারেন্স স্কেল প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আলাদা। আলাদা সাইকোলজিক্যাল প্রোফাইলও। সুইসাইডের মতো ঘটনা তখনই ঘটে যখন মানুষ তার সহ্যের নির্দিষ্ট রেঞ্জটা অতিক্রম করে ফেলে। এই নির্দিষ্ট রেঞ্জ যে সবার আলাদা আলাদা এই সাধারণ বোধটা আমরা কেন জানি সব সময়ই ভুলে যাই। প্রতিটা সুইসাইডই ডিপ্রেশনের কারণে হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন সুপারফিশিয়াল স্থর পেরিয়ে এতটাই ডীপে চলে যায় যে সেটাকে আমরা সাধারণ হিসেবের বাইরে নিয়ে যেতে পারি। ডীপ স্থরের কিছু সুইসাইড এরকম..
১। মিলিটারি সুইসাইড। শত্রু পক্ষ ধরে নিয়ে প্রচন্ড টর্চার করে তথ্য উদ্ধারের পর হত্যা করবে এই ভয়ে আত্মহত্যা।
২। অলআউট কজ ফর এ সুইসাইড। যেমন একটা মেয়েকে গ্যাং রেপ করা হয়েছে। সে বিচার চাইতে গেছে মাতব্বরের কাছে। মাতব্বর তার বাড়িতে রেখে নিজেই আরেকবার রেপ করেছে। তার বাবা মা অপমানে তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। কোথাও কোনো পথ নেই.. আত্মহত্যা।
৩। কঠিন কোনো অসুখ যার ফলাফল নিশ্চিত মৃত্যু। (কোনো কোনো ক্ষেত্রে)
এসব সমস্যা নিরাময় অযোগ্য। এগুলোকে সুইসাইড না বলে দুর্ঘটনা বা সরাসরি হত্যা বলা যেত পারে। আমরা মনোযোগ দেব সুপারফিশিয়াল লেয়ার ডিপ্রেশন সুইসাইড নিয়ে।
একটা বড় প্রশ্ন উঠতে পারে। মেন্টাল টলারেন্স স্কেলের উন্নতি অবনতি হয় নাকি এটা জন্ম থেকে ফিক্সড?
অবশ্যই এটা ফিক্সট কোনো ভ্যালু না। জন্মগতভাবেই মানুষ একটা ভ্যালু পায় ঠিকই (সেটা কম বেশি হতে পারে) কিন্তু যাপিত জীবন সেটাকে উপর নিচ করে প্রতিনিয়ত। আপনি খালি চোখে দেখছেন একটা ছেলে বা মেয়ে প্রেমের কারণে আত্মহত্যা করেছে; প্রকৃত ঘটনা কিন্তু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়।
মানুষের ধৈর্য এবং সহ্যের একটা দেয়াল থাকে। খোলা মাঠে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাচীর প্রতিনিয়তই ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই ধরুন আপনি আপনি তিন ঘন্টার জন্য ঢাকার জ্যামে পড়েছেন। আপনার ধৈর্যের দেয়ালে নিজের অজান্তেই কয়েকটা হাতুড়ির বাড়ি পড়ে গেল। সামান্য পলেস্তার যে খসে গেল আপনি জানলেনই না। ধরুন আপনি বিসিএস প্রিলিতে টিকলেন না, প্রেশার আসল পরিবার থেকে। দেয়াল থেকে খসে গেল কয়েকটা ইট। রিয়াল- বার্সা নিয়ে তুমুল ঝগড়া করলেন বন্ধুর সাথে, সামান্য হলেও আঘাত লাগল তাতে। এক সময় প্রেমে ব্যর্থ হলেন, খসে গেল হয়তো মোটে পাঁচটা ইট। কিন্তু কেউ জানত না আগে থেকে ভাঙতে ভাঙতে এটাই দেয়ালের সর্বশেষ ইট ছিল। দেয়াল ভেঙে গেল, আত্মহত্যা করল কেউ একজন। খবর আসল "প্রেমের কারণে অমুকের আত্মহত্যা।"
একটা ব্যাপার এখানে পরিষ্কার করি। আত্মহত্যা গৌরবের কোনো বিষয় না, এটাকে সরাসরি ঘেন্না করারও সুযোগ নেই। এটা এক ধরণের মানসিক ইম্যুনিটি, যার যতটা আছে সে ততটাই ফলাফল পাবে।
আপনি বলতে পারেন ঢাকার জ্যামে আমিও থাকি, আমার নিজেরও চাকরি নেই, আমি নিজেও প্রতিদিন সবার সাথে ঝগড়া করি কিন্তু কোনোদিনও আত্মহত্যার কথা মনে হয়নি। আমি কখনো হতাশ হইনি।
আপনাকে অভিনন্দন। আপনার ক্ষেত্রে দুইটা ব্যাপার ঘটছে। হয়তো জন্মগতভাবে কিংবা পরিবেশগত কারণে আপনার যে মেন্টাল স্কেল সেটাকে আঘাত করলে সে লোহার মতোই আরো শক্ত হচ্ছে। তবে আপনারও ব্রেকিং পয়েন্ট আছে। ব্রেকিং পয়েন্টে আঘাত পড়লে আপনি সুইসাইড না করলেও ভেঙে পড়বেন নিশ্চিত। অন্য হিসেবে আপনার দুর্বল জায়গা বরাবর এখনো আঘাত পড়ছে না। দুর্বল জায়গা সবার ক্ষেত্রে সমান হয় না। কোনো কোনো রাইটার আছেন যাদের জীবন সবদিক থেকে রঙিন হওয়া সত্ত্বেও নিছক রাইটিং ব্লকের কারণে তারা আত্মহত্যা করে বসেছেন। হ্যাঁ, এটাই তাদের দুর্বল জায়গা।
সুইসাইডের মূল কারণ ডিপ্রেশন। ডিপ্রেশনের কারণ এবং প্রকারভেদ অসংখ্য।
ডিপ্রেশনই বোধহয় এদেশে একমাত্র মহামারি যেটা রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দূরে থাক, রীতিমতো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়। অথচ এদেশের অর্ধেক মানুষই নানা কারণে ডিপ্রেশনে পড়ে আছে। বাজে শোনালেও এক্ষেত্রে একটা উদারণকে খুব পারফেক্ট মনে হচ্ছে। আমরা প্রত্যেকেই যৌনাঙ্গ নিয়ে ঘোরাফেরা করি, অন্যেরটার ব্যাপারেও সচেতন। কিন্তু সবাই সেটাকে ঢেকে রাখার ব্যাপারে একমত। ঢেকে রাখা নিয়ে কোনো ছাড় নেই।
মেন্টাল স্কেল যেমন আলাদা, ডিপ্রেশনের গভীরতাও এক নয়।
- বাংলাদেশ ভারতের সাথে এক রানে হেরে গেছে- ডিপ্রেশন! - নতুন টিউশনি চলে গেছে- ডিপ্রেশন! - সুন্দরী মেয়েটা ইনবক্সের রিপ্লাই দিচ্ছে না- ডিপ্রেশন! - পরীক্ষায় দুইটা প্রশ্ন লেখা যায় নি- ডিপ্রেশন! - খুব চমৎকার একটা ছবি বা লেখা ফেসবুকে দেয়ার পরও সেটাকে খুব কম লাইক পড়েছে- ডিপ্রেশন!
এই ডিপ্রেশনকে মাইনর ডিপ্রেশন বলে। এসব সমস্যা সবার জীবনেই আসে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমতে শুরু করে। ঝামেলাটা হচ্ছে কেউ কেউ এই ব্যাপারগুলোকে ইগনোর করতেই পারে না। সময়ের সাথে সাথে ঘটনা ভুলে যায় হয়তোবা কিন্তু রেশ থেকে যায় ঠিকই। এর সাথে যখন চলে আসে বিগত জীবনের বিশেষ কোনো ঘটনা তখনই এই সামান্য জিনিষগুলো টেনে নিয়ে যায় মেজর ডিপ্রেশনের দিকে।
উদাহরণ দিই।
ধরুন একটা মেয়ে খুব ছোটবেলায় কোনো বয়স্ক মানুষের দ্বারা সেক্সুয়ালি এবিউজড হয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে হয়তোবা তার মধ্য ভেতর থেকে এই বিভৎসতা চলে গেছে। হুট করে কোনো বয়স্ক মানুষ তার ইনবক্সে নোংরা কোনো ছবি পাঠিয়ে দিল। এই মেয়ে এক লাফে চলে যাবে অতীতে। ডিপ্রেশন ঘিরে ধরবে তাকে। এই সামান্য ঘটনাটাই তার জন্য হয়ে যাবে ডিপ্রেশন মেজর।
সুইসাইডের ক্ষেত্রে আমরা যেটাকে বলি কারণ সেটা আসলে সরাসরি কারণ না। প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় ফেল, শিক্ষকের বকাবকি, পাখি ড্রেস না পাওয়া এসব একটা জীবনকে কেড়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এসব কারণ কেবলমাত্র সুইসাইডকে "ট্রিগার" করে। বিশেষ কারণে ডিপ্রেশনের ডিপ লেয়ারে পৌঁছে যাওয়া মানুষ ছাড়া প্রতিটা আত্মহত্যাকারী আগে থেকেই সময় নিয়ে নিজের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে সুইসাইড করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছে। উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত ট্রিগারে চাপ পড়ে গেলেই এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে যায়।
ডিপ্রেশন মেজরে পৌঁছে যাওয়া প্রতিটা মানুষই আত্মহত্যার জন্য একরকম প্রস্তুত হয়ে থাকে। সমস্যাটা হচ্ছে এটা জ্বর বা কাশির মতো কোনো স্থুল লক্ষণ সমৃদ্ধ অসুখ না। ডিপ্রেশন মেজর অবস্থা যে দীর্ঘদিনের জন্য হয় তাও না। মাসে কিংবা বছরে মাত্র দুই ঘন্টা থেকে দুই দিনের জন্য কারে কারো ডিপ্রেশন মেজর হয়। অনেকটা বমি লাগার মতো এই অবস্থাটা কেটে গেলে এসব রোগী ভীষণ অনুতাপ বোধ করে। "ছি! এসব কী ভেবেছি" বলে লজ্জা পায়। অন্যের সুইসাইড করা পোস্টে নিজেও হাহা দিয়ে আসে। এজ এ ম্যাটার অব ফ্যাক্ট, মাত্র দুই মিনিটই আত্মহত্যার জন্য যথেষ্ট। কেউ কেউ মাত্র একবার ডিপ্রেশন মেজরে পড়ে, কিন্তু ঐ একবারের জন্য আর ফিরতে পারে না।
বাংলাদেশে কতজন ডিপ্রেশন মেজর রোগী আছে? মানসিক স্বাস্থ্যের সঠিক কোনো হিসাবই এদেশে নেই। ২০১০ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগ যে জরিপ করেছে তাতে বলা হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা ন্যূনতম ৬৫ লাখ। মানে ৬৫ লাখ মানুষ আছে সুইসাইডের ঝুঁকিতে। (এই লেখার সকল প্রকার তথ্য লিংক ও স্ক্রিনশট কমেন্ট বক্সে পাওয়া যাবে)।
ঝুঁকির ব্যাপারটা যে মিথ্যা না সেটা চলে আসে পরের হিসেবে। এই রোগীদের মধ্য থেকে লাখে ১২৮ জন রোগীই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে বসে। আত্মহত্যার চেষ্টা করে আরো একশগুণ বেশি মানুষ।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এদেশে খুনের চেয়ে ৬ গুণ বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। পুলিশের হিসেবে গত বছর সারা দেশে খুন হয়েছেন ৩৫০০ মানুষ, আত্মহত্যার সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেই ২০১০ সালেই এদেশে ২০ হাজার আত্মহত্যার হিসেব দিয়েছিল। এ বছরের মার্চে বাংলা ট্রিবিউন আত্মহত্যা নিয়ে যে ফিচার ছেপেছে তাতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে আত্মহত্যার প্রকৃত সংখ্যা রেকর্ড করা সংখ্যার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এ ব্যাপারে পুলিশ বা বিশেষজ্ঞ কারো কোনো দ্বিমত নেই।
বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনি কি আগে জানতেন এদেশে বছরে ২০ হাজার মানুষ সুইসাইড করে? জানতেন ৬৫ লাখ মানুষ আছে সুইসাইডের ঝুঁকিতে?
আমি নিশ্চিত জানতেন না। আমাদের জানার অভাব বলেই সুইসাইড আমাদের কাছে হয় আবেগী নয়তো হাস্যকর ইস্যু। খুব সহজেই ৬৫ লাখ অসুস্থ মানুষ থেকে বছরে ২০ হাজার করে ঝরে পড়া মানুষকে আমরা হিসেব থেকে বাদ দিয়ে দিই। কখনো বুঝিও না এই ৬৫ লাখে আমি বা আমার পরিবারের যে কেউ থাকতে পারে।
বাংলাদেশের সুইসাইড ইস্যুতে আবারো ফিরে আসব। এখন অরিত্রি নিয়ে বলি। যদিও অরিত্রি আর বাংলাদেশের সুইসাইড আলাদা কিছু না।
এই যে মেয়েটা মারা গেল, আমরা হয়ে গেলাম দুই পক্ষ। কেউ বলছি স্কুল দায়ী, কেউ বলছি পরিবার। কিন্তু সত্য হচ্ছে দায়ী বললে সবাই ই দায়ী, নির্দোষ হলেও সবাই নির্দোষ। প্রকৃত সমস্যাটা অন্য জায়গায়। অরিত্রির এখানে নিছকই বাটখারা।
অরিত্রি ঠিক কেন আত্মহত্যা করেছে বলতে পারবেন?
আমরা সহজ চিন্তায় বলছি তার বাবা- মায়ের অপমানের কষ্টে। এখানে আমরা সম্ভবত আরেকটা ভুল করছি।
আত্মহত্যা দুইটা কারণে হয়। অতীত ঘটনার কষ্টে কিংবা ভবিষ্যত প্রতিক্রিয়ার ভয়ে। একটা ধর্ষিত মেয়ে কিন্তু ধর্ষণের কষ্টে আত্মহত্যা করে না। সমাজে কীভাবে মুখ দেখাব- এই ভয় তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। একটা চাকরি চলে যাওয়া যুবক চাকরি চলে যাওয়ার কারণে আত্মহত্যা করে না, করে পরবর্তীতে তার অর্থনৈতিক দুরাবস্থা এবং সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবার ভয়ে। আমার ধারণা অরিত্রির আত্মহত্যাটার কারণটাও অতীত না, ভবিষ্যত।
কত বয়স মেয়েটার? ১৪-১৫। সে এই বয়সে তার বাবা- মায়ের অপমানবোধের কতটা বুঝতে পারবে? আর যদি সেই অপমান বুঝতেও পারে সেটা তার কর্মের কারণে যে অপমান হচ্ছে সে জন্য না, হবে তার কর্মের ফলাফলে যা হবে তার জন্য।
ঢাকার বড় বড় স্কুল বা কলেজ ফ্রিক কিছু অভিভাবককে আমি জানি। এদের কাছে বড় স্কুল এবং ভালো রেজাল্টের বাইরে অন্য কোনো কিছু সত্য না। ভিকারুন্নিসার মতো স্কুলে চান্স পাওয়ার জন্য একটা মেয়ে এবং তার অভিভাববকদের কতটা চেষ্টা চালাতে হয় সেটা অনুমান করা কঠিন না। এরকম একটা স্কুল থেকে একটা মেয়েকে যখন বের করে দেয়া হবে তখন তার একটা বছর সময়, নিজের "ভিকি" ইউনিফর্ম বিসর্জন তার গার্ডিয়ানের জন্য কী ভীষণ কঠিন অপমানের হবে সেটা হয়তো মেয়েটা বুঝতে পেরেছিল। একটা ভালো স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করাতে পারা বিশ্বজয়ী গার্ডিয়ান এবং ভর্তি করাতে ব্যর্থ হওয়া যুদ্ধবন্দী গার্ডিয়ান.. দু পক্ষকে দেখার সুযোগ হয়েছে বলে জানি এটা একটা বাচ্চা মেয়ের জন্য সহজ কোনো বিষয় না। যারা ভাবছেন মেয়েটা তার স্কুলে বাবা মায়ের অপমানে সুইসাইড করেছে তারা ভুল পথে আছেন। একটু যুক্তি এবং বিবেক খাটান, বুঝবেন এই বয়সের বাচ্চারা বাবা মায়ের প্রতি ততটা দরদী না। এটা মোটেও তাদের দোষ না। কারণ বাস্তবতার কারণেই তাদের দরদী হওয়ার সুযোগই নেই। আর যে টিনএজারট সত্যিই বাবা মায়ের প্রতি দরদ অনুভব করবে, সে কষ্টে-অপমানে ছাঁই হয়ে যাবে হয়তো; তবে সুইসাইড করতে গিয়ে ঠিকই থমকে দাঁড়াবে।
আমি বলছি না ভিকারুন্নিসার প্রিন্সিপাল, পরিচালক নির্দোষ। তাদের এপ্রোচ খুবই বাজে হয়েছে। টিসি যদি দিতেই হয় তবে ডেকে নিয়ে ঝাড়াঝাড়ি করার কোনো অধিকার তারা রাখেন না। ঝাড়াঝাড়ি করলে টিসি দিতে পারেন না। তারা দুটোই করতে চেয়েছেন। তবে এজন্য থ্রি ইডিয়টস থেকে ইন্সপায়ার হয়ে তাদেরকে যেভাবে খুনি সাজিয়ে রীতিমতো জেল পর্যন্ত পাঠিয়ে দেয়া হলো সেটা বাড়াবাড়ি না; বাড়াবাড়ি রকমের বাড়াবাড়ি।
অরিত্রির বাবা যখন মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন তখন নিয়ম ব্যাপারে তিনি জানতেন না? নিশ্চয়ই জানতেন। তিনি জেনে শুনেই ভর্তি করিয়েছেন। বাংলাদেশে প্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানশূন্য দেশ। এখানে সবকটা পড়ালেখা প্রতিষ্ঠান। আমাদের গার্ডিয়ানরাও ভিকির মতো এসব পড়ালেখা প্রতিষ্ঠানকে অসম্ভব পছন্দ করেন বলেই ফি বছরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এসব পড়ালেখা প্রতিষ্ঠান এমন কঠোর নিয়ম বানিয়ে গার্ডিয়ানদের চাওয়াটাকেই শুধু ফুলফিল করছে। বছর শেষে শতভাগ এ প্লাস দেখাটাই যে দেশের শতভাগ মানুষের একমাত্র লক্ষ্য, তারা যদি এত কঠোর না হয় হবে কে?
ব্যক্তিগত কোনো কিছু এই লেখায় লিখব না ভেবেছিলাম। তারপরও খুবই প্রাসঙ্গিক হওয়ার কারণে ছোট্ট একটা ঘটনা শেয়ার করি।
২০০৭-২০১০ পর্যন্ত সিলেটের মধ্যে স্কলার্সহোম একটা ক্রেজের নাম ছিল। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট সাথে টাই... সিলেটের বিত্তবানরা নিজেদের আভিজাত্য দেখানোর একটা সুযোগ পেত ছেলে মেয়েদের স্কলার্সহোমে ভর্তি করিয়ে। আমি ফুল স্কলারশীপ নিয়ে যোগ দিলাম এই ক্রেজে। প্রথম দিনেই কলেজের প্রিন্সিপাল ব্রিগেডিয়ার জুবায়ের সিদ্দিকী স্বাগত বক্তব্যে বললেন, "আমাদের কলেজে একবিন্দু নিয়মের ব্যত্যয় নেই। সকাল আটটার মধ্যে গেট বন্ধ হবে। এক মিনিট পরে আসলে নাকে খত দিয়েও ভেতরে ঢুকা যাবে না।" তারপর এই নিয়ম সেই নিয়ম বলে যখন বক্তব্য শেষ করলেন তখন আমি আর আমার মেজ ভাই পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। মেজ ভাই হাতের রেখার মতো আমাকে চেনেন। প্রোগ্রাম শেষ হলে বাইরে নিয়ে বললেন, কী মনে হয়? থাকবি এই কলেজে?
আমি সরাসরি বললাম, না। সম্ভব না। দুই বছরে আমি মরে যাব।
এরপর আমরা দুই ভাই মিলে যা করলাম সেটা প্রায় অবিশ্বাস্য। এক দিনের ব্যবধানেই কলেজের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলাম। নিজেদের লাগেজ, ব্যাগ, বেড, বিছানা প্যাক করে ফিরে আসলাম প্যাভিলিয়নে। ভর্তি হলাম গ্রামের কলেজের শেষ ছাত্র হিসেবে। পেছনে পড়ে রইল স্কলার্সহোম ক্রেজ, দুই বছরের ফুল স্কলারশীপ।
আমি এবং আমার ভাই একই সাথে বুঝতে পেরেছিলাম যে কলেজ প্রথম দিন স্বপ্ন না দেখিয়ে ভয় দেখায়, নীতি না শিখিয়ে নিয়ম শেখায় সেটা আমাদের না। আমি টিকতে পারব না।
এখন ধরুন এক বছর পর যদি আমি সেখানে সুইসাইড করতাম দায়টা কার উপর আসত? কলেজের উপর তো অবশ্যই। কিন্তু আমার গার্জিয়ানের উপর কি একটুও আসত না? কেউ বিষ খাওয়ালে অবশ্যই ব্লেইম করা যায়। কিন্তু "জেনে শুনে বিষ করেছি পান" অবস্থায় ব্লেইম করাটা খুব একটা শোভনীয় না।
আমাদের এখন উচিত ছিল এই সুইসাইডের কারণ অনুসন্ধানের। আমরা পারতাম একটা পুঁজি করে একটা বৃহৎ গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করতে।
ভাবুন তো, বিশ হাজার প্রাণ খসে যাচ্ছে প্রতি বছর; কী করতে পারছি আমরা? বেশিরভাগ সময় ঠাট্টা, জাহান্নামি বলে অভিশাপ দেয়া এবং বিশেষ কেসে সহানুভূতির বাইরে আমরা কিছু করি না।
আমরা সুইসাইড সমস্যাকে কতটা অবহেলা করি একটা পরিসংখ্যানেই সেটা পরিষ্কার হয়। এদেশে প্রতি বছর এইডসে মারা যায় সর্বোচ্চ এক হাজার মানুষ। এইডস নিয়ে হাজারটা সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হচ্ছে। টিভি-বিলবোর্ড জুড়ে বিজ্ঞাপনের বাহার। সেই তুলনায় ২০ গুণ বড় সমস্যাকে আমরা কোনো রকম গুরুত্বই দিচ্ছি না। সুইসাইড বন্ধে কোনো বৃহৎ পদক্ষেপ চোখে পড়েছে কখনো?
আমার পড়েনি।
খবর নিন, দেখবেন অরিত্রি মেয়েটা থেকেই সমস্যার কারণ ও সমাধান পেয়ে যাচ্ছেন। সে নিশ্চিতভাবেই কোনো কারণে ডিপ্রেশন মেজর রোগে ভুগছিল। হয়তো সে অতীত জীবনে এবিউজড হয়েছে, পারিবারিকভাবে চাপের মধ্যে ছিল নয়তো ভুগছিল Borderline Personality Disorder এ।
এই বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের রোগীরা আমাদের খুব কাছাকাছি থাকে। কদিন পরপরই কিছু মেয়ের হাত কাটার ভিডিও বা ছবি ভাইরাল হয়। কেন কাটে এরা?
কারণ বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। খবর নিলে দেখবেন এদের বেশিরভাগেরই পারিবারিক সমস্যা আছে। বাবা মায়ের একজন বা উভয়ের মধ্যে বড় কোনো সমস্যা আছে, আছে এবিউজিং এর স্মৃতি। এরা হাত কাটে, হুটহাট আচরণ বদলিয়ে ফেলে, গতকালকের আত্মার বন্ধুকে পরের দিন শত্রুর মতো ট্রিট করে বিনা কারণে। বিশ্বাস করুন, এরা আমাদের কাছাকাছি বাস করা অসুস্থ মানুষ। আপনি যেমন জ্বরে ভুগেন, এরা ভুগছে।
আলোচনার শুরুতে বলেছিলাম মেন্টাল টেম্পারমেন্ট স্কেলের কথা।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং সময়ের সাথে সাথে বাড়বেই.. এটা যেমন তিক্ত সত্য, আমাদের মেন্টাল টেম্পারটমেন্ট স্কেলের নরমাল ভ্যালু কমবে এটাও সত্য। আমাদের রাইটারদের অনেকেই একটা কমন ভুল করেন। নিজেদের সাথে বর্তমান প্রজন্মকে মিশিয়ে দেন, দুইটা ভিন্ন স্কেলকে এক করার চেষ্টা করেন।
যেমন আমাদের সময় স্কুলের শিক্ষকরা ব্যাপক মারধর করতেন। আমরা জানতাম এই ঘটনা স্বাভাবিক, আমাদের গার্ডিয়ানরা সন্তানকে শিক্ষকের হাতে তুলে দিয়ে বলতেন "হাড় আমার, চামড়া-মাংস আপনার।" আমাদের টেম্পারটেমন্ট স্কেলে সেই মারধর গিয়ে আঘাত করত না। আমাদের সময় মোবাইল ফোন ছিল না, আমরা সবাই ছিলাম সাধারণ। এখন সবার হাতে হাতে ফোন, সবাই নিজেকে সেরা বলা-সেরা ভাবার এক অদম্য যুদ্ধে লিপ্ত।
এই সময়ের একটা ছেলে মেয়ের কাছে থেকে যদি আপনি নাইনটিজের আচরণ আশা করেন সেটা আপনার বোঝার ভুল। যে সময়ে আপনাকে আপনার ক্লাসেরও সবাই হয়তো চিনত না, এখন একটা আইডিতে চিনতে পারছে হাজার হাজার। আপনি সারা জীবনে যতটা তর্ক করেননি, একদিনেই ততটা তর্কযুদ্ধ হচ্ছে ভার্চুয়ালে। কেবল একটা ফেসবুক যতটা অসহিষ্ণু এবং হতাশ করছে প্রজন্মকে নাইনটিজের সকল কারণ মিলে তার ১০% ও ছিল না।
হতাশ কেন হবে না প্রজন্ম?
নাইনটিজের কজনের উপর খড়গ ছিল ফার্স্ট হওয়ার? ডাক্তার হওয়ার অমানসিক চাপ নিয়েছে কজন? ভর্তি যুদ্ধের ভয়াবহতা ছিল তখন? এই যে সামনে একটা বিসিএস আসছে, ক্যাডার হবে মাত্র দুই হাজার।
বাকিরা?
হতাশ, হতাশ, হতাশ!
যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে ডিপ্রেশন মেজরে আছে ২০-২৬% পুরুষ এবং ৮-১২% মহিলা। আমাদের মতো বেকারত্ব ও হতাশার দেশে এর পরিমাণটা তাহলে ঠিক কত হতে পারে ভাবুন এবার।
সত্যি বলতে আমরা ভয়াবহ এক সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। গত এক বছরে যতটা সুইসাইডের খবর শুনেছি, গত পাঁচ বছরে ততটা শুনিনি। ঢাবিতে এক সপ্তাহে মারা গেল চার জন। মেডিকেলে বছরের প্রথম ৬ মাসে মারা গেছে ৮ জন। গত পাঁচ বছরেও এতজন মারা যায়নি।
আমরা প্রতিক্রিয়া শেষ করি "আহারে! উহারে!" বলে। গালি দিই শিক্ষা ব্যবস্থাকে। আমরা কেন ভাবি না একই শিক্ষা ব্যবস্থায় আরো হাজারটা ছাত্র পড়ালেখা করছে, তাহলে কেন সবাই সুইসাইড করছে না? এই ইনডিভিজ্যুয়াল মেন্টাল টেম্পারমেন্ট স্কেল নিয়ে কেন কেউ ভাবে না? কেউ কেন খুঁজে বের করার চেষ্টা করে না ৬৫ লাখ ডিপ্রেশন মেজরের রোগীগুলো কোথায়?
আমরা থ্রি ইডিয়টস দেখে ইন্সপায়ার্ড হয়ে সমানে গালি দিই শিক্ষা ব্যবস্থাকে। বারবার দেখি এই মুভি। জীবন যে সিনেমা না, এদেশ যে ভারত না, সবাই যে রাঞ্চুর মতো অসম্ভব মেধাবী না, সবাই যে রাজুর মতো হুইল চেয়ারে বসে চাকরি পাবে না.... এসব সত্য কী এড়ানো সম্ভব?
আমাদের মোটিভেশনাল স্পিকাররা পর্যন্ত সমস্যাটাকে উস্কে দিচ্ছেন। সবকিছু ভুলিয়ে বলছেন "তোমাকে সেরা হতেই হবে। সিক্স ডিজিটের বেতন লাগবেই।" আরে ভাই এটা বাংলাদেশ। মানুষ ১৮ কোটি, ৬০-৭০% তরুণ বেকার। ইউরোপে মোটিভেশন দিলে প্রতিটা যুবককে সেরা বানানো সম্ভব। আমাদের দেশে সেটা কীভাবে সম্ভব? বরং সেরা হওয়ার, বিরাট কিছু করার বুদ্ধি অযোগ্য কারো মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে দিন শেষে তাকে বানানো হচ্ছে ডিপ্রেশন মেজরের আরেকটা সাবজেক্ট।
অরিত্রি আত্মহত্যা আমাদেরকে কিছুই দিচ্ছে না। তিনজন শিক্ষককের পরিবারে বিপর্যয়, একটা বাচ্চার বাবা মায়ের শূন্য বুক এবং মিডিয়া কাটতি... এর বাইরে প্রাপ্তি বলতে কী আছে?
আছে। ভয়াবহ এক প্রাপ্তি আছে। মনে পড়ে শুরুতেই বলেছিলাম "কপিক্যাট ইফেক্ট"? হ্যাঁ, অরিত্রি আমাদের জন্য রেখে যাচ্ছে কপিক্যাট ইফেক্টের অভিশাপ।
খুব সচেতনভাবেই সুইসাইডের কারণ হিসেবে কপিক্যাট ইফেক্টকে এড়িয়ে গেছি আলাদা করে আলোচনা করার জন্য। আমার ধারণা কেবল বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বে বর্তমান সময়ের প্রতিটা সুইসাইডের পেছনেই এই কপিক্যাটের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ অবদান আছে।
অরিত্রি মেয়েটা কীভাবে জানল তাকে সুইসাইড করতে হবে? এটা নিছক প্রবৃত্তি নাকি তাকে কেউ শিখিয়ে দিয়েছে? আত্মহত্যার আইডিয়াটা আসল কীভাবে তার মাথায়? ১৪ বছরের মেয়ে কী করে নিল এত এক্সিম ডিসিশন?
কারণ কপিক্যাট ইফেক্ট।
১৯১৬ সালে নরেন কুলম্যান প্রথম এই থিওরী প্রদান করেন। একজনের প্রভাবে অন্য কারো অপরাধ করার প্রবণতাকেই কপিক্যাট ইফেক্ট বলে। বর্তমান সময়ে কপিক্যাট অপরাধ না বরং সুইসাইড সমস্যার ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হচ্ছে বহুলভাবে।
কপিক্যাট ইফেক্ট যে নিছক কোনো থিওরী নয় সেটার প্রমাণ পাওয়া গেছে নানান সময়ে। ১৭৭৪ সালে "The sorrows of yong men Werther" নামের আত্মহত্যার কাহিনী নির্ভর উপন্যাস প্রকাশ পাওয়ার পরপরই ইতালি এবং কোপেনহেগেনে আত্মহত্যার বন্যা বয়ে যায়। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে বইটি ব্যান করা হয় শুধুমাত্র আত্মহত্যা ঠেকানোর জন্য।
কপিক্যাটের আরেকটা বড় উদাহরণ ছিলেন অভিনেত্রী মার্লিন মর্লিং। ১৯৬২ সালে আত্মহত্যা করা এই অভিনেত্রীর মৃত্যুর পরপরই আমেরিকায় স্বাভাবিক হারের চেয়ে ৩০৩ টি বাড়তি আত্মহত্যা ঘটেছিল। দেশের সামগ্রিক আত্মহত্যার রেট বেড়ে যায় ১২%।
দক্ষিণ কোরিয়ান অভিনেতা চই জেইন সিল মারা যাওয়ার পর কোরিয়া জুড়ে আত্মহত্যা বেড়েছিল ১৬৩%।
"Final Exit" নামের একটা বই প্রকাশের পর আত্মহত্যা বেড়ে গিয়েছিল ৩১৩%। তখন আত্মহত্যা করা ২৭% মানুষের পাশে পাওয়া গিয়েছিল এই বইটি।
টিনএজারদের আত্মহত্যার কাহিনী নির্ভর টিভি সিরিয়াল "13 reasons why" যখন রিলিজ পায় তখন গুগল দেখতে পায় নতুন ম্যাজিক। ২৬% How to suicide, ১৮% How to commit suicide এবং ৯% How to kill myself লেখা সার্চ বেড়ে গেছে গুগল জুড়ে।
আপনি যখন একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ, আপনার কাছে কারো আত্মহত্যা তেমন কোনো বড় ব্যাপার না। কিন্তু যে সব মানুষজন ডিপ্রেশন মেজরে বসে আছে নিজেদের অজান্তে, তাদের কাছে এসব বই, টিভি সিরিয়াল, সিনেমা কিংবা কোনো সেলিব্রেটির মৃত্যু মানেই সুইসাইড করার বিরাট বড় ইন্সপায়ারেশন। ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে যে ৪২ টি গবেষণা হয় সেখানে দেখা গেছে যে কোনো বড় সেলিব্রেটির সুইসাইড যে কোনো আত্মহত্যাকারীর সুইসাইড করার প্রবণতাকে ১৫ গুণ বাড়িয়ে দেয়। কোনো অবাস্তব গল্পের সুইসাইডে যদি খুব বেশি রোমান্টিসিজম থাকে তবে সেটাও সুইসাইড বাড়াতে পারে ৪ গুণ।
আপনাদেরকে কি মনে হচ্ছে না আমরা ভয়াবহভাবে এই কপিক্যাট ইফেক্টে আক্রান্ত?
হুট করে কেন বাড়ছে এত সুইসাইড? ২০১৬ তে আমরা র্যাংকি এ ছিলাম ১৩০ এ, এক বছরে নেমে এসেছি ১১৪ তে। আমি নিশ্চিত আগামী বছর যে র্যাংকিং হবে তাতে আমরা একশর নিচে চলে আসব। অবশ্য প্রকৃত সংখ্যা হিসেবে করলে আমরা এমনিতেই পঞ্চাশের কাছাকাছি থাকতাম।
ফেসবুকের পূর্ব এবং পরের হিসাবটুকু বিবেচনায় নিলেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। মানুষ এখন সুইসাইড করার চেষ্টা করছে লাইভে এসে। মানুষ সুইসাইড নোট লিখছে ফেসবুকে। ফেসবুকের পরিচিত কেউ আত্মহত্যা করলেই সেটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে। আমরা কেঁদে বুক ভাসাচ্ছি, ভিক্টিমের ছবি পোস্ট করে আবেগী পোস্ট দিচ্ছি, না হলে দিয়ে দিচ্ছি গালি। যাই করি না কেন, এসব প্রচার বাড়িয়ে দিচ্ছে কপিক্যাট ইফেক্ট।
এ্যান্ডি ওয়ারহোল ফেসবুক আসার আগে "15 min famous" নামের একটা থিওরী বের করেন। তার মতে বিশ্বের মানুষ একটা সময়ে মাত্র ১৫ মিনিটের জন্যে হলেও বিখ্যাত হতে চাইবে। বর্তমানে বেড়ে যাওয়া সুইসাইডের হার এই থিওরীরই আরেকটা আউটকাম।
ডিপ ডিপ্রেশন লেয়ারে না যাওয়া বেশিরভাগ সুইসাইড করা মানুষ মনোযোগ আকর্ষণের জন্য না হয় প্রতিশোধের জন্য সুইসাইড করে। অবচেতনভাবে প্রতিটা মানুষই জীবনের একটা বড় সময় কল্পনা করে তার মৃত্যুতে কোনো প্রিয়জন কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে। ফেসবুক আসার পর এসব প্রতিক্রিয়া চোখের সামনেই চলে আসছে বারবার। এই ব্যাপারটা ট্রিগার করছে আত্মহত্যাকারীর মনে। কারো উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চেয়ে সুইসাইড করলে ফেসবুক সেটাকেও বাস্তবায়ন করে দিচ্ছে।
কমেন্টে স্ক্রিনশট দিচ্ছি দেখুন। এই প্রজন্মের ১৫-২৯ বছরের তরুণদের একটা বড় অংশ গুগলে সার্চ করে "How to suicide" "How to overdose" "How can i kill myself" লিখে। গুগলের টপ টেন সার্চের মধ্যে এই তিনটা সার্চও অন্যতম। মানুষ রীতিমতো সুইসাইডের জন্য উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে আমাদের মিডিয়া এবং ফেসবুক লেখকদের প্রতিক্রিয়া আগুনটাকে উস্কে দেয়া ছাড়া আর কিছুই করছে না।
WHO আশা করছে ২০২০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে ১০% সুইসাইড কমবে। আমাদের দেশে উল্টো বছরে বাড়ছে ১০-১৫% করে। কপিক্যাট নিয়ে গবেষণা করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন সুইসাইড কমবে না। বর্তমানে যে ৯ লাখ সুইসাইড করে, দুই বছর পর কেবল কপিক্যাটের কারণে সেটা চলে যাবে দেড় মিলিয়নে।
"অরিত্রি আত্মহত্যা" লিখে গুগলে সার্চ দিলাম। গুগল ৮৭ টা রেজাল্ট দেখিয়ে আমাকে বলল 'আরো অনেক আছে, সব এক রকম। তোমার আর দেখার দরকার নেই।'
ভাবা যায় একটা আত্মহত্যার জন্য শতশত গুগল রেজাল্ট! হাজার হাজার ফেসবুক পোস্ট! ফলাফল হিসেবে তিনজন মানুষকে ফাঁসাতে গিয়ে কপিক্যাটে ফেঁসে যাবে কয়েকশ আত্মহত্যাকারী।
আপনার কাছে মনে হতে পারে আমি অত্যুক্তি করছি। কমেন্টে প্রায় সব লিংক দিয়ে রেখেছি দেখতে পারেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সুইসাইড বিষয়ক খবর প্রচার করার জন্য আলাদা করে প্রেস লো তৈরি করেছে।
১৯৮৭ সালে অস্ট্রিয়া সরকার সংবাদপত্র আইন প্রণয়ন করে যেখানে প্রতিটা মিডিয়াকে শক্তভাবে বলা হয়েছে কোনো প্রকার আত্মহত্যার খবর প্রথম পাতায় প্রচার করা যাবে না। আত্মহত্যা কখনো হেডলাইন হতে পারবে না। এমনকি হেডলাইনে আত্মহত্যা শব্দটি বলাই যাবে। ১৯৯২ সালে সুইজারল্যান্ড অস্ট্রিয়ার পথ অনুসরণ করে একই রকম আইন তৈরি করে। ফলাফল আসে হাতে নাতে। প্রথম বছরেই আত্মহত্যার হার ২০% থেকে নেমে ৪% এ চলে আসে। হেডলাইনবিহীন খবর প্রচার আত্মহত্যা কমিয়ে দেয় ৩৭%।
নরওয়ে সরকার আইন না করে নির্দেশ দিয়েছে সুইসাইড এবং সুইসাইড চেষ্টা কোনো রকম খবরকে কোনো গুরুত্ব দেয়া যাবে না। তুরষ্ক সরকারের নির্দেশে সে দেশের সকল পত্রিকায় সুইসাইড বিষয়ক সকল চিত্র, ভিডিও প্রচার নিষিদ্ধ। আয়ারল্যান্ডেও একই অবস্থা।
আমেরিকায় এই আইন প্রচার করতে গেলে প্রেস কাউন্সিল বেঁকে গিয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্ন তুলে আইন করতে দেয়নি। তবে শীর্ষ ১৬ পত্রিকার সবাই সুইসাইডকে গুরুত্ব না দিয়ে সংবাদ প্রচারের মৌখিক সম্মতি দিয়েছে।
আত্মহত্যাকে রোমান্টিসিজমে রূপ দিতে নিষেধ করেছে প্রতিটা উন্নত দেশ। আত্মহত্যা যেভাবেই হোক, মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করে এমন খবর ছাপা নিষিদ্ধ। কোনো প্রকার ফলোআপ রিপোর্ট তো পুরোপুরি হারাম।
অরিত্রির আত্মহত্যার পর আমাদের অতি প্রতিক্রিয়া, অতি সহানুভূতি এবং সবশেষে শিক্ষামন্ত্রীর অবিবেচক মন্তব্যের পর আমাদের দেশে কপিক্যাট ইফেক্ট আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়বে। সদ্য টিনএজে পা দেয়া ছেলে মেয়েরা যে জটিল শারীরিক ও মানসিক ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যায় তাদেরকে আমরা কী বার্তা দিলাম?
আমরা বার্তা দিলাম, তোমাদের ইগোর প্রচুর দাম। তোমরা চাইলেই সুইসাইড করতে পারো। আমরা তাদের দুর্বল মেন্টাল টেম্পারটমেন্ট স্কেলকে স্বীকৃতি দিলাম। বুঝিয়ে দিলাম মানসিক শক্তি, ধৈর্য বাড়ানোর কোনো দরকার নেই। আমরা তোমাদের পাশে আছি।
সারা বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের মৃত্যুর ২য় বড় কারণ সুইসাইড। ওয়ার্কিং ডিজএবিলিটির সবচেয়ে বড় কারণ ডিপ্রেশন। অথচ এই দুইটা ব্যাপার নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।
ভাবতে কষ্ট লাগে। ডিপ্রেশন নামক মহামারি কিন্তু নিরাময়যোগ্য। সঠিক চিকিৎসা ও থেরাপী দিতে পারলে যে কেউ সুস্থ হতে বাধ্য। মানুষ ভাবে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গেলে সবাই পাগল ভাববে। সম্মান বাঁচানোর চেয়ে মৃত্যুই ভালো। আহারে!
অরিত্রি আমাদের জন্য ফিউবা প্রিন্স হতে পারত। ২০১০ সালে সাইবার বুলিং এর শিকার হয়ে আত্মহত্যা করা এই মেয়ের জন্য কেঁপে ওঠেছিল পুরো আমেরিকা। বুলিং রোধে তার নামেই করা হয়েছিল আইন। স্কুল জুড়ে শুরু হয়েছিল কর্মশালা। আমরা সেটা না করে হয়ে গেলাম প্রতিশোধ পরায়ন। ভাবলাম তিনটা মানুষকে জেলে দিতে পারলে সব সমাধান হয়ে যাবে।
ভিকারুন্নিসার তিন শিক্ষক হয়তো ভুল করেছেন। শ্রেণী শিক্ষকের অপরাধ কোথায় জানি না, তবে বাকি দুইজন সহনশীল হতেও পারতেন। তাদেরকে জরিমানা করা যেত, কদিনের জন্য বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া যেত। দেশের সব স্কুল কলেজ জুড়ে কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম শুরু করা যেত। করা যেত শিক্ষকদের নিয়ে কর্মশালা, সেমিনার।
কিচ্ছু না করে তাদেরকে জেলে ভরে দেয়া খুব বাজে হয়েছে। শিক্ষক ছাত্রের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি করে দিল। এই যে এত এত এত মিডিয়া প্রচার... কপিক্যাট ইফেক্ট যখন জলোচ্ছাসের মতো নেমে আসবে, বুঝবেন ভুলটা কোথায় ছিল।
সমস্যা ভীষণ বড়, সমাধান খুব একটা কঠিন না।
আমাদের দেশে হতাশ হওয়ার হাজারটা উপাদান। আপনি যত যাই করেন ৬০% বেকার থেকেই যাবে, প্রতি বছর মেডিকেল বুয়েটে টিকতে না পেরে ৫০ হাজার ছাত্র হাপিত্যেশ করবে, একেকটা বিসিএস বের করবে চার লাখ হতাশ তরুণ। এসব ফ্যাক্টরকে বিবেনায় নিয়েই সামনে এগুতো হবে। আল্লাহ কা ওয়াস্তে মানুষকে "সফল হতেই হবে" ধরণের টিপস দেয়া বন্ধ করুন। জীবনে সবাই সব পাবে না। প্রতি বর্গকিলোতে ১২০০ মানুষের বাস যে দেশে,সেখানে সবাই ৬ ডিজিটের স্যালারি পাবে না। বাঁচার পথটুকুকে ডাক্তার-ইঞ্জিয়ার-বিসিএস ক্যাডারে সীমাবদ্ধ করে দিয়েন না।
ফুসফুটে অক্সিজেন এবং পেটে ভাত থাকলে বেঁচে থাকাটা অপমানের না। আমাদের স্কিল বাড়ে না, আমাদের বুদ্ধি আড়ষ্ট, আমাদের জ্ঞান সীমাবন্ধ.. কিন্তু প্রজন্মকে আমরা শেখাচ্ছি সেরা হতে। আমরা তুমুল অপমানবোধ গায়ে মাখি। অন্তঃসারশূন্য হয়েও আমরা একেকজন ইগোর টাইটাইনিক।
ভার্চুয়ালটাকে কম গুরুত্ব দিন, দিতে শেখান। জীবন বাস্তব হোক। সন্তানকে, ছোট ভাই বোনকে বলুন তাদের কাজ যেন তারাই করে। "ওলে বাবালে" প্রজন্মই এক সময় চাপ নিতে পারে না। ঐ যে টেম্পারমেন্টের দেয়াল, সেটা এমনি এমনি শক্ত হয় না, শক্ত করতে হয়।
আরেকটা জরুরি কাজ হচ্ছে আত্মহত্যা বিষয়ে ফেসবুক এবং মিডিয়া আইন তৈরি করা। বেশিরভাগ দেশে আত্মহত্যার খবরে আত্মহত্যা বলাই নিষেধ। "মিস্টার জন ৬০ বছরে বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। জানা গেছে তিনি তিনি বিষ পানে মারা যান"
খবর এখানেই শেষ।
টিভিতে যে সুইসাইড দেখি আমরা, খবরের কাগজে একই জিনিষ পড়লে আমাদের মাথায় ৮৩% বেশি প্রভাব পড়ে। খবরের কাগজগুলো বলা উচিত তাদের ব্যবসা সুইসাইড ছাড়া অন্য জায়গায় যেভাবে খুশি সেভাবে করুন। এখানে মানুষের জীবনের প্রশ্ন। ব্যবসা না করলেও হবে।
ডিপ্রেশনকে রোগ হিসেকে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নামতে হবে। কেউ না কেউ রাস্তায় নামুক। সাইকিয়াট্রিতে রোগীরা ভীড় করুক। সামান্য কটা ট্যাবলেট, দুই সেশনের কাউন্সেলিং...কতগুলো জীবন বাঁচে হিসেব নেই।
হ্যাঁ, ধর্মের কথা সচেতনভাবে এগিয়ে গেছি। "সুইসাইড মহাপাপ, জাহান্নাম নিশ্চিত" এই নিষেধ বাণী সুইসাইড প্রতিরোধের অন্যতম হাতিয়ার। কিন্তু এর মাধ্যমে একজনকে এক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ঘরে তালা দিয়ে রাখার সমান হয়। সঠিক ধর্মচর্চাকারী মানুষদের মধ্যে হতাশা কম কাজ করে। সুইসাইড থেকে বাঁচার জন্য ধর্মকে যদি ব্যবহার করতে হয় তবে সেটা হলো ধর্ম চর্চা, ধর্মীয় আইন না। ধর্মের প্রতিটা নিয়ম মানতে পারলে এমনিতেই সুইসাইড করার দরকার পড়বে না। কেবল আইন দিয়ে এত বড় একটা মহামারীকে আটকানো সম্ভব না। আটকানো যাচ্ছেও না।
একটা মানব প্রাণের চেয়ে দামী কিছু জগতে নেই। সেই প্রাণ যখন একজন নিজের হাতে নিজে কেড়ে নিচ্ছে... ব্যাপারটা হালকা কিছু না। এইডস হওয়ার যে মূল কারণ সেটাকে ধর্ম বা সমাজ স্বীকৃতি না দিলেও এই রোগ নিয়ে কত মাতামাতি। ডিপ্রেশন নিষিদ্ধ কিছু না। আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণা, লিফলেট প্রচারের সময় এসেছে। সব জায়গায় পজেটিভিটি ছড়িয়ে দিতে হবে। নাটককে ভাড়ামো, সিনেমাকে প্রেম আর মারামারি, গল্পকে ন্যাকামির জায়গায় সীমাবদ্ধ না রেখে ছড়িয়ে দিতে হবে জীবনের গান।
আমরা খারাপ আছি, কষ্টে থাকি... তারপরও চাইলে ভালো থাকা যায় এই বোধটা ছড়িয়ে দিতে পারলেই বেঁচে যাবে অনেকগুলো প্রাণ। আপনার কাছে থাকা ডিপ্রেশন মেজরে ভোগা বন্ধুটাকে হয়তো হারাতে হবে আর।
আত্মহত্যা গৌরব নয়, আত্মহত্যা অভিশাপ নয়। অরিত্রিদেরকে কাঠগড়ায় বা সহানুভূতির মঞ্চে দাঁড় না করিয়ে প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করুন। ধন্যবাদ।
(২৬ টি ভুল নিছক রূপক শব্দ ছিল। এ টু জেড পর্যন্ত মোট ২৬ টি বর্ণ আছে।)
Comments