অভিশপ্ত আয়না ২য় পর্ব
পরের দিন বাসায় বিকেলে হৈ হৈ করতে করতে চৈতী, সুমন আর তুলি আসলো। সুপ্তির আম্মু মানুষ কে খাওয়াতে পারলেই খুশী। ৬/৭ পদের নাস্তা বানিয়ে ফেললেন তখনই। আয়না দেখে সবাই থ। চৈতী তো পারলে নিয়েই যায়। কয়শ বছরের পুরনো জিনিস, কে এটা বানিয়েছে, কেই বা ব্যবহার করতো- এসব নিয়ে ব্যাপক আড্ডাবাজী।সুমন বরাবরই কল্পনার রঙ ছড়াতে ভালোবাসে। তার ধারণা, আয়নাটা অভিশপ্ত।
সবার রক্ত চুষে নেয়। একারণেই ময়ূরগুলোর চোখ লাল। নতুবা কে কবে শুনেছে ময়ূরের চোখ লাল। সবার হো হো অট্টহাসিতে তার মতবাদ চাপা পড়লো। কিন্তু সুপ্তি বিশেষ খুশী হতে পারলো না। বন্ধুরা যখন ডাইনিং রুমে খেতে বসেছে, আর সে এসেছে তুলির মোবাইলটা তার ঘর থেকে নিতে; আবার তার সেই অনুভূতি ফিরে ফিরে এলো। কেউ তাকে দেখছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেংচি দিলো সুপ্তি। নাহ, এটা তার মনের ভুলই হবে।
সবাই চলে গেলে রাতের খাওয়া সেরে সুপ্তি নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। ঘুমুতে যাবার আগে সে আবার আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আয়নাটা যেন তাকে আবিষ্ট করে ফেলছে। ঘড়ির আওয়াজে চমকে গেলে সে দেখলো ১টা বেজে গেছে। মানে সে প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। এত সময় ধরে আয়নায় সে কি দেখছে? হঠাৎ তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি জাগলো। মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটা বইতে সে পড়েছে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ১৭শ সালের ডাইনী ব্লাডি মেরীকে ডাকলে সে আসে।
অবশ্য প্রতিবার ৪৫ বার করে ডাকতে হবে অনেক দিন ধরে। সে আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো, “ব্লাডি মেরী, ব্লাডি মেরী, ব্লাডি মেরী”। নিঃশ্বাস বন্ধ করে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। কিছুই হলো না। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই হেসে ফেললো। কি বোকার মত সে গল্পের বই এর কথায় মেরী না কাকে ডাকাডাকি করছে। সবুজ রঙের ডিম লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আবার ঘুমের মাঝে সেই অস্বস্তিকর অনুভূতি। কেউ অবশ্যই তাকে দেখছে।
রাত তিনটার দিকে ঘুম ভেঙে গেলো। সারা ঘরে কেমন যেন শীতল একটা ভাব। বৈশাখ মাসের এই বিশ্রী গরমে এরকম ঠান্ডা ভাব কি করে হলো? বৃষ্টি নাকি বাইরে? পরদা সরালো সুপ্তি। নাহ, বাইরে সব শুকনো, বাতাস পর্যন্ত নেই। গাছের পাতাগুলিও চুপ চাপ, সবাই ঘুমে বিভোর। হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন বিছানার মাথার কাছ দিয়ে সরে গেলো। ঝট করে ঘাড় ঘোরালো সুপ্তি। শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত নামলো। নাক কুঁচকে গেলো তার।
কেমন যেন একটা গন্ধ; বিশ্রী পচা গন্ধ। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো কপালে। এসব কি হচ্ছে? তার জানামতে বাসায় কোন ইঁদুর নেই, তেলাপোকা অবশ্য আছে। তেলাপোকা মরলে এরকম গন্ধ কখনো হয়না। বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলো সুপ্তি। উদ্দেশ্য আয়নার পাশের সুইচবোর্ডে টিউব লাইটের সুইচ অন করবে। আয়নার কাছাকাছি গিয়ে সে কেমন যেন আওয়াজ শুনতে পেলো। কেউ গুন গুন করে কোন গান গাচ্ছে, না কবিতা পড়ছে। ধীর লয়ে নীচু সুরে কেউ গুন গুন করছে। একটু গোঙগাচ্ছেও যেন। আয়নার দিকে তাকাবে না তাকাবে না করেও সুপ্তি তাকিয়ে ফেললো।
নাহ, আয়নায় তাকেই দেখা যাচ্ছে। ওই তো সে, ফুল আঁকা টি শার্ট পড়া। সবুজ ডিম আলোতে নিজেকে দেখতে একটু অন্যরকম লাগছে, কিন্তু এটা তারই প্রতিবিম্ব। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাত বাড়ালো সুইচের দিকে। আয়নার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো সুপ্তি। আয়নার সুপ্তি এখনো তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে; হাত দুইটা পাশে রাখা। কিন্তু সে তো বাম হাত উপরে তুলেছে সুইচ অন করার জন্য। আতংকে চিৎকার দিয়ে সে পিছনে সরে এলো। আয়নার সুপ্তি এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আয়নার সুপ্তি হাত বাড়িয়ে দিল, যেন সুপ্তিকে ছুঁতে চায়।দুই হাতে মুখ ঢেকে আকাশচূর্ণ করা চিৎকার করে উঠলো সুপ্তি। আতংকে থর থর করে কাঁপছে।
বাইরে তার আম্মু আব্বু দরজা ধাক্কাচ্ছে। সুকন্যার গলাও যেন শোনা যাচ্ছে। সুপ্তি মুখ থেকে হাত সরিয়ে দেখলো আয়নায় এখনো তাকে দেখা যাচ্ছে। হাত নাড়ালে আয়নার হাতও নড়ছে। কোনমতে আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলতেই তার আম্মু ঝাঁপিয়ে পড়লো। “কি? কি হয়েছে রে মা? সর্বনাশ, এত ঘেমে গেছিস কেন?” “জানি না আম্মু”। বলে সুপ্তি একেবারে শুয়ে পড়লো তার মার কোলে।
১৫ মিনিট পর লেবুর সরবত খেয়ে মাথা মুছে সে মোটামোটি সুস্থির হলো। তার বাবা মার ধারনা সে কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছে। এখন এই আলোকিত রুমে এত প্রিয় মানুষের মাঝে সুপ্তির নিজেরই লজ্জ্বা করতে লাগলো। তার কোন সন্দেহ নেই যে মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভাঙার জন্য এবং বেশী সাইকো থ্রীলার দেখার ফলাফল হচ্ছে এটা। ফিচলে সুকন্যা ঘোষনা দিলো যে রাত্রে গুরু ভোজন হবার কারণে পেট গরম হওয়ায় সুপ্তি উলটা পালটা স্বপ্ন দেখছে। ইদানিং সে নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের ভক্ত হয়েছে। কথায় কথায় টেনিদার উক্তি উদ্ধৃতি করে সবার মাথা ধরায়। সুকন্যাকে ভেংচি দিয়ে সুপ্তি আবার ঘুমুতে চলে গেলো, তবে এবার আম্মুও সাথে এলেন। আবার কি স্বপ্ন দেখে কোন ঠিক নাই।
পরের দিন দুপুরে খাবার টেবিলে রাত্রের কাহিনী নিয়ে আলোচনা হলো। আসলে ঘটনা টা কি? সুপ্তি দুঃস্বপ্ন বলে এড়িয়ে গেলো। এখন আবার সুকন্যাকে টিজ করার কোন সুযোগ দেয়ার মানে হয় না। তবে সে নিজেই চিন্তিত, আসলেই কি দুঃস্বপ্ন ছিলো? সবকিছু এত বাস্তব মনে হচ্ছিল—নাহ সুপ্তি এ নিয়ে আর ভাবতে চায় না। বিকেলে তুলি আর সুমনের সাথে সুমনের গুরুর গিটার বাজানো শুনতে যাওয়ার কথা, সে সেটা নিয়েই ভাববে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হবার সাথে সাথে সুপ্তির আবার অস্বস্তি হতে থাকে। আজ রাতে কি হবে কে জানে। আজ সে দরজা না লাগিয়ে শুয়ে পড়ে। ডাইনিং এর লাইট সারা রাত্রি জ্বালানো থাকে, তাতে করে তার রুমেও আলো পৌঁছায়। ওই ভৌতিক সবুজ আলোর চাইতে সাদা আলো যথেষ্ট স্বস্তিদায়ক। রাত গভীর হতে থাকে, কিন্তু সুপ্তির আর ঘুম আসে না। চাপা অস্বস্তিতে সে জেগে থাকে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানেনা। হঠাৎ তার আবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সারা ঘরে গুন গুন একটা আওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছে। সুপ্তি উঠে বসে। সাথে সাথে সব চুপ। তার ভয় ভয় করতে থাকে। ঘড়ির দিকে তাকে দেখলো, আড়াইটা বাজে। ঘরটা আবার কেমন যেন শীতল, যেন এসি চালানো হয়েছে। সাথে সেই গন্ধ।
সুপ্তি নাক কুঁচকে বসে থাকে। আবার আম্মুকে ডাকার একটা ইচ্ছে জেগে উঠে। অনেক কষ্টে নিজেকে বার কয়েক গালি দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করতেই আবার সেই গুন গুন আওয়াজ। এবার একটু জোরে। তীক্ষ্ণ স্বরে কে যেন একটানা মন্ত্র পাঠ করে চলেছে অত্যন্ত দ্রুত লয়ে। সুপ্তি লাফিয়ে নামে বিছানা থেকে। কিন্তু একটা অমোঘ আকর্ষন তাকে টেনে আয়নার দিকে নিয়ে চলে। কোন এক অজানা শক্তি তাকে বাধ্য করে আয়নার দিকে তাকাতে। না এবার আয়নায় তাকেই দেখা যাচ্ছে, ভীত মুখে তাকিয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে সুপ্তি। এবার চোখ খুলতেই সে ভয়ানক ভাবে চমকে যায়। আয়নায় এ কার মুখ? চিৎকার দেবার জন্য মুখ খোলে সে, কিন্তু আয়নার চোখটির ব্যথিত ভাব দেখে থমকে যায়। অপূর্ব এক চেহারা।
তবে অনেক শুকনো। ঘন কালো চুল, বাতাসে আস্তে আস্তে দুলছে। খাড়া নাক, উন্নত ললাট, যেন এক গ্রীক দেবতা। তবে সবচেয়ে মায়াভরা তার চোখ, তার মাঝে যেন সাগরের গভীরতা। ছেলেটি ব্যথিত চোখে সুপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। মায়াভরা বিষন্ন সেই চোখ অগ্রাহ্য করা সুপ্তির পক্ষে অসম্ভব। সুপ্তি ভুলে যায় সে কোথায় আছে, তার কাছে মনে হয় এটাই বাস্তব। আয়নার মাঝে মানুষ দেখা যাবে, এটাই স্বাভাবিক। সে চাপা কন্ঠে প্রশ্ন করে, “তুমি কে?” ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপরে বলে, “আমি ইভান”। দৃপ্ত এবং ভরাট কিন্তু ভীষন আপন করা কন্ঠ। “তুমি আয়নার মাঝে কেন? তুমিই কি কাল রাতে এসেছিলে?” “হ্যাঁ, আমি তোমাকে ডাকার চেষ্টা করছিলাম”। “তুমি আয়নায় কেন? তোমার পরিচয় কি?”
আর কোন কথা না বলে আয়নার মাঝে ছবি মিলিয়ে যায়। লাইট জ্বালিয়ে সুপ্তি অনেক করে দেখে, নাহ, আয়না আবার স্বাভাবিক একটা আয়না হয়ে গেছে। লাইট নিভিয়ে সুপ্তি অনেক বার বলে, “ইভান, ইভান, শুনতে পাচ্ছ?” আয়না নিশ্চুপ থাকে, অন্ধকারে শুধু ময়ূরের চোখগুলো ঝিকমিকিয়ে ওঠে। পরের দিন সারাটা ক্ষণ সুপ্তি ভার্সিটিতে অস্থির হয়ে থাকে। কখন সে বাড়ি যাবে, কখন রাত হবে। তার অস্থিরতা দেখে চৈতী বললো, “কি রে প্রেমে পড়েছিস নাকি কারো? এত ছট ফট কেন?” সুপ্তি না শোনার ভান করলো। ইভান দেখতে যেন রুশ দেশের রূপকথার ইভানের মত। সে কি কখনো ভেবেছিল, তার ঘরের আয়নায় কোন এক রাজপুত্র এসে দেখা দেবে?
রাত ১২টা বাজতে সুপ্তি তাড়াতাড়ি লাইট নিভিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। আজ রাতে সে ঘুমাবে না। রাত দুইটার দিকে হঠাৎ ঘরে ধীর গতিতে শীতল হাওয়া বইতে থাকে, সাথে সেই গন্ধ। এত সুন্দর দেখতে ইভান, কিন্তু এই পচা গন্ধ কেন আসে তবে? সুপ্তি তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে যায়। ইভানের মুখে স্মিত হাসি। ইভান ভীষন রকম ফ্যাকাসে। “কেমন আছ সুপ্তি?” “ভালো। তুমি?” ইভানের মুখ বিষন্ন হয়ে যায়। “আয়নার মাঝে আর কেমন থাকবো?” “তুমি আয়নায় কেন? কি হয়েছে?” ইভান বিষন্ন কন্ঠে জবাব দেয়, “আমি কিছুই জানি না। আমি শুধু এক সকালে উঠে দেখতে পাই আমি আমার ঘরের আয়নার মাঝে বন্দি হয়ে গেছি। তারপর থেকে এখানেই আছি। কতবার কতজন কে ডাকার চেষ্টা করেছি, কেউ শোনেনি। ১০০ বছর পর আজ তুমি শুনলে”। ১০০ বছর! সুপ্তির গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। “তোমার তাহলে বয়স কত?”
ইভান হাসে।“৩০০ বছর আগে তো ২৩ ছিল, এখন তোমাদের হিসেবে নিশ্চই ৩২৩, কিন্তু আমার হিসেবে ২৩”। “১০০ বছর পর আমি ডাক শুনলাম, আগে কে শুনেছিল?” সুপ্তি নিজের কন্ঠের আবেগ লক্ষ্য করে নিজেই অবাক হয়। ইভান উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে। “সুপ্তি, আমার অনেক কষ্ট, অনেক কষ্ট”। সুপ্তির বুকে আবেগের বান ডাকে। তার ইচ্ছে হতে থাকে গ্রীক দেবতার মত দেখতে ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দেয়। “তুমি কি আমার হাতে হাত রাখবে সুপ্তি?”- করুণ ভাবে ইভান জিজ্ঞেস করে।
সুপ্তি হাত বাড়িয়ে দেয়। আয়নায় সে ইভানের হাতের উপর হাত রাখে। বরফের মত ঠান্ডা। হাত যেন বেশীক্ষন রাখা যায় না। সে সরিয়ে নিতে চায়, কিন্তু অবাক হয়ে দেখে সে হাত সরাতে পারছে না। ইভানের চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে সে। ইভানের চোখে এখন জান্তব উল্লাস। ভীষন লোভে চোখ ঝক ঝক করছে। সুপ্তি ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে। সাথে সাথে ইভান আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ছবি মিলিয়ে যায়।
সুপ্তি তারপরো পরের রাতের জন্য অপেক্ষা করে। আবার ইভান আসে, হাতে হাত রেখে তারা গল্প করে। ইভান চলে যায়। ইভান দিনে দিনে আরো সুন্দর হয়।ফ্যাকাশে গালে গোলাপী ছোপ লাগে। মাত্র ৩ দিনেই সুপ্তির স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। কিছুতেই সে কোন শক্তি পায় না। চোখের কোণে কালি। তার মা ব্যস্ত হয়। “কি হয়েছে রে সুপ্তি? তুই দেখতে এমন হচ্ছিস কেন? রাতে ঘুমাস না?” সুপ্তি দুর্বল কন্ঠে প্রতিবাদ করে। “কই মা, ঠিকই তো আছি”।
চলবে
Comments