top of page
Writer's pictureJust Another Bangladeshi

অবহেলিত মানুষ

মিরাজ হোসাইন শান্ত




আমি কাশেম ( গুপ্ত নাম )। অবশ্য কাশেম নামটা কে রেখেছিলো তা আমার জানা নেই। জানার কথাও না। কারন ছোট বেলা থেকেই অবহেলা আর দারিদ্রতার কোষাঘাতে চেপে বড় হয়েছি। জন্মের পর বাবা মা কে কখনো দেখিনি। যখন একটু একটু করে বুঝতে শিখেছি ভিক্ষাবৃত্তি পেশা ছেড়ে ছোট্ট একটা কর্মে নিয়োজিত আছি। আর এটাই আমার জীবন। এইতো প্রতিদিনের ব্যস্ততা শেষে রাতে ফুটপাতের কোথাও গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থেকেই রাতের পার করে দেই। কখনো বা বৃষ্টিতে ভিজে এই দেখ কখনো রুদে শুকায়। আমি ফেরিওয়ালা। ঢাকা শহরের বিভিন্ন অলিতে-গলিতে ফেরি করে বেড়াই। মানুষের নিত্যদিনের বিভিন্ন জিনিস পত্র বিক্রি করি। কখনো কখনো ফেরি করতে করতে শহর ছেড়ে পাড়ি দেই সূদুর পরান পুরে। ভালো লাগে। অভ্যস্ত হয়ে গেছি। প্রতিদিনই কত মানুষের সম্মূখীন হই আমি। কখনো কখনো জোকার দের জোকস বলি মানুষকে আকর্ষণ করার জন্য। পথ হারা প্রতীকের মত ছুটে চলি আমি আপন দিগন্তে। এইতো সেদিনের ঘটনা। আলমাজ সাহেব নামে এক বড় লোকের বাড়ির সামনে দিয়ে ফেরি করে যাচ্ছিলাম। তিনিই আমার কাছ থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ক্রয় করেছিলেন। দাম কষাকষির এক পর্যায়ে তিনি আমাকে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেন। বুঝতেই পারিনি সেদিন এই চোখ দুটো থেকে কেন জানিই দুফোটা রহস্য টপ টপ করে ঝড়ে পড়ছিলো। আরে আমি সেদিন কান্না করে নিমিষেই আবার বোকার মত হেসে উঠি। তাৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়ে যায় এই শহরে আমার মত কাশেমের জন্মই ত শুধু অবহেলা আর কষ্ট পাওয়ার জন্য। তবুও বেঁচে থাকি। বেঁচে থাকি সুন্দর এই ধরণীর একটু স্বাদ উপভোগ করার জন্য। যদিও স্বাদ থেকে বিস্বাদ টাই আমার/ আমাদের জীবনে বেশি। আজ আবার বের হয়েছি। ক্লান্ত আমি। তাই বট বৃক্ষের ছায়ায় নিজের ঘর্মাক্ত দেহটা কিছুক্ষনের জন্য এলিয়ে দিয়ে সস্তির নিঃস্বাশ ফেলছি। ভালো লাগে যখন দেখি দূর আকাশে এক জোড়া পাখি মেঘের আড়ালে নিমিষেই লুকিয়ে যায়। আরও ভালো লাগে আকাশে নীল রঙের মেঘের ছুড়াছুড়ি। আমি বট বৃক্ষের নিচে শুয়ে আছি। চোখ দুটি বন্ধ করে শুয়ে আছি। পাশেই পড়ে আছে আমার জীবিকার সামান্য কিছু উপকরণ। হঠাৎই আমার পাশ ঘেষেই একজনের বসার আওয়াজ কানে ভেসে এলো। তৎক্ষণাৎ উঠে বসে পড়লাম। উঠে দেখি সুদর্শন একটা যুবক আমার পাশ ঘেষেই বসেছে। আমাকে দেখেই প্রশ্ন বিদ্ধ করে ফেললো। আমি অবশ্য কথা বলতে প্রস্তুত ছিলাম না। কারন আমার মত ফুটপাতের ফেরিওয়ালার সাথে কেই বা কথা বলতে আসবে। ভদ্রলোক আমাকে জিগ্গেস করলো কেমন আছেন? আমি উওর দিলাম ভালো আছি।। আমি বললাম আপনাকে কিন্তু ঠিক চিনতে পারলাম না জনাব! বললো আমাকে আপনি চিনবেন না। ওই যে পাঁচ তলার বাসাটা দেখছেন ওটা আমাদের। আমি অবশ্য ওখানে থাকিনা। কিন্তু মায়ের কাছে শুনলাম আমার বাবা নাকি কোনো এক ফেরিওয়ালার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। আপনাকে দেখে মনে হলো আপনিই সেই ফেরিওআলা হবেন। আহা বাদ দিন ত এসব কথা। আমাদের জন্মই হলো আজন্মের পাপ। অবহেলা আর দারিদ্রতা যার নিত্যসঙ্গি তাদের সাথে কেই বা ভালো ব্যবহার করবে বলুন। আসলে আমি আমার বাবার পক্ষ থেকে সরি বলছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। ভদ্রলোক টা বললেন আপনি কোথায় থাকেন। আমি উওর দিলাম যেখানে রাত সেখানেই কাট। ভদ্রলোক টা বললো বুঝতে পারলাম না। আমি বললাম মানে যেখানেই রাত হয় সেখানেই রাত কেটে যায়। আসলে আমার ত থাকার মত নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই তাই আরকি। ভদ্রলোক টা বললেন তুমি কিন্তু অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারো!! এই দেখুন আপনাকে তুমি বলে ফেললাম। কি হলো কিছু বলছেন না যে? আমি জবাব দিলাম আসলে আপনার মত কখনো আমার সাথে এভাবে কথা বলতে এগিয়ে আসে নি ত তাই ভাবছি। ভদ্রলোক টা বললো আরে ভাবনার কিছু নেই। তুমি চাইলে আমরা বন্ধু হতে পারি। কিন্তু আপনার সাথে আমার কিভাবে যায় বলুন। কই আকাশ আর কই পাতাল। রাত দিন পার্থক্য। ভদ্রলোক টা বললো আরে বন্ধুত্ব রূপ, চেহারা, টাকা পয়সা দিয়ে হয়না। বন্ধুত্ব হয় মন থেকে। আমি বললাম আচ্ছা আমি ভেবে দেখব। আমি বললাম আমি ত প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গায় ফেরি করি তাই একেক দিন একেক জায়গায় যেতে হয়। ভদ্রলোক টা বললো আমি কালকেও এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করব। তুমি তোমার কাজ শেষ করে এখানে এসে আমার জন্য অপেক্ষায় থাকবে। আমি ঠিক আছে বলে বট বৃক্ষের ছায়া ত্যাগ করলাম। মনের ভেতর বিভিন্ন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ভদ্রলোক কি দেখে আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে আসলো। যেখানে সবাই আমাকে/ আমাদেরকে ঘৃনা করে। রাস্তার মানুষ বলে গালি দেয়। সত্যিই অনেক ভাবনার বিষয়। যাইহোক ভাবনা পরে ভাবা যাবে। সারাদিন কিছুই পেটে পরেনি। হোটেল থেকে 10 টাকার ভাত খেয়ে এই পেট টাকে শান্ত করি আগে। *খাওয়া শেষ করতেই সন্ধ্যা নেমে এলো চারিপাশে। অবশ্য ঢাকা শহরের রাস্তায় সোডিয়াম লাইটের আলোয় বুঝাই যায়না কখন দিন কখন রাত। ফেরির মাল পত্র গুলো একদিকে রেখে রাস্তায় কোনো একটা সাইডে শুয়ে পড়লাম। সোডিয়ামের আলোয় হালকা বুঝা যাচ্ছে আকাশে চাঁদ উঠেছে। চাঁদ আমার খুবই প্রিয়। যখন আকাশে চাঁদের আলো আমার গায়ে এসে পড়ে তখন মনের অজান্তেই মনের সব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যায়। আজকে ওই ভদ্রলোকের কথা কেন যেন খুব মনে পড়ছে। ওনার মায়াবী মুখের চাহনী, এত সুন্দর করে কথা বলার ধরন সবই এই অবহেলিত ছেলেটাকে মুগ্ধ করেছে। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম। এক ঘুমেই রাত পার করে দিলা। পরদিন খুব সকাল সকালই বেরিয়ে পড়লাম। আজকে শহরের আশে পাশেই ফেরি করলাম। ভদ্রলোকের দেওয়া টাইম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পৌছালাম। আমি পৌছানোর আগেই ওনি বসে আছেন দেখতে পেলাম। আমি গিয়ে ওনার থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বসলাম। ভদ্রলোক আমাকে জিগ্যেস করলো এই কালকে ত তোমার নামটাই জানা হয় নি। আমি বললাম কাশেম! কাশেম আমার নাম। আমিও ওনার নাম জিগ্যেস করলাম। উনি উওর দিলেন উধার নাম সানভী চৌধুরী।। আচ্ছা আমি আপনাকে কি বলে ডাকব? সানভী চৌধুরী বললেন তুমি আমাকে নাম ধরেই ডেকো। যেহেতু ইতিমধ্যে আমরা বন্ধু হয়েই গেছি। ওনি আমাকে জিগ্যেস করলেন তোমার মা বাবা কি করেন? আমি বললাম আমার মা বাবা নেই। জন্মের পর আমি আমার বাবা মা কে দেখিনি। ফুটপাতে বড় হয়েছি। ফেরি করেই দুটো পয়সা রোজগার করি। 50 মিনিট আগে * সানভী আমার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। সে আমাকে বললো এখন আর কোনো চিন্তা নেই। আমাকে বন্ধু বানাতে কোনো আপত্তি আছে তোমার? আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। বট গাছের নিচে বসে অনেক কথা বললাম সানভীর সাথে। সানভী বললো এখন থেকে আমরা এখানে প্রতিদিন একবার করে দেখা করব। আমি হ্যাঁ বলে চলে আসলাম। আজকে নিজেকে অনেক খুশি লাগছে এই ভেবে যে, একটা অবহেলিত জীবনে একজন বন্ধু ত পেলাম। গান গাইতে গাইতে সে স্থান ত্যাগ করলাম। আমার কাছে কোনো ফোন নেই। যার থাকার মত একটু জায়গা নেই তার আবার ফোন। তবে রাত হলেই কেন জানি সানভীর কথা অনেক মনে পড়ে। ইচ্ছে হয় সারারাত তার সাথে বসে গল্প করি। আবার নিমিষেই মনকে বুঝ দেই। সে থাকে সু-বিশাল অট্টালিকায় আমি থাকি ফুটপাতে। চাইলেই ত সব সম্ভব নয়। বিকাল বেলায় মন খারাপ করে বসে আছি। আজকে আকাশটা অনেক মেঘলা বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা আছে বোধহয়। বৃষ্টি আমার খুবই ভালো লাগে। আবার ভয় ও করে খুব। ভয়ের কারন এটাই যে, বৃষ্টি আসলে সে রাতের ঘুম আমার জন্য হারাম হয়ে যায়! °°°°°°°°°° যেটা ভেবেছিলাম তাই হলো। সন্ধ্যা নামতেই আকাশ ফেটে বৃষ্টি শুরু হলো। তড়িঘড়ি করে কোনো একটা ছাউনির নিচে আশ্রয় নিলাম। তবুও ভিজে যাচ্ছি। আজ সানভীর সাথে দেখা হয় নি। খুব মন খারাপ হচ্ছিলো তার জন্য। বৃষ্টিতে ভিজে কাপা কাপা অবস্থা আমার। হঠাৎই পেছন থেকে কে যেন আমার উপর ছাতা দরলো। --আরে সানভী চৌধুরী আপনি? --কেন আসতে পারিনা। --তা বলছিনা কিন্তু আপনি এই গরিবের ঠিকানা কই পেলেন। --সানভী উওর দিলো চেষ্টা করলে সবই সম্ভব। আচ্ছা চলো বৃষ্টি থেমে গেছে। আমরা কোথাও গিয়ে বসি। দুজনে একটা নির্জন জায়গায় এসে বসলাম। বৃষ্টি থামার পর পরই আকাশে তাঁরার ঝিকিমিকি লক্ষ্য করলাম। সানভী তার নিজের প্যাকেট থেকে টিস্যু ভের করে আমার গা মুছে দিলো। আমার জন্য রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে এসেছে সে! সানভী নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে দিলো।। অর্ধেক খাওয়া শেষ করতেই চোখ ভেয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ছিলো আমার। সানভী বললো আরে পাগলা কাদছো কেন? আমরা ত বন্ধু তাই না। আমি বললাম আপনার মত যদি সবাই হতো তাহলে আমাদের মত ফুটপাতের মানুষরা একটু হলেও সস্তির নিঃস্বাশ নিয়ে মরতে পারতো। সানভী বললো নিজেকে ছোট মনে করবেনা। একদিন তুমিও অনেক বড় কিছু হবে।। আচ্ছা আমি এখন যাই। আর শুনো কালকে কিন্তু ফেরি করতে যেয়োনা। তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব। আমি আচ্ছা বলে সায় দিলাম।। আমার মনে পড়ছেনা ঠিক ফেরি করা ছাড়া আমি জীবনে কোনদিন ঘুরতে গিয়েছিলাম। যাইহোক নিজের কাছে রাখা ত্যানা খানা পরেই সানভীর জন্য অপেক্ষা করছি। কিছুক্ষন পরেই সানভী তার মোটর গাড়ি নিয়ে আমার জন্য হাজির হলো। নীল পাঞ্জাবী তে অপরূপ লাগছে তাকে। যেন চোখ ফেরানো যায়না।। ও আমাকে নিয়ে প্রথমেই একটা শপিংমলে ডুকলো। আমার জন্য কিছু কাপড় কিনে নিজ হাতে আমাকে পড়িয়ে দিলো। আয়নায় তাকিয়ে নিজেই যেন নিজেকে চিনতে পারছিলাম না।। অনেক ঘুরাঘুরি করলাম। আনন্দে আনন্দে সারাটা বেলা কেটে গেলো।। আজকাল আমাকে আর ফেরি করতে হয় না। সানভী আমাকে ছোট খাটো একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ফুটপাতেও রাত কাটাতে হয় না। অনেক পরিবর্তন এসেছে আমার মাঝে। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবি কোথায় ছিলাম আর কোথায় আসলাম। সবই ত বিধাতার লিলাখেলা......!! আজকাল সানভীর সাথে ওতটা দেখা হচ্ছেনা। সেও দেখা করার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছে না................. বেশ কদিন এভাবেই কেটে গেলো তবুও সানভীর কোনো খুজঁ পেলাম না। বাধ্য হয়েই তার বাসার সামনে গেলাম। বাসার দারোয়ান কে সানভীর কথা জিগ্যেস করতেই ওনি বললো স্যার ত বেশ কদিন দরেই হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আমি পাগলের মত তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি সানভীর বাবা হাসপাতালের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে খুব কান্না করছে। ডাক্তার কে জিগ্যেস করতেই ওনি সানভীর ক্যাবিন টা আমাকে হাত দিয়ে ইশারায় দেখিয়ে দিলেন। দুটু হাত দুদিকে মেলে আছে। আমার বুঝতে আর বাকি রইলো না যে সানভী আর বেঁচে নেই। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। চিৎকার করে বললাম শেষ বারের মত একটি বার তোমাকে দেখতে পারলাম না।। এভাবে কেন ছেড়ে চলে গেলে? সানভীর বাবা এসে আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিলেন। তাতে লেখা আছে: কাশেম! যেদিন আমার বাবা তোমাকে চড় মেরেছিলো আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো জানো। তারপর তোমাকে খুজে বের করেছিলাম। জানো কাশেম সবাই অবহেলিত! কেউ ভাত কাপড়ের আর কেউ একজনের ভালোবাসার। আমার ব্রেইন টিউমার ছিলো। তোমাকে কখনো বলা হয় নি। অনেক ভালো থেকো কাশেম। এই সানভীকে মনে রেখো!! আমি চিৎকার করে কাঁদতে যেয়েও কাদতে পারছিলাম না। কেমন যেন সব কিছু গুলিয়ে আসছিলো। আজ সানভীর মৃত্যুর দুই মাস পার হয়ে গেলো। ইট পাথরে ঘেরা শহরে নিজেকে আজকাল খুব একা লাগে..... মনের ভেতরে সানভীর জন্য তৈরি হওয়া সুপ্ত ভালোবাসা টা আর প্রকাশ পেলোনা...... তবে সানভী বেঁচে থাকতে আমার স্মৃতিতে।

0 comments

Comments


Enjoy
Free
E-Books
on
Just Another Bangladeshi
By
Famous Writers, Scientists, and Philosophers 
click here.gif
click here.gif

Click Here to Get  E-Books

lgbt-bangladesh.png
bottom of page