Just Another Bangladeshi

Apr 15, 20183 min

সেই পুরানা চশমা, চিকিৎসকরা কী ক্রীতদাস?

প্রথম আলোতে বিশ্বজিৎ চৌধুরী চট্টগ্রাম চিকিৎসক হেনস্থার একটা সাম্প্রতিক ঘটনায় প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসকেরা আইনের ঊর্ধ্বে কিনা? চট্টগ্রামের সার্জন ডাঃ সুরমান আলীকে অপারেশনের সময় সুঁই রেখে দেয়ার অভিযোগে আদালত তাকে জামিন না দিয়ে জেলহাজতে চালান দেয়, ডাঃ সুরমান কে এরপর হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ জেলে নিয়ে যায়। চট্টগ্রামের চিকিৎসকরা এই ঘটনার প্রতিবাদে প্রাইভেট প্রাকটিস স্থগিত করেছিলেন। অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত চিকিৎসকদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন প্রাইভেট প্রাকটিস স্থগিত করা আইন বহির্ভূত।

একজন চিকিৎসকের ভুল হতেই পারে, পেশাগত দায়িত্বে অবহেলা হতেই পারে, তিনি ফেরেস্তা নন। তার জন্য অভিযোগ করা যেতেই পারে। অভিযোগ প্রমাণ হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের শাস্তি বা জরিমানা হবে। আমরাও চাই জনগণ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করুক এবং আদালতে এর মীমাংসা হোক। ডাঃ সুরমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচার হোক, এবং যদি কেউ ক্ষতির স্বীকার হয়ে থাকেন তবে তিনি যথার্থ ক্ষতিপূরণ পান সেই বিষয়ে সেটা সচেতন যেকোন মানুষ মেনে নেবে। বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবা বিশ্বমানের নয়। কিছু কিছু চিকিৎসকের দায়িত্ব বা কর্তব্যে অবহেলা আমাদের লজ্জিত ও ব্যথিতই করে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সমাজের সর্বব্যাপী নৈতিক অবক্ষয় যে চিকিৎসক সম্প্রদায়কে স্পর্শ করবে না এমন হতে পারে না। কিন্তু ডাঃ সুরমান কী যথার্থ আচরণ পেয়েছে? তার লিগ্যাল রাইট কী রক্ষিত হয়েছে? আমাদের মত জড়বৎ সমাজে কেউ প্রশ্ন করে না, সবাই মেনে নেয়। আমরা মেনে নেই বলেই, অসংখ্য সামাজিক-রাজনৈতিক আর মানবিক বিপর্যয়ের অধিকাংশ সময়ে কোন মন্তব্য না করতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

ডাঃ সুরমানের বিরুদ্ধে অভিযোগটি যদি সত্য বলে আদালতে প্রমাণিতও হয় তবে এটা ক্রিমিনাল অফেন্স নয় এটা হয় মেডিক্যাল নেগ্লিজেন্স অথবা ক্লিনিক্যাল এরর। কিন্তু কোন যুক্তিতে তাকে হাতকড়া পরানোর মত অপমানজনক ঘটনার শিকার হতে হোল? হাতকড়া পরানোর সুনির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক নীতিমালা আছে। সে নীতিমালায় বলা আছে, “ দ্যা ইউজ অব হান্ডকাফস ইজ আমাউন্টস টু সাচ অ্যান আসাল্ট অ্যান্ড ইজ আন ল ফুল আনলেস ইট ক্যান বি জাস্টিফাইড। এই জাস্টিফিকেসন টা কীভাবে আসবে? আসবে লিগ্যাল গ্রাউন্ড এবং অবজেক্টিভ কন্ডিশন থেকে। অবজেক্টিভ কন্ডিশনটাও বলে দেয়া আছে, সেটা হতে হবে রিজনেবল, নেসেসারি এবং প্রোপোরশনেট। যদি অভিযুক্তের শক্তি প্রয়গে পালাবার বা পলায়ন চেষ্টার সম্ভাবনা থাকে, যদি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ গুরুতর হয় যেমন হত্যা, সহিংসতা, সহিংস আচরণের ইতিহাস ইত্যাদি। পুলিশ বাহিনী কী সুরমান কে হাতকড়া পরানোটা জাস্টিফাই করতে পারবে? এটাকে রিজনেবল, নেসেসারি এবং প্রোপোরশনেট বলে প্রমাণ করতে পারবে?
 
আদালত অভিযোগটি আমলে নিয়েছে কোন প্রমাণের ভিত্তিতে? প্রমাণ হচ্ছে কোলকাতার একজন চিকিৎসকের সার্টিফিকেট। চিকিৎসকটি যদি বাংলাদেশের ও হতো তাহলে সার্টিফিকেটটি আমলে নেয়ার আগেও কী সেই সার্টিফিকেট টেস্টিফাই করানোটা যুক্তিযুক্ত ছিলনা? বিশেষ করে সেই অভিযোগে যেই অভিযোগ এতই গুরুতর যে অভিযুক্তকে জেল হাজতে যখন পাঠানোর প্রয়োজন হয়। প্রথম শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে সুরমানকে গ্রেফতারের আগে প্রয়োজনীয় অনুমতি কী নেয়া হয়েছিলো?

পাশাপাশি এর প্রতিবাদে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্রাকটিস স্থগিতের বিষয়টিতে শ্রদ্ধেয় আইনজ্ঞ রানা দাশগুপ্ত আইনসিদ্ধতা দেখতে পাননি । গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বক্তব্য সকলেই গুরুত্ব দেন। কিন্তু এই বক্তব্যটি বিস্মিত করার মতো। তিনি এমন বিস্মিত হবার মত মন্তব্য কেন করলেন সেটা আমার কাছে অস্পষ্ট। চট্টগ্রামের চিকিৎসকরা তাঁদের কর্মস্থলে কাজ করছিলেন ঠিকই। রানা দাশগুপ্তের ওপর পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, কোন চিকিৎসক প্রাইভেট প্রাকটিস করতে বাধ্য নন। নিজস্ব সময়ে পরিবারকে এবং নিজেকে বঞ্চিত করে একটু অতিরিক্ত উপার্জনের জন্য যে প্রাণপাত পরিশ্রম করেন চিকিৎসকরা; সেই অতিরিক্ত উপার্জন না করার জন্য নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার চিকিৎসকদের আছে।

দায়িত্ব অবহেলার জন্য আদালতে শুধুমাত্র একটি পেশাকে শাস্তি দেয়ার নজির বাংলাদেশে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে হার্ভার্ড এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে আমেরিকাতে অধিকাংশ ডাক্তারই তাঁর পেশাগত জীবনে ম্যালপ্রাকটিস অথবা কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে আদালতের মুখোমুখি হন। প্রত্যেক বছর ৭ শতাংশের বেশী ডাক্তারম্যাল প্রাকটিসের অভিযোগে অভিযুক্ত হন।

একটা প্রশ্ন আসতেই পারে, বাংলাদেশের হাজারো লাঞ্ছনার মধ্যে একজন রোগীর ক্লিনিক্যাল এরর কী প্রধান সমস্যা? অবশ্যই নয়। তবে ডাঃ সুরমান একটা সহজ টার্গেট। বদ মেজাজি গৃহাকর্ত্রী যেমন গৃহকর্মীকে কখনো কখনো গরম খুন্তির ছ্যাকা দেন তেমনি ডাক্তারকে চাইলে মারধর করা যায়, পিটিয়ে জখম করা যায়, অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়া যায়, ইচ্ছেমত গালি, কর্মস্থলে খুন করে ফেলে রাখা যায়, হাতকড়া পরিয়ে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়া যায়। বাঙালি মধ্যবিত্তের সকল লাঞ্ছনা আর বঞ্চনার ক্ষোভ গিয়ে পড়ে মোটা চশমার নিরীহ গোবেচারা ডাক্তারের ওপর– যে ছেলেটা বা মেয়েটা স্কুল কলেজের সেরা ছাত্র ছিল, ছয় বছরের গ্রাজুয়েশন, চার বছরের ট্রেনিং (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিনা বেতনে) তারপর সৎ জীবনযাপনের চেষ্টা করতে থাকা একজন “মানুষের” পরিচিতি মানুষের কাছে দিনে দিনে বদলে হয়ে উঠতে থাকে “অমানুষ-কসাই”। শুধু বাংলাদেশের ডাক্তাররা। বিদেশী ডাক্তাররা পরিত্রাতা।

কর্পোরেটের দাপটে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আজকে বাংলাদেশে চিকিৎসক এক প্রান্তিক খেলোয়াড়, যার অর্থ নেই, ব্যাক্তিগত জীবন নেই, প্রতিষ্ঠা নেই, সন্মান নেই আছে শুধু চিৎকার করে ‘না” বলার অধিকার সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নিতে হবে, চিকিৎসক বলতে পারবে না, “ আমি এই অসন্মানের প্রতিকার চাই, বলতে পারবে না, আমার আইনি সুরক্ষা চাই, বলতে পারবে না, এই চিকিৎসার বাজার বাণিজ্যের উপকরন হতে পারবে না। বলতে পারবে না, কারণ চিকিৎসককে আজকে ক্রীতদাস মনে করা হয়। মনে করা হয় কয়েকশো টাকার ফি নিয়ে অহোরাত্র সেবা দিয়ে যেতে আমি বাধ্য। সকালে আট ঘণ্টা কাজ করে, নিজের জীবনী শক্তিকে নিঃশেষ করে আরো অতিরিক্ত পরিশ্রম না করলে তাই সবার সমালোচনার চাবুক আমার প্রাপ্য। এই জীবন ক্রিতদাসের চাইতে আর বেশী কী?

একটা বিশাল চক্রান্ত চলছে। খেয়াল করলে দেখবেন বিপুল ব্যয়ের কর্পোরেট হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই, অভিযোগ নেই বিদেশের ডাক্তারদের বিরুদ্ধেও। যত অভিযোগ সব পুওর মেনস ডক্টরদের বিরুদ্ধে যারা এখনো কর্পোরেটের বাইরে। এই অবশিষ্ট অভিমন্যুর দল পরাজিত হলেই শুরু হবে কর্পোরেট আর বিদেশী হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা শোষণ। ততদিনে গ্রাম থেকে উঠে আসা সুরমানরা পরাজিত আর লাঞ্ছিত হতে হতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

    1