Just Another Bangladeshi

Jun 10, 20184 min

মধুময় স্মৃতিগুলো

আমার এক ফুপাতো ভাই ছিলেন, উনি এক বিদেশি ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ওনার পোস্টিং ছিল ঢাকার বাইরে, অফিসের কাজে ঢাকায় এলে উনি আমাদের বাসায় থাকতেন, উনি এলে আমাদের আনন্দের বন্যা বয়ে যেতো। কাজ থেকে ফেরার সময় উনি আমাদের জন্য কেক বিস্কুট নিয়ে আসতেন। সন্ধ্যার পর উনি বারান্দায় বসে আব্বার সাথে সুখ দুঃখের আলাপ করতেন, ওই সময় যতগুলো ফেরিওয়ালা আসতো, যেমন হটপেটিস, বাদাম বুট, মিষ্টি বাখরখানি, ফুচকা চটপটি ইত্যাদি সবই তিনি একে একে আমাদের কিনে দিতেন। যাবার সময় আমাদের সবার হাতেই পাচ-দশ টাকা করে দিয়ে যেতেন। এই পাচ-দশ টাকা যে সেইসময় কত বড় ব্যাপার ছিল তা বলে বুঝানো যাবে না। এই টাকায় আমাদের পুরো একটা মাস চলে যেত, সখ আবদার পূরনের জন্য আর কারো কাছে হাত পাততে হতো না। তখন এক আনায় একটা আইসক্রিম পাওয়া যেত আর কাগজে মোড়া দুধের আইসক্রিমের দাম ছিল চার আনা। শীতে আবার দাম কমে অর্ধেক হয়ে যেত কিম্বা আইসক্রিমের বাক্সের উপর চাকতি বসিয়ে কাটা ঘুড়িয়ে লটারির মাধ্যমে ভাগ্য নির্ধারণ করা হতো, এতে আমাদের মতন বাচ্চাদের আইসক্রিম কেনার হিড়িক পড়ে যেত। শুধু আইসক্রিম না, মুদি দোকানের সন্দেশ বা বড়ই এর আচার পাওয়া যেত এক আনায় চারটি, এক আনার বাদাম বা বুট কিনলে দুইজন ভালো ভাবেই খাওয়া যেত, এক প্লেট ফুচকার দাম ছিল চার আনা।
 
এখন অনেকেই আনা হিসাবের সাথে পরিচিত নয়। ছয় পাই এ হতো এক আনা, এর পর চার আনা, আট আনা এবং এক টাকা। ওজনের হিসাবে ছিল মণ, সের, পোয়া, ছটাক, তোলা, আনি, লতি ইত্যাদি। ৪ তোলায় ১ ছটাক, ৪ ছটাকে ১ পোয়া এবং ৪ পোয়ায় ১ সের, ৪০ সেরে ১ মণ। আনি আর লতিটা সাধারণত ব্যবহার করা হতো না, এটা শুধুমাত্র সোনা রুপার কারবারিরাই ব্যবহার করতো।
 
এর পর চলে আসলো আধুনিক বা ম্যাট্রিক পদ্ধতি, এখানে পাই হয়ে গেল পয়সা, ১ পয়সা, ৫ পয়সা, ১০ পয়সা, ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সা এবং ১ টাকা। ২৫ পয়সাকে আমরা ৪ আনা এবং ৫০ পয়সাকে ৮ আনা বলতাম। এখন সমস্যা দেখা দিল ৬ পয়সাকে আমরা ১ আনা বলি তাহলে তো ২৪ পয়সায় ৪ আনা হয় আবার ৪ টা চার আনায় যদি ১ টাকা হয় তবে তো ৯৬ পয়সায় ১ টাকা হয়। যাইহোক আস্তে আস্তে পাই এর হিসাবটা বিলুপ্ত হয়ে ১০০ পয়সায় ১ টাকা হলো। মণ, সের, ছটাক থেকে যখন গ্রাম, কিলোগ্রাম এর প্রচলন শুরু হলো তখন প্রথমেই পুরনো কাগজ ক্রেতা ফেরিওয়ালারা এর প্রচলন চালু করে। এদের কারো কাছেই আর সেরের বাটখারা পাওয়া যেত না, সবাই কেজির বাটখারা ব্যবহার শুরু করলো। কিনে কেজিতে আর বেচে সেরে, আহা লাভে লাভ।

আমাদের বাসায় কাচের কোন জিনিস ভাঙলে আম্মার মন খুব খারাপ হয়ে যেত। আম্মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আমরাও মন খারাপের ভান করতাম, আসলে মনে মনে খুশিই হতাম। আম্মা চলে যাওয়ার পর আমরা সেটাকে নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে আসতাম। যে ওটাকে প্রথমেই নিতে পারতো সেই ওটার মালিক হয়ে যেত, পরদিন সকালেই ওটা দিয়ে কটকটি খাওয়া হতো। হ্যাঁ, কটকটি হচ্ছে গুড়কে জাল দিয়ে শক্ত করা এক প্রকার খাদ্য, ভাঙা জিনিসপত্র দিয়েই ওটা নিতে হতো, দোকানে কিনতে পাওয়া যেত না। ছোট বেলায় আমরা কত কিছুই না খেয়েছি, মাছের বরফকে কাঠ চাছার যন্ত্র দিয়ে চেছে একটা ছাচের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন আকৃতি দেওয়া হতো, তারপর ওটার উপর লাল, নীল, হলুদ ইত্যাদির তরল রঙ আর সেকারিন মিশিয়ে আমাদের পরিবেশন করা হতো। কি মজা করেই না আমরা এগুলো খেতাম। হজমি ওয়ালা আসতো সাইকেলে চড়ে, সাইকেলের পিছনে একটা ছোট বাক্সে ছোট ছোট অনেক ডিব্বা থাকতো, প্রত্যেকটা ডিব্বা থেকে অল্প অল্প করে সব কিছুই নিয়ে তৈরি করতো মজাদার হজমি। খাওয়ার পর জিহবাটা কালো হয়ে থাকতো দুই-এক দিন। বাসায় এসে বকা শুনতে হতো। চানাচুরওয়ালাটা রংবেরঙের কাপড় পড়তো, পায়ে অনেক গুলো নুপুর পড়তো, একটা মোটা বাশকে বিভিন্ন রঙে রঙিন করে তার মধ্যেও নুপুর লাগাত, এরপর শুধু ওটা দিয়ে শব্দ করলেই হতো, কাস্টমারের অভাব হতো না, সব বাচ্চারাই কেনার জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দিত। এখনকার বাচ্চারা আর এইসব খাবার খায় না, এমনকি তারা এসবের নামও শুনে নাই। ওরা খায় বার্গার, পিজ্জা, ডোনাট ইত্যাদি, আর আমরা ছোট বেলায় এসব খাওয়া তো দূরের কথা আমরা এসবের নামও শুনিনি। আমি জীবনে প্রথম বার্গার খাই কলেজ জীবনে।

ছোট বেলায় আমাদের সিনেমা দেখতে আর হলে যেতে হতো না, পুরো হলটাই মাথায় করে নিয়ে আসতো, আমরা শুধু চোখ লাগিয়ে দেখতাম। রহিম বাদশা আর রুববান এর কাহিনী, সাতভাই আর চম্পার কাহিনী, শৌরানী আর দৌরানী কাহিনী। স্থির চিত্রের সাথে সুর আর ছন্দের সংমিশ্রণে অপূর্ব বর্ণনায় আমরাও হারিয়ে যেতাম সেই গল্পের সাথে।

রিকশার গ্যারেজ থেকে ফেলে দেওয়া পুরনো টায়ার আমরা দুই-চার টাকা দিয়ে কিনে নিতাম, তারপর ওটাকে ধুয়ে মুছে চকচকে করে গাড়ি বানাতাম। পাড়ার সবারই এইরকম একটা করে গাড়ি থাকতো, দল বেধে একটা ছোট লাঠি দিয়ে ওটাকে চালাতাম। গাড়ি চালানোর আনন্দই পেতাম। অভিজ্ঞরা অনেক সামনে চলে যেত, আমরা পিছনে পড়ে থাকতাম। আমাদের মধ্যে আবার প্রতিযোগিতা হতো। যা'রা একটু বড়লোক ছিল তারা টায়ার এর পরিবর্তে স্টিল এর রিং কে গাড়ি বানাতো, তাদেরকে আমরা একটু বেশি দাম দিতাম। মাঝে মাঝে অনেক অনুরোধ করে তাদের গাড়ি চালাতাম।

ছোট বেলায় অনেক জঙ্গলে কচু পাওয়া যেত, যার তরকারি খেলে গলা ধরতো, এখন আর এই ধরনের কচু পাওয়া যায় না। আমাদের বাসায় একটা কথা চালু ছিল, যারা ঝগড়াটে তাদের কচু খেলে গলা ধরে। তাই কচু খাওয়ার পর যদি আমাদের গলা ধরতো তবে আমরা কেউই তা শিকার করতাম না। কষ্টে ছটফট করতাম, লুকিয়ে তেতুল খেতাম, তারপরও বলতাম না। বাড়িতে সবার নামেই একটা করে মুরগী পালা হতো, যারটা আগে ডিম দিত সে খুব গর্ববোধ করতো, প্রথম ডিমটা তাকেই খেতে দেওয়া হতো। পাড়াপ্রতিবেশি কেউ বাসায় বেড়াতে আসলে কখনোই খালি মুখে যেতে দেওয়া হতো না, এক গ্লাস শরবত বা সুজির হালুয়া হলেও খাওয়ানো হতো। হটাৎ করে যদি কোন আত্নীয় -স্বজন চলে আসতো তবুও পোলাও রান্না করা হতো, খোপ থেকে মুরগী বারকরা হতো। আমরা কেউই তার নিজের মুরগী জবাই করতে চাইতাম না, আম্মা অনেক বুঝিয়েই বা আমাদের টাকা দিয়েই তবেই মুরগী জবাই করতে পারতেন। কাচের প্লেট বারকরা হতো, প্লেটের টুংটাং শব্দ হতো আর আমাদের জিভে জল আসতো। মেহমান চলে যাওয়ার পর যেটুকু হাড্ডিগুড্ডি থাকতো তাই আমরা খেতাম।

ঈদ ছিল সবচেয়ে আনন্দপূর্ণ এক মহা উৎসব, ঈদের দুই-এক দিন আগে বোনদের জন্য জামার কাপড় কেনা হতো। আম্মা সারারাত জেগে সেগুলো সেলাই করতেন, আপু আম্মাকে সাহায্য করতো। ছেলেদের জামা অবশ্য বাইরেই বানানো হতো, আমি কিছুক্ষণ পর পর খোঁজ নিতাম আমারটা বানানো হলো কিনা, শুরু হলে দৌড়ে বাসায় এসে খবর দিতাম আমারটা শুরু করেছে। ঈদের দিন পড়ার জন্য আমাদের সবারই ঈদের টুপি ছিল, সেটা ঈদের আগের রাতে বের করা হতো, ওটা শুধু বছরে দুই দিনই পড়া হতো, আম্মা ঈদের পর তা আবার তুলে রাখতেন। ওই টুপিকে জিন্নাহ টুপি বলা হতো, মখমলের তৈরি। টুপি বের করলেই আমাদের ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে যেত। ছোটবেলার ঈদের ছিটাফোঁটা আনন্দও এখন আর পাই না।
 
আনন্দঘন শিশুকাল আর কখনোই ফিরে আসবে না, তবে চিরকাল রয়ে যাবে তার মধুময় স্মৃতিগুলো।

    5