Just Another Bangladeshi

Nov 5, 20174 min

বাংলাদেশে শাসকদের সংকট কী?

স্বাধীনতার পর থেকেই বহুমুখী রাজনৈতিক সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ। ’৯০-এর ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের পর একটা প্রগতিশীল রূপান্তরের সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও সংকট আরো গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। এই সংকটের সৃষ্টি সম্পর্কে নানা ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে, সেই সংকট থেকে উত্তরণের রাস্তাও অনেকে খুঁজছেন, কিন্তু সংকটের প্রকৃত প্রকৃতি না বুঝতে পারলে যেটাই করা হোক না কেন, সংকট কাটবে না।

কোনো একটি দেশের বা জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিতে গেলে দু’টি জিনিসের দরকার হয়।

১। লেজিটিমেসি বা বৈধতা। যেটা আমরা ভোটের মাধ্যমে নিশ্চিত করি;

২। হেজিমনি।

হেজিমনির অর্থ হচ্ছে, সমাজের উপর বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক নেতৃত্ব। এই হেজিমনি রূপায়িত হয় কোনো আদর্শবাদ দিয়ে। এই আদর্শবাদ ডমিন্যান্ট বা প্রমিনেন্ট ক্লাসের ইন্টারেস্টকে একটা সার্বজনীন রূপ দেয়; পাশাপাশি আপাতদৃষ্টিতে সাব-অর্ডিনেট ক্লাসের ইন্টারেস্টকেও প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।

কোনো সরকার লেজিটেমেট হতে পারে, বৈধ হতে পারে; কিন্তু সে তাঁর হেজিমনিক কন্ট্রোল মানে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা হারাতে পারে। যেমন, আমরা দেখি ১৯৯০-এর পর থেকে সকল নির্বাচিত সরকারের শেষ বছরগুলোতে। আবার কোনো সরকার ইল্লেজিটেমেট বা সাংবিধানিকভাবে অবৈধ হতে পারে কিন্তু সমাজে পর্যাপ্ত হেজিমনিক কন্ট্রোল থাকতে পারে; ঠিক যেটা ঘটেছে ২০০৭-২০০৮-এর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম কয়েকটা মাস।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের হেজিমনিক টুল ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলার জনগণের উপর পাকিস্তানি শোষণ। পাকিস্তানের শুরু থেকেই পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংঘাতই পরবর্তীতে ব্যাখ্যাত হয়েছে বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র হিসেবে। সাবল্ট্রান, মধ্যবর্তী এবং বর্ধিষ্ণু ধনিক শ্রেণি সকলের আকাঙ্ক্ষকে ধারণ করে এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং পাকিস্তানি উপনিবেশিক শোষণ মুক্তির লক্ষ্যের মধ্যেই এই ভূখণ্ডের সকল শ্রেণি সেই পাকিস্তানি উপনিবেশিক শোষণমুক্তির মধ্যে নিজের স্বপ্ন পূরণের আশা করেছে। সেটাই হয়ে উঠেছিল হেজিমনিক কন্ট্রোলের টুল।

আমাদের শাসকরা সব সময়েই হেজিমনিক কন্ট্রোলের সমস্যায় ভুগেছে। হেজিমনিক কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতায় রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে সমস্ত সংকট সৃষ্টি হয়েছে। কোনো শ্রেণিই তাঁর হেজিমনি তৈরি করতে পারে না যদি তাঁর আদর্শ তাঁর নিজস্ব শ্রেণির সীমানার বাইরে আবেদন রাখতে ব্যর্থ হয়। স্বাধীনতার পর থেকেই ধনিক শ্রেণিই সব সময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল, তাঁরা কখনো তাদের ক্ষুদ্র শ্রেণি-স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। এই লুম্পেন ধনিকদের লুটপাটের আদর্শই সুবিধাভোগী নাগরিক সমাজের আদর্শ হয়ে উঠেছে। এই লুটপাট আর দুর্নীতির আদর্শকে বৃহত্তর সমাজ কখনো গ্রহণ করেনি। সে কারণেই ওয়ান-ইলেভেনের সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সংকল্প নিয়ে যখন ক্ষমতায় আসলো, এবং কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিল, বৃহত্তর সমাজ মুহূর্তেই এক নতুন আশা নিয়ে তাঁর পেছনে দাঁড়ালো। সেই এক ঘোষণাই ওয়ান-ইলেভেনের সরকারকে কিছুদিনের জন্য হলেও হেজিমনিক কন্ট্রোল এনে দিল।

এই হেজিমনিক কন্ট্রোল হারালে বা হেজিমনিক রাপচার হলে সাংবিধানিক বৈধতা থাকলেও সেই সরকার সামাজিক কর্তৃত্ব হারায় এবং জনগণ সেই সরকারের কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করতে থাকে। গ্রামসি’র মতে দু’ভাবে এই হেজিমনিক রাপচার হতে পারে,

১। শাসকদল যদি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হয়। ওয়ান-ইলেভেনের সরকার এভাবেই হেজিমনিক কন্ট্রোল হারিয়েছিল। অথবা
 
২। জনগণের একটি বড় অংশ মূলত কৃষক এবং পেটি বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা থেকে কিছু মাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে।

গ্রামসি আরো বলেন, এই হেজিমনিক রাপচার বা হেজিমনিক ক্রাইসিসের পরিণতি দু’ধরনের হতে পারে

১। মধ্যবর্তী, যেখানে রাজনীতির মাঠ কোনো ধরনের সহিংস সমাধানের দিকে যেতে পারে, যেখানে ত্রাতার ভূমিকায় কোনা ‘ম্যান অব ডেস্টিনি’র নেতৃত্বে কোনো অজানা শক্তির উদ্ভব হতে পারে। অথবা
 
২। দীর্ঘমেয়াদে সমাজে নানা মরবিড সিমটম বা মৃত্যুকালীন উপসর্গ দেখা দেয়; কারণ, পুরনো আদর্শ মৃত কিন্তু নতুন আদর্শ এখনো জন্ম নিতে পারেনি। আমাদের সমাজে এবং রাষ্ট্রে নানা সময় আমরা মধ্যবর্তী পরিণতির উদাহরণ দেখেছি। আর এখন বর্তমান সংকট হচ্ছে সেই হেজিমনিক রাপচারের দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি, মরবিড সিমটম।

স্বাধীনতার পর আমাদের হেজিমনিক রাপচার কীভাবে হলো? মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হেজিমনিক টুল ‘পাকিস্তানি শোষণমুক্তি’ পাকিস্তানের পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে অপসৃত হলো। এর পর প্রয়োজন ছিল একটা নতুন হেজিমনিক টুল, নতুন ইকোনমিক এবং সোশ্যাল অর্ডার। আওয়ামী লীগের র‌্যাডিক্যাল অংশ মুক্তিযুদ্ধকে ‘অসমাপ্ত বিপ্লব’ আখ্যা দিয়ে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার ডাক দিল। এই ডাকে শেখ মুজিবের সাড়া না পাওয়ায় ১৯৭২-এর এপ্রিলে এই অংশ আওয়ামী লীগ ত্যাগ করলো। এর পর মে মাসে কৃষক লীগের র‌্যাডিক্যাল অংশ, জুনে শ্রমিক লীগের র‌্যাডিক্যাল অংশ আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে জাসদ গঠন করলো। বলাই বাহুল্য, জাসদের সকলেরই মুক্তিযুদ্ধে গৌরবজনক ভূমিকা ছিল। জাসদ শুধু আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেই ক্ষান্ত হলো না, তাঁরা শাসকদলের বিপরীতে নতুন আদর্শ হাজির করলো। তাঁরা বললো, উদীয়মান ধনিক শ্রেণি রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে শোষণমূলক সামাজিক স্ট্রাকচার তৈরি করেছে, একমাত্র সর্বহারার বিপ্লব এবং সমাজের সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরই একমাত্র শোষিত শ্রেণির জন্য স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে পারে। জাসদের আদর্শিক অবস্থানের অনেক স্ববিরোধীতা এবং দুর্বলতা সত্তে¡ও অল্প সময়েই এই নতুন দলটি দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একই সময়ে সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি আত্মগোপনে থাকা সত্তে¡ও গ্রামীণ অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। বিকল্প হেজিমনির উত্থানে শাসকদল পাল্টা আদর্শ তুলে ধরে, সেই আদর্শ ছিল ‘মুজিববাদ’। এই মুজিববাদের মূল উপাদানগুলো ছিল, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র। কিন্তু বাস্তবে প্রায়োগিক দিক থেকে মুজিববাদ নানা অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতির (এটা আরেকটা বিস্তারিত আলোচনা, আরেকটা লেখায় পূর্ণাঙ্গ আলোচনার ইচ্ছা রইল) জন্ম দিতে থাকায় হেজিমনিক হয়ে উঠতে পারেনি। পাশাপাশি পাল্টা র‌্যাডিক্যাল বাম হেজিমনির উত্থানে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, শাসকশ্রেণির হেজিমনিক কন্ট্রোল রাপচার হয়েছে।

মুজিব সরকারের পর জিয়া সরকার পাল্টা হেজিমনি তৈরির জন্য ধর্ম, ভূখণ্ড ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, জাতীয় সুরক্ষা (মূলত ভারতের কাছে থেকে) তাঁর আদর্শের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। যেহেতু ধর্মের একটি সার্বজনীন আবেদন থাকে, তাই হেজিমনিক টুল হিসেবে ধর্মের ব্যবহার শাসকদলের কাছে একটা জনপ্রিয় এবং কার্যকর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হলো। যখনই শাসক হেজিমনির সংকটে পড়েছে, তখন আশ্রয় খুঁজেছে ধর্মের কাছে। ধর্মের হেজিমনির বলে বলিয়ান হয়ে তাদের শাসন এবং শোষণ অব্যাহত রেখেছে। এই কাজ করতে গিয়ে নানা সময় নানা ধর্মীয় দল, উপদলকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছে। এভাবেই ধর্মীয় রাজনীতি বাংলাদেশের পলিটিক্যাল ডিসকোর্সে ক্রমাগত বৃহত্তর স্থান দখল করেছে এবং শক্তি সঞ্চয় করেছে। এই পাকচক্র এখনো চলছে।

৯০-এর পর থেকে এক শাসকদল নানা অঙ্গীকারে ভোটের মাধ্যমে লেজিটিমেসি পেয়ে সরকার গঠন করে কিন্তু হেজিমনিক কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। বাস্তবিক অর্থে হেজিমনি প্রতিষ্ঠিত করার কোনো পদক্ষেপও তাঁরা কখনো নেয়নি। একই ভুল তাঁরা বারবার করেছে। হয় তাঁরা এর প্রয়োজনীয়তাকে বুঝতে পারেনি অথবা তারা ধর্মকে ব্যবহার করে সাময়িক সমাধানের সহজ পথে সব সময় চলতে চেয়েছে। এই সমস্যার চাপ বাড়তে বাড়তে এখন মধ্যবর্তী আর দীর্ঘমেয়াদী সকল সমস্যা একসাথে মাথা তুলেছে। পুরনো ব্যবস্থা মৃত, নতুন সোশ্যাল এবং ইকোনমিক অর্ডার এখনো ভূমিষ্ঠ হয়নি। আর সেটা না হলে কোনো সংকটই কাটবে না।

    4