Just Another Bangladeshi
Feb 14, 20184 min
অনেকদিন পরে ঘর ঘুছানোর কাজে হাত দিয়েছি। ইমরান ভাইয়ের ঘর। খুবই অগোছালো ধরনের একটি ছেলে। নিজেরও কোনো যত্ন নেই ,ঘরেরও নেই। মেয়েদের ঘর গুছাতে ভালো লাগে,আর ছেলেদের ভালো লাগে ঘর আউলাতে। ইমরান ভাইয়েরও ঘর আউলাতে ভীষণ ভালো লাগে। ঘরের মাঝের খাট, এক পাশের কাপড়ের আলনা, জানালার পাশের টেবিল-চেয়ার সবই সে আউলিয়ে রাখে।ঘুমুতে গেলেই খাটের চাদর- টাদর টেনে গুছিয়ে ফেলে, আর বাইরে থেকে ঘরে ফিরলেই গায়ের সার্ট-প্যান্ট খুলে ছুড়ে ফেলে এদিক-সেদিক। একদম বাজে স্বভাবের ছেলে।
বুড়ি মা আর বুড়ো বাবা তো সারাক্ষন আর ঘর গুছিয়ে রাখতে পারে না। যারা নিজেদের যত্নই ভালো করে নিতে পারে না,ঘরের যত্ন নিবে কি করে ?
আমি হচ্ছি এই বাড়ির বিনা পয়সার চাকর। সারাদিন ঘর-টর আউলিয়ে গেলে সেগুলো গুছানোর দায়িত্ব আমার। বুড়ি মা যদি রান্না করতে গিয়ে অস্থির হয়ে পড়ে তবে রান্না শেষ করার দায়িত্বও আমার। মহারাজ বিয়ে-টিয়ে করবেন না। তিনি শুধু একটা কাজই করতে পারেন। শার্ট-প্যান্ট খুলে এদিক-সেদিক ছুড়ে ফেলার কাজ। কি ভয়ানক বিশ্রী ঘামের গন্ধযুক্ত সার্ট। নাকের কাছে নিলেই অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো অবস্থা হয়। ঘরের দেয়ালে মহারাজের একখানা বাদুড়মুখো ছবি টানানো। দাঁতগুলো বের করে ভেঙ্চি দিয়ে রয়েছে। দেখলেই মনে চায় এক ঘুষি দিয়ে নাকটাকে ভোতা করে দেই।
শুভ দিনে ঘর বাড়ি গুছাতে হয়। আজ ইমরান ভাইয়ের জন্মদিন। শুভ দিন। তাই ঘর-বাড়ি গুছিয়ে রাখছি। বাইরে বুড়ি মা পায়েস রান্না করছেন। ছেলের প্রিয় খাবার পায়েস। শুভ দিনে মানুষকে তার প্রিয় খাবার খাওয়াতে হয়।
খবর শুনেছিস খোকা?
(বুড়িমা রান্না রেখেই খবর বলতে ছুটে এসেছেন।)
কি খবর?
তুলি এসেছে।
তুলির কথা শুনতেই আমি কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হতে চাচ্ছিলোনা। বুড়ি মা থেমে আবারো বললেন, তুলির একটা ছেলে হয়েছে!
বুড়িমায়ের চোখে এইবার দেখা গেল জল। আমি বললাম, ছিঃ মা, কাঁদেন কেন?
বুড়িমা সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, না কাঁদি না তো; পায়েস হয়ে গেছে তুই খাবি একটু?
আমি দেখলাম বুড়িমার চোখ ছাপিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। মায়েরা বড় দুঃখ পুষে রাখে।
পাঁচবছর আগের তুলি আপাকে ভেবে আজ কি আর কাঁদতে আছে? হাত হাত-পা ধুতে বাইরে এসে দেখি ফুটফুটে সূর্যের আলো নেমেছে। চারদিকে কী চমৎকার আলো। উঠোনের বেলি ফুল গুলো আলোয় আলোয় ঝকমক করে সুবাস ছড়াচ্ছে। কতদিনের চেনা ঘরবাড়ি কেমন অচেনা লাগছে আজ।
বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন ইমরান ভাইয়ের অন্ধ বাবা। তার পাশে একটি শূন্য টুল। রান্না ঘরের সমস্ত কাজ সেরে বুড়িমা এসে বসলেন সেখানে। ফিসফিস করে কিছু কথা হবে। দুজনেই তাকিয়ে থাকবেন বাইরে। একজন দেখবেন উথাল-পাথাল জোছনা, অন্যজন অন্ধকার।
ইমরানের বাবা মৃদু স্বরে ডাকলেন, খোকা, ও খোকা!
আমি তাঁর কাছে এগিয়ে গেলাম। তিনি তাঁর অন্ধ চোখে তাকালেন আমার দিকে। অস্পষ্ট স্বরে বললেন, তুলি এসেছে শুনেছিস?
শুনেছি।
আচ্ছা যা।
আমরা খুব দুঃখ পুষে রাখি। হঠাৎ-হঠাৎ এক-একদিন আমাদের কত পুরনো কথা মনে পড়ে। বুকের ভেতর আচমকা ধাক্কা লাগে। চোখে জল এসে পড়ে। এমন কেন আমরা? এমন একটা শুভদিনে এইসব অমঙ্গলের কথা কি মনে করতে আছে।
দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখছি, বুড়িমা হাত ধুতে কলঘরে যাচ্ছেন। মাথার কাপড় ফেলে তিনি একবার আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর অনেক সময় নিয়ে অজু করলেন। একসময় এসে বসলেন শূন্য টুলটায়। ইমরানের বাবা ফিসফিস করে বললেন, খাওয়া হয়েছে তোমার?
হুঁ। তোমার বুকে তেল মালিশ করে দেব?
না।
তারপর দুজন নিঃশব্দে বসেই রইলেন, বসেই রইলেন। বেলি ফুলের চকচকানি ক্রমশ কমতে লাগলো। এত দূর থেকে বুঝতে পারছি না কিন্তু মনে হচ্ছে বুড়িমা কঁদছেন। তার বুড়ো স্বামী ভঁর শীর্ণ হাতে তার হাত ধরলেন। কফ-জমা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, কেঁদো না, কেঁদো না।
বুড়োবাবা তার বৃদ্ধা স্ত্রীকে আজ আবার আগের মতো ভালবাসুক। বুড়িমার আজ বড় ভালোবাসার প্রয়েজন। আমি তাঁদের ভালোবাসার সুযোগ দিয়ে নেমে পড়লাম রাস্তায়। বুড়িমা ব্যাকুল হয়ে ডাকলেন, বাড়ি যাস খোকা?
এই একটু হাঁটব রাস্তায়।
পায়েস খেয়ে যাস কিন্তু!
আচ্ছা।
রাস্তায় রুপার মতো সাদা ধুলো চিকমিক করে। আমি একা একা হাঁটি। মনে হয় কত যুগ আগে যেন অন্য কোনো জন্মে এমন জোছনা হয়েছিল। একদিন ইমরান ভাই আর আমি গিয়েছিলাম তুলি আপাদের বাসায়। আমার লাজুক ইমরান ভাই শিমুলগাছের আড়াল থেকে মৃদুস্বরে ডেকেছিলেন, তুলি,ও তুলি।
লণ্ঠন হাতে বেরিয়ে এসেছিলেন তুলির মা। হাসিমুখে বলছিলেন,
ওমা তুই? কবে এলি রে? কলেজ ছুটি হয়ে গেল?
ভালো আছেন খালা? তুলি ভালো আছে?
খবর পেয়ে তুলি হাওয়ার মতো ছুটে এসেছিল ঘরের বাইরে।
এক পলক তাকিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে বলেছিল, ইশ! কতদিন পর কলেজ ছুটি হল আপনার।
আমার মুখচোরা লাজুক দাদা ফিসফিসিয়ে বলছিলেন—তুলি, তুমি ভালো আছ?
হ্যাঁ। আপনি কেমন আছেন?
ভালো। তোমার জন্য গল্পের বই এনেছি তুলি।’
এসব কোন্ জন্মের কথা ভাবছি? হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে এসব কি সত্যিসত্যি কখনো ঘটেছিল?
তুলি আপার বাড়ির সামনে থমকে দাড়ালাম । খােলা উঠোনে চেয়ার পেতে তুলি আপা চুপচাপ বসে আছেন। পাশে একটি শূন্য চেয়ার। তুলি আপার বর হয়তো উঠে গেছেন একটু আগে। তুলি আপা আমাকে দেখে স্বাভাবিক গলায় বললেন, খোকা না?
হ্যাঁ।
উহ! কতদিন পর দেখা। বোস এই চেয়ারটায়।
আপনি ভালো আছেন তুলি আপা?
হ্যাঁ, আমার ছেলে দেখবি? বোস নিয়ে আসছি।
লাল জামা গায়ে উল-পুতুলের মতো একটি ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে করে ফিরে আসলেন তিনি।
দেখ, অবিকল আমার মতো হয়েছে। তাই না?
হ্যাঁ, কী নাম রেখেছেন ছেলের?
নীলয়। নামটা তোর পছন্দ হয়?
চমৎকার নাম।
অনেকক্ষণ বসে রইলাম আমি। একসময় তুলি আপা বললেন, বাড়ি যা খোকা। রাত হয়েছে।
বুড়োবাবা আর বুড়িমা তেমনি বসে আছেন। বাবার মাথা সামনে ঝুঁকে পড়েছে। তার সারা মাথায় দুধের মতো সাদা চুল। মা দেয়ালে ঠেস দিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরে। পায়ের শব্দে চমকে উঠে বাবা বললেন, খোকা ফিরলি?
জি।
তুলিদের বাসায় গিয়েছিলি?
হ্যাঁ।
অনেকক্ষণ আর কোনো কথা হল না। আমরা তিনজন চুপচাপ বসে রইলাম। বুড়ি মা ঘর থেকে পায়েস নিয়ে এলো।
নে পায়েস খা।
আমি পায়েসের বাটি হাতে নিলাম। এক চামচ পায়েস মুখে নিতেই চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো।চোখের কোণ বেয়ে টুপটাপ করে জল গড়াতে লাগলো।
এক সময় বাবা বললেন, তুলি কিছু বলেছে?
না।
বুড়িমার শরীর কেঁপে উঠল। একটি হাহাকারের মতো তীক্ষ্ণস্বরে তিনি ফুঁপিয়ে উঠলেন, আমার বড় খোকা। আমার বড় খোকা।
যেদিন তুলিকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো সেদিনই ইমরান ভাই এমন একটা কাজ করে ফেললেন যে কেউ ভাবতেও পারবে না। তাকে শহরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, কিন্তু সে আর জীবন্ত প্রাণ নিয়ে ফিরে আসেনি। মুখ ভর্তি সাদা সাদা ফ্যানা, চোখ দুটো খোলা অথচ বন্ধ। একটু আগেও তার সাথে কথা হয়েছিলো, হাতে-পায়ে ধরে অনেক কেদেছিলাম।
প্লিজ, ভাই। কোনো গন্ডগোল করিস না। যা হবার হয়ে যাক। আমি আছি তো, তুই আমাকে ভালোবাসিস। এত ভালোবাসার দরকার নাই, শুধু একটু বাসলেই হবে। প্লিজ, তুই নিজেকে সামলা।যদি মন দিতে না পারিস,দেহটা দিয়ে যা।
ইমরান ভাই তৃপ্ত চোখে চলে গেলো। বাড়িতে যেতেই শুনি সে বিষ খেয়েছে। আমার বাকরুদ্ধ হবার মতো অবস্থা। কাছে যেতেই দেখি তার মুখ ভর্তি ফ্যানা। তখোনো দম আছে, আমি তার হাতটি আকড়ে ধরলাম। কিছু হবে না তোর, আমি আছি তো!
ইমরান নিস্তেজ মুখে বললো, তুই আমার দেহ চাইলি না। তোরে দেহটা দিয়ে গেলাম।
ওই শয়তান। আমি কি তোর প্রাণছাড়া দেহ চাইছিলাম। আমি তো চাইছিলাম, তোর ওই বুকে মাথা গুজতে। তোর মৃতদেহ দিয়ে আমি কি করবো? তুই কেন করলি এমন!
রবি, মা-বাবাকে দেখে রাখিস। আর তুলি....
এনড্রিন খেয়ে মরা আমার অভিমানী ইমরান ভাইটা যে প্রগাঢ় ভালোবাসা পরী আপার জন্যে সঞ্চিত করে রেখেছিলেন তার সবটুকু দিয়ে বুড়োবাবা বুড়ি মাকে কাছে টানলেন। ঝুঁকে পড়ে চুমু খেলেন মার কুঞ্চিত কপালে। ফিসফিস করে বললেন, কাঁদে না, কাঁদে না।
ভালোবাসার সেই অপূর্ব দৃশ্যে আমার চোখে জল আসল। আকাশ ভরা জোছনার দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে বললুম–তুলি আপা, আজ তোমাকে ক্ষমা করেছি।
(আব্দুল্লাহ+ হুমায়ুন আহমেদ)