Just Another Bangladeshi

Sep 15, 20184 min

পুঁজিবাদের ফিলসফিক্যাল আন্ডারপিনিং (দার্শনিক ভিত্তি) কী?

কোন এক আলাপে এই শিরোনামের বাক্যটি উচ্চারণ করাতে একজন সাবেক বামপন্থী জানতে চেয়েছিলেন এর অর্থ কী? বাংলাদেশের বামপন্থীদের একাডেমিক শিক্ষা খুব গভীরে না পৌছানর কারণে তাঁদের চিন্তার খুব বেইসিক কিছু সমস্যা থেকেই যায়। এই বিষয়ে প্রথম হোঁচট খাই ফরহাদ মজহারের “ধর্ম ও আধুনিকতা” পড়বার পরে। তিনিই প্রথম এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক চিন্তার দুয়ার খুলে দেন। এর পরে ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট, ধর্ম দর্শন এবং মার্ক্সের পুনঃ পাঠে বিষয়টা আমার কাছে আরো পরিচ্ছন্ন রূপ নিয়ে হাজির হয়।

মার্ক্সের কাজ তো সমাজ আর অর্থনীতি নিয়ে, তবে উনি দার্শনিক হেগেলকে নিয়ে পড়লেন কেন? কেন হেগেলকে বাতিল করাটা এতো গুরুত্বপূর্ণ হল? তিনি কেনই বা হেগেলকে মাথার উপরে দাড়িয়ে থাকার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে গেলেন? পুঁজিবাদের দার্শনিক ভিত্তিতা বুঝতে হলে, এই জায়গাটা খুব ভালো করে অনুধাবন করা প্রয়োজন। পুঁজিবাদের দর্শনকে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে পরাস্ত না করলে পুঁজিবাদকে অতিক্রম করে পৌস্ট ক্যাপিটালিস্ট সোসাইটি বিনির্মাণ করা সম্ভব নয় এটা মার্ক্স খুব ভালো করেই বুঝেছিলেন, তাই হেগেলকে সোজা করে দেয়ার প্রয়োজন হয়েছিল মার্ক্সের।

পৃথিবীর সব ধর্মই মানুষকে প্রকৃতির অংশ বলে মনে করে। সেকারণেই প্রকৃতিতে প্রাচীন মানুষেরা ঈশ্বরত্ব আরোপ করতো। বাতাসেরও দেবতা থাকতো, পাথরকেও পুজা করতো। হেগেল প্রকৃতি থেকে মানুষের চৈতন্যকে আলাদা করেন এবং চৈতন্যকে একটি আলাদা বৈষয়িক ভিত্তি দেন। এখানেই আসে হেগেলের ভাব আর বস্তর চিন্তা, কোনটা আগে? হেগেল বলেছিলেন মানুষের চৈতন্য আগে প্রকৃতি জগতকে মানুষের চৈতন্যই ভিত্তি দেয়। ফয়েরবাখ বলেছিলেন ঠিক তার উল্টো।

হেগেলের লেকচারস অন দ্য ফিলসফি অব রিলিজিওনে ঠিক এই আলাপটাই তিনি করেছেন। আসুন, সেখান থেকে সারবস্তুকে আমরা দেখি, হেগেল আসলে কী বলতে চেয়েছিলেন?

“হেগেল বলেছেন, ঈশ্বরের মধ্যে মানুষের অস্তিত্বের শেকড় আর সত্তার পরিচয় নিহিত। বিশ্ব ইতিহাসের চালিকা শক্তি হচ্ছে ঈশ্বরের স্বভাব এবং মানুষের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার অর্থ ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈশ্বরের ঐশ্বরিক সত্তার জ্ঞান অর্জন। এই জ্ঞান অর্জনের প্রাথমিক প্রক্রিয়ায় ঈশ্বর কোন বিশেষ প্রাকৃতিক রূপের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়। এই প্রাকৃতিক রূপটি হচ্ছে যীশু। যীশু যেহেতু ঈশ্বরের পুত্র তাই তাঁর মধ্যে দিয়েই ঈশ্বরের রূপ প্রকাশিত। কিন্তু মানব স্বভাবের অন্তর্গত বিকাশের তাগিদে ঈশ্বরের এই প্রাকৃতিক রূপটি একসময় আর যথেষ্ট মনে হয়না। তাই ঈশ্বর এর পরবর্তী পর্যায়ে প্রাকৃতিক রূপ থেকে উত্তরন লাভ করে মানুষের সার্বজনীন স্পিরিট হিসেবে প্রকাশ লাভ করে। এই সার্বজনীন স্পিরিটে পৌঁছানো মানুষের, পৃথিবীর এবং সভ্যতার নিয়তি। ঈশ্বর ধারণাকে যীশু থেকে সকল মানবজাতির মধ্যে এই সার্বজনীন স্পিরিট হিসেবে পৌঁছে দেয়াই হেগেলের কৃতিত্ব। ঈশ্বর তার প্রাকৃতিক রূপ থেকে মুক্তি পেয়ে নিরাকার হয়ে চৈতন্যে অধিষ্ঠিত হলেন। সকল মানুষ ঈশ্বরের সন্তান কিন্তু সেই ঈশ্বর আর প্রাকৃতিক রূপে নেই, আছেন চৈতন্যে সকল মানুষের। মানুষ তার ক্ষুদ্র অবয়বে অসীমকে ধারন করে মুক্ত হোল, স্বাধীন হোল। প্রকৃতির উপর ঈশ্বরত্ব আরোপের প্রয়োজন থাকলো না। মানুষ উপলব্ধি করলো তাঁর মধ্যেই ঈশ্বরের অধিষ্ঠান তাঁর দিব্য উপস্থিতি। মানুষ নিজেই যেহেতু এই স্পিরিটকে নিজেই উপলব্ধি করতে পারে তাই তাঁর চিন্তা স্বাধীন। মানুষ হিসেবে তাঁর স্বতন্ত্র স্বাধীন সত্তার এই মুক্তির ধারণা বিশ্বকে প্রথম দিল খ্রিস্ট ধর্ম হেগেলের মাধ্যমে।”

এর সমালচনার মার্ক্স কী বলেছিলেন দেখুন,

“হেগেল বিধয়কে, উদ্দেশ্যের বিষয়কে স্বাধীনসত্তা হিসাবে দাঁড় করিয়েছিলেন, কিন্তু কর্মটা তিনি করেন তাঁদের সত্যিকারের স্বাধীনতা , অর্থ্যাৎ তাঁদের স্বরূপ থেকে আলাদা করে নিয়ে। পরবর্তীতে আসল রূপের আবির্ভাব ঘটে এই কারবারের ফলাফল হিশাবে– অথচ দরকার ছিল বিষয়ের স্বরূপ থেকেই শুরু এবং তার মূর্তায়ন প্রক্রিয়া বিবেচনা। কাজে কাজেই রূপ ধারন করে হাজির হয় এক রহস্যময় সত্তা, আর আসল সত্তা হয়ে ওঠে অন্য কিছু, বলা যায় হয়ে ওঠে সেই রহস্যময় সত্তার মুহূর্ত। যেহেতু হেগেলের শুরু আসল অস্তিত্ব থেকে নয়, সার্বজনীন সত্যের বিধেয়বাচনগুলোর একটি আশ্রয় দরকার , রহস্যময় ব্রহ্মজ্ঞান (Idea) হয়ে উঠে সেই রহস্যময় আশ্রয়।”( মার্কস ১৯৭৫। পৃ–৮০)

হেগেল মানুষের মুক্তির ধারনা দিলেন। তিনি বললেন মানুষের মুক্তি মানে হচ্ছে প্রকৃতি থেকে নিজেকে আলাদা করতে শেখা। শুধু আলাদা করতে শিখলেই হবেনা তাঁকে প্রকৃতির উর্ধে এক পরম সত্তার সাথে সম্পর্কিত করে দিতে হবে। শুধু আলাদা করতে পারলেই মুক্তি আসেনা; মুক্তি আসে সেই প্রকৃতির উপর প্রভুত্ত করতে পারার ক্ষমতায়। এটা অবশ্যম্ভাবী যখন চৈতন্য আর প্রকৃতি আলাদা হয়ে বিরাজ করে তখন একটা আরেকটার উপর প্রভুত্ব করতে না পারলে পূর্বোক্তটি নিজেকে কখনো মুক্ত ভাবতে পারেনা। এখন প্রকৃতি যদি প্রভুত্ব করে তাহলে মানুষ মুক্ত স্বাধীন নয়। যদি প্রকৃতির উপর মানুষের প্রভুত্ব চালু হয় তবেই একমাত্র মানুষ নিজেকে স্বাধীন ও মুক্ত ভাবতে পারে।

পুঁজিবাদকে সেকারণেই প্রকৃতি বিনাশি হতেই হবে। পুঁজিবাদকে যুদ্ধবাদি হতেই হবে। এটাই পুঁজিবাদের নিয়তি। কমিউনিস্ট ইশতেহারে সে কথাও স্পষ্ট ভাবে বলা আছে,

“বুর্জোয়া শ্রেণীর যখনই ক্ষমতা হয়েছে, সেখানেই সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক প্রকৃতি শোভন সম্পর্ক খতম করে দিয়েছে। যেসব বিচিত্র সম্পর্কে মানুষ বাধা ছিল তাঁর উপরওয়ালাদের কাছে তা এঁরা ছিড়ে ফেলেছে নির্মমভাবে।”

একক মানুষের চৈতন্য যখন বৈষয়িক ভিত্তি পাবে সেই বৈষয়িকতাকে মুক্ত বা স্বাধীন হতে হলে তাঁকে স্বার্থপর হতেই হবে। সেই আত্মপরতার দর্শনই পুঁজিবাদী সমাজের ভিত্তি। নইলে সেই একক চৈতন্যের কোন মূল্য নাই।

পুঁজিবাদের ফিলসফিক্যাল আন্ডারপিনিং আসলে তিনটা। এর মধ্যে হেগেল দুটো বেইসিক কাজ করে দিয়েছেন পুঁজিবাদের।

১/ প্রকৃতি চৈতন্য আলাদা

২/ মানুষ স্বার্থপর।

তৃতীয় কাজটা করে দিয়েছে ইউরোপের এনলাইটমেন্ট। পুঁজিবাদের নতুন মূল্যবোধকে জায়গা করে দিতে হলে সব পুরনো নীতি নৈতিকতাকে যা মুলত ধর্ম থেকে উৎসারিত তাঁকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয়া ছাড়া তো উপায় নেই। পুঁজিবাদে মুনাফাই নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করবে। ধর্মের নৈতিকতা অবশ্যই এখানে বাঁধা। ধর্ম যদি নৈতিকতার পথে বাধা হয় তবে ধর্মকেও সে ঝেটিয়ে বিদায় করে দেবে অথবা প্রয়োজন মত নিজের উপযোগী করে গড়ে নেবে। এটাই রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার মুল গোমোর। এই প্রসঙ্গে মার্ক্স কী বলেছেন লক্ষ্য করুন’

“পুজিবাদ সেই সকল ধর্ম তত্ত্বরই বিনাশ ঘটায় যা তাঁর বিকাশের পথে বাঁধা, কিন্তু ধর্ম তত্ত্বের মধ্যে বদলও ঘটায় পুঁজি যা তাঁর খাপে খাপে মেলে।”

“এনলাইটমেন্ট” শব্দটা যতই মধুর শোনাক না কেন, এর মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে এটাই প্রতিষ্ঠিত করা যে “মুনাফা নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করবে“ আর কিছু নয়।

তাই পুঁজিবাদের তৃতীয় ফিলসফিক্যাল আন্ডারপিনিং হচ্ছে,

৩/ সমাজের সকল নৈতিকতার ভিত্তি হবে “মুনাফা”।

এই তিনটি দার্শনিক অবস্থানই হচ্ছে পুঁজিবাদের অন্তর্গত দর্শন যেটাকে আমরা আধুনিকতা বলে জানি। এই আধুনিকতাকে বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধ সকল বামপন্থী বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করেছেন, এবং এভাবেই পুঁজিবাদের হাতকেই তাঁরা নিজের অগোচরে শক্তিশালী করেছেন।

পুঁজিবাদকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে গেলে এর দার্শনিক ভিতকেও সমানভাবেই আঘাত করা দরকার। বাংলাদেশের বামপন্থীরা এই কাজটি পারবেন না। কারণ তাঁরা পুঁজিবাদের এই দার্শনিক ভিতের উপর নিজেদের চিন্তার সৌধ গড়েছেন।

বাংলাদেশের বামপন্থীদের দেখে তাই হাসন রাজার গানটি মনে আসে, “কী ঘর বানাইলা তুমি শূন্যের মাঝার?”

    2