Just Another Bangladeshi

Jul 11, 201324 min

ধোঁয়াশে আলাপ

ইচ্ছা হলে আমাকে জারজ ডাকতে পারেন আপনি।

ইচ্ছা করে? বেজন্মা বলে গাল দিতে ইচ্ছা করে? দেন। কিছু আসে যায় না। আর তাছাড়া কথা তো ভুল না। কথা সত্য।

আমার আম্মা আটক ছিলেন পাগলাগারদে, সেখানে দুই বছর কাটানোর পরে জন্ম নিলাম আমি। আম্মা গারদে ছিলেন কি কারণে, শুনবেন?

কারণ না আসলে, বলেন অজুহাত। অজুহাত টা হচ্ছে - উনার ‘নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ নেই’, এবং ‘সমাজে নিরাপদে চলতে পারার মত ক্ষমতা নেই’, তাই। এটা সেই বিরাশি-তিরাশি সালের কথা। আম্মার ফ্যামিলি পুরান ঢাকার টাকাওলা এবং শিক্ষিতশ্রেষ্ঠ পরিবারগুলার একটা। ইমেজের একটা ব্যাপার কাজ করে। তখনকার দিনে, বাপ-মায়ের কথা না শুনে ধরেন একটা মেয়ে যদি কিঞ্চিৎ ঘাড়ত্যাঁড়ামি করে, এলাকার ছেলেদের সাথে তারে মিলতে মিশতে দেখা যায় এখানে ওখানে, রাত্তিরবেলা - তাহলে মেয়েটাকে শায়েস্তা করা নিশ্চয়ই আপনের পবিত্র দায়িত্ব। সমাজে ফষ্টিনষ্টি হতে তো দেওয়া যায় না, তাই না? যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে।

তাহলে শায়েস্তা কিভাবে করবেন? করার জন্য বেশি কিছু লাগে না। আপনে শিক্ষিত মানুষ, যা করার বুক ফুলিয়ে করেন, অফিশিয়ালি করেন। সরকারি ডাক্তারের কাছ থেকে সনদ নিয়ে নেন - যে- এই মেয়ের ক্লিনিকাল নিম্ফোমেনিয়া আছে। সে নিজের জন্যে এবং সমাজের বাকিদের জন্যে রিস্ক। এই কাগজটা আরেকজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তারকে দিয়া ভেরিফাই করে নেন। ব্যস, কেল্লা ফতে। নিকটস্থ থানায় এবারে একটা আবেদনপত্র মেরে দেন, দুই দিনের মাথায় পুলিশ এসে খপ করে মেয়েকে ধরে নিয়ে যাবে, সমাজকে ঝুঁকিমুক্ত করে দিবে। ঝামেলা শেষ। আম্মার ক্ষেত্রেও এইটাই ঘটে। নানা স্বয়ং সিভিল সার্জন, আম্মার বিভিন্ন 'নষ্টামি'র কারণে তিনি পরিবারের সুনাম নিয়া ভয়ে ছিলেন, মানসম্মান বাঁচানোর জন্যে নিজেই সনদ করে দেন। কুমিল্লায় তার আরেক ডাক্তার বন্ধু আছে, দুইজন একসাথে প্রাকটিস করেছেন ডাক্তারি পাশ করে। উনি সেইটারে ভেরিফাই করে। তারপর- আম্মা সোজা পাগলাগারদে।

সুতরাং, আনন্দের ব্যাপার- আমি নানাজানকে চিনি। তবে বাপকে চিনি না। কারণ আমার বাপ হলো একজন র‍্যান্ডম সুযোগসন্ধানী বান্দা, যে কি না আম্মারে সুবিধামত পেয়ে রেপ করে গেছিল ‘বিবি সুফিয়া আশ্রম ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’ নামক ভবনটার নিচতলায়, পাঁচ নম্বর রুমে। পাগলাগারদের ভদ্র লেবাসি নাম এটা আর কি। 'আশ্রম ও পুনর্বাসন কেন্দ্র'। শুনলেই ভাল্লাগে, তাই না? বৌদ্ধদের আশ্রম থাকে না হিমালয়ে- নিস্তব্ধ, শান্তিপূর্ণ, চুপচাপ; সেই রকম একটা শান্তি শান্তি অনুভূতি হয়।

বাস্তব ভিন্ন।

দুই হাজার চার কি পাঁচে ভবনটা ভেঙ্গে সরকারি বাসভবন বানালো, আমি গিয়েছিলাম তার আগে, এক নজর দেখতে। দালানটার প্রতিটা ইট থেকে ঠিকরে ঠিকরে বেরুচ্ছিল প্রস্রাব আর ব্লিচিং পাউডারের একটা সম্মিলিত দুর্গন্ধ। করিডোরগুলো লম্বা, দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে। আর ঘরগুলো গুচ্ছ গুচ্ছ করে জেলখানার গারদের মত একটার গায়ে আরেকটা চেপেচুপে বসানো। একেকটা ঘর থেকে ভেসে আসছে বিচিত্র রকমের ফোঁপানি, আর্তনাদ। কিছু ঘর নিস্তব্ধ, ওপাশ থেকে দুই একজন নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে, তাদের চোখে চোখ রাখতে পারি নি আমি। কিছু নরকে যাওয়ার জন্য মরতে হয় না, দুনিয়াতেই তাদের দেখা মেলে। ‘বিবি সুফিয়া আশ্রম ও পুনর্বাসন কেন্দ্র’ নিঃসন্দেহে এদের মধ্যে একটা।

আম্মার রিপোর্টে উল্লেখ করা আছে- আশ্রমে থাকাকালীন তিনি মোট চারবার গর্ভবতী হন। বাচ্চা হয়েছে একবারই, আমি; এর আগে বাকি তিনবার জোরপূর্বক গর্ভপাত। মেডিকেল অফিসার নোট লিখেছেন – ‘পেশেন্ট ইয প্রমিস্কিউয়াস ইন নেচার, ক্যান নট কন্ট্রোল হার সেক্স ড্রাইভ’ - সোজা বাংলায়, রোগী যে কারুর জন্যে যে কোনো সময় পা ফাঁক করতে উৎসাহী। কিন্তু আমার সন্দেহ হয়। আম্মাকে এরা মরফিনের ওভারডোজ দিয়ে রাখত, উনি দিনের অর্ধেক সময় অসংলগ্ন হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতেন। আর বাকি সময়টা তাকে স্ট্র্যাপে হাত পা আটকে রাখা হত। মজা লুটতে চাইলে আর কিচ্ছু দরকার নেই, স্রেফ রুমটার চাবি জোগাড় করলেই হয়ে গেল। ভার্সিটিতে ভরতি হওয়ার আগের ছয়টা মাস আমার খুব ব্যস্ত গেছে। দুইজন পুরুষ নার্স, একজন ওয়ার্ড ডাক্তার, আর আশ্রমের পরিচালক - এই চারজনকে খুঁজে বের করতে হয়েছে বহু সোর্স ঘেঁটে। এরা মজা লুটতে আগ্রহী ছিল। এই চারজনের একজন আমার বাপ, খুব সম্ভব।

আশ্রমে ঢোকার আগে আম্মার বয়স ছিল উনিশ। আমার কাছে সাদাকালো ছবি আছে একটা তার, সেই সময়েই তোলা। আম্মার একমাত্র স্মৃতি। একটা বটগাছের পেছনে লুকিয়ে মাথা বের করে আছেন, ক্যামেরার দিকে চোখ ভরতি কৌতুক নিয়ে তাকিয়ে হাসছেন। খুব সুন্দরী ছিলেন আমার আম্মা।

চারজনের মধ্যে আমার বাপ কে- তা নিশ্চিত হতে পারিনি। সবাই স্বীকার করেছে রেপ করার কথা, তাই মেরে ফেলতে হল চারজনকেই। একেক জন একেক ভাবে মরল। বেশি ইন্টারেস্টিং ছিল আশ্রমের পরিচালকটা। মনিরুজ্জামান নাম। লাল গোলগাল মুখ, বেঁটে, গাবদা গোবদা। গলার টাই টা সুন্দর করে পরেছিল। ডাবল নট। ওটা দিয়েই গলায় পেঁচিয়েছিলাম। মুখ থেকে রক্তমাখা থুতু আর বুদবুদ বেরোল কিছুক্ষণ, তারপর নীল-কালো হয়ে গেল গলা অবধি। শেষ।

আশ্রমে আরো মানুষ ছিল যারা সম্ভাব্য পিতার তালিকায় আসতে পারত, কিন্তু এই চারটাকে মারার পরে আর ইচ্ছা হচ্ছিল না। আমি নিজেকে বুঝ দিলাম এই বলে- যে কয়জন মারার, মেরে ফেলেছি। আম্মাকে যে কয়জন রেপ করেছে, যদি সবগুলাকে ধরতে যাই, তখন এইটা নিতান্ত ব্যক্তিগত প্রতিশোধ থাকবে না, পুরো গণহত্যা হয়ে যাবে। পুলিশের নজরে পড়বে তখন। তারচে এইখানে থেমে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

জন্মের পর আমার জায়গা হয়েছিল এলাকার এতিমখানায়। আম্মার ফেলোপিয়ান টিউবগুলা তখন বেঁধে টিউবেকটোমি করে ফেলা হল, খরচ ওই মনিরুজ্জামান-ই দিয়েছিল। মজা লুটতে গিয়ে ভুল করেও বাচ্চা হওয়ার দ্বিতীয় কোন ঝুঁকি যেন না থাকে।

আমার বয়স যখন দশ, আম্মা নিজেকে মেরে ফেললেন। কত সাল ছিল যেন...ছিয়ানব্বুই মনে হয় চলে তখন। দশ বছর বয়েস, আমি যখন এতিমখানার উঠানে দৌড়ুতে দৌড়ুতে হাডুডু, গোল্লাছুট খেলছিলাম, মিষ্টির দোকানে চুরি করে ঢুকে সন্দেশ খাচ্ছিলাম, কেয়ারটেকারের ধমক খেয়ে কেঁদে ফেলছিলাম; আম্মা তখন নিজের ছোট্ট ঘরটায় বসে একমনে আয়নার ভাঙ্গা কাঁচে নিজের কবজি ঘষে যাচ্ছিলেন। পরিষ্কার ভাবে কাটে নি প্রথমে, আঙ্গুলের আশেপাশে, তালুর ভেতরে কেটে গিয়েছিল, তারপর কেটেছে শিরা। কিন্তু কেটেছে তো একসময়। আম্মার লাশ খুঁজে পেয়েছিল মানুষজন সকালে। মেঝেতে আলুথালু বেশে ছড়ানো অবস্থায়। লাল, চটচটে আঠালো, আর শীতল।

আওলাদ সাবের লোকজন আমাকে খুঁজে নেয় যখন, আমি বারো বছরের পিচ্চি। এতিমখানার সহকারি প্রধান ছিল পঞ্চাশোর্ধ্ব, কাঁচা-পাকা দাড়িওলা চমৎকার দেখতে একজন মানুষ। তিনি অত্যন্ত ভালবাসার সাথে আমাদেরকে নিজের ব্যক্তিগত হারেমখানার গেলমান হিসেবে ভোগ করতেন। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে বসতে জায়গাটা জখম হয়ে গেছিল আমাদের। তার কথা শুনবেন, পশ্চাৎদেশে সামান্য ব্যথা আর হাতে একগাদা মিমি চকলেট নিয়া ফিরত আসতে পারবেন। প্রতিবাদ করবেন, যেতে চাইবেন না? এই তো বিশাল ভুল করে ফেললেন। আপনারে একা একটা রুমে খাবার পানি না দিয়া আটকায়া রাখা হবে কয়েকদিন। তারপর কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসবেন, বোনাস হিসেবে থাকবে পশ্চাৎদেশে ভয়ানক ব্যথা আর বুকেপিঠে আঁচড়-কামড়ের দাগ। আসল নাম কায়সার হলেও আমরা তারে ডাকতাম ছোট বাবু বলে। একাকী করিডোরে আমাদের কারুর সাথে দেখা হলেই তিনি একগাল হাসি দিতেন, তারপর যৌনাঙ্গে হাত ডলে দিয়া বলতেন, ‘বাবু, তোমার ছোট বাবু কেমন আছে?’ অসাধারণ লোক।

তার একটা ছোট্ট মরিস মাইনর গাড়ি ছিল, বহুত শখ করে কেনা। ছোট বাবুকে, কিংবা ছোট বাবুর লাশকে কিছুদিন পরে লোকজন আবিষ্কার করে তার বাসার গ্যারাজের ভিতরে। কালো ধোঁয়াভরা মরিস মাইনরের ভিতরে তিনি এলিয়ে পড়ে আছে, ইঞ্জিন অন করা, জানালা-দরজা আটকানো। আর একটা সবুজ হোসপাইপ-- একজস্ট পাইপের সাথে একমুখ লাগানো, আরেক মুখ চলে গেছে সামনের জানালা দিয়ে গাড়ির ভেতরে। কার্বন ডাই অক্সাইড পয়জনিং। পুলিশ এলো, অনেক হম্বিতম্বি করলো, আমাদের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। দুই সপ্তা পর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট হল - ছোট বাবু আত্মহত্যা করেছেন। কথাটা শুনে সেদিন এতিমখানার পঁচাত্তরটা ছেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল একসাথে।

কিন্তু ঝামেলা হয়ে গেল আরেক জায়গায়। ছোট বাবু আওলাদ সাবের পুরাতন বেতনভোগী। অনেকবার কাজ করে দিয়েছে অতীতে। যখন কোন একজন ক্যাবিনেটের সদস্য, কিংবা বিদেশী পলিটিশিয়ানের কচি ছেলের খিদে উঠত, এতিমখানা থেকে বেছে বেছে যত্নসহকারে স্পেসিমেন পাঠাত এই ছোট বাবু। সুতরাং আওলাদ সাব দুই তিনজন ইনভেস্টিগেটরকে পাঠিয়েছিলেন ছোট বাবুর ব্যাপারটা খুঁড়ে দেখতে, অস্বাভাবিক কিছু আছে কি না। এরা খুঁজতে গিয়ে যখন দেখল একমাত্র সম্ভাব্য অপরাধী একটা বারো বছরের পিচ্চি বাচ্চা, খেপবে কি, হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছিল তাদের।

আওলাদ সাব মজা পেয়েছিলেন, একটু কৌতূহলও বোধহয় জেগেছিল। তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন সরাসরি। এই কাহিনী বহুত আগের, ওই সময়ে আওলাদ সাব মুখোমুখি দেখা করতেন, সামনাসামনি কাজ করতেন; এখনকার মত আঁধারে ঢেকে রাখতেন না নিজেকে। মনে হয় ভেবেছিলেন আমি সুন্দর, নাদুস নুদুস হবো। কিন্তু হতাশ হয়ে গেছিলেন দেখে। আমার তখনকার চেহারা আর এখনকার চেহারার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই - একটু বেশীই চিকন, রাম দার মতো চোখা চোয়াল আর নাক, আর কান দুটো বাচ্চা হাতির কানের সমান। উনার চেহারা তখন কেমন ছিল আমার পরিষ্কার মনে নেই। শুধু মনে আছে লোকটাকে বিশাল মনে হচ্ছিল, মায়াদয়াহীন। উনার বয়স যে খুব বেশি ছিল তখন তা না, কিন্তু আমি সেইভাবে দেখি নি - বুঝতে পারছিলাম এই মানুষটা একটা এডাল্ট, তার মানেই আমার শত্রু।

স্কুল থেকে ফেরার সময় কয়েকটা গুন্ডা-টাইপ চেহারার লোক এসে ধরে নিয়ে গেছিল আমাকে। প্রথমে তো ভয়ের চোটে প্যান্ট নষ্ট হয়ে যাওয়ার জোগাড় আমার, মনে করেছিলাম ধরা খেয়ে গেছি, পুলিশ! কিন্তু একটূ পরেই এদের হাবভাব দেখে বুঝলাম- না, পুলিশ না, অন্য কিছু। পুলিশ কি জিনিস তা এতিমখানার একটা ছেলে খুব ভালোমতোই জানে। এরা আমাকে নিয়ে গেল বাড্ডার ভেতরে, ছোট একটা দালানে। ভেতরে টিপটপ গোছানো ধূসর রঙা একটা অফিসে।

তখন কাঠফাটা গরম চলে, বাইরে উজ্জ্বল রোদ্দুর- কিন্তু অফিসের ভেতরে আলো নিবুনিবু। ডেস্কের ওপরে একটা টেবিল-বাতি জ্বালানো, হলদে বিষণ্ণ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে সেটা। টেবিলের ওপারে বিশাল একটা মানুষ বসে আছে। উবু হয়ে লম্বাটে হিসাব-খাতায় বলপয়েন্ট কলমে কিছু একটা লিখছেন উনি। আমি রুমের ভেতরে ঢোকার মিনিট পাঁচেক পরে তার লেখা শেষ হলো, তিনি মাথা উঁচু করে আমার দিকে তাকালেন। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সমস্তটা দেখে নিলেন এক নজরে।

‘সিগারেট খাও?’

আমি উপরে নিচে মাথা নাড়লাম। উনি ক্যামেলের একটা প্যাক এগিয়ে দিলেন, নিলাম একটা শলা। এক হাত বাড়িয়ে তার সোনালি-কালো রঙের লাইটারে তিনি জ্বালিয়ে দিলেন শলাটা। তারপর নরম গলায় প্রশ্ন না, মন্তব্য করলেন, ''তুমি কায়সাররে মারছো।’

আমি চুপ করে রইলাম।

‘কি হইল? কিছু বলবা না?’

‘বলার কিছু নেই’, আমার সংক্ষিপ্ত জবাব।

‘যখন শুনছি কায়সাররে পাইছে প্যাসেঞ্জার সিটে, তখনি সন্দেহ জাগছে আমার। সুইসাইড-ই যখন করবে, সে প্যাসেঞ্জার সীটে ক্যান বসবে, ইঞ্জিন তো ছাড়া লাগবে তার, সে থাকবে ড্রাইভিং সীটে। তাই না?’

আমি চুপ।

'আমার ধারণা কি জানো? তুমি ঘুমের ওষুধ দিয়া তারে অজ্ঞান করছো, তারপর গাড়িতে তুলছো। সহজে পারার কথা না, শালায় তো জিন্দা লাশ একটা, শুয়ারের মত শরীর, তার মানে বাকি এতিমগুলাও হাত লাগাইছে। ঠেইলাঠুইলা তুলছো, তারপর ড্রাইভ কইরা নিয়া গেছো তার বাসার গ্যারাজে। সে হাঁ কইরা প্যাসেঞ্জার সীটে ঘুমাইতাছে, তুমি এইদিকে ইঞ্জিন ছাইড়া হোসপাইপ সেটিং করতাছো। ঠাণ্ডা মাথার কাজ। ভয় পাও নাই? যদি কেউ দেইখা ফালাইতো?’

‘সন্ধ্যার দিকে অন্ধকার হয়ে আসে, কেউ নজর দেয় না গাড়ি কে চালাচ্ছে না চালাচ্ছে’, আমি উত্তর দিলাম, ‘আর সামনের গেট আটকানোই ছিল। আমি গাড়ি বের করেছিলাম পিছনের গেট দিয়ে।’

আওলাদ সাব মুচকি হাসছিলেন। আরো কিছু জিনিস জিজ্ঞেস করলেন, ইস্কুল নিয়ে, এতিমখানা নিয়ে, আমার কি ভাল লাগে করতে- এইসব। তারপর উনি আবার কাজে ডুবে গেলেন, আর গুন্ডা-টাইপ চেহারার লোকগুলো আমাকে ফেরত দিয়া এলো এতিমখানায় আবার।

পরের সপ্তায় এক দম্পতি এসে আমাকে দত্তক নিয়ে নিলো। 'আব্বা' হচ্ছেন হাইকোর্টের উকিল, 'আম্মা' একটা প্রাইভেট ভার্সিটির ইংলিশ টীচার। বাস্তবে এরা একে অপরকে আদৌ চিনত কিনা আমার জানা নেই, ওই দত্তক নেবার দিনের পর থেকে আমার সাথে আর দেখা হয় নি তাদের। সেদিন থেকে আমি আওলাদ সাবের ‘জিনিস’ হয়ে গেলাম।

মাঝে মধ্যে আমি চিন্তা করি - আওলাদ সাব সেদিন আমার মধ্যে কি দেখেছিলেন। সম্ভাবনা? হয়তো বা। একটা পোষা কুকুর, যে তার সর্বস্ব দিয়ে হলেও আনুগত্য দেখাবে। তার চয়েসে ভুল হয় নি। আমি আওলাদ সাবের অনুগত, জান দিয়ে হোক- প্রাণ দিয়ে হোক- শতভাগ লয়াল। এখানে কোন প্রশ্নের সুযোগ নেই।

উনার আসল নাম যদিও আওলাদ সাব না। কিন্তু আসল নাম বললেও ক্ষতি নেই, আপনি চিনবেন না তারে। ইনারা নিজেদেরকে আলোয় আনতে পছন্দ করেন না। আওলাদ সাব এশিয়া আর ইউরোপের সম্মিলিত সর্বশ্রেষ্ঠ দশজন ধনী মানুষের একজন। আপনারে আরেকটা মজার কথা বলি, বাকি যে নয়জন, তাদেরকেও আপনি চিনবেন না। ইনাদের নাম ফোর্বসের টপ হাণ্ড্রেডে কখনো আসবে না- বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেটদের পাশে এদেরকে দেখবেন না আপনি। আমি বলছি একচুয়াল ধনী মানুষের কথা, যাদের কথায় স্টক মার্কেট ওঠানামা করে, যুদ্ধের বাজার রমরমা হয়, তেলের দাম বাড়ে কমে। এদের পরিচয় যেন কখনো টিভিতে বা পেপারে না আসে, এজন্যে কোটি কোটি টাকা দিয়ে পোষা হয় মিডিয়া এজেন্ট।

আওলাদ সাব জিনিস কালেক্ট করতে পছন্দ করেন। রকমারি ধরণের জিনিসের মালিক হয়ে তিনি একপ্রকার তৃপ্তি পান সম্ভবতঃ। আগে যেমনটা বলেছি, আমি ওই রকমারি জিনিসগুলার একটা। যদিও তাকে আমি নিজের মালিক হিসেবে যতটা দেখি, তারচে বেশি দেখি একপ্রকার প্রক্সি বাপ হিসেবে। এই মানুষটা আমাকে জীবনে কখনো হতাশ করেন নি। উনিই আম্মার রেপিস্টদের তথ্য এনে দিয়েছিলেন, ফাইলের পর ফাইল। শিখিয়েছিলেন কিভাবে প্রতিশোধ নিতে হয়।

গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পরে (ফার্স্ট ক্লাস, বিজনেস স্টাডিজ এন্ড ইন্টারন্যাশনাল ল), ঠিক করলাম - ভাল রেজাল্ট করেছি, একটা গিফট তো আমার প্রাপ্য হয়। এতিমকে আর গিফট কে দেবে, নিজেই নিজেকে দিব ঠিক করলাম- আমার সুপ্রিয় ডাক্তার নানাজান-কে একটা দর্শন দিয়ে আসব। তাকে খুঁজে বের করে রেখেছি অনেক আগে, কিন্তু ইচ্ছে করেই এতদিন যাই নি। এবার যেতে হয়।

উনি বুড়ো হয়ে গেছেন ততোদিনে, রিটায়ার করার আর বছরখানেক বাদ ছিল মনে হয় তখন। সাদা সোয়েটার পরা ক্ষুরধার চেহারার একজন মানুষ। ওই সময়েও ডাক্তারেরা রাত্রিবেলা রোগীর কলে যেতেন দূরদূরান্তে। আমি এক রাতে তার পিছু ধরলাম। উনি রোগীর বাসায় গিয়ে, মেডিকেল জ্ঞানের ফুলঝুরি ছড়িয়ে যখন বাইরে এসে রিকশা খুঁজছেন, তখন কাছে গিয়ে ডাক দিলাম, 'নানাজান সালাম।' নিজের পরিচয় ঢেকে কি হবে? উনার আর আমার চেহারায় পার্থক্য নেই বললেই চলে- সেই একই হাতির কান, চোখা নাক; মাঝখানে শুধু চল্লিশটা বসন্তের ব্যবধান। চুলটা শুধু পাতলা হয়ে গেছে, আর শুঁয়োপোকার মত মোটা একটা মোচ রেখেছেন উনি। আমার মোচ পছন্দ না। উনি আঁতকে উঠে আমাকে দেখলেন, তারপর নরকের কীট দেখছেন যেন, এইভাবে ঘেন্না ভরে জিজ্ঞেস করলেন যে আমি কি চাই।

‘আম্মাকে যে আটকে রাখলেন অইভাবে, মরে গেল মানুষটা- কাজটা ঠিক হয় নি, কি বলেন?’

উনি আমারে বললেন দূর হয়ে যেতে, বা এইরকম কিছু একটা।

‘অনার্স পাস দিয়েছি আজকে। ফার্স্ট ক্লাস থার্ড,’ আমি তাকে বললাম, ‘শুনে খুশি খুশি লাগছে না আপনার, নানাজান?’

উনি আমাকে পুলিশের ভয় দেখালেন। বললেন, উনি জানেন আমি কে। যদি এক্ষুণি আমি চলে না যাই, তাহলে তিনি পুলিশ ডাকবেন, থানার ওসি তার কাছের মানুষ। তারপর আমাকেও আম্মার মত আটকে রাখা হবে।

আম্মার কথা না তুললেও পারত হারামজাদা। বাম চোখ দিয়ে সরাসরি মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিলাম ছুরিটা। উনি যখন উবু হয়ে রাস্তায় রক্ত ছড়িয়ে হাঁসফাঁস করছিলেন, ওই সময়ে আস্তে করে তার মানিব্যাগটা তুলে নিলাম। দুটো কারণ - এক- ছিনতাইয়ের মোটিভ হিসেবে কাজ করবে, আর দুই - স্মৃতি হিসেবে। জন্মদিনের গিফট বলে কথা। এই মানিব্যাগেই আম্মার ছবিটা পেয়েছিলাম, পঁচিশ বছর আগেকার সাদা-কালো ক্যানভাসে লেগে থাকা হাস্যোজ্জ্বল একটা মানুষ। আমার আম্মাজান। ছবিটা কে তুলেছিল কে জানে?

মানিব্যাগটা প্রথমে গুলিস্তানে পকেটমারি হতে দিলাম। তারপর চোরাই মার্কেট থেকে দ্বিগুণ দামে কিনে নিলাম আবার। পরিষ্কার কাজ, কোন চিহ্ন থাকল না। অনেক বুদ্ধিমান মানুষ আছে আমার লাইনে, যারা আবেগের বশে এরকম স্মৃতি রাখতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেছে। স্মৃতি হয়ে গেছে এভিডেন্স। আমি রিস্ক নিতে আগ্রহী না। মাঝে মধ্যে চিন্তা করি - সেই দিন আমি নিজের নানাকেই কেবল মেরেছি, নাকি তার সাথে নিজের বাপকেও? জিজ্ঞেস করলে বুড়ো উত্তর দিত না জানি। কিন্তু সন্দেহ জাগে। যদিও, দিনশেষে সে তার মেয়েকে রেপ করেছে কি করে নাই তাতে কিই-বা আসে যায়, বলেন? পাপ বাপকে ছাড়ে না, নানাকেও না।

এরপরে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে আমি আওলাদ সাবের জন্যে ফুল টাইম কাজে নেমে পড়লাম। শ্রীলঙ্কায় সময় দিতে হল কয়েকদিন, তারপর বোগোটায় এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টের কাজে হাত দিলাম, ট্রাভেল এজেন্টের ভেক ধরে। তারপর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলাম, ঢাকায়। গত পনের বছর ধরে এইখানেই আছি, আওলাদ সাবের বিশালাকার মেশিনে গ্রিজ হিসেবে কাজ করছি। ট্রাবলশ্যুটার। ট্রাবল দেখা দিলে, শ্যুট করো। সিম্পল কাজ।

তো যা বলছিলাম, আওলাদ সাব পর্দার আড়ালে থাকেন। তার ব্যবসার ভিতরে কি নিয়ে, কোথায় কাজ হয়, মোট সম্পদের পরিমাণ - এইসব অত্যন্ত গোপন ট্রেড সিক্রেট। আরো গোপন সিক্রেট হচ্ছে ব্যবসার বাইরে তার কিছু শখ-আহ্লাদ।

ব্যবসার বাইরে তার একমাত্র শখ-আহ্লাদ হচ্ছে যৌনতা। তার এই শখ মিটানোর জন্যেই ওই মুহূর্তে আমি এয়ারপোর্ট স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর পকেটে আমার চার কোটি টাকা দামের নীল-সাদা কাটা হীরের বটুয়া। আওলাদ সাবের শখ, আরো পরিষ্কার করে বললে, যৌনতা - সুশ্রী বালকদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এখন দ্যাখেন, ভুল বুঝবেন না, আওলাদ সাব ভাল মানুষ, তিনি কচি শিশুদের জোর করে ভোগ করেন - তেমন কিছু না। উনি সুস্থ স্বাভাবিক যৌনস্বভাবের একজন পুরুষ - যে কিনা স্রেফ অন্য পুরুষ এবং প্রাক-পুরুষকে ভোগ করে মজা পায়। দুনিয়ার সকল টাইপের লোকের দরকার আছে না, বলেন? একটা রেস্টুরেন্টের মতন। যে যার পছন্দ মত অর্ডার দেবে। সবার পছন্দ যে এক হবে তা না। ভিন্ন ভিন্ন পছন্দ, কিন্তু তৃপ্তি- সার্বজনীন।

আমি যার নুন খাই, তার গুণ গাই।

এইটা বছর দুয়েক আগের কথা। জুলাই মাস ছিল মনে হয়। এয়ারপোর্ট স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে, পকেটে চার কোটি টাকার মাল নিয়ে, আমি আওলাদ সাবের গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করছিলাম, আর শুয়ারের মত ঘামছিলাম। টেনশনে না, গরমে। টেনশন করার কিছু নাই, আমার ভিতরের পকেটে যা আছে, তা চুরি হবার জিনিস না। প্রত্যেকটা হীরে মার্ক করা। বাজারে তুললেই ধরা পড়ে যাবে। সমস্যা হচ্ছে গরমটা। অসহ্য। ঘাড় বেয়ে ঘাম পিঠে নেমে যাওয়ার অনুভবটা অসহ্য রকমের বিরক্তিকর। বিরক্তি কমাতে আমি আশেপাশের মানুষ দেখা শুরু করলাম। বিড়ির দোকান চারিদিকে ছড়ানো, ইয়াবার ডিলার একটা ঘুরছে অনেকক্ষণ ধরে, কাস্টমার পাচ্ছে না। ফ্রক পরা একটা মেয়ে হাঁটছে আর বিড়ি বেচছে। সে এখনো টাকাপয়সা ভাল মত চেনে না মনে হয়। একজনকে দশ টাকা ফেরত দিতে গিয়ে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দিল, বুঝতেও পারল না। গাঁজাখোরের দল চোখ লাল করে ঘুরছে বিচ্ছিন্নভাবে। একটা ছেলে ঘাড় কাত করে দেয়ালে পোস্টার মারছিলো, 'অমুককে ভোট দিন, প্রচারে এলাকাবাসী', আমার চোখে চোখ পড়তেই কি ভাবলো, পোস্টারের বাণ্ডিল বগলে নিয়ে হনহন করে বাইরে চলে গেল। ভয় পেয়েছে কি? গেন্ডারির জুসে বরফ ঢেলে বিক্রি করছে কয়েকজন।

আর এদের সবার মধ্যে দিয়ে অবিরাম ছুটে যাচ্ছে মানুষ আর মানুষ আর মানুষ।

আওলাদ সাবের গাড়ি এসে ফুটপাতের কাছে মসৃণ গতিতে থেমে গেল। গাড়িটার মডেল বছর চারেকের পুরাতন। দেখতে সুন্দর, ক্লাসি, কিন্তু এতটাও না যে চোখে লেগে থাকবে। আমি দরজা খুলে ঢুকে পড়লাম ভেতরে।

সামনে আওলাদ সাব বসেছেন, আর ড্রাইভার। পেছনের সীটে আমার সাথে বসে আছে জুবুথুবু একটা মানুষ, বাটি ছাঁট চুল, গায়ের স্যুটটা ক্যাটক্যাটে রঙ। একে দেখে আমার ষাটের দশকের বাংলা সিনেমার ধনী বাপের সন্তানগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। নায়িকার সাথে লুতুপুতু করতে যাবে, তারপর নায়িকা একে ডাম্প করে ফেলে দিয়ে উত্তমকুমারের সাথে ভেগে যাবে। আমি মাথা নাড়লাম তার দিকে। লোকটা হাত মেলানোর জন্যে চেষ্টা করল, তারপর যখন দেখল আমি আমলে নিচ্ছি না, কাঁচুমাচু মুখে হাত টেনে নিলো।

আওলাদ সাব আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন না, যদিও সেটা সমস্যা না, খুব ভালভাবে চিনি এরে। আমিই একে খুঁজে বের করেছি, টোপ ফেলে ধরেছি, তারপর ডাঙায় এনে ফেলেছি- যদিও লোকটা সেটা জানে না। সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভাষাতত্ত্বের প্রফেসর। ঢাবিতে তার থিসিস ভয়ানকভাবে প্রশংসিত বলে শুনেছি। তার ধারণা এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সিক্রেট সার্ভিসের সাথে সে কাজ করছে। এই ধারণাটাও সৃষ্টি করে দিয়েছি আমি। খুব বেশি কিছু না, দুটো ঠিক জায়গায় ফোনকল, এখানে দুফোঁটা তেল ঢালা, ওখানে দুটো মোচড় - তাতেই হয়ে গেছে। বউকে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির প্রফেসর বলে এসেছে - সে সাঁওতাল গোষ্ঠীর ওপরে একটা পেপার পড়তে এসেছে ঢাকায়, কনফারেন্সে। এটাও মিথ্যে না। আসলেই তেমন একটা কনফারেন্স হচ্ছে এখন, আমি ব্যবস্থা করে এসেছি।

‘ট্রেনে যাওয়া আসার কি দরকার? দম বন্ধ লাগে না তোমার?’, আওলাদ সাব হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘টাকা বাঁচাইতে তো আর ট্রেনে উঠো না, নাকি?’

'কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে? আমি তো ভাবলাম গত এক ঘণ্টা নষ্ট করে আপনার জন্যে যে আমি দাঁড়িয়ে আছি এখানে, আর আপনি এসির হাওয়া খাচ্ছেন জ্যামে বসে বসে- এই ফ্যাক্টটাই ব্যাখ্যা হিসাবে যথেষ্ট!’ আমি একটু কড়া গলায় উত্তর দিলাম। অনুগত পোষা কুত্তা হতে পারি, তবে মাঝেমধ্যে ঘেউঘেউ করি। এই জিনিসটা আওলাদ সাবের পছন্দ। অন্ধ ভক্তি তিনি দুই চোখে দেখতে পারেন না। ‘ঢাকায় একমাত্র গ্রহণযোগ্য বাহন হতে পারে বাইক। তাও হয় বাস নয় গাড়ি এসে ঠুকে দেবে যখন তখন। পকেটে যখন মাল থাকবে আমার, তখন রিস্ক নেয়ার মানে হয় না। ট্রেনই একমাত্র চয়েস।’

‘আপনি ঢাকায় কার চালান না?’ প্রফেসর জিজ্ঞেস করল। ওফফ! এই লোকের স্যুটের রঙ টা আসলেই চোখে লাগছে আমার। মনে মনে আমি এর নাম দিলাম বালঃস্যুট।

‘চালাই। রাতে। যখন রাস্তা ফাঁকা থাকে।’ আমি উত্তর দিলাম, ‘মাঝরাতের পরে বিশেষ করে। তখন চালাই।’

আওলাদ সাব কাঁচ নামিয়ে চুরুট ধরালেন একটা। আমি লক্ষ্য করলাম উনার হাত কাঁপছে। তর সইছে না আর মনে হয় মানুষটার।

তারপর আমরা বনানী হয়ে এগোতে লাগলাম। পাশ দিয়ে চারতলা-পাঁচতলা প্রায়ান্ধকার বিল্ডিংগুলো, যেগুলো নিজেদের হোটেল বলে দাবি করে কিন্তু আসলে কামুকদের উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় প্রতি রাতে- কাটিয়ে যেতে লাগল আমাদের। এই রাস্তা, ওই গলি হয়ে আমরা ঢুকে যেতে লাগলাম আরো ভিতরে। একটা নগ্ন বস্তি, তারপর একটা নর্দমাময় রাস্তা, তারপর একটা রাস্তাময় নর্দমা...কড়াইল বস্তি, তারপর গুলশানের সুরম্য সড়কসমূহ... নদীর এপার ওপার... মাঝেমধ্যে শহরের এই অংশটাকে আমার ভাদ্রের দুপুরে তাপ ওঠা কুত্তির মত মনে হয়। উন্মত্ত, উত্তাল; এই স্বাভাবিক আছে তো এই পাগলাটে হয়ে তেড়ে আসছে। পূর্বাভাস বোঝা কঠিন।

আসলে, বর্ণনা শুনে মনে হতে পারে জায়গাটা আমার পছন্দ। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এখানকার মানুষ কিংবা মানুষের বসতি কোনোটাই আমার মন মত না। খুব দ্রুত পালটায় এখানে সবকিছু, খুব বেশিই তাড়াহুড়ো সবার মধ্যে। আমি শহর নিয়ে রোমান্টিসিজমে বিশ্বাসী না, কিন্তু তবু, এই কংক্রিট জঙ্গলের চেয়ে দক্ষিণের জিঞ্জিরা ভালো। কিংবা সদরঘাট। বিশেষ করে সদরঘাট। বুড়িগঙ্গার এই কুলাঙ্গারের পায়ের কাছেই সকল কিছু শুরু হয়, ভাল হোক বা মন্দ। জিঞ্জিরা-সদরঘাট এরা মনে করেন ঢাকার যোনি আর পায়ুপথ, সবসময় কাছাকাছি, তিন আঙ্গুল বা তিন কিলোর বেশি না কখনোই। তাহলে পুরান পল্টন ঢাকার কি হবে? ক্ষুদ্রান্ত্র-বৃহদান্ত্র? এতদূর গেলে তখন আর রূপক খাটে না, গুলিয়ে যায়। কারণ ঢাকা, আমার মনে হয়, উন্মাদ একটা শহর। মাল্টিপল পারসোনালিটির সমস্যা। ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম আর মফঃস্বল একে অপরের গায়ে পড়ে, ঠেলাঠেলি করে একটা মহানগরী গড়ে তুলেছে ঠিকই, কিন্তু নিজেদের পুরাতন সীমানা-স্বভাব ভুলতে পারে নি।

তো ড্রাইভার গুলশানের ভেতরে কোনো একটা জায়গায়, কোন একটা দালানের সামনে গাড়ি থামাল। চারতলা দালানটা কোনো এক কালে আবাসিক হোটেল ছিল মনে হয়, জানালায় ধুলো জমে আছে। দুটো জানালায় পেরেক ঠুকে বোর্ড লাগিয়ে রাখা। ‘এইটাই বাসা, সার,’ ড্রাইভার বলল।

‘হু,’ আওলাদ সাবের উত্তর।

ড্রাইভার নেমে দরজা খুলে ধরল, আওলাদ সাব বেরুলেন। আমি আর বালঃস্যুট নিজেরাই দরজা খুলে বাইরে দাঁড়ালাম, ফুটপাত আর রাস্তায় নজর বুলালাম একবার। চিন্তায় ফেলার মত কিছু চোখে পড়ল না।

দরজার কাছে গিয়ে নক করলাম আমরা, দু'বার। তারপর অপেক্ষা। দরজার ঘাড়ের কাছে একটা সিসি ক্যামেরা লাগানো, লাল বাতি টিপটিপ করে জ্বলছে ওটার, আমি চোখ টিপে মিষ্টি হাসি দিলাম একটা ওদিকে তাকিয়ে। আওলাদ সাব চুপচাপ, উত্তেজনায় গাল লাল হয়ে গেছে, মুখে বিব্রত হাসি, আর মাজার সামনের অংশ দুহাতে ঢেকে রেখেছেন উনি। যৌনাঙ্গ দাঁড়িয়ে গেছে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ঢেকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন তবু। ঠ্যাটা বুড়া!

থাকগে। সবারই তো এমন উত্তেজনার সময় আসে জীবনে। আমরা নিজেকে সামলে নেই, আর আওলাদ সাব অন্যকে সাবড়ে দেন, এইতো! আমার মনে হয় দুই ধরণের মানুষ আছে দুনিয়ায়- একদল যাদের বেঁচে থাকার জন্যে ভালবাসা-প্রেমটেম লাগে, আর একদলের লাগে না। আওলাদ সাব দ্বিতীয় শ্রেণীর। চেনা যায় এদেরকে। আমারো লাগে না। তবে আওলাদ সাব শৌখিন মানুষ তো, প্রেমহীন কামনাতেও তিনি শৌখিন।

দরজায় ঠং করে শব্দ হল, ছিটকিনি খোলা হল বেজায় শব্দ করে, তারপর দরজা সরে গিয়ে একটা বৃদ্ধার চেহারা উন্মুক্ত হল। যদিও একে চেহারা বলা যায় কিনা সন্দেহ আছে আমার। সারা মুখে অসংখ্য খাঁজ-ভাঁজ-তিল-বিকৃতি, ঝুলে পড়া চামড়ার ফাঁকে ফাঁকে মেদ বেরিয়ে আছে। মহিলা একটা কালো বোরকা টাইপের কিছু পরে ছিল। আমি চেহারাই দেখছিলাম, আর কিছু লক্ষ্য করি নি। মহিলার চেহারা কেমন জানেন? কিছু বেঢপ সাইজের আলু থাকে না? মিষ্টি আলু? সেগুলো পুড়িয়ে খাওয়ার সময় দেখবেন দুই একটা দেখতে ঠিক মানুষের মুখের মতো হয়ে গেছে। মহিলার চেহারা ছিল সেরকম। পুড়ে যাওয়া, ধোঁয়া ওঠা মিষ্টি আলুর মত।

মহিলা আমাকে অপরিচিত ভাষায় কিছু একটা বলল, আমি বুঝতে পারলাম না, কিন্তু প্রফেসর বালঃস্যুট উত্তর দিয়ে দিল আমার হয়ে। আস্তে আস্তে, থেমে থেমে। মহিলা আমাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, কপাল কুঁচকে, মুখভরা সন্দেহ; তারপর বিকট শব্দে দরজা আটকে দিয়ে ইশারা করল তার পিছে পিছে যাওয়ার জন্যে। আমি প্রথমে এক চোখ, তারপর আরেক চোখ বন্ধ করে আবার খুললাম। ঘরের ভেতরের পরিবেশের সাথে যত দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়া যায়।

দালানের শরীর জুড়ে পুরাতন মসলার দম বন্ধ করা একরকম গন্ধ। পুরা ব্যাপারটাই আমার কাছে অস্বস্তিকর মনে হচ্ছিল, এই বিদেশী চিযগুলো একটু বেশিই বিদেশী, সহ্যসীমার বাইরে। চামড়ার ভেতরে চুলকায় এদের দেখলে। মিষ্টি-আলু মহিলা আমাদেরকে সিঁড়ির পরে সিঁড়ি বাইয়ে ওপরে নিয়ে যাচ্ছিল, আর ছায়ার পেছন থেকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম এরকম আরো কিছু মহিলা, কালো কাপড়ে ঢাকা সারা দেহ, দরজা থেকে-করিডর থেকে বসে বসে জুলজুলে চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। সিঁড়ির কার্পেটটার রঙ জ্বলে গেছে, থ্যাতলানো মাংসের মত নরম হয়ে আছে জিনিসটা। যতবার জুতার সোলে কার্পেট ঘষা খাচ্ছিল, টেনে ধরছিল। প্রতি পদক্ষেপে দেয়াল থেকে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছিল প্লাস্টার, আর মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল আমার। আওলাদ সাবের এমন জায়গায় আসার কথা না। এমন জায়গায় আসা উচিতই না, যেখানে আমি তাকে প্রটেকশন দিতে পারব না। আর তাকে তো দূর, সত্য বলতে আমার সন্দেহ হচ্ছিল তেমন অবস্থা হলে আমি নিজেকেই প্রটেক্ট করতে পারব কি না ঠিকমত।

অন্যান্য ছায়াঘেরা মহিলারা ঠিকই তাকিয়ে তাকিয়ে গিলছে আমাদের, আর মিষ্টি-আলু মহিলা বালঃস্যুটের সাথে কথা বলছে ইতঃস্তত। এখানে দুই একটা শব্দ, ওখানে দুই একটা পঙক্তি। বালঃস্যুট হাঁপিয়ে গেছে, কুত্তার মত দেড় হাত জিহবা বের করে ফ্যালে পারলে। তারই মধ্যে জবাব দিচ্ছে।

‘মহিলা জানতে চায় আপনি হীরা এনেছেন কিনা,’ সে হাঁপরের মত বুক ওঠানামা করাতে করাতে আমাকে জানায়।

‘তারে কও আগে জিনিস দেখবো, তারপর হীরার কথা,’ আওলাদ সাব জবাব দিয়ে দেন। উনি হাঁপাচ্ছেন না। তবে গলায় সামান্য কম্পন আছে, সেটা উত্তেজনা আর প্রতীক্ষার কারণে।

গত দুই দশকে যে কয়টা পুরুষ অভিনেতা বের হয়েছে টালিউড আর ঢালিউডে, আমার জানামতে তার তিন ভাগের দুইভাগেরই ডোঙ্গা উপুড় করে পোঙ্গা মেরেছেন আওলাদ সাব; আর পুরুষ মডেলের কথা তো বাদই দিলাম, অগণিত। তার শ্লোগান হওয়া উচিত- ‘বিশ্বজোড়া ঠাপশালা মোর, সবাই ভোগের পাত্র’। দুনিয়ার আনাচে কানাচে থেকে সুদর্শন পুরুষ চেখে চেখে এনে তিনি ভোগ করেছেন। তাদের কেউই জানত না কে এই ব্যক্তি যে থাপুশ-থুপুশ দিচ্ছে তাদেরকে, আর যেহেতু বিনিময়ে ভাল অঙ্কের টাকা পাচ্ছে, সুতরাং তেমন মাথাও ঘামায় নি তারা।

বাড়ির ছাদে পৌঁছাতে গিয়ে আরেক ধাপ কার্পেটহীন কাঠের সিঁড়ি পেরুতে হল আমাদের। ছাদের মাথায় একটা চিলেকোঠা, আর চিলেকোঠার দরজার দুই পাশে দুটো দানবীয় মহিলা, কালো বোরকায় শরীর ঢাকা। দেখে মনে হচ্ছিল যেকোনো সুমো কুস্তিগীরের সাথে স্বচ্ছন্দে টেক্কা দিতে পারে এরা। আর এদের হাতে, বিশ্বাস করবেন কি না জানি না কিন্তু আল্লার কসম, ইয়াব্বড় একটা করে রামদা। ‘শাহিনাইয়ের গুপ্তধন’ পাহারা দিচ্ছে এরা। দুটোরই গায়ের বোরকা ছালার মত মোটা, আর ঘোড়ার গন্ধ আসছে শরীর থেকে।

মিষ্টি-আলু মহিলা গিয়ে এদের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াল, একজোড়া গোমড়া ষাঁড়ের সামনে একটা খরগোশের মত, আর এদের নির্বিকার মুখ দেখে আমার ইচ্ছে হচ্ছিল জিজ্ঞেস করি বাসা কই। সামোয়ান হতে পারে, মঙ্গোলীয় হতে পারে, কিংবা ইন্ডিয়া বা ইরানের কোন রাজ্য থেকে উঠে আসলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

মিষ্টি-আলুর কথায় এরা দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল। দরজায় ধাক্কা দিলাম আলতো করে, খুলে গেল। আটকানো ছিল না। আগে ভেতরে ঢুকে আমি নিশ্চিত করলাম জায়গাটা নিরাপদ কি না, তারপর ইশারা দিলাম আওলাদ সাবকে - ভেতরে আসেন। আর এই কাজটা করতে গিয়ে, আমার প্রজন্মের মধ্যে আমিই প্রথম পুরুষ যে কিনা শাহিনাইয়ের গুপ্তধন চর্মচক্ষে দেখতে পেল।

ছেলেটা সিঙ্গেল খাটের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ছিল। মাথা অবনত।

শাহিনাই গোত্রের সাথে 'পৌরাণিক' শব্দটা যায়। এর মানে হচ্ছে আমি এদের নাম এর আগে জীবনে শুনি নি, এবং আমার পরিচিত একাডেমিক-দের কেউই পুরাণের গল্পকথার বাইরে এদের অস্তিত্ব দেখে নি। যখন আমি সিরিয়াস হয়ে এদেরকে খুঁজতে শুরু করেছিলাম, তখন এমনকি ওই পুরাণ-স্পেশালিষ্টরাও মাথা নেড়েছিল অবিশ্বাসে।

‘কারণটা বুঝলে, ঘাড়ত্যাড়া বন্ধু আমার,’ আমার রাশিয়ান স্পেশালিস্ট হাতের পান্ডুলিপি নেড়ে নেড়ে বলছিল, ‘তুমি এমন এক গোত্রের খোঁজ করছো, যাদের উপরে হেরোডোটাস লিখে গেছেন এক হালি লাইন, আরব্য রজনীতে তাদের নিয়ে আছে একটা মাত্র দুর্বল ছন্দের কবিতা, আর ‘ত্রুআ সারাগোশে’ নামের পঞ্চশতাব্দীর প্রাচীন এক ফারসি পান্ডুলিপিতে পাওয়া গেছে এক পৃষ্ঠার মত বর্ণনা, যার নব্বুই ভাগই বোঝার উপায় নেই। নির্ভরশীল সোর্স হতে পারে এগুলা, বলো?’
 
কিন্তু আওলাদ সাবের কানে গুজব পৌঁছেছে, উনার আগ্রহ জেগেছে, উনি চেয়েছেন। আর আওলাদ সাব যা চান, আমি সেটা জোগাড় করি, পুরো দুনিয়া তাতে উলোট পালোট হয়ে যাক না কেন- তাতে কিছু যায় আসে না। এই মুহূর্তে আওলাদ সাবের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল আমার পরিশ্রম সার্থক। খুশির চোটে বুড়া আটখানা না হয়ে যায়!

ছেলেটা উঠে দাঁড়াল। খাটের নিচ থেকে একটা প্লাস্টিকের পট উঁকি দিচ্ছে, তাতে টলটল করছে কাপখানেক হলুদ তরল। ছেলেটার গায়ে পাতলা, শাদা সূতির কাপড়- অসম্ভব রকম পরিষ্কার। পায়ে সিল্কের নরোম নীল জুতা।

ঘরের ভেতরটা এত ভ্যাপসা গরম! দুটো গ্যাসবাল্ব জ্বলছিল ঘরের দুপাশে, মৃদু হিসস শব্দ তুলে। অবশ্য ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছিল না তাপ গায়ে লাগছে তার। আমার পাশে বালঃস্যুট ভয়ানক হারে ঘামতে শুরু করে দিল। আমি হাঁ করে ছেলেটাকে দেখছিলাম।

পৌরাণিক কাহিনীমতে, শাদা সুতির কাপড় জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই সতেরো কি আঠারো বছর বয়সের ছেলেটা - দুনিয়ার সবচে সুদর্শন পুরুষ। কথাটা বিশ্বাস করতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছিল না আমার।

আওলাদ সাব ছেলেটার কাছে গেলেন। তারপর মানুষ কোরবানির গরু যেমন করে পরীক্ষা করে, তেমন করে নেড়েচেড়ে টিপেটুপে দেখতে শুরু করলেন। গাল চেপে ধরে হাঁ করিয়ে মুখের ভেতরটা দেখলেন, চোখ কান দেখলেন, হাতে ছেলেটার আঙ্গুল একটা একটা করে নিয়ে মায় নখ পর্যন্ত জহুরীর ধৈর্য নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর খুব স্বাভাবিকভাবে শাদা কাপড় উঠিয়ে ছেলেটার অপুংস্পর্শা শিশ্ন পরখ করলেন, তারপর বিছানার কাত করে শুইয়ে পশ্চাৎদেশের অবস্থা দেখলেন।

পুরো সময়টা ধরে আমি ছেলেটাকে দেখছিলাম। তার কোন ভাবান্তর নেই, মুখচোখ থেকে শিশুতোষ একটা আভা ঠিকরে ঠিকরে পড়ছিল। আর কিছু না।

সবশেষে আওলাদ সাব ছেলেটারে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে লম্বা সময় ধরে চুমু খেলেন। আস্তে আস্তে, সাবধানে। তারপর মুখ সরিয়ে এনে জিভে নিজের ঠোঁট ভেজালেন কয়েক সেকেন্ড, যেন চুমুপরবর্তী স্বাদের বিচার করছেন, তারপর বালঃস্যুটের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মহিলারে কও মাল পছন্দ হইছে আমার। নিবো।’

বালঃস্যুট মিষ্টি-আলুকে বলল একটা কিছু, মহিলার মুখটা চেপে-বেঁকে সুখী মিষ্টি-আলুর মত দেখাল কিছুক্ষণের জন্যে। হাসছে সে! তারপর মহিলা হাত পাতল।

‘এখনই হীরেগুলো চাচ্ছে উনি,’ প্রফেসর বলল আমাকে।

আমি ভেতরের পকেটে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে দুটো কালো ভেলভেটের বটুয়া বের করে এনে মহিলার তালুতে দিলাম। প্রত্যেকটায় পঞ্চাশটা করে নিখুঁতভাবে কাটা ডি কিংবা ই গ্রেডের হীরে রাখা আছে, পাঁচ ক্যারেটের। এসব অধিকাংশই আওলাদ সাবের হাতে এসেছে নব্বুইয়ের দিকে। অস্ত্রব্যবসার ভাল একটা ডিল ছিল, কম খরচে পেয়ে গেছেন। একশোটা হীরে। চার কোটি টাকা। মহিলা তালুতে ঢেলে কয়েকটাকে নেড়েচেড়ে দেখল আঙ্গুল দিয়ে। তারপর সবগুলোকে বটুয়ায় ভরে নিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।

মহিলার কালো বোরকার ভেতরে উধাও হয়ে গেল বটুয়া দুটো। তারপরে সে সিঁড়ির কাছে গিয়ে গলায় যতটা শক্তি ছিল তার পুরোটা দিয়ে চিৎকার করে বলল একটা কিছু, তার সেই অদ্ভুত সুরেলা ভাষায়।

আমাদের পায়ের নিচ থেকে সমস্ত বাড়িটা জুড়ে মরাকান্না শুরু হয়ে গেল সাথে সাথে। চিৎকার, প্রতিটা দরজা-প্রতিটা করিডোর থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে চিৎকার ভেসে আসছিলো। শেষ বিদায় জানাচ্ছে। আমরা সিঁড়ির গোলকধাঁধা বেয়ে নেমে গেলাম, ছেলেটাকে সামনে নিয়ে, চিৎকার থামল না। সত্যি বলতে আমার ঘাড়ের রোমগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল, এই অমানবিক হাহাকারের মধ্যে; আর পুরাতন মশলার ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধে দম আটকে আসছিল আবার। ফালতু বিদেশীর দল!

ঘর থেকে বের হতে দেওয়ার আগে মহিলা তিনপ্রস্থ কাঁথায় জড়িয়ে দিল ছেলেটাকে। যেন এই জুলাই মাসের আটত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থেকেও ঠাণ্ডা লেগে যাবে, এই ভয়। ছেলেটাকে প্রায় কোলে করে গাড়িতে তুলে দিলাম। আমার আর ইচ্ছে করছিল না গাড়িতে বসতে। আওলাদ সাবকে ছেড়ে দিয়ে আমি বাইক আনালাম একটা। বাইকে শহর ঘুরলাম কিছুক্ষণ। মাথা ফ্রেশ করার দরকার আছে।

পরের সপ্তাটা বিনা কারণে দৌড়াদৌড়িতে কাটলো। মস্কোর কাস্টোমার ঝামেলা বাঁধিয়েছে। সব শালা মাতব্বর। আল্লা আল্লা করছিলাম যেন মস্কোতে গিয়ে ঝামেলা মেটাতে না হয়, এখানেই মিটে যাক। রাশিয়ানদের খাবার হজম হয় না আমার।

আসলে বয়স যত বাড়ছে, লক্ষ্য করছি তত ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছি। এম্নিতেও অবশ্য ঘোরাঘুরি অতটা পছন্দ না আমার, কিন্তু প্রয়োজন পড়লে কিচ্ছু করার নেই, যেতে হয়। আওলাদ সাব বলছিলেন জাহিনদের পার্টি বেশি বুঝতে শুরু করেছে, সরিয়ে দেয়ার কথা। আমি বললাম নিজেই করব কাজটা। জাহিনকে আমার তেমন দেখতে মনে চায় না, বাচাল একটা পাব্লিক। ওভার কনফিডেন্ট। পায়ে ইট বেঁধে তুরাগে ফেলে দেওয়ার সময়ে অবশ্য চুপ মেরে গেছিল, কথা বেশি বলে নি। আমিও কিছু বলি নি। দুজনেই জানি, ব্যবসায় আবেগ খাটে না। মাফটাফ চাইলে লাভ হোত না।

সেদিন রাতে দেখলাম গা ম্যাজম্যাজ করা শুরু করেছে। শরীরের কোষে কোষে টেনশন জমে গেছে। সরান দরকার। আতিককে কল দিলাম, ও নিশিকে পাঠিয়ে দিল আমার ফ্ল্যাটে। মেজাজের একটু উন্নতি হল মেয়েটাকে দেখে। ভদ্র মেয়ে, এই নিশি। ঢঙ নেই। শরীরে মাগী মাগী গন্ধ নেই। প্রফেশনাল। কাজ বোঝে।

তাকে মনোযোগ দিয়ে ভালবাসলাম সেই রাতে, তারপর যাওয়ার সময় হাতে একটা হাজারের নোট ধরিয়ে দিলাম। ‘দেওয়া লাগবে না!’ নিশি চোখ বড় করে বলল, ‘আতিক ভাই সব করে রেখেছেন তো!’

‘রাখো। কিনে নিও একটা কিছু,’ আমি উত্তর দিলাম ওকে, ‘আমার মন ভালো আজ’। মাথার চুল নেড়ে দিলাম ওর একবার, ইস্কুলে পড়া বালিকার মত নিষ্পাপ হাসি দেখাল মেয়েটা আমাকে।

সোমবারে আওলাদ সাবের সেক্রেটারি কল দিল। জানাল সব ঠিক আছে, প্রফেসর বালঃস্যুটকে পে করে দিলে ভাল হয়। রেডিসনে রেখেছেন আওলাদ সাব তাকে। আমি তাকে বললাম সম্মানিত প্রফেসরকে যেন টঙ্গী ব্রীজে পাঠায়ে দেওয়া হয়।

জায়গাটা সুন্দর ছিল একসময়। তুরাগের সৌন্দর্য অন্যান্য নদীর মত না, এর জন্ম হয়েছে ঢাকার বুকে চলতে চলতে ঢাকার হাতেই মরার জন্যে। একে ভিন্ন কোন শহরে, অন্য কোন উপত্যকায় মানাবে না। ছোটবেলায় আমরা একটা খেলা খেলতাম, দম আটকে নদীর নিচ থেকে মাটি তুলে আনার খেলা। একটা ছেলে বলেছিল- ঠিক মাঝখানে গিয়ে যদি নদীর বুক থেকে মাটি তুলে আনতে পারিস, তাহলে হাত মাটিতে রাখার সময় মনে মনে যা চাইবি তাই পাবি। আমি কখনো মনে মনে তেমন কিছু চাই নি। তবু, ইচ্ছা পূরণের জন্যে নয়, দম আটকে রাখার প্রাকটিস হিসেবে এই কাজটা করতে গিয়েছিলাম। নদীর মাঝখানটায় গিয়ে ডুব দেবার পর একসময় গুলিয়ে ফেলেছিলাম মাটি কোনদিকে আকাশ কোনদিকে, বুদবুদ উঠে যাচ্ছিল দ্রুতবেগে, হাত অবশ হয়ে যাচ্ছিল। কোনমতে বুদবুদ যেদিকে যাচ্ছে তার উল্টোদিকে এগোতে এগোতে তলদেশ খুঁজে পেয়েছিলাম। এক খামচি মাটি তুলে লাথ মেরে উঠে এসেছিলাম পানির ওপরে। ভাগ্য ভাল একটা নৌকা যাচ্ছিল কাছ দিয়ে, আমাকে তুলে নিয়ে বাঁচিয়েছিল মাঝি।

খেলাধুলার বয়েস নেই এখন। বাকিদেরকে ইচ্ছে পূরণের সুযোগ দিতে হয়, তাদেরকেও নদীর মাঝখানে ঝাঁপ দেওয়াতে হয় মাঝেমধ্যে। আমার সাথে তাদের পার্থক্য এই- তাদের হাত-পা বাঁধা থাকে।

বালঃস্যুট এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আজকে যে স্যুটটা পরেছে সেটা আরো বদখত। আমার হাতে একটা পেটফোলা খাম দিল, আমি খুলে দেখলাম। এফোর পেজে টাইপ করা অনেকগুলো কাগজ। বাংলা থেকে শাহিনাইতে রূপান্তর করা অনেকগুলো বাক্য দেওয়া আছে সেখানে, ছোটখাটো একটা অভিধানের মত। ‘খিদে পেয়েছে?’ ‘গোসল করো’ ‘মুখ খোলো’ এই টাইপের বাক্য। ছেলেটার সাথে কথা চালানোর জন্যে আওলাদ সাবের যা যা প্রয়োজন আর কি। আমি পকেটে ভরলাম খামটা।

‘হাঁটবেন কিছুক্ষণ?’ আমি প্রস্তাব দিলাম। বালঃস্যুট খুশিমনে স্বীকার করে নিল, তারপর আমার পাশে এসে বকবক করতে শুরু করল, ‘শাহিনাই ভাষাটা আসলে খুব ইউনিক, মানে এর শেকড়গুলো খুঁজে বের করে সেখান থেকে অর্থ বের করা আনাটা সোজা ছিল না,’ আমি মাথা নেড়ে নেড়ে খুব মনোযোগ দিচ্ছি এমন ভান করতে লাগলাম, ‘এর উৎস দুটো হতে পারে, ফিনো-উফ্রিক ফ্যামিলি বা আরামিক ফ্যামিলি। ধরুন যিশু যদি পড়ালেখা শিখতেন, তাহলে নিজে এই ভাষায় লিখতেন, প্রাচীন এস্তোনিয়ানদের জন্য। একে বলা হয়েছে ল্যাঙ্গুয়েজ অফ দা প্রফেটস- প্রেরিত পুরুষদের ভাষা। ধারণা করা হয় ইউসুফ নবীরও ভাষা ছিল এই শাহিনাই ভাষার প্যারেন্ট একটা অংশ। এই ভাষায় মৌলিক শব্দ অনেক বেশি, বলতে গেলে ধার করেই নি অন্য কারুর কাছ থেকে। ইউনিক! ভাল কথা, আমার পেমেন্ট এনেছেন আপনি?’

আমি মাথা নাড়লাম। পকেট থেকে আয়তকার একটা ছোট্ট কাগজ বের করে তার হাতে ধরিয়ে দিলাম, ‘আপনার জন্যে।’

আমরা টঙ্গী বাজারের কাছাকাছি চলে আসছিলাম। ‘আসল জিনিস তো?’

‘নিশ্চয়ই! আন্তর্জাতিক লটারি। আপনি আমাদের এয়ারপোর্ট হয়ে যাওয়ার সময় তালে তালে কিনে ফেলেছেন। শনিবারে নাম্বার শো করবে। দশ লাখ টাকার প্রাইজমানি হয়ে গেছে অলরেডি। যথেষ্ট হবার কথা।’

বালঃস্যুট পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে লটারি টিকেট-টা রাখল, তারপর ওয়ালেট
 
ঢোকাল স্যুটের ভিতরের পকেটে। রাখার পরেও বারংবার হাত চলে যাচ্ছে তার নিজের অজান্তে, স্পর্শ করে দেখছে ওয়ালেটটা ঠিক জায়গায় আছে কি না। এরকম হাবভাব চলতে থাকলে আশেপাশে পকেটমারগুলোর চোখে পড়তে খুব বেশি সময় লাগবে না।

‘আসুন, কিছু খাই একসাথে। মাই ট্রিট,’ বালঃস্যুট বলল, কিন্তু আমি আপত্তি করলাম। পেটে ভারী কিছু ঢুকাতে ইচ্ছে করছে না। এরকম সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দিনে হাল্কা খাবার-ই ভাল। সুতরাং আমরা একটা অফ-লাইসেন্স বারে ঢুকলাম। আমি কমলার রস নিলাম, প্রফেসর নিলো ব্রান্ডির আস্ত একটা বোতল। মুখ চালিয়েই যাচ্ছে।

‘পুরুষগুলোই আসল পণ্য, বুঝলেন?’ আমরা রাস্তার পাশেই কাঠের বেঞ্চিতে বসেছি, হাওয়া দিচ্ছে চমৎকার। ‘খুব বেশিদিন বাঁচে না এরা। অধিকাংশই শিশু অবস্থায় মারা যায়। প্রতি জেনারেশনে দুই একজন থাকে, খুব বেশি হলে, যারা পূর্ণবয়স্ক হয়। এরাই শাহিনাইয়ের গুপ্তধন। দুনিয়ার সুদর্শনতম পুরুষ। এদের গোত্রে মেয়েরা ছেলেদের দেখাশোনা করে। নিরাপদ রাখে।’

‘আলেকজান্ডার নাকি এদের কাছ থেকে কিনেছিলেন একবার। ক্রেতার তালিকায় ভ্যাটিকানের দুই জন পোপের নাম এসেছে। রাণী এলিজাবেথের নাম এসেছে। এমনকি সম্রাট অশোকের নামও পাওয়া গেছে পুরাতন পুঁথিতে, যদিও যথেষ্ট প্রমাণ নেই। সত্য নাও হতে পারে।’

আমি বালঃস্যুটকে বললাম যে পুরা ব্যাপারটা শিশুতোষ কাহিনীর মতো শোনাচ্ছে। ‘চিন্তা করে দেখুন। এদের একমাত্র কারেন্সি হচ্ছে মরদগুলোর চেহারা। প্রতি একশ বছর পর পর তারা বেঁচে থাকা পুরুষদের একজনকে বিক্রি করে দেয় যৌন দাস হিসেবে, তারপর সেই টাকায় নিজেরা চলে,’ আমি বিরতি দিয়ে কমলার রসে চুমুক দিলাম, ‘বিশ্বাস করা কঠিন না? আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়- এই শাহিনাই গুষ্টির সব মহিলাই কি সেদিন ওই দালানে ছিল?’

বালঃস্যুট মাথা নাড়ল, ‘মনে হয় না।’ সে ব্রান্ডি ঢালল আবার, তারপর গেলাস উঁচিয়ে ইঙ্গিত করল আমার দিকে, ‘বাদ দেন। আওলাদ সাবের কথা বলেন। অনেক টাকাপয়সা উনার, না?’

‘হু, আছে মোটামুটি,’ আমি উত্তর দিলাম।

‘আমি কিন্তু সমকামী না, বুঝলেন,’ লালমুখো হয়ে বালঃস্যুট এবারে সামান্য মাতাল জড়ানো গলায় কথা বলতে শুরু করল, আমি অবাক হলাম- এত সহজেই টাল হয়ে গেল?! কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে তার, ‘কিন্তু সুযোগ পেলে চোখ বন্ধ করে চুদতাম পোলাটারে। এত সুন্দর মানুষ আমি জীবনে দেখি নি।’

‘হু, চেহারা খারাপ না। ভালোই।’

‘আপনি চুদতেন না?’

‘আমার টাইপ না,’ আমি উত্তর দিলাম।

আমাদের পেছন দিয়ে একটা কালো ট্যাক্সি ধোঁয়া ছেড়ে চলে গেল। কালো কাঁচে ঘেরা জানালা। প্যাসেঞ্জার নেই কোনো।

‘আপনার টাইপ কি তাহলে?’ বালঃস্যুট আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল। আমার একটু বিরক্ত লাগতে শুরু করল তখন। মাতাল মানুষের সাথে কথা বলার কোন মানে নেই। একে ঝাঁকি দেওয়া দরকার একটা। আমি উত্তর দিলাম- ‘ছোট্ট মেয়ে ভাল্লাগে আমার।’

বালঃস্যুট ঢোঁক গিলল, ‘কত ছোট?’

‘নয়, দশ। এগারো বারো পার না হলেই বেটার। তারপর এদের বুক ফুলে উঠে, যোনির আশেপাশে চুল গজিয়ে যায়- তখন দেখলে ঘেন্না লাগে। আর দাঁড়ায় না আমার।’

বালঃস্যুট চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ আমার দিকে, যেন আমি মরা কুত্তা ঠাপানোর কথা বলেছি। ব্রান্ডির গ্লাসে চুমুক দিতে ভুলে গেছে, নেশা ছুটে গেছে ওর। ‘এইটা,’ সে আমতা আমতা করল কিছুক্ষণ, ‘মানে এই কাজটা আমাদের দেশে নিষিদ্ধ, জানেন?’

‘তাই নাকি?’ আমি অবাক হওয়ার ভান করলাম, ‘আমাদের এখানে পুলিশকে খুশি করে দিলেই তো হয়!’

‘আ-আমি হোটেলে যাব,’ শুকনো মুখে বলল সে, যেন অনুমতি প্রার্থনা করছে, ‘আজকে উঠি?’

কালো ট্যাক্সিটা আবার মোড় ঘুরছে। আমি ডাক দিলাম। তারপর প্রফেসর বালঃস্যুটকে ধরে উঠিয়ে দিলাম। এই ট্যাক্সিটা আমাদের। স্পেশাল কাজে ব্যবহারের জন্য। একবার এতে উঠলে মানুষ আর ফিরে আসে না, শহর তাকে গিলে নেয়। আমি ড্রাইভারকে ইঙ্গিত দিলাম, সতর্ক করে দিলাম, ‘কাজ যেন ক্লিন হয়!’

ড্রাইভার মাথা ওপর-নিচ করল, ‘জি সার।’ তারপর বালঃস্যুটকে নিয়ে হারিয়ে গেল ট্রাফিকের সমুদ্রে।

আওলাদ সাব শাহিনাই ছেলেটাকে ভালরকম আদর-যত্ন দিয়ে রাখতেন। যখনি তার সাথে দেখা হয় আমার, মিটিঙয়ে বা অন্য কোনো কাজে, দেখতাম ছেলেটা বসে আছে উনার পায়ের কাছে; আর আওলাদ সাব ছেলেটার কুচকুচে কালো চুলে হাত বুলাচ্ছেন, গালে আঁকিবুঁকি কাটছেন, চিবুক ধরে টানছেন। এদের দুইজনের মাঝের সম্পর্ক পুরো লুতুপুতু ভালবাসা আর কি, দেখলে বোঝা যেত। আমার মত হৃদয়হীন মানুষও চুপ করে যেত এদের কথা উঠলে, তাহলে বোঝেন!

মাঝে মাঝে শাহিনাই গুষ্টির মহিলাদেরকে রাত্তিরবেলা স্বপ্নে দেখতাম আমি। বাদুরের মত ভেসে ভেসে এরা আসছে, কালো বোরকা পতপত করছে বাতাসে, আর একটা পচতে থাকা বিশাল দালানের মধ্যে এরা অপার্থিব গলায় চিৎকার করে বেড়াচ্ছে। দালানটা হঠাৎ করেই আম্মাকে আটকে রাখা সেই বিবি সুফিয়া আশ্রম হয়ে যেত। বাদুর-মুখো মহিলাদের কয়েকজন কোলে করে নগ্ন পুরুষদের বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের চেহারা থেকে এত উজ্জ্বল আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে যে চোখ রাখা দায়।

এরকম স্বপ্ন দেখলে কি আর ঘুম আসে আর! ঘুম ভেঙ্গে যেত, আর পরের দিনটা জঘন্য কাটত আমার।

তো, কই ছিলাম? শাহিনাই। হ্যাঁ। সেই শাহিনাই গুষ্টির গুপ্তধন, দুনিয়ার সবচে সুদর্শন মানুষটা, টিকল মাত্র আট মাস। তারপর ঠাণ্ডা লেগে গেল তার।

শরীরের তাপমাত্রা উঠল ১০৬ ডিগ্রি। মানুষের শরীরে এত তাপ উঠতে পারে আমি এইটাই জানতাম না। ছেলেটার ফুসফুস ভরে গেল পানিতে, ডাঙায় তোলা মাছের মতন খাবি খাওয়া শুরু করে দিল তখন। আওলাদ সাব দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম ডাক্তারদের এনে দেখালেন। লাভ হল না। ছেলেটা পুরাতন বাল্বের মত কয়েকদিন জ্বলে-নিভে তারপর ফুরিয়ে গেল। চুপচাপ। আসলে শাহিনাই গুষ্টির পুরুষগুলো এমনি হয় মনে হয় - ননীর পুতুলের মতো। সুন্দর কিন্তু নাজুক।

আওলাদ সাব বিশাল একটা ধাক্কা খেলেন এই মৃত্যুতে। নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে শিশুর মত কাঁদলেন সারাটা দিন। জানাযার নামাযের সময়েও তার কান্না থামাতে পারছিলাম না। বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন, আজিমপুর গোরস্তানের অর্ধেক কাদা মনে হয় আমার জুতার ভিতরে ঢুকে গেল এই সুযোগে। বিশ হাজার টাকার জুতা বরবাদ। কোন মানে হয়?

ফ্ল্যাটে বিনা কারণে বসে রইলাম সেদিন। নুডলস রান্না করলাম, পুড়ে গেল। নাইফ থ্রোয়িং প্রাকটিস করলাম কিছুক্ষণ। ফুটবল খেলা দেখলাম, স্পেন ভার্সেস জার্মানি।

রাতে আতিককে কল দিলাম। তিন্নি নামের একটাকে পাঠাল ফ্ল্যাটে। মেজাজের কারণেই হোক বা রুচির, ভাল লাগে নি আমার।

পরের দিন কিছু লোকজন নিয়ে আমি গুলশানের সেই দালানে ঢুঁ মারলাম আরেকবার। শাহিনাই গুষ্টির কেউ আছে কি না চেক করে দেখি। ওই ছেলের মত আর দুই একটা তো এটলিস্ট থাকার কথা, তাই না? চার কোটি টাকায় একটা গোষ্ঠীর কয়দিন চলবে আর?

কিন্তু গিয়ে দেখি ঝুরঝুরে প্লাস্টারের উপরে রক পোস্টার লাগানো হয়েছে, পুরো দালান গমগম করছে ইউরোপিয়ান মালে। একটা যদি দেশি মানুষ থাকে! সব উলঙ্গ নইলে অর্ধ-উলঙ্গ মানব-মানবীতে ভরপুর। দালানের গায়ে সেই ভেজা ভেজা মসলার গন্ধটা উধাও, গাঁজার ধোঁয়া জড়িয়ে আছে তার বদলে। কিচেনে গিয়ে দেখলাম গোল হয়ে বসেছে বিদেশীগুলো দশ-বারোজন, রগে সিরিঞ্জ দিয়ে এলএসডি পুশ করছে মিলির পর মিলি। ঝাপসা চোখে আমাদের দিকে তাকাল কয়েকজন, বাকিরা আমলেই নিল না। কাত হয়ে পড়ে রইল একে অন্যের উপরে, অন্য জগতে বিচরণ করছে তারা এখন।

আমরা সামনের গেট থেকে শুরু করে একেবারে চিলেকোঠার ছাদ পর্যন্ত পুরো জায়গাটা চিরুনি-খোঁজা খুঁজলাম। যদি কিছু পাই! একটা ক্লু, একটা কোনো চিহ্ন - স্রেফ আওলাদ সাবকে দেখাতে পারি এরকম কোন একটা জিনিস!

কিচ্ছু না।

গুলশানের ওই বাড়িতে কিছুই খুঁজে পাই নি আমি। শুধু একটা দৃশ্য মাথায় নিয়ে ফিরে এসেছি। দুইতলার রুমে জানালার পাশে বিছানায় শুয়ে ছিল একটা মেয়ে। ঘুমাচ্ছিল, কিংবা টাল হয়ে পড়ে ছিল, যাই হোক। পর্দা নেই জানালায়, পর্দা ছিল না মেয়েটার উন্মুক্ত শরীরেও।

আমি মুহূর্তের জন্য দরোজার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, হয়তো কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে নজর পড়েছিল মেয়েটার ওপরে। শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়মিত বিরতিতে ওঠানামা করছে বুক, আর ডালপালা-জানালার শিক পার হয়ে রাস্তার সোডিয়াম আলো এসে মিশে যাচ্ছে মেয়েটার স্তনের খুব বাদামি বোঁটায় - এই দৃশ্যটা কেন যেন মাথার ভেতরে খোদাই হয়ে গেল আমার ওই কয়েক সেকেন্ডে।

এই দৃশ্য, এই তুচ্ছ স্মৃতিগুলো ভুলতে পারি না।
 
কোন মানে হয়?

[গল্পঃ ধোঁয়াশে আলাপ - স্মৃতি - দৃশ্যপট]

    0